১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনীরা তড়িঘড়ি করে খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর সামনে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়। সেনাবাহিনী, রক্ষী বাহিনী ও দেশবাসীর সামনে তারা দেখাতে চায় যে, বঙ্গবন্ধু জীবিত নেই বলে বাংলাদেশে কোন ক্ষমতার বা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি। ১৫ আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে খুনী খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু করেন রাষ্ট্রপতির সচিব আব্দুর রহিম এবং স্বঘোষিত মুখ্য সচিব মাহবুব-উল-আলম চাষী (সিআইএ’র চর বলে প্রমাণিত হওয়ায় পাকিস্তান আমলে চাকরিচ্যুত) এবং তাদের আদেশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খুনী মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের ভাব-গাম্ভীর্য বৃদ্ধির জন্য খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক হয়।

বঙ্গভবনে খুনীদের একদিন পার হলো। ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের ফটোগ্রাফার আমির খসরুর কাছ থেকে খবর পেয়ে আমি ও কুমার শংকর হাজরা (খুনী মোশতাকের অফিসার) দোতলায় গেলাম খুনীদের মাতলামি করার ঘটনা

দেখতে। আমরা দু’জন দোতলায় লিফটের দরজা খুলতেই দেখলাম লিফট থেকে ১০-১২ হাত দূরে বঙ্গবন্ধুর এক খুনী রিসালদার মহিউদ্দিনের এক হাতে মদের বোতল, আরেক হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। রাতে জানলাম আর্মি চীফ জেনারেল শফিউল্লাহ বঙ্গভবনে বন্দী। রাত ১১টার পরে খুনীদের দুটি মাইক্রোবাসে সুন্দরী মহিলারা এসে বঙ্গভবনে নামল। তাদের দোতলায় কিলারদের কক্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। বলা হলো কিলারদের স্ত্রীরা এসেছেন। অনেকে বিশ্বাস করতে পারল না।

১৭ আগস্ট সকাল ৯/১০টার দিকে বঙ্গভবন থেকে ফোন করে ঢাকার পত্রিকার সম্পাদকদের বঙ্গভবনে আসার ফরমান জারি হলো। ঢাকার সম্পাদকরা প্রবীণতম সম্পাদক জনাব ওবায়দুল হক সাহেবের নেতৃত্বে ১০-১২ জন সম্পাদক এলেন বঙ্গভবনে। বঙ্গভবনের গেট পেরিয়ে আসার পর বঙ্গভবনের সিঁড়িতে তাঁদের আটকে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড় করিয়ে রাখল অস্ত্রধারীরা। আমরা তাদের সেখান থেকে আনার জন্য গেলাম। কিন্তু অস্ত্রধারী খুনীরা হাতের ইশারায় আমাদের দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদক জনাব ওবায়দুল হক সবার পক্ষ থেকে অস্ত্রধারীদের বললেন, বঙ্গভবনের বৈঠকের জন্য তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁদের যদি ভেতরে যেতে না দেয়া হয়, তবে তাঁরা চলে যাবেন। এ কথা বলামাত্র মাথায় খুন চেপে থাকা বঙ্গভবনের অস্ত্রধারী খুনীরা তাদের দিকে হিংস্রভাবে তেড়ে এসে তাদের মাথার ও বুকের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে চিৎকার করে বলে উঠল : “Shut up, shut up you bustards, if you say a word, you are dead, all of you are dead. সম্পাদকরা সেই রক্ত পিপাসু খুনীদের আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে ভয়ে আতঙ্কে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ির ওপর পড়ে যান। কেউ কেউ কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ির ওপর বসে পড়েন। দেশের গুণী সম্পাদকরা নিজেদের আত্মসম্মান বাঁচাতে বঙ্গভবনে খুনীদের হাতে তাঁদের লাঞ্ছিত হবার ও নিগৃহীত হবার ঘটনা সেদিন জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি!! (গত ২০ জুলাই, ২০০৩ হোটেল শেরাটনে দৈনিক ভোরের কাগজের যুগপূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন দেশের প্রবীণতম সম্পাদক ৯৮ বছরের বর্ষীয়ান এই বিবেকের কণ্ঠস্বর জনাব ওবায়দুল হক।) অনুষ্ঠান শেষে আমি তাঁকে জানালাম যে, ”৭৫-এর ১৭ আগস্ট বঙ্গভবনে খুনীরা সম্পাদকদের বুকের ওপর যে আগ্নেয়াস্ত্র ধরেছিল, সেটা আমি বহুবার ১৫ আগস্টের পত্র-পত্রিকায় লিখেছি।’ তিনি আমার হাত জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে তাঁর পাশে বসালেন। তখন সেখানে বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মমতাজউদদীন সাহেবও তাঁর আরেক পাশে ছিলেন।

