কপালেই টিপ দেওয়ার রেওয়াজ। কিন্তু ওপরের ছবিটিতে দেখুন, তার টিপটি কপালে নয়। ঠিক চাঁদির ওপরে। তাতে প্রসাধনের ব্যাকরণ হয়তো লঙ্ঘিত হলো, কিন্তু রূপের খোলতাই যে হয়েছে চোখ জুড়ানো, তা না মেনে উপায় কী? ওর নাম ‘নীলরাজা’। কেবল এমন নামই হয়তো ওকে মানায়। রং বলতে যদিও ওই নীল আর কালো, সঙ্গে একটু সাদার ছোঁয়া। তাতেই আমাদের দেশের সুন্দর পাখির তালিকায় নীলরাজার স্থান প্রথম সারিতে।

পাখিটির গলা, পিঠ ও বুক ঝলমলে নীল রঙের পালকে মোড়া। পেটের নিচে আর পাখনার কয়েকটি পালকে সাদা বা হালকা বাদামি আভা। গলায় একটি গাঢ় কালো রেখা। সবচেয়ে আশ্চর্য সুন্দর তার মাথার ওপরে ওই গোল টিপের মতো কালো বৃত্তটি। এই বৃত্তের কালো পালকগুলো দেখতে অন্য রকম—মখমলের মতো উজ্জ্বল, কার্পাস তুলার মতো কোমল। পা ও ঠোঁট নীলচে। ঠোঁটের ওপর যেন হালকা একটু গোঁফের রেখা। কালো রঙের। চোখ দুটিও দুটি কালো বিন্দু। সব মিলিয়ে নীল-কালো-সাদার এক দুর্দান্ত ‘কম্পোজিশন’। তবে ছবির নীলরাজাটি পুরুষ। স্ত্রী পাখির মাথায় ওই কালো টিপটি থাকে না, রংও খানিকটা নিষ্প্রভ। কী আর করা, পক্ষীকুলে স্ত্রীর চেয়ে পুরুষগুলোই অধিক দর্শনধারী, এটাই প্রকৃতির নিয়ম!

নীলরাজা দেশের অনেক এলাকায় ‘নীল কটকটিয়া’ বা ‘ছোট লেজনাচুনে’ বলেও পরিচিত। অনেক অঞ্চলে এর কোনো নামই নেই। চট করে এদের দেখা পাওয়া যায় না। খোলামেলা জায়গা তেমন পছন্দ নয়—এই কারণে। বাঁশঝাড় ও গাঢ় ছায়াময় গ্রামীণ বন-বাগান এদের প্রিয়।এই পাখিটির দেখা মিলেছিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে এক বাঁশ বাগানে। কী যেন কী শোনার জন্য একটু কাঁধ বাঁকিয়ে কান পেতেছিল সে। সাড়া পেয়ে উড়ে যাওয়ার আগেই বন্দী সাইফুল ইসলামের ক্যামেরায়। এর ইংরেজি নাম ব্ল্যাক-নেপ্ড মনার্ক, বৈজ্ঞানিক নাম হাইপোথাইমিস আজুরিয়া (Hypothymis Azurea)। আকার ছোটখাটো, ১৫-১৬ সেন্টিমিটার মাত্র।

ছবিটি কিশোরগঞ্জের  সরারচর ইউনিয়নের মিরাপুর গ্রাম  থেকে তোলা 

কিছুটা দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, দেখতে সুন্দর হলেও নীলরাজার কণ্ঠস্বর তেমন নয়। বরং তীক্ষ, কর্কশ। সে কারণেই হয়তো নাম হয়েছে কটকটিয়া। তবে যেমন সাহসী, তেমনি উপকারী। পাখি পর্যবেক্ষক শরীফ খানের কাছে জানা গেল, নীলরাজা দেশের সব অঞ্চলে নেই। তবে যেসব এলাকায় বন-বাগান বেশি, সেখানে আছে পর্যাপ্ত সংখ্যায়। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া—এসব এলাকায় তুলনামূলক বেশি দেখা যায় এদের। পোকামাকড় প্রধান খাদ্য। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উড়ন্ত পোকামাকড় ছোঁ মেরে পেটে পুরে ফেলে। নীলরাজার এভাবে শিকার ধরার দৃশ্যটি দেখার মতো। এরা বিশেষত আম, কাঁঠাল, আতা, নারকেল, ডুমুর, লেবু, পেয়ারা, গোলাপজাম—এসব ফলগাছে থাকা পোকামাকড় দিয়ে ভোজনপর্ব সমাধা করে বলে গ্রামীণ বন-বাগানের মৌসুমি ফলফলাদি অনেকটাই নিরাপদে বেড়ে ওঠে। এতে যে মানুষের বিপুল উপকার হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এমন উপকারী প্রাণী পাখিদের আজ বড়ই দুর্দিন। প্রকৃতি ও পরিবেশের নিরন্তর বিনাশ ঘটে চলেছে আমাদেরই হাতে। পাখপাখালির থাকার ঠাঁই আর খাদ্য উভয়ই কমে যাওয়ায় তাদের অনেকেই আজ বিপন্ন। কিন্তু পাখিদের বাঁচতে না দিলে প্রকৃতির গান থেমে যাবে, আর বিরূপ প্রকৃতির রোষ বিপন্ন করে তুলবে মানুষের অস্তিত্বও।

– আশীষ-উর-রহমান