“আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে,
সপ্তসিন্ধু কল্লোল রোল বেজেছে সপ্ত তারে।”

উমা এসেছে।  পুত্রকন্যাসহ পুরো পরিবার নিয়ে।  তাঁর আগমনে খুশির জোয়ারে বাঁধ ভেঙেছে প্রকৃতিতে, সবার মনে। আগমনী গানের উমা আমাদের ঘরের মেয়ে।  মা মেনকার উদ্বেগও আমাদের চেনা –

“ও মা, কেমন ক’রে পরের ঘরে,
ছিলি উমা, বল মা তাই।
কত লোকে কত বলে, শুনে ভেবে ম’রে যাই।”

উমা মা’কে সবিস্তারে বলে এক বছরের উপাখ্যান :
“তুমি তো মা ছিলে ভুলে,
আমি পাগল নিয়ে সারা হই।
হাসে কাঁদে সদাই ভোলা,
জানে না মা আমা বই।”

সমস্ত আয়োজন উমার আগমণকে ঘিরে।  এ তো তাঁরই আরাধনা। মা মেয়েকে ডেকে তোলেন :
“গা তোল উমা, রজনী প্রভাত হলো,
মঙ্গল আরতি হবে. উঠ মা সর্ব মঙ্গলে।
ব্রহ্মা-আদি দেবগণ, করিতেছে আগমণ,
পূজিতে ও শ্রীচরণ  করে জবা-বিল্বদল।”

জগজ্জননী বিপত্তারিনী আনন্দময়ী মা, শক্তিরূপিনী দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা এসেছেন আমাদের মাটির পৃথিবীতে; এসেছেন মৃন্ময়ীরূপে. আর চিন্ময়ীরূপে তো তিনি রয়েছেনই। তাই আজ উৎসব, দুর্গোৎসব –  শারদোৎসব। বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে আনন্দ। শঙ্খ আর ঢাকের আওয়াজে মেতে উঠেছে শহর-গ্রাম আর মহল্লা। চারদিকে মঙ্গলধ্বনি।  নানা রঙে-ঢঙে সেজেছে গ্রামবাংলার হিন্দু অধ্যুষিত জনপদসমূহের পূজামন্ডপগুলো। মহালয়ার মধ্য দিয়ে যার প্রারম্ভিকা, ষষ্ঠীপূজায় আনুষ্ঠানিকতা; সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পর বিজয়া দশমী এবং প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে যার আনুষ্ঠানিক যবনিকা।

দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব।  তন্ত্রশাস্ত্রের অন্যতম গ্রন্থ হচ্ছে ‘শ্রীশ্রী চন্ডী’।  এই চন্ডী গ্রন্থে দেবী দুর্গার আবির্ভাব এবং তাঁর কর্মকান্ডের উল্লেখ রয়েছে। আদিকালে পূজিত চন্ডী দেবীই পরবর্তীকালে দুর্গার রূপ ধারণ করেছেন বলে অনেক বাঙালি সামাজিক নৃতাত্ত্বিকের ধারণা। তাই বাংলার লোকসংস্কৃতির ইতিহাস পরিক্রমায় এক সময় ‘চন্ডীমন্ডপ’ ‘দুর্গামন্ডপ’-এ পরিনত হয়েছে।  দুর্গাপূজা শক্তি পূজার এক বিশেষ রূপ।

শ্রীশ্রী চন্ডীতে ভগবতী ও কালী এ দুজনই আদ্যাশক্তিরূপে পূজিত।  ভগবতী দেবী দুর্গারই আরেক নাম। দেবী ভগবতী তান্ত্রিকবাদের সূত্রেই বাংলার হিন্দু সমাজে সাংবাৎসরিক পূজ্য সত্তা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। মাতৃকেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু তার হারানো মাকে খুঁজে পেল এবং তান্ত্রিকবাদের মূলনীতি অনুসারে দৈনন্দিন সব কর্মকে শক্তি পূজার অঙ্গবিশেষ বলে মনে করতে লাগল। কালী তপস্যার বলে শিবকে প্রসন্ন করেছেন, এজন্যে তিনি হলেন গৌরাঙ্গী।

তিনিই পরে গৌরী অর্থাৎ দুর্গা বলে খ্যাত হলেন। দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের পৌরাণিক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে পঞ্চদশ শতকের বাঙালি কবি কৃত্তিবাস প্রণীত রামায়ণে।  রামায়ন অনুযায়ী ত্রেতাযুগে অযোধ্যার রামচন্দ্র শরৎকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন।  এই পূজার মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার কাছ থেকে শক্তি সঞ্চার করে রামচন্দ্র লঙ্কার রাজা রাবনকে হত্যা করে তার অধীনে বন্দিনী স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন। অর্থাৎ দুর্বিনীত ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ও প্রতিকার লাভের চেতনাই দুর্গোৎসবের মর্মবাণী। রামায়ণে বাঙালির সামাজিক জীবনের প্রধান আনন্দোৎসব তথা রামচন্দ্রের শারদীয় দুর্গোৎসব অকাল বোধনের কথা রয়েছে।