তিনি তাঁর পাশে বসিয়ে আমাকে বললেন, “মুসা সাদিক, আপনি ‘খুনীদের মাথার মুকুট’ শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে যেটা লিখেছেন, সেটা লেখার সাহস এদেশে আর কেউ দেখাতে পারেনি। সেজন্য আপনাকে আমি ধন্যবাদ দেই। আপনার অসীম সাহস। ‘৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসটা আপনাকে দেখলে চেনা যায়। আমি দোয়া করি, আল্লাহতায়ালা যেন আমার চেয়েও আপনার আয়ু বেশি দেন।” তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা জিয়ার সময় আইএসপিআরের ডিরেক্টর কে ছিল যেন? ওর নাম কি যেন? ওর নামটা কি ছিল? দেখুন না, বয়স হয়েছে, এখন আর কিছু মনে করতে পারি নে!” আমারও তখন নামটা মনে পড়ছিল না। তিনি নামটি মনে করার জন্য অনেকক্ষণ চেষ্টার পর বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, জাহিদ। আপনার লেখায় জাহিদের একটা কথা লিখে দেবেন যে, জিয়ার সময় জাহিদ ১৯৮১ সালে একদিন অবজারভার অফিসে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। এসে সে বলে যে, “ক’দিন আগের ক্যু’য়ের জন্য আর্মির দু’হাজার অফিসার ও র্যাঙ্কার্সদের (জওয়ানদের) মৃত্যুদণ্ডের একটি ফাইলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আজ সই করে দিলেন। ফাইল স্বাক্ষরের সময় আমি সেখানে ছিলাম। জানেন, এই ফাইল স্বাক্ষরের সময় তার মধ্যে আমি কোন ভাবান্তর দেখলাম না।” জাহিদ আমাকে আরও বলল, “তার বিরুদ্ধে এটা নিয়ে ১৮-১৯টা ক্যু হয়েছে।” প্রত্যেক ক্যু’তে হাজার হাজার আর্মি অফিসার ও জওয়ানের মৃত্যুদণ্ড হলে জিয়া কত হাজার জওয়ান ও অফিসারের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ঠাণ্ড মাথায়, নিজের গদির জন্য, ভেবে দেখুন …।” (২০০৩ সালের আগস্ট মাসে এ তথ্যসহ আমার এ আর্টিকেল অবজারভার পত্রিকাসহ দেশের অন্যান্য বাংলা ও ইংরেজী পত্রিকায় ছাপা হয় শ্রদ্ধেয় ওবায়দুল হক সাহেব বেঁচে থাকতে।)

বঙ্গভবনে খুনীদের ২য় দিন পার হলো ঘন ঘন মিটিং করে এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের থেকে আনা গাড়ি গাড়ি মদের বোতল ও হোটেল পূর্বাণীর রাশি রাশি অন্ন ধ্বংস করে। (খুনীরা আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে গাড়ি ভর্তি করে মদ এনে বঙ্গভবনের দোতলায় বোঝাই করে ফেলে। এসব মদের কোন টাকা পরিশোধ করেনি খুনীরা। হোটেল পূর্বাণীর খাবারের কোন টাকা দেয়নি তারা। উক্ত দুই হোটেল থেকে মদ ও খাবার অস্ত্রের মুখে হাইজ্যাক করে আনত তারা।) বঙ্গভবনের দোতলায় অতিথিদের থাকার রুমের সবগুলোতেই খুনীরা থাকতে শুরু করে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা ১৮ আগস্ট সোমবার রাতে হঠাৎ কয়েক রাউন্ড ফায়ার করে বসলে সমগ্র বঙ্গভবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

প্রেসিডেন্টের পিএস-২ জনাব আব্দুল মান্নান (আমরা উভয়ে পশ্চিমবঙ্গের হিসেবে আমার সঙ্গে তার আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং আমরা পারস্পরিক বিশ্বাসভাজন ছিলাম) পরদিন সকালে আমাকে বললেন : “কাল রাত ৯টার দিকে দোতলায় খুনীদের মধ্যে মাতলামো শুরু হয়। তারা আকাশে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, “মীরজাফর শেখ মুজিব শেষ, বাংলাদেশ শেষ। কোন কুত্তাকা বাচ্চা শেখ মুজিবের বাচ্চার নাম লিয়া তো উয়ো বাস্টার্ড কো খতম কর দেংগে। উয়ো বাঙালী বাচ্চাকে হাম খতম কর দেংগে। বাংলাদেশ মর গিয়া। ইসলামী দেশ হো গিয়া ….। কোইয়ি, কাহা, কোন শালা মাদার…হঁযায়, হাম লোগোকে রোখেংগে। মুজিব কা বাচ্চা কোইয়ি, কাহা হঁযায় …।” মদ খেয়ে মাতাল হয়ে অটোমেটিক মেশিন গান হাতে উর্দুতে খিস্তিখেউড় করে বঙ্গবন্ধুকে ও বাঙালী জাতিকে তারা গালাগাল দিচ্ছিল। বঙ্গভবনের সব সিভিল অফিসার ও স্টাফরা ভয়ে দূরে দূরে গিয়ে পিলার আড়াল করে তাদের এসব উর্দু অশ্রাব্য গালাগাল শুনছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় টিক্কা-নিয়াজীরা বঙ্গভবনে বসে বাঙালী জাতির মা-বোন তুলে যেভাবে অশ্রাব্য গালাগাল করত সেভাবেই তারা আমাদের মা-বোনের জাত তুলে পাক সেনাদের কণ্ঠস্বরে গালাগাল করছিল।”

