আমাদের দেশে সাদা চাঁপা আছে কি নেই, এ নিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের মধ্যে একধরনের কৌতূহল রয়েছে। সেই কৌতূহল মিটল দিন কয়েক আগে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহীম ফোনে জানালেন ধানমন্ডির ৫-এ সড়কেই নাকি খোঁজ মিলেছে একটি সাদা চাঁপার। জাহাজ-অবয়বের দালানটির বিপরীত দিকে, লেকের পাড়ে পায়েহাঁটা পথের ধারেই আছে গাছটি।

দেখতে গেলাম ফুলটি। সত্যিই তো, সাদা চাঁপা! গাছটি খুব বেশি বড় নয়, ফুলও বিক্ষিপ্ত, হাতেগোনা কয়েকটি। স্বর্ণচাঁপার মতো অতটা পুষ্পপ্রাচুর্য নেই। তবে গড়ন ও গন্ধ একই রকম, তফাত শুধু বর্ণে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে মোটামুটি সহজলভ্য হলেও আমাদের দেশে জানামতে সাদা চাঁপার আর কোনো গাছ নেই। কিন্তু স্বর্ণচাঁপা ইদানীং বেশ সহজলভ্য। ঢাকার বিভিন্ন উদ্যানে বেড়াতে গেলে গ্রীষ্মের আলুথালু বাতাসে হঠাৎ করেই স্বর্ণচাঁপার সুবাস আপনার মন ভরিয়ে দেবে। শাহবাগের খুদে ফুলবিক্রেতাদের কাছেও পাবেন দু-এক আঁটি। আর যদি এই সাদা চাঁপাটি দেখতে চান, তাহলে যেতে হবে ধানমন্ডির উল্লিখিত সড়কটিতে।

চাঁপা ফুলের প্রতি আমাদের বেশ পক্ষপাত আছে। এর জনপ্রিয়তা বহুকালের। মৈমনসিংহ গীতিকায় আছে, ‘চাইর কোনা পুষ্কুনির পারে চাম্পা নাগেশ্বর/ ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি।’ চাঁপা সুষমা ও সুগন্ধের জন্য কাব্য, চিত্রকলা, উপহার, অর্চনা সর্বত্রই ব্যবহূত। চাঁপা ফুলকে আঞ্চলিক ভাষায় চাম্পা ফুল বলা হয়। প্রাচীন লোককথায়ও চাম্পা নামটিই এসেছে বারবার।

এখানে বলে রাখা ভালো, সব চাঁপাই চাঁপা নয়। প্রসঙ্গত, কনকচাঁপার কথা বলা যেতে পারে। নাম চাঁপা হলেও আদতে এটি চাঁপা-পরিবারের সদস্য নয়। একটির সঙ্গে অন্যটির দুস্তর ফারাক। স্বর্ণচাঁপার উজ্জ্বল বর্ণ ও স্নিগ্ধ সৌরভ পবিত্রতার প্রতীক। বৃদ্ধি দ্রুত, জীবন দীর্ঘ, চাষ সহজ এবং প্রস্ফুটন অফুরান। হিন্দু ও বৌদ্ধদের কাছে এ গাছ অত্যন্ত পবিত্র। শ্রীলঙ্কায় বুদ্ধমূর্তি তৈরিতে এই কাঠ বহুল ব্যবহার্য।

স্বর্ণচাঁপার মতো সাদা চাঁপাও (Michelia champaca) মূলত পাহাড়ি প্রজাতি। তবে সমতলেও বৃদ্ধি স্বাভাবিক। গাছের কাণ্ড সরল, উন্নত, মসৃণ ও ধূসর। পাতা চ্যাপ্টা, উজ্জ্বল সবুজ, একান্তরে ঘনবদ্ধ। ফুল একক, কাক্ষিক ও সাদাটে। পাপড়িসংখা প্রায় ১৫, তুলনামূলকভাবে ছোট ও সরু। আর স্বর্ণচাঁপার রং ম্লান হলুদ, সোনালি কিংবা প্রায় সাদা।

ফুলের বর্ণগত বিচিত্রতায় বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মাটি, আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এমনকি সতেজ ও বাসি ফুলের ক্ষেত্রেও রঙের তারতম্য হতে পারে। পরিপূর্ণ প্রস্ফুটিত চাঁপা তীব্র সুগন্ধি। গ্রীষ্মের প্রথম ভাগ থেকে বর্ষা-শরৎ অবধি ফুল থাকে। ফুল শেষ হলে গুচ্ছবদ্ধ ফল ধরে; দেখতে অনেকটা আঙুরের মতো; কাক ও শালিকের প্রিয় খাদ্য। চাঁপা ভেষজগুণেও অনন্য। বাকল ও ফুল বাতরোগের ওষুধ। ফুলের আরক চক্ষুরোগে ব্যবহার্য। বীজ পায়ের ক্ষতে উপকারী। কাঠ দারুমূল্যযুক্ত।

-প্রথম আলো