প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে জানা যায়, বাংলায় আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্গাপূজার প্রচলন হয় ষোড়শ শতকে। প্রথমদিকে এ পূজা ক্ষুদ্র ধনিক শ্রেণির মাঝেই অনেকটা সীমাবদ্ধ থাকে।  অষ্টাদশ শতকে ইংরেজ আমলের শুরুর দিকে দুর্গাপূজা বাংলাদেশে ধনী জমিদার ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির পারিবারিক পূজায় পরিনত হয়। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে বঙ্কিমচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের মতো বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের রচনায় বাংলার লৌকিক দেবী দুর্গা দেশমাতৃকার বন্দনায় রূপান্তরিত হন। এ সকল কীর্তিমান সাহিত্যিকের মাতৃভুমির বন্দনায় লোক-ভাবনা নতুন রূপ পায়।  বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী বিনয় সরকারের ভাষায়, “দেবী দুর্গার আরাধনাই দেশমাতৃকার আরাধনা আবার দেশমাতৃকার আরাধনাই দেবী দুর্গার আরাধনা।” রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন  ‘‘ভালবাসার অপর নাম যদি পূজা হয় তাহলে দুর্গাপূজার আসল অর্থ হচ্ছে নিজের দেশকে ভালবাসা, সব ধরণের দুর্গতি দূর করে একে সুখী সমৃদ্ধরূপে গড়ে তোলার আকাঙ্খা।’’

আবহমান বাঙালির সমন্বিত ঐতিহ্যকে নজরুল যেভাবে সাফল্যের সঙ্গে ধারণ করেছিলেন সেভাবে বোধকরি আর কোনো কবি পারেননি। এখানে নজরুল অদ্বিতীয়। তাঁর কবিতায় হিন্দু পুরাণ ও ইসলামী ঐতিহ্য সমান নৈপুণ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।  হাম্দ-নাত ইসলামী গান ও শ্যামাসঙ্গীত-বৈষ্ণবপদ রচনায় যে বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর নজরুল রেখেছেন তা এককথায় নজিরবিহীন।

দুর্গাপূজা উৎসবটি নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চৈতন্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ও ‘পূজা অভিনয়’ কবিতায় দেবী দুর্গাকে নজরুল শুধু ঐশী শক্তির অধিকারী হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন সামাজিক অনাচার, কূপমন্ডুকতা, ভন্ডামি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধ-প্রতীক রূপেও।   কিন্তু সেই চেতনা কি একালের দুর্গাপূজায় উপস্থিত? নজরুল দেখিয়েছেন এই পূজায় আড়ম্বরই হয়ে উঠে বড়, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়াস হয়ে পড়ে গুরুত্বহীন। আড়ম্বরসর্বস্ব দুর্গাপূজাকে তাই তিনি বলেছেন ‘পূজা অভিনয়’।  তিনি দুঃখ করে বলেছেন-

“এমনি শরৎ সৌরাশ্বিনে
অকাল বোধনে মহামায়ার
যে পূজা করিল রুধিতে রাবনে
ত্রেতায় স্বয়ং রামাবতার,
আজিও আমরা সে দেবী-পূজার
অভিনয় করে চলিয়াছি।”

দেবী দুর্গা শক্তির প্রতীক। তাই দুর্গাপূজার মানে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অপশক্তিকে নির্মূল করা। ত্রেতাযুগে রাবন অত্যাচারীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নজরুলের দৃষ্টিতে কলিযুগের রাবন হচ্ছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ।  নজরুলের ভাষায়

“দশমুখো ঐ ধনিক রাবণ,
দশদিকে আছে মেলিয়া মুখ;
বিশ হাতে করে লুন্ঠন, তবু
ভরে না ক ওর ক্ষুধিত বুক।”

দুর্গাপূজার এমন তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে এই উৎসব শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, এর সার্বজনীনতা স্পর্শ করে অন্যসব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকেও। সৃষ্টি হয় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে একতা ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন। আশা ও আনন্দের কথা, এইরূপ একতা ও সম্প্রীতির বিষয়টিকে এ অঞ্চলের মানুষ সবসময়ই বড় করে দেখে অভ্যস্ত। দশমুখো ধনিক রাবণের বিশ হাতব্যাপী লুন্ঠনকে প্রতিরোধ করার মধ্যেই শারদীয় দুর্গোৎসবের মর্মবাণী নিহিত। দুর্গাপূজার এমন সার্বজনীন বাণীকে মর্মে ধারণ করেই এই উৎসবটিকে আরো স্বার্থক এবং অর্থবহ করে তোলা সম্ভব।

বিমল সরকার :
সহকারী অধ্যাপক, বাজিতপুর কলেজ; কিশোরগঞ্জ