বঙ্গভবনে তৃতীয় দিন পার হলো খুনী মোশতাকের কেবিনেট মিটিং করে। ওই মিটিংয়ে সিদ্ধানত্ম হয় যে, শেখ মুজিবের অর্থ ও ধন-সম্পদের বিবরণী রেডিও-টিভি এবং পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে। বিকেলে সব ব্যাংকের এমডিকে বঙ্গভবনে ডাকা হলো।

কর্নেল রশিদ নিজে দরবার হলে তাঁদের সবাইকে ১৫-২০ জওয়ানের স্টেনগান এবং এসএলআরের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল : “মীরজাফর শেখ মুজিবের কোন ব্যাংকে কত টাকা আছে, আপনারা তার বিবরণী নিয়ে এসেছেন?” সব এমডি বললেন যে, তাদের কারও ব্যাংকে ওঁনার কোন একাউন্ট বা টাকা-পয়সা নেই। সোনালী ব্যাংকের এমডি বললেন যে, সোনালী ব্যাংক, ধানমণ্ডি শাখায় ওঁনার ৩৩০০/- (তিন হাজার তিন শ’) টাকা আছে। তখন কর্নেল রশিদ স্টেনগান এবং এসএলআর তাক করে রাখা সৈনিকদের চিৎকার করে বললেন : They are bustard, dogs of Sheikh Mujib, fire them (তারা সব জারজ, শেখ মুজিবের কুত্তা, তাদের গুলি করে মেরে ফেলো।) এ কথা শোনা মাত্র এক ব্যাংকের জনৈক এমডি অজ্ঞান হয়ে বঙ্গভবনের দরবার হলের মেঝেতে ধপাস করে পড়ে গেলেন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তখন আরেক ব্যাংকের এমডি বলে উঠলেন : “স্যার, স্যার, মারবেন না। স্যার, আমার ব্যাংকে একটা আছে?” কর্নেল রশিদ তার কাছে এগিয়ে গিয়ে টাইসহ তার কোটের কলার চেপে ধরে হুঙ্কার দিল, You bustard, now open your mouth. (তুমি জারজ, এখন তোমার মুখ খোল।) তিনি বললেন : “স্যার, আমি হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের এমডি। হাউস বিল্ডিং থেকে উনি (ভয়ে আতঙ্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটাও উচ্চারণে অপারগ) ৩২ নম্বরের বাড়ি করার জন্য লোন নিয়েছিলেন। সে লোন পরিশোধ করেননি এবং সুদে আসলে তা এখন ৫-৬ লাখ টাকা হবে। এই টাকা ওঁনার কাছে সরকারের পাওনা আছে।” খুনী রশীদ হুকুম দিল : “বাড়ি এক্ষুনি জব্দ করে নিন।” এমডি সাহেব বললেন : “স্যার, নিউজ পেপারে একটা নোটিস দিয়ে দিতে হবে।” খুনী রশিদ বলল : “এক্ষুনি দিয়ে দিন।

পত্রিকার লোক কে আছে এখানে?” সবার আগে সেই মার্শাল’লর ধামাধরা ইবলিশ কুদ্দুস ছুটে এল। সে তৎক্ষণাৎ ড্রাফট করে দিল “মৃত শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র মৃত শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির ঋণ বাবদ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের কাছে সুদে আসলে ৫-৬ লাখ টাকা … বছর যাবত অপরিশোধ্য থাকার প্রেক্ষিতে উক্ত বাড়ি আগামী ৪৫ দিনের পরদিন প্রথম কার্যদিবসে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন কর্তৃক প্রকাশ্যে নিলামে তোলা হবে। আগ্রহী ক্রেতাগণ … তারিখে উক্ত বাড়ির সম্মুখে ডাকা প্রকাশ্য নিলামে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। নিলামে সর্বোচ্চ দর ডাকার কাছে বাড়িটি বিক্রি করা হবে। খুনী মোশতাকের আরেক ডান হাত খ্যাত তাহের উদ্দীন ঠাকুরের নির্দেশে সেখানে উপস্থিত মর্নিং নিউজের সম্পাদক জনাব শামসুল হুদার হাতে এই নিলামের নোটিস এইচবিএফসির এমডি স্বাক্ষর করে দিয়ে দিলেন। ১ দিন পর ১৯ আগস্ট অথবা ২০ আগস্ট দৈনিক মর্নিং নিউজের পেছনের পাতায় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির নিলামের বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়। এই হলো খুনী মোশতাক-রশিদ-ডালিম-ফারুক চক্রের জিঘাংসার শিকার বাংলার মুকুটহীন সম্রাটের অর্থ-বিত্ত ও ধন-সম্পদের সরকারীভাবে প্রকাশিত তথ্য বিবরণী।

