বিদেশে থাকলে যে দেশের প্রতি কতোটা প্রবল, কতোটা তীব্র আকর্ষণ আর মমত্ত্ববোধ তৈরি হয় তা ভাষায় বুঝানো কঠিন। রক্তের ভেতর মাতৃভূমির নাড়ির টান পাগল করে তুলে। তাই দেশের যে কোনো ভালো খবর শুনলে মনটা আনন্দে ভরে যায়, ভাললোলাগার আবেগে ভিজে ওঠে চোখ। আর কোনো খারাপ খবর পেলে বিষন্ন বেদনায় বুকটা ভারি হয়ে উঠে।
বাবা সিসিইউতে। তাই ২০০৯-এ ছুটে গেলাম দেশে। সেই সময় শাহবাগে এক বিপ্লবী কবি কথায় কথায় আক্রমণ করে বললেন- আমরা রাজপথে আন্দোলন করেছি, জেলজুলুম সহ্য করেছি। আর এখন বসন্তের কোকিলের মতো বিদেশ থেকে এসেছেন সরকারি সুবিধেটা নেয়ার জন্য! আমি তো অবাক! কি বলবো? খালেদা জিয়ার আমলে তো আমাকে চাকরিচুত্য করা হয়েছে, বায়তুল মোকাররমের খতিব ওবায়দুল হক-মুফতি আমিনীসহ জঙ্গীবাদী মোল্লারা আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে, ইনকিলাব-সংগ্রাম-খবরপত্র আমাকে দাউদ-তাসলিমা বানিয়েছে। ক’য় বছরে কি সবাই এ সব ভুলে গেছে?
ক’দিন পর প্রধানন্ত্রীর ইফতারি দাওয়াত। গণ ভবনে ঢুকতেই তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের সাথে দেখা। তিনি আমার দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়। হাতে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে পর দিন বাসায় যেতে বললেন। গেলাম মিন্টো রোডের ৬ নং হেয়ার রোডে। তিনি দেশে ফিরে কোথাও কাজে জয়েন করার জন্য অফার দিলেন। তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। সাথে সাথে মনে পড়লো সেই তখন বিপ্লবী কবির কথা। বিদেশ থেকে বসন্তের কোকিল হয়ে এসেছি…। কাক-কোকিলের কথা থাক। যে কারণে আজ ‘একটি বিনীত অনুরোধ’ করছি, সেই প্রসঙ্গেই আসি।
নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেনকে প্রাণ দিতে হলো সন্ত্রাসীর গুলিতে! এভাবে আর কতো জীবন যাবে? আলতাফ-বাবর-সাহারারা তো জাতিকে সান্ত্বনা দিয়েই যাচ্ছেন- সন্ত্রাসী যেই হোক, তাকে শাস্তি পেতেই হবে। এ প্রসংগে আর কিছু বলার নেই।
বলতে চাই, তার করুণ মৃত্যুর ক্ষোভে মানুষেরা আন্তঃনগর এগারোসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি পুড়িয়ে দেয়! জ্বলে উঠা নরসিংদীর ক্রোধের দাউ দাউ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো বগিগুলো। ক্ষুব্ধ জনতা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করে। ‘নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ড অভিযোগের তীর মন্ত্রী ও তাঁর ভাইয়ের দিকে’ বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। অপর দিকে সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবীর খোকনকে। খুবই আতঙ্কে আছি, হয়তো এর জের ধরে আরো গাড়িবাড়ি জ্বলবে, পুড়ে ছাই হবে গরীব দেশের সম্পদ। হরতালে বা আন্দোলনে ভাংচুরের দৃশ্য দেখে বিদেশে বসে কষ্ট পাই, পেয়ে লিখিঃ ‘যখন আমরা আবাদি জমির বিরুদ্ধে আন্দোলন নামলাম-/ ভাঙচুর করলাম বাংলাদেশ, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিলাম বাংলাদেশ/ তখন ভাসমান মেঘ মুখ ফিরিয়ে ফিরে গেলো মেঘালয়ে’। কবিতা লিখেও মনে শান্তি পায় না!
প্রতিটি হরতালে কতো কোটি কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয়। আমাদের মতো একটি দরিদ্র দেশের এই ক্ষয়ক্ষতি কী আমরা কোনো ভাবে পোষাতে পারি? কি অপরাধ এই সব জাতীয় সম্পদের? একটি গাড়ি কী সন্ত্রাসী, একটি ট্রেন কী অপরাধী, একটি বিল্ডিং কী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ?
তাহলে আমরা কেনো ক্ষোভের বশীভুত হয়ে গাড়ি ভাঙচুর করি? আমরা কেনো পুড়ে ছাই করি ট্রেন? কেনো ধ্বংস করি আমাদের সম্পদ! এতে ক্ষতি ছাড়া কি লাভ? সম্পদ কী তো আমাদের শত্রু? তাই, আমার একটি বিনীত অনুরোধ- গাড়ি ভাংবেন না, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করবেন না গরীব দেশের ট্রেন। এ সব আমাদের সম্পদ; শত্রু না।