বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু প্রায় সমার্থক। হাজার বছর ধরে বাঙালি একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ডের জন্য লড়াই করে আসছিল। সেই দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলাফল—বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও জাগ্রত নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে দখলদার পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা এবং অবিস্মরণীয় বিজয়। কিন্তু এই বিজয় অর্জনের আগে উনিশ শতকের শুরু থেকে কেমন ছিল আমাদের মাটি ও মানুষের রাজনীতি, কেমন ছিল এখানকার রাজনৈতিক নেতাদের মানসকাঠমো—তার কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ অনেকদিন আমাদের কাছে ছিল না। বঙ্গবন্ধুর `অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আমাদের সেই অভাবই কেবল পূরণ করেনি, আমাদের ইতিহাসের আয়নায়ও দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ফলে আমরা যেমন আমাদের চিনতে পারছি, একইভাবে আবিষ্কার করতে পারছি সেই কালের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূগোলও।
আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, সৌন্দর্যবোধ ও সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তির কথা ও আব্বাস উদ্দীনের গানে মুগ্ধ হওয়ার ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। বইটি উল্লেখযোগ্য দু’টি কারণে :(১)এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছয় পৃষ্ঠার একটি ভূমিকায় সমৃদ্ধ এবং ভাষান্তরটি যথার্থই প্রশংসনীয়। এজন্য এর অনুবাদক অবশ্যই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার পাত্র।
বাঙ্গালি কালে কালেই শাসক-শোষকের বিভিন্ন কুচক্রান্তে আবর্তিত হয়েছিল। আর যুগে যুগে জন্ম হয়েছিল কিছু নির্লোভ সূর্য সন্তানের। যাঁরা মাতৃভূমির মানকে সমুন্নত রাখতে তুচ্ছ করেছিল নিজের জীবনকে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গতে উজ্জ্বীবিত করেছিল পুরো জাতিকে। বিনিময়ে শাসক গোষ্ঠীর চক্রান্তে বরণ করে নিয়েছিল শত বঞ্চণা আর অমানুষিক অত্যাচার। তবুও স্বপ্নকে বিকিয়ে দেয়নি। মাথা নত করেনি পরদেশী শাসকের বর্বর নির্যাতনের কাছে। কংগ্রেস থাকতে মুসলিম লীগ কেন? মুসলিম লীগ থাকতে আওয়ামী মুসলিম লীগ কেন? কোন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়? লাহোর প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের প্রবক্তা এ কে ফজলুল হক কেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন? অথবা পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী হয়েও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর লেখক কেন সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছেন? এসব ঘটনা প্রবাহের অবিচ্ছেদ্য অংশীদার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়েছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালে ১৯৬৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি বইটি রচনা শুরু করেন। তাঁর স্মৃতিময় জীবনের প্রথমার্ধই অর্থাৎ ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এ গ্রন্থের উপজীব্য। ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি প্রাপ্তি সম্পর্কে বলেন ‘মনে হচ্ছিল, আল্লাহর তরফ থেকে ঐশ্বরিক অভয়বাণী এসে পৌছাল আমার হাতে’, যা এই গ্রন্থের ঐতিহাসিক গুরুত্বই ফুটিয়ে তোলে।
২০০৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা চারটি খাতা আকস্মিকভাবে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার হস্তগত হয়। খাতাগুলি অতি পুরানো,পাতাগুলি জীর্ণপ্রায় এবং লেখা প্রায়শ অস্পষ্ট। মূল্যবান সেই খাতাগুলি পাঠ করে জানা গেল এটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী,যা তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন,কিন্তু শেষ করতে পারেননি। জেল-জুলুম,নিগ্রহ-নিপীড়ন যাঁকে সদা তাড়া করে ফিরেছে,রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসর্গীকৃত-প্রাণ, সদাব্যস্ত বঙ্গবন্ধু যে আত্মজীবনী লেখায় হাত দিয়েছিলেন এবং কিছুটা লিখেছেনও,এই বইটি তার স্বাক্ষর বহন করছে। বইতে আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, লেখকের বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশ বিভাগের পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণ এবং এসব বিষয়ে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে।
আছে লেখকের কারাজীবন,পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সর্বোপরি সর্বংসহা সহধর্মিণীর কথা,যিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সকল দুঃসময়ে অবিচল পাশে ছিলেন। একইসঙ্গে লেখকের চীন, ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের বর্ণনাও বইটিকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু যেন এক মানবীয় উপাখ্যান। যার পরতে পরতে ছিল নিষ্ঠা, দেশপ্রেম আর আত্মোৎস্বর্গী মানসিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি যদি এই বইটির রসদ অর্থাৎ ডায়েরীটা না লিখে যেতেন, তাহলে বাঙ্গালি জাতি তথা বর্তমান প্রজন্ম জানতোই না বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ সম্পর্কে। দেশের জন্য তাঁর মমত্ববোধ আর অসামান্য আত্মত্যাগের কথা। আমরা খুব সৌভাগ্যবান যে তারই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও সহযোগীরা বিষয়টির অন্তমিল রেখে সুচারুভাবে পাঠোদ্ধার করেছেন। বাঙ্গালি জাতি সুযোগ পেয়েছে স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনকের আত্মোপলব্ধি ও জীবনবোধের সাবলীল কথাগুলো জানার। যুগে যুগে বাঙ্গালীর দাবী ও আন্দোলন উজ্জ্বল সংগ্রামের এই অগ্রণী ভূমিকা বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসকে করেছে চিরস্মরণীয় ও সমৃদ্ধ। তারই ধারাবাহিকতায় ৭১’ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের কাছে অবিসংবাদিত নেতা।
“মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না”- চোখের পানিতে এই প্রতিজ্ঞা যিনি করেছিলেন, বাংলার মানুষের জন্য যিনি জেল খানায় পার করেছেন অর্ধেক সময়, বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে গোপালগঞ্জের কিশোর শেখ মুজিব যখন ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠছেন, ঠিক তখনই সমাপ্ত হল তাঁর -অসমাপ্ত আত্মজীবনী। আর তাঁর আত্মজীবনীর মতো জীবনটাকেও অসমাপ্ত করে দিল এই বাংলারই কিছু মানুষ। কিন্তু আজ সেই অসমাপ্ত ইতিহাসই নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে বাংলার মানুষের হৃদমাঝারে।
সুমিত বণিক,
উন্নয়নকর্মী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।