১৯৭৫-এর ১৭ আগস্ট কয়েকজন ডিসিকে বঙ্গভবনে ডাকা হলো। সে বিষয়ে আমাকে গত ১৭ আগস্ট (২০১১) সচিব মোকাম্মেল হকের বাসায় এক ইফতার পার্টিতে সে সময়ের (১৯৭৫ সালে) ডিসি জনাব হাসনাত আব্দুল হাই ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, “সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ১৫ জন ডিসির সঙ্গে আমাকে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রেসিডেন্ট মোশতাক আমাদের বললেন, ‘শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়িতে ২০ ভরি সোনা পাওয়া গেছে। এগুলো আপনারা অফিসারদের সব জানাবেন। এসব অবৈধ সোনা এবং তাঁর দুর্নীতির প্রমাণ।’ মিটিং শেষে আমার সহকর্মীরা সকলে বলাবলি করলেন যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে মাত্র ২০ ভরি সোনা পাওয়া গেছে, যখন তাঁর দুই পুত্র শেখ জামাল ও শেখ কামালের বিয়ে হয়েছে মাত্র কয় মাস আগেই। এরপর এই ২০ ভরি সোনার গহনার কথা আমাদের অজস্র অফিসারের কাছে তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর দুর্নীতি প্রমাণের চেষ্টা করা হলে তাদের কাছে ডিসিদের আর কোন মান-সম্মান থাকবে না। আমার সহকর্মীরা প্রায় কোরাশের কণ্ঠে বললেন, খুন-খারাবি করে খুনী মোশতাকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর চেয়ারে বসার স্বপ্ন সে কি করে দেখে?”

১৮ আগস্ট সোমবার প্রথমবারের মতো ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী সমর সেন বঙ্গভবনে আসেন প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করতে। ১৫ আগস্ট ক্যু’য়ের সময় তিনি ভারতে ছিলেন। ১৭ আগস্ট বিকেলে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকা আসেন। পরদিন দুপুরে আসেন বঙ্গভবনে। সমর সেন বঙ্গভবনে প্রবেশের পর সেখানকার সবাই জানত যে, প্রেসিডেন্ট তাকে ডাকেননি। তিনি স্বেচ্ছায় দেখা করতে এসেছেন। তখন প্রেসিডেন্টের সহকারী একান্ত সচিব মান্নান সাহেব জানালেন, “আগের রাতে পাকিস্তান ফেরত সেনাদের চাপে জেনারেল জিয়া ও খুনী মোশতাক বাংলাদেশকে “ইসলামী প্রজাতন্ত্রের’ ঘোষণা অথবা ‘পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের’ ঘোষণা দেবার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারই ফলস্বরূপ বঙ্গভবনের দোতলায় খুনীরা সারারাত পিপে পিপে মদ গিলেছে, আনন্দ-ফুর্তি করেছে আর পাক সেনারা যেভাবে গালাগালি দিতে, সেভাবে বাঙালী মা-বোনদের অশ্রাব্য ভাষায় উর্দুতে তারা গালাগাল করেছে। বঙ্গবন্ধুকে গালাগাল করেছে …।”

রাষ্ট্রদূত সমর সেন আসার পর প্রেসিডেন্টের কক্ষের চারপাশে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। তখন আমাদের সহকর্মী মোশতাকের অফিসার শ্রী কুমার শংকর হাজরার মুখ থেকে সমর সেনের আগমনের মূল কারণ জানতে পারলাম। সে আমাকে বলল : “দোস্ত, ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ অথবা ‘পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের’ যে কোন একটি ঘোষণা হলে আমি চাকুরি ছেড়ে ভারতে চলে যাব।” (জেল হত্যাকাণ্ডের পরই ক্ষুব্ধ চিত্তে মুক্তিযোদ্ধা হাজরা সত্যি সত্যি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ভারতে চলে যায়।)

১৮ আগস্ট সোমবার কখন কি ঘোষণা হয়!! কি ঘোষণা হয়!! তা জানার জন্য বঙ্গভবনের মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা উদ্বেলিত চিত্তে সারাক্ষণ একতলা থেকে দোতলা এবং এ কক্ষ থেকে ওই কক্ষে ছোটাছুটি করতে লাগলাম। আমরা সবাই সারাক্ষণ চোখ কান পেতে রাখলাম। খুনী মোশতাককে সমর সেন কি বলে, কি বলে, সারাক্ষণ আমরা জপ করতে থাকলাম। জেনারেল জিয়া তখন বঙ্গভবনে। জেনারেল শফিউল্লাহ তখন বঙ্গভবনে বন্দী। সমর সেন সাক্ষাত শেষে চলে গেলেন। জিয়া খুনী মোশতাকের বঙ্গভবনের পেছনের কক্ষে (নিরাপত্তার জন্য প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত সামনের কক্ষে না বসিয়ে প্রেসিডেন্টকে তখন খুনীরা বঙ্গভবনের পেছনের কক্ষে বসাত) ঢুকলেন। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ডজন ডজন জেনারেল ও ব্রিগেডিয়াররা এসে তার সঙ্গে যোগ দিলেন। সারা বিকেল ও সারা সন্ধ্যা গ্রুপ, গ্রুপে সেনা অফিসাররা মিটিংয়ের পর মিটিং করল বঙ্গভবনে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক গ্রুপ যায়, আরেক গ্রুপ আসে।

