কিছুদিন ধরেই একটা নিরব আর্তি আমায় কষ্ট দিচ্ছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে আপন জায়গা মায়ের কাছেই চাপা কষ্টটা খুলে বলি! বলতে ইচ্ছে করছে ‘মাগো, ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নেবে। তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না।’ আততায়ী বা দুর্বত্তের হামলা আর চাপাতির কোপে নৃশংস নিথর দেহগুলো গণমাধ্যমে দেখতে দেখতে কিছুটা বিধ্বস্ত। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র ‘মাগো ওরা বলে-’ কবিতার প্রেক্ষাপট যেন আবারও আমাদের জেঁকে বসেছে। আর সেটা দেশে এবং বৈশ্বিকভাবেও। কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লা’র লেখা সেই ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ও নেই। তাঁর কবিতায় তো ছিল-‘সারারাত আমার ঘুম আসেনা-,তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার, নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ, মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস্য শরীর ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি ঘুমুতে পারিনা’। এখন তো এই কবিতার প্রেক্ষাপটও নেই! তবুও কেন এই নির্ঘুম রাত্রি যাপন! তবুও কেন মানবিকতার করুণ আর্তনাদ চারিদিকে? তবুও কেন স্বজন হারানোর হারাকারে অসহায় আর নিরপরাধ মানুষের রক্তাক্ত লাশের মিছিল! উত্তর মেলে না, মেলাতে পারি না!
একটা স্বাধীনদেশে এধরণের নিরাপত্তাহীনতা শুধু কষ্টদায়কই না বরং দুঃখজনক। স্বাধীনতার অম্লান অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই কিছু মানুষ যেন পরিকল্পিতভাবে মানুষ হত্যার হোলি খেলায় মেতেছে। পাশাপাশি একটি সংঘবদ্ধ চক্রও দেশে ধর্ম নিয়ে বিরোধের মাধ্যমে সংঘাত তৈরিতে সদা তৎপর। ধর্মের অপব্যাখ্যা শুনিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরিই তাদের কাজ। পাশবিক মনোবৃত্তিটাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ হত্যার মহোৎসব করে তারা!
ইতোমধ্যে হামলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক সুরক্ষিত দেশে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের কারণে সারা বিশ্বেই নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। সন্ত্রাস এখন আর কোনো একক গোষ্ঠী, বর্ণ, ধর্ম, দেশের সমস্যা নয়। এটি এখন বৈশ্বিক আতংকেরও বিষয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ক্রমবর্ধমান এ সমস্যা মোকাবিলায় দেশগুলোর মধ্যে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা এখন সময়ের দাবী। বিশেষ করে সন্ত্রাস বা উগ্রবাদকে ভিন্ন চোখে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সন্ত্রাস, উগ্রবাদী হামলাগুলোর পাশাপাশি এর কারণগুলোও মোকাবিলার চেষ্টা করতে হবে সরকারকে। কারণ মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপে সন্ত্রাসী বা উগ্রবাদী কোনো হামলাগুলো আমাদের দেশেও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে উদ্বুদ্ধ করছে। তাই এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর হামলা ও তৎপরতা কঠোর হস্তে দমন করা জরুরি।
বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিক, মুক্তমনা ব্লগার, প্রকাশক ও ভিন্নমতাবলম্বী বিশেষ করে নিরপরাধ সংখ্যালঘুদের হত্যার মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট যে, এ দেশে উগ্রবাদের উত্থান ঘটছে। তাই এ ধরণের ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম আরো জোরদার ও কার্যকর করা প্রয়োজন।
শ্বাশত কল্যাণের পথ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ধর্মের প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক ও পরম সহিষ্ণুতার বাণীর বদলে বিকৃত প্রচার ও প্রসার বন্ধ করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কে আরো শাণিত করতে হবে। উন্মোচন করতে ধর্মান্ধ ও জঙ্গিদের অপকর্মের আসল চেহাড়া। ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিবাদকে রুখতে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার কোন বিকল্প নেই। আর বাঙালি জাতি দেশের সর্বজনীন সংঙ্কটে যতবারই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, ততবারই এর সুফল ভোগ করেছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিস্মরণীয় বিজয়ই এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে আজ জাতীয় সংঙ্কটেও কেন আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না? আর সামষ্ঠিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি অন্যতম বাঁধা। অবশেষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম’র ‘কান্ডারী হুশিয়ার!’ কবিতার চরণটুকু কেই সাথী হিসেবে দেখতে চাই-‘আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতেরে করিবে ত্রাণ, দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার।’।
সুমিত বণিক, উন্নয়নকর্মী