নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অমর খ্যাতি বড়দের জন্য রচিত উপন্যাস ও গল্পের জন্য। কিন্তু শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনায় তার খ্যাতি বড়দের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় মারা গেছেন প্রায় ৪০ বছর হলো। কিন্তু তার রচিত ছোটদের বইগুলো চিরায়ত হয়ে আছে আমাদের কাছে। বছর বছর ছাপা হচ্ছে বইগুলো। তার রচিত পদ্মপাতার দিন, পঞ্চাননের হাতি, লালমাটি, তারা ফোটার সময়, ক্যাম্বের আকাশ, বাংলা গল্প বিচিত্রা, ঘন্টাদার কাবলু কাকা, খুশির হাওয়া, কম্বল নিরুদ্দেশ, চারমূর্তির অভিযান, ঝাউবাংলার রহস্য ও ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে নতুন সংযোজন।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। তার প্রথম লেখা ছাপা হয় মাস পয়লা শিশু মাসিকে। সন্দেশ, মুকুল, পাঠশালা, শুকতারা প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখেছেন। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় সুনন্দার জর্নাল লিখে সুখ্যাতি অর্জন করেন। এ সময় তিনি বড়দের জন্য আনন্দবাজার, বিচিত্রা, শনিবারের চিঠি ও চতুরঙ্গে লেখালেখি করেন। তার সাহিত্য জীবন শুরু হয় কাব্যচর্চা দিয়ে। পরে তিনি গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। বড়দের জন্য রচিত প্রথম প্রকাশিত ‘উপনিবেশ’ ছাপা হয় মাসিক ভারতবর্ষে। ওটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে। তার উপন্যাস-গল্প রচনার অনুপ্রেরণা যোগান উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, সুধাংশুকুমার রায় চৌধুরী, বিজয় লাল চট্টোপাধ্যায়, মন্মথসান্ন্যাল, সজনীকান্ত দাস ও ফনীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশের সন্তান। তিনি ১৯১৮ সালে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম প্রমথনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। তার পৈত্রিক নিবাস বরিশালের বাসুদেব পাড়া গ্রামে। তার শিক্ষাকাল কাটে দিনাজপুর, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ বরিশালের বিএম কলেজ ও কলকাতায়। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন এবং ডক্টরেট ডিগ্রী নেন ১৯৬০ সালে। এরপর তিনি জলপাইগুড়ি কলেজ, সিটি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম তারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
বড়দের জন্য রচিত তার উলেস্নখযোগ্য বইগুলো হলো: একতলা, কালা বদর, কৃষ্ণপক্ষ, গন্ধরাজ, পন্নন্তর, ট্রফি, তিমির তীর্থ, দুঃশাসন, গদসঞ্চার, বনজ্যোৎন্সা, বিদিশা, বীতংস, বৈতালিক, ভাঙাবন্দর, চন্দ্রমুখর, মহানন্দা, রামমোহন, শিলালিপি, শ্বেতকমল, সাগরিকা, স্বর্ণ সীতা, সূর্যসারথী, সঞ্চারিণী, সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী, সাপের মাথায় মণি, আশিধারা, ভাটিয়ালী, আগন্তুক, অমাবস্যার গান, বিদুষক, সাহিত্যে ছোটগল্প, বাংলা সাহিত্য পরিচয়, ছোটগল্পের সীমারেখা ও কথাকোবিদ রবীন্দ্রনাথ।
শৈশব ও কৈশোরে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে। বাংলাদেশের নদ-নদী, গাছ-পালা আর মানুষের সংগ্রামী জীবনের সাথে সেই থেকেই ছিল ঘনিষ্ঠ পরিচয়। তার অধিকাংশ লেখায় ইতিহাসবোধ ও স্বাদেশিকতা বিদ্যমান। ছোটদের তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন এবং হাসিয়ে মজা পেতেন। তার হাসির ব্যাপারটা ছিল গল্পের কাহিনীতে, গল্পের গঠনে, গল্পের চরিত্র সৃষ্টিতে এবং সর্বোপরি রচনাভঙ্গিতে। তার অমর সৃষ্টি টেনিদা ও প্যালারামের গল্পগুলো পড়লেই বোঝা যায়।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ৮ নবেম্বর মাত্র ৫৩ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। কালজয়ী এই কথাশিল্পীকে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।