সময় মতো কৃষির সর্বোপকরণ সরবরাহে নিশ্চয়তা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় সারাদেশে বিশেষ করে হাওর-ভাটি এলাকায় এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এ এক মাইল ফলক।
কিন্তু কবি গুরু রবি ভাষায় বলা যায় ’
….ধান কাটা হলো সারা…,
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই সোনার তরী;
আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি…’ অবস্থা ।সর্বত্রই রাশি রাশি ধান। সরকারি গুদামে ঠাঁই নাই বলে সরকার বেশী পরিমাণে ধান কিনতে পারছে না। হাওর এলাকাসহ সর্বত্র অত্যন্ত কম দামে ধান বিক্রয় হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কৃষকের গোলায় ধান সংগ্রহ ও সংরক্ষণে আমাদের কিছু প্রস্তাবনা সদয় বিবেচণার জন্য উপস্থাপণ করছি।
- সারা দেশে সাড়ে ছয় হাজারের বেশী ইউনিয়ণ, বিশ হাজারের বেশী ওর্য়াড এবং প্রায় নব্বই হাজার গ্রাম আছে।
এসব স্থানীয় সরকার পরিষদে প্রায় লক্ষাধিক জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। তাঁরা সরকারেরই অংশ। এ প্রতিনিধিগণের প্রায় সবাই অবস্থাপন্ন স্বচ্ছল কৃষক। প্রত্যেকের বাড়িতে পর্যাপ্ত জায়গা, ঘর ও ম্বক্ষমতা রয়েছে, যে কোন নতুন ধ্যাণ-ধারণা বহণ ও গ্রহণের। প্রত্যেক গ্রামে এ রকম আরো অনেক কৃষক পাওয়া যাবে। সব মিলে কয়েক লক্ষ স্বক্ষম কৃষক বাচাঁই করা যাবে, যাঁরা সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাঁদের গোলায় ধান সংরক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবে। - যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখে মান সম্পন্ন গোলাঘর নির্বাচন করতে হবে। গোলাঘর মেরামত, নির্মাণ ও সংরক্ষণে পরামর্শ ও ট্রেনিং দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক সহযোগিতা দিলে সংগ্রহিত ধানের মূল্য হতে কেটে রাখা যেতে পারে।
- নির্বাচিত এ কৃষকগণের গোলায় ১০, ২০, ৩০,… টন করে ধান সংরক্ষণ করা হবে। এ ধান কৃষকের নিজের/ কয়েকজনের উৎপাদিত যৌথ ধান হবে। সহজ সংরক্কণ প্রযুক্তিও উদ্ভাবণ করতে হবে।
- চুক্তিবদ্ধ কৃষককে গোলায় মজুদকালে ধানের পূর্ব নির্ধারিত সরকারি/ধার্য্যকৃত ন্যায্য মূল্যের এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক দাম এবং বাকী টাকা মান সম্মত সব ধান সরবরাহের সময় দেয়া যেতে পারে। ব্যাংকও এক্ষেত্রে ধান বন্ধক রেখে জিম্মাদার হয়ে টাকা দিতে পারে।
- স্থানীয় সরকার বা অন্য কোন ব্যবস্থাপনা সব কিছু তদারকি করতে পারে। সরকারি গোদামে ধান সংরক্ষণে অনেক টাকা ব্যয হয়। এ ক্ষেত্রে সংরক্ষককারি কৃষককে সংরক্ষণের খরচ হিসাবে কিছু টাকা দিতে হবে। সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব কৃষকের। নষ্ট বা কম মান সম্পন্ন ধান সরকার নেবে না বা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না বা কৃষক প্রদত্ত টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হবেন ।