১৮ আগস্ট রাত ১১টায় বন্ধু হাজরার মুখ থেকে যখন জানতে পারলাম ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ অথবা ‘পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন’ এর কোনটাই হবে না … তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আনন্দাশ্রুতে বুক ভাসিয়ে আমরা বঙ্গভবন থেকে বের হলাম। চোখের ওপর ভেসে উঠল একাত্তরের রণাঙ্গনে, রণাঙ্গনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত-সহস্র বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ, আর বাঙালী ভাই-বোনের রক্তে ভেসে যাওয়া কালো পিচ্ছিল দূর্বা ঘাস, মাঠ-ঘাট।

খুনী মোশতাকের অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী কুমার শংকর হাজরা জানাল সে ইতিহাস। ১৮ আগস্ট দুপুরে দিল্লীর কঠিন ও কঠোর বার্তা নিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হাসি হাসি মুখে খুনী মোশতাকের কক্ষে প্রবেশ করে। হাসি হাসি মুখে বিটিভির ক্যামেরার সামনে ও ফটোগ্রাফার আমির খসরুর সামনে পোজ দেয়। তারা বের হওয়া মাত্র খুনী মোশতাককে সমর সেন দিল্লীর অনুশাসনমূলক প্রথম বার্তাটি জানিয়ে দেন : Any change of the name of the “People’s Republic of Bangladesh” and any “Confederation” with any country, the Indian Army shall take appropriate measures in accordance with the legal and valid deed, which India possess. But if you abstain form changing the name of ‘Bangladesh’ and so called ‘Confederation’ idea, India will consider what ever had happened since August 15 as your internal matter.” ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ বা ‘কোন দেশের সঙ্গে কনফেডারেশনের’ ঘোষণা দেয়া হলো ভারতের সেনাবাহিনী ‘৭১-এর মিত্রবাহিনীর পরম্পরায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার রাখে এবং এ রূপ পদক্ষেপের অনুকূলে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ দলিল ভারত সরকারের কাছে সংরক্ষিত আছে। উল্লিখিত ধরনের কোন কিছু পরিবর্তন করা না হলে এবং সবকিছু অব্যাহতভাবে অবিকল ও অপরিবর্তিত থাকলে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে যা কিছু ঘটেছে, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে গণ্য করা হবে।”

১৮ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে বাজ পড়ার মতো এসে পড়ল দিল্লীর হুকুম নামা! বঙ্গভবন থেকে জরুরী ডাক পেয়ে খুনী মোশতাক-জিয়া-ফারুক-রশিদদের মদদদাতা পাকিস্তান প্রত্যাগত ব্রিগেডিয়ারা-কর্নেলরা-মেজররা ১৭ ডিসেম্বরে বঙ্গভবনে দলে দলে হুমড়ি খেয়ে এসে পড়তে লাগল! বঙ্গভবনে ঢুকেই সমর সেনের বার্তা জানতে পেরে তাদের হাঁটু কাঁপতে শুরু করল। ভিমরি খাওয়া রোগীর মতো গড়িয়ে দিয়ে পড়ল বঙ্গভবনের ফ্লোরে ও মাঠে। অথচ ২৪ ঘণ্টা আগে ১৭ ডিসেম্বর তারাই দলে দলে এসে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বলেছে, “সিকিম-ভুটান হবার হাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতে” পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের’ ঘোষণা দিতেই হবে। ইহা আমাদের জন্য ফরজ কাজ। আর ইহা করা না গেলে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ ঘোষণা দেয়াই হইবে বাংলাদেশের সকল মুমিন-মুসলমানের জন্য ফরজ, ফরজ এবং ফরজ কাজ।”

সকল ক্যু ও মার্শাল’ল ঘোষণার সময় তাদের যে তোস্য দালাল সর্বদা প্রস্তুত উপ-সচিব কুদ্দুসকে দেখলাম হাতে কলম ও প্যাড নিয়ে খুনী ডালিম-ফারুকদের সঙ্গে লাটিমের মতো ঘুর ঘুর করছে … বাংলাদেশের নাম পাল্টিয়ে কখন ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ বা ‘পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন’-এর ড্রাফটে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর নেয়া যায় সেজন্য!! কিন্তু তখনও বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে, বন্দরে-নগরে ৩০ লাখ বাঙালী ভাই-বোনের সঙ্গে শহীদ হয়ে যাওয়া হাজার হাজার ভারতীয় বীর জওয়ানদের রক্ত শুকায়নি … সেখানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভারতীয় সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকার সম্ভাবনার চেয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আশঙ্কা অধিক উপলব্ধি করে খুনী মোশতাক-জিয়া ও তাদের অনুসারী পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সেনারা সেই হটকারী ঘোষণা থেকে বাধ্য হয়ে পিছিয়ে আসে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত পুণ্যময় বাংলাদেশ সেদিন আল্লাহর অশেষ রহমতে রক্ষা পায়। আলহামদুলিল্লাহ।

