ফুলের নামে মেয়েদের নাম রাখার প্রচলন বাংলা সংস্কৃতির একটা অংশ। যেমন শিউলি, বকুল, চম্পা। আরও একটা জনপ্রিয় নাম পারুল। নাম শুনলেই মানসপটে একটা সুন্দর ছবি ভেসে আসে। সেই পারুল যদি হারিয়ে যায় তাহলে মন খারাপ হবারই কথা।

রবীঠাকুর অবশ্য পারুল বনে হারিয়ে গিয়ে কয়েকটা লাইন লিখে ফেলেছেন –

পারুল বনে চম্পারে মোর হয় জানা , মনে মনে
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে

কবির হারিয়ে যাওয়ার মানা না থাকলেও বাংলা থেকে পারুল হারিয়ে গেছে । আসলেই কি তাই !!! যদি হারিয়ে গিয়ে না থাকে, তাহলে কোথায় আছে, কেমন আছে – একটু খোজ নেয়া দরকার।

প্রথম আলো’তে পারুল হারিয়ে গেছে বলে একটা লেখা এসেছে। লেখকের নাম মোকারম হোসেন। এই লেখাটির সুত্র ধরে নেটে যা পেলাম তাহল – ফুলটি প্রায় বিলুপ্ত হবার পথে। গত বছরের নভেম্বরের ২২ তারিখেই একই লেখক রমনার এক নার্সারিতে বেশ কিছু সুন্দর নীল পারুলের সন্ধান পেয়ে ছবিসহ ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। দেখতে অনেকটা পারুলের মতই কিন্তু আসলে পারুল না। আসল পারুল দেখতে অনেকটা তামাটে রংয়ের।

দেশে একমাত্র পরীক্ষিত পারুল ফুল পাওয়া গেছে বগুড়াতে। সোনাতলা গ্রামে পারুল ফুল গাছের সন্ধান মিলেছে। জনকন্ঠের এই সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক এসে এর সেম্পল পরিক্ষা করে নিশ্চিত হন যে এই সেই হারিয়ে যাওয়া পারুল। পারুল’কে পাওয়া গেছে। এই আনন্দে অনেক বয়োজষ্ঠরা বেশ স্মৃতি রোমান্থিত হতে পারেন। আফটার অল আমাদের পুরানো দিনের অনেক গানেই এই ফুলের নাম বার বার এসেছে। বিভিন্ন লেখা পর্যালোচনা করে আমি যা বুঝলাম পারুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণ যৌবনের উন্মাদনায় রোমান্টিকতায় ভরিয়ে দেয়। আমাদের প্রেমিক মন এর সুবাসে উতাল-পাতাল হয়।

হাল্কা বেগুনি কিংবা তামাটে যেটাই হোকনা কেন পারুল সৌন্দর্য্য অতুলনীয়। এককভাবে এই ফুলটিকে ঢোলকলমির কিংবা মাইক ফুলে বলে মনে হতে পারে। মনে যাই হোক পারুলের তুলনা শুধুই পারুল। মিষ্টি গন্ধের এই ফুলটিকে কেউ কেউ রসুন্দি নামে জানে। কারন আর কিছুই না – এর পাতা হাতে নিয়ে ঘসে সেই গন্ধ নাকে নিলে রসুনের গন্ধের মত লাগে। মজার ব্যাপার না!

ময়মনসিংহে পারুলের স্থানিয় নাম কামসোনালু । গারোরা ডাকে ভাতসিল নামে। বিগোনিয়া জাতের এই ফুল মুলত আমেরিকার প্রদেশ থেকেই আমাদের দেশে গিয়েছিল বলে মনে করা হয়। এখানে একে Garlic Vine নামে চিনে।

এক নজরে পারুল

বাংলা নাম – পারুল লতা
অন্যান্য স্থানীয় নামঃ পারুল লতা, কামসোনালু, ভাতসিল, Garlic Vine

যৌবনের এই ফুল বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশ থেকে। পুরাপুরি বিলিন হবার আগেই দেখা যাক কিছু পারুলের সুন্দর ছবি।

