পাখিরা বাসা তৈরি করে, ডিম পাড়ে, তা দেয় ও বাচ্চা ফোটায়। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। তবে ব্যতিক্রমও আছে। কোকিলজাতীয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বাসা তৈরি করে না, লুকিয়ে অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে। এ ছাড়া লম্বা পা-ওয়ালা মুরগিজাতীয় কিছু পাখি আছে,ইনকিউবেটর বা থার্মোমিটার পাখি নামে পরিচিত। এরা বাসা বানায় না, ডিম পাড়া ও ডিম ফোটানোর জন্য ঢিবি তৈরি করে।বিশ্বের অনেক দেশের মতো এ দেশেও এমন একধরনের পাখি আছে, যারা না তৈরি করে বাসা, না পাড়ে অন্যের বাসায় ডিম। এরা ডিম পাড়ে মাটিতে এবং তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। প্রয়োজনে মুখ ও পায়ের সাহায্যে ডিম ও বাচ্চা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরায়। দিনে ঘুমিয়ে কাটায়, রাতে হয় সক্রিয়। ছদ্মবেশী (Camouflage) নিশাচর এই পাখির নাম কি কারও জানা আছে?
১৯৯৭ সালের মে মাসে সুন্দরবনবিষয়ক এক সেমিনারে যোগ দিতে আমরা কয়েকজন খুলনার গেলাম। সঙ্গে ছিলেন ড. রেজাউর রহমান ও শরীফ খান। সেমিনার শেষে দুই দিনের জন্য ফকিরহাটের সাতশৈয়া গ্রামের জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণে যাই।
গ্রামে পৌঁছেই নেমে পড়লাম ছদ্মবেশী নিশাচরের খোঁজে। পিছু পিছু নিঃশব্দে কখন যে একটি কুকুর এসেছে, খেয়ালই করিনি। হঠাৎ করে ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে শরীফ ভাই সবাইকে থামার সংকেত দিলেন। থামলাম। উনি একটা জায়গার দিকে আঙুল নির্দেশ করলেন। লক্ষ করলাম, ঘাস-লতা-পাতা-ফার্ন ও শুকনো পাতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে চোখ বুজে বসে আছে পাখির মতো কিছু একটা। বুঝতে বাকি রইল না এটা কী! শরীফ ভাই পাখিটির একদম কাছে চলে গেলেন। তবু এর কোনো নড়ন-চড়ন নেই। যেইমাত্র পাখিটির গায়ে তাঁর হাতের ছোঁয়া লাগল অমনি সেটি উড়ে গিয়ে বসল পাশের বড় গাছটাতে।
যেই না গাছের দিকে ক্যামেরা তাক করব, তখনই চোখ আটকে গেল যেখানে পাখিটি বসে ছিল ঠিক সেখানে। দেখলাম, মুরগির বাচ্চার মতো তুলতুলে ও আদুরে একটা ছানা বসে আছে। এতক্ষণ পাখিটি একে তাপাচ্ছিল। বয়স মাত্র তিন-চার দিন। এরপর শরীফ ভাই বাচ্চাটি আলতো করে ধরে সেখান থেকে অল্প দূরে সরিয়ে রাখলেন। আমরা চলে এলাম। পাখিটিও বাচ্চার কাছে চলে গেল।
এতক্ষণ যে পাখির কথা বললাম, সেটি আমাদের গ্রামীণ ঝোপ-জঙ্গল-বাঁশঝাড়ের পাখি লম্বালেজি দিনেকানা (Large – tailed Nightjar) বা রাতচরা। এরা ঠুকঠুকিয়া, বক্কা বা বাচ্কা নামেও পরিচিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পাখির ৭৬টি প্রজাতি রয়েছে। সবার বৈশিষ্ট্য কমবেশি একই রকম। এ দেশে আছে চার প্রজাতি। লম্বালেজির বৈজ্ঞানিক নাম Caprimulgus macrurus। এ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বেশি দেখা যায়। ঢাকার শহরতলির দু-এক জায়গায়ও দেখা যায়।
দিনেকানা নিরীহ ও সুন্দর পাখি। প্রয়োজনে কাত-চিৎ হয়েও উড়তে পারে। দিনের বেলা দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। রাস্তার ধুলোয় বুক মিশিয়ে বসতে ভালোবাসে। রাতে চোখ জ্বলজ্বল করে। ডাকও মিষ্টি।
উড়ন্ত পোকামাকড় খায়। ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে উপকার করে। বনবিড়াল, খাটাশ, শিয়াল, ভুতুম পেঁচা, সাপ, গুঁইসাপ এদের প্রধান শত্রু। এরা পা চালিয়ে, ডানা ঝাপটিয়ে ও ব্যাঙের মতো মুখ হাঁ করে শত্রুকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে।
দিনেকানা বাসা তৈরি না করলেও স্ত্রী ও পুরুষ পাখি মিলেই ডিম পাড়ার জায়গা পছন্দ করে। মাটিতে এক-দুটি সাদাটে ডিম পাড়ে। ডিমে কালচে, বাদামি, মেটে বা লালচে দাগ থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি মিলেই তা দেয়। ডিম ফোটে ১৬ থেকে ২০ দিনে। বাচ্চারা দিনের বেলা একটুও রা করে না, চুপটি করে মাটিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। রাতে বেশ নড়াচড়া করে। মা-বাবা মুখে খাবার নিয়ে ফিরলে ছোট ছোট ঠোঁট ফাঁক করে ধরে।দিনেকানা এ দেশে এখনো বেশ সংখ্যায় আছে। তবে দিনে দিনে যেভাবে ঝোপ-জঙ্গল উধাও হচ্ছে, তাতে এরা আর কত দিন ভালো থাকবে কে জানে।
আ ন ম আমিনুর রহমান