বঙ্গভবনের সেই গোপন অধ্যায় অজানা থাকায় বাংলাদেশের কিছু লোক এ যাবতকাল বলে এসেছে যে, মোশতাক-জিয়ার ক্ষমতারোহণকে ভারত সরকার সেদিন মেনে নিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পক্ষ থেকে বঙ্গভবনের বহু গোপন অধ্যায়ের একটা অধ্যায় প্রিয় দেশবাসীর সামনে আজ উন্মোচিত করে দিলাম। ভারত সরকার কেন সেদিন খুনীদের সরকারকে ক্ষণস্থায়ীভাবে সময় দিয়েছিল, যখন বাংলাদেশের ওপর ভারত সরকারের যে কোন সামরিক পদক্ষেপের বিপরীতে বাংলাদেশের জন্মকালীন শত্রু আমেরিকা ভারতের রাজধানী দিল্লীর ওপর পারমাণবিক কার্যক্রমের হুমকি দিয়েছিল, সে অধ্যায় উন্মোচনের আগ্রহ আপাতত সংবরণ করলাম।

১৯ আগস্ট ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিবিসির সংবাদদাতা বিখ্যাত সাংবাদিক মার্ক টালির সঙ্গে দেখা করলাম। বিবিসিতে প্রচারের জন্য তাকে Mukthi Bahini and Mujib Bahini are organising in Dhaka against the killers of Bangabandhu. They will attack them any time in and around Dhaka. The killers of Bangabandhu are Pakistani agents and enemy of Bangladesh. People of Bangladesh shall never accept the killer. The killers shall be hanged by the people at the Race Course of Dhaka very soon. Freedom Fighters are now taking full preparations in and around Dhaka. Resistance will start at any moment. Killers will not be able to escape. People will hang them in race course you will see it.

১৮ আগস্ট বিবিসির দিল্লী ব্যুরো চীফ মার্ক টালি ঢাকা আসেন। এসেই বঙ্গভবনে আমাকে ফোন করে তার হোটেলে আসতে বলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘ওয়ার করেসপন্ডেন্ট’ হিসেবে ‘৭১ সালে রণাঙ্গনের বহু সংবাদ আমি তাঁকে স্বতঃপ্রণোদিত চিত্তে দিয়ে দিয়েছি এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশে আমি তাঁকে বহু সার্ভিস দিয়েছি। তিনি আমাকে চিনতেন এবং আমার ওপর তাঁর অগাধ আস্থা ছিল। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আমি যখন আবার এই তথ্য উল্লেখ করছি, তখন ও must salute Mr. Mark Tully on behalf of all the Freedom Fighter Officers & Employees of the Republic for his kind favour to broadcast the news over the B.B.C on that evening. The news inspired all the Freedom-Fighters in resisting the killers in Dhaka and all over Bangladesh. মার্ক টালি আমাকে বললেন, “মুজিব বাহিনী কোথায় প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে আমাকে নিয়ে চলো।” সেখানে এক্ষুনি নিয়ে যাওয়া সম্ভব না বলে জানিয়ে বললাম, “তুমি এক্ষুনি বিবিসি থেকে এই নিউজ প্রচার করিয়ে দাও। তাহলে পরে তোমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।”

বিবিসির মাধ্যমে প্রচারিত সেই প্রথম সংবাদে দেশবাসী রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। বাংলার ঘরে ঘরে ৬৮ হাজার গ্রামে এই সংবাদে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল যে, ঢাকায় মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনী বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ধরবে এবং ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ফাঁসিতে ঝুলাবে। বিবিসি সেদিন মার্ক টালির বরাতে সংবাদ প্রচার করল, “ঢাকার ঘরে ঘরে মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী প্রস্তুত হচ্ছে এবং তারা যে কোন সময় সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে ঢাকা দখল করে ফেলবে এবং শেখ মুজিব হত্যার প্রতিশোধ নেবে মর্মে প্রতিজ্ঞা নিয়েছে বলে জানা যায়।” বিবিসিতে এই সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গভবনে খুনী মোশতাক ও তার সহযোগী খুনী ডালিম-ফারম্নকদের হৃদকম্পন শুরু হয়ে যায়। তাঁরা বিডিআর থেকে অতিরিক্ত ফোর্স আনে বঙ্গভবন গার্ড দেবার জন্য।

বিবিসির এই সংবাদে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায় এবং খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোয় প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাই যে যার সাধ্যমতো চেষ্টা করতে থাকে। ১৯ আগস্ট ফেনীতে মুক্তিযোদ্ধারা রেল লাইন উপড়ে ফেলে। পরদিন ২০ আগস্ট খুলনা পোর্টে আগুন ধরায়। একই দিনে মিরপুরে এবং আসাদগেটে আর্মির ট্রাকে বোমা পড়ে। টাঙ্গাইলে বীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের কব্জায় চলে যায় টাঙ্গাইল। হালুয়াঘাটে বীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কামানের গোলা নিক্ষেপ হয়। কাদের সিদ্দিকী ঘোষণা করে “বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ সনত্মান কাদের সিদ্দিকী পিতার খুনীদের রক্তে বাংলাদেশের মাটি সিক্ত না করে মাংস খাবে না”। চট্টগ্রামে যুবলীগের জঙ্গী নেতা এসএম ইউসুফের নেতৃত্বে রেজিস্টেন্স শুরু হয়ে যায় চট্টগ্রামব্যাপী। এসএম ইউসুফের দাপটে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের সেনারা সন্ধ্যার পূর্বেই ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেত আর সকালের আগে কেউ বেরুবার সাহস পেত না।