পারুল ফুলের কথা এখন কে-ই বা মনে করে! বর্তমান প্রজন্ম পারুল নাম শুনেছে মেয়েদের নাম হিসাবে। এটি যে একটি ফুলের নাম তা বলতে পারে না অনেকেই। এই ফুল দেখেওনি তারা। দেখবে কী করে- বিরল এই পারুল ফুলের গাছ বলতে গেলে বিলুপ্তই হয়ে গেছে। ‘পারুল গাছ কোথাও হয়তো টিকে আছে যে খবর আমরা জানি না… একটা সময় পারুল ফুল নিয়ে কতই না মাতামাতি ছিল। পরিচয়ের পর প্রণয়ের পালায় প্রেমিক-প্রেমিকা পারুল ফুলের মালা গেঁথে গলে পরিয়ে দিত। লতা মুঙ্গেশকরের কন্ঠে পুরনো দিনের ‘সাত ভাই চম্পা’ গানে ভাইদের জন্য পারুল বোনের ডাকের কি আকুলি বিকুলি… কোথায় যে হারিয়ে গেল সে-ই ফুল…’ পারুল ফুলের কথা শুনতেই নস্টালজিক হয়ে স্মৃতির ভেলায় চড়ে এমনই কথার ঢেউয়ে ঢেউয়ে অতল গহ্বরে ডুবে যেতে থাকেন প্রায় ৯০ বছর বয়সী খন্দকার গোলাম কাদের। মানুষের অজস্র স্মৃতির সেই পারুল ফুলের গাছের সন্ধান পাওয়া গেল বগুড়ার গ্রামে। যেখানে নীরবে নিভৃতে পারুল ফুলের একটি গাছ বয়সের ভারে নু্যয়ে যাওয়ার পরও মাথা উঁচিয়ে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

সোনাতলা এলাকার সমাজসেবী প্রবীণ ব্যক্তি শামসুজ্জামান মনি জানালেন, কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগের এক অধ্যাপকসহ কয়েক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এসে গাছটি দেখে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানালেন এটি পারুল ফুলেরই গাছ। কলেজের অধ্যক্ষও একই কথা জানিয়ে বলেন, উদ্ভিদ গবেষণা জরিপে পারুল ফুলের গাছের যে বর্ণনা আছে তা বিশেস্নষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ একমত হয়েছেন সোনাতলা কলেজের ভিতরের এই গাছটি পারুল গাছেরই ঘনিষ্ঠ প্রজাতি এবং এটা পারুল ফুলেরই গাছ। শিক্ষকগণ বিরল প্রজাতির এই ফুল গাছের ডাল, বাকল, ফুল সবই পরীক্ষা করেছেন। এই গাছ থেকে হাল্কা মিষ্টি গন্ধের ফিকে তামার মতো রঙের ফুল ফোটে মে থেকে জুলাই মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত। বলা যায়, পারুল গ্রীষ্মকালীন ফুল। শিক্ষকগণ বিরল এই গাছটি ভালভাবে সংরক্ষণের আহ্বান জানান। ওই গ্রাম থেকে কিছুটা দূরের গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আজাহার বললেন, ‘যৌবন কালে ওই রাসত্মা দিয়ে যাওয়ার সময় পারুল ফুলের বাসনায় (ঘ্রাণ) মন যে কী হতো…’। তাঁর কথায় বোঝা গেল পারুল ফুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণ যৌবনের উন্মাদনায় রোমান্টিকতায় ভরিয়ে দিত। মানবজীবনের যৌবনের এই ফুল বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সোনাতলার সমাজসেবী শামসুজ্জামান মনি বললেন, ‘এই গাছ থেকে টিসু্য কালচার বা কলম পদ্ধতিতে বা অন্য কোন পদ্ধতিতে বিরল এই পারুল গাছের অসত্মিত্ব টিকিয়ে রাখা যায় কি না তা উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের উচিত বিলুপ্ত হওয়ার আগেই ঐতিহ্যের ওই পারুল ফুলের গাছটি টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা।

ব্লগার পাভেল চৌধুরীদৈনিক জনকণ্ঠের রিপোর্ট থেকে সংকলিত