- দেশে বেশ কিছু স্থানে বিএডিসি, কৃষি বিভাগসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিত্যক্ত গোদাম/গোডাউন রয়েছে। এগুলো মেরামত করে ব্যবহার করা যেতে পারে। স্কুল, কলেজও মাদ্রাসার খালি ঘরেও রাখা যেতে পারে। সরকারি গোডাউনে আমদানিকৃত চাল না রেখে দেশে উৎপাদিত ধান রাখা যেতে পারে। বেসরকারি আমদানিকারিগণ নিজ দায়িত্বে আমদানিকৃত পণ্য সংরক্ষণ করবেন। সাবেক সচিব কারার মাহমুদুল হাসানের এই ধারণার সাথে আরো সংযোজন করে বলা যায়-
- চাল কল গুলোকে এ সংরক্কণ কৃত ধান কিনে ভাংগাতে বাধ্য থাকতে হবে । চাল কল স্থাপণে, পরিচালণায় সংরক্কতি ধান কেনার বাধ্যকতা থাকতে হবে ।
- বর্তমানে চাল নিয়ে ধান্ধাবাজি বন্ধ করতে হবে । ভারত হতে সস্তায় আমদানিকৃত চল গোলায় সংরক্কণ করা হচ্ছে, সরকার যখন চাল কিনবে তখন এ চাল উচ্চ মূল্যে সরকারি গোদামে সরবরাহ করা হবে। কোনভাবেই তা হতে দেয়া যাবে না। এতে কৃষককে সহায়তার সরকারি ঊদ্যোগ সম্পূর্ণ ভেস্তে যাবে ।
- “দেশীয় চাল কলে ভাংগা চাল” যথাযথ কর্তৃপক্কের এ রকম সার্টিফিকেট ছাড়া সরকারি কোন গোদামে চাল কেনা যাবে না । যুক্তি সংগত দামে তাঁদের কাছ থেকে চাল কিনতে হবে। চাল কলগুলোকে বিভিন্ন রকম সহায়তাও দিতে হবে ।
- হাওর এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে গোদাম ঘর/ খাদ্য শাইলো নির্মাণ করতে হবে।
শত বছরের বংশ পরস্পরায় অভিজ্ঞ কৃষক জানে ধান কতটুকু ও কিভাবে শুকাতে এবং সংরক্ষণ করতে হবে। একটি ধান দাঁতে কেটে বা কানের কাছে নিয়ে শব্দ শুনেই শুকনার অবস্থা বুঝতে পারেন। আর একটু বুদ্ধি, পরামর্শ বা ট্রেনিং এর মান বাড়িয়ে দেবে হাজার গুণ বেশী।
কৃষকের গোলায় ধান মজুদের ফলে সরাসরি কৃষককে সরকার নির্ধারিত মূল্য নিশ্চিত করা এবং এলাকায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীতে ব্যবহার করা যাবে। এলাকা ভিত্তিক চাল কলও স্থাপণ করতে হবে। ফলে খাদ্য পরিবহণ ব্যয় ও অপচয় কমে যাবে। হাওর এরাকার বাহিরে ধান নিয়ে চাল বানিয়ে ফেরত আনার দ্বিমূখী ক্ষতি হতে রক্ষা পাবে। অনেক কর্মসংস্থান ও প্রাণ চাঞ্জল্য আসবে।
সরকার নির্ধারিত/ন্যায্য মূল্যে ধান কিনবেন, এ নিশ্চয়তা দিলে কৃষক যথাযথভাবে ধান সংরক্ষণ করবে, অধিক উৎপাদনে আগ্রহী হবে, প্রয়োজনে গোদাম ঘর তৈরী করে ধান রাখবে। দায়িত্ব দিলেই মানুষ দায়িত্ববান হয়। এভাবে লক্ষ লক্ষ মন ধান কৃষকের গোলায় সংরক্ষণ করে মধ্যস্বত্যভোগীদের দৌরাত্ব কমিয়ে সরকার সহজেই বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারবে। এরুপে গড়ে উঠা একটি জনসম্পৃক্ত টেকসই সংস্কৃতি আমাদের কৃষির ভিতকে মজবুত করবে বলে আমার াবশ্বাস।
ড. নিয়াজ পাশা, কৃষি প্রকৌশলী ও হাওর ভূমিপুত্র।
সার্ক কৃষি কেন্দ্র, ঢাকা। ফোনঃ ০১৭২৭ ০৭৪ ৫৮৪