এ সময় তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় ড. সেলিমুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে ১৯ আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আমার সাক্ষাত হয়। আমি তাঁকে বললাম : Don’t worry, we will fight them back insha Allah. Resistance has started in Dhaka and all over the country, তিনি আমাকে বললেন, “তাহের উদ্দীন ঠাকুর আমার ক্ষতি করতে পারে। অন্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বলে রেখ।” তিনি আমাকে আরও বললেন, “বঙ্গবন্ধুর কিলারদের বিরুদ্ধে আমি ধানমণ্ডি থানায় জিডি করব।

আমি তাঁকে আমার বাসার ও বঙ্গভবনের টেলিফোন নম্বর দিলাম এবং তাঁর অফিসের ও বাসার নম্বর নিলাম। যদিও তিনি বললেন যে, তিনি তখন বাসায় থাকেন না। বিএসএসের জেনারেল ম্যানেজার হাজারী ভাইয়ের বাসায় লুকিয়ে থাকেন। তাঁকে আরও বললাম, “আমরা এখন সিজিএস খালেদ মোশাররফ স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। আর্মির সকল মুক্তিযোদ্ধা অফিসার এখন তাঁর সঙ্গে আছে। কিছু একটা হতেই হবে। তিনি যেন খালেদ মোশাররফ সাহেবের ভাই রাশেদ মোশাররফের কলাবাগানের বাসায় যোগাযোগ রাখেন। আমরা ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা সিভিল অফিসাররা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সব কিছু এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। দূতাবাসগুলোর সাথেও আমাদের মাধ্যমে তাঁর যোগাযোগ রক্ষা করছি। বঙ্গভবন থেকে খুনীদের ভেতরে বসে আমি তাদের সব মুভমেন্ট খালেদ মোশাররফ স্যারদের দিয়ে যাচ্ছি।”

সেলিমুজ্জামান সাহেব ছলছল চোখে বললেন, “আমাদের হারাবার আর কিছুই নেই। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আমরা এতিম হয়ে গেছি।” আমি বললাম : “মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারায়নি। হিমালয়ের মতো বঙ্গবন্ধু আবার ফিরে আসবে ঘূর্ণিঝড়ের মধ্য থেকে। ঢাকার মুক্তিযোদ্ধারা ও আমরা শপথ নিয়েছি খুনীদের ওপর আঘাত হানব। মরতে হলে তাদের মেরে মরব। কাদের সিদ্দিকী তার কাদেরীয়া বাহিনী নিয়ে যে কোন সময় ঢাকায় প্রবেশ করবে। সচিবালয় ও বঙ্গভবন কাদেরীয়া বাহিনীর ভয়ে মৃগী রোগীর মতো কাঁপছে ….।” ২০ আগস্ট হারেসউদ্দীন সরকার বীরপ্রতীকের সঙ্গে দেখা হলো। ‘৭১-এ তিস্তার পাড়ের অসীম সাহসী বীর হারেসউদ্দীনের কথা শুনে বুক ভেঙ্গে গেল। তিনি বললেন যে, “তাদের মিশন ব্যর্থ হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীকে জিঞ্জিরা দিয়ে উত্তরবঙ্গে নিয়ে গিয়ে সরকার গঠনের যে পরিকল্পনা তারা নিয়েছিলেন তা ব্যর্থ হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা লে. কর্নেল দেলওয়ার হোসেন, লে. কর্নেল নওয়াজেশ, লে. কর্নেল ইয়াজদানী, লে. কর্নেল মোসলেম উদ্দীন প্রমুখ বাঙালী জাতির বীরদের নেতৃত্বে পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করে বেরিয়ে এসেছিলেন।” লে. কর্নেল দেলওয়ারের বনানীর স্টাফ কোয়ার্টারে বসে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন-ছাত্র, জনতা ও আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর নেতৃত্বে উত্তরবঙ্গে খুনী মোশতাকের বিরম্নদ্ধে পাল্টা সরকার গড়ে তুলবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই মহান বীর যোদ্ধাদের, সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আওয়ামী লীগের নেতারা সাড়া না দিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। “বঙ্গবন্ধুকে যারা মেরে ফেলেছে, আমাদেরও তারা মেরে ফেলবে”- এই ধুয়া তুলে কাপুরুষের মতো তাঁরা পিছিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও ঢাকার বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ঢাকাবাসী ও ছাত্র-জনতা, রিকশাওয়ালা, শ্রমিক, দিনমজুর তখন ক্রোধে রাগে ফুঁসছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা কাপুরুষতা না দেখালে খুনীরা ঢাকাবাসীর রুদ্ররোষে কর্পুরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। কবর দেবার জন্য এই সব ভাড়াটে খুনীদের কারও লাশ পাওয়া যেত না। ঢাকার বাতাসে মিশে যেত।

এখানে বিশেষ করে, আমি এক বঙ্গ জননীর কথা গর্বের সঙ্গে উলেস্নখ করতে চাই, যিনি লে. কর্নেল দেলওয়ারের বনানী স্টাফ কোয়ার্টারে আগত ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ও মেজর বজলুল হুদাকে প্রবেশ করতে দেখে চিৎকার করে বলেছিলেন, “তোমরা, বঙ্গবন্ধুর কিলার, এখানে কি জন্য এসেছ?” মেজর হুদা তাঁকে বলেছিলেন, “ভাবি, চা খেতে এসেছি।” উত্তরে ময়মনসিংহ মহিলা ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপিকা সেই নির্ভীক বেগম নুরজাহান দেলওয়ার বলেছিলেন, “তোমরা এখনই বেরিয়ে যাও। তোমাদের মুখ যে দেখবে তার কবরে দোজখের আগুন জ্বলবে।”

সেখানে উপস্থিত হারেসউদ্দীন সরকার বীরপ্রতীকের সামনে এই ঘটনা ঘটে। অতঃপর কিলাররা হাসতে হাসতে চলে যায়। কিন্তু তারপরেও জাতির এই সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তাননরা প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীকে খুঁজে পাবার আগেই তাঁর সঙ্গে কর্মরত এক সিভিল অফিসার বিশ্বাসঘাতকতা করে (তিনি তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার বড় পুরস্কার পেয়ে পরবর্তীতে সচিব ও যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রদূত হয়ে গাড়িতে বাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিশ্বাস করেন না) খুনীদের কাছে তাঁর গোপন আস্তানার তথ্য জানিয়ে দিয়ে তাঁকে ধরিয়ে দেয়। খুনী মোশতাক মনসুর আলীকে তাঁর অধীনে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। খুনী মোশতাকের জনসংযোগ কর্মকর্তা, আমার বিশ্বস্ত বন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধা কুমার শংকর হাজরা আমাকে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সেই পীড়াপীড়ির ঘটনাবলী বর্ণনা করে বলেছিলেন, “প্রেসিডেন্ট মোশতাক হুঙ্কার দিয়ে মনসুর আলী স্যারকে বললেন, এবার যারা জেলে যাবে, তারা কেউ জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট মোশতাকের ও বঙ্গভবনের খুনীদের হুঙ্কার এবং প্রধানমন্ত্রী হবার প্রলোভন মনসুর আলী সাহেব ঘৃণাভরে দু’পায়ে দলে বঙ্গভবন থেকে চলে যান।” কুমার শংকর হাজরা তাঁর সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা নিবেদন করে মনসুর আলী সম্পর্কে বলেছিলেন, “মৃত্যুর পরোয়ানা আর প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনের মধ্যে কেউ যে মৃত্যুর পরোয়ানা বেছে নিতে পারে, এমন মানুষ এই দুর্ভাগা দেশে আছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না, দোসত্ম।” ট্র্যাজেডি হলো, এই ঘটনার ক’মাস পরে দুঃখে-শোকে জর্জরিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার কুমার শংকর হাজরা সিভিল সার্ভিসের চাকরি ইস্তফা দেন।

২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার বঙ্গভবন থেকে প্রথম যেদিন সচিবালয়ে গেলাম সেদিন এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের সমবায় বিভাগের সচিব খোরশেদ আলম সাহেবের রুমে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি আমাকে জানতেন যে, আমি মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিবনগর অফিসারদের সংগঠন করি। আমাকে দেখে বঙ্গবন্ধুর নাম বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেললেন। তাঁর বিপদ হবে ভেবে আমি তাড়াতাড়ি তাঁর রম্নমের দরজার নব টিপে বন্ধ করে দিলাম। তিনি আমাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন না করলে পাঞ্জাবী সিএসপিরা আমাদের দিয়ে তাদের জুতা মোছাতো আর এই সচিবালয়ে টিবয় করে চা আনিয়ে খেত। আমাদের বাঙালী সিএসপি এবং ইপিসিএস অফিসারদের এই দশাই হতো।” ওই দিন দুপুরে পিআইডির তৎকালীন সিনিয়র কর্মকর্তা মকবুল আহমেদের সামনে সচিবালয়ের মেডিকেল অফিসার উঁচু, লম্বা, কৃষ্ণ বর্ণের, স্বাস্থ্যবতী ডা. ফজিলা নবী পিআইডির শেডে এসে সজল চোখে বললেন, “দেখুন, আমরা ডাক্তার। আমাদের কাছে কোন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আজ সচিবালয়ে আসার পথে শেরেবাংলা নগর থেকে আমি যখন আমার মাইক্রোবাসে আসছিলাম, তখন ৩২ নম্বর রোডের মুখে নির্মম নির্যাতন দেখে এলাম। এমন নির্যাতন নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। আমার মাইক্রোবাস যখন ৩২ নম্বর রোডের মুখে আসে, তখন দেখলাম সেখানে বয়স্কা মহিলা, কিশোরী ও শিশুরা কিছু ফুল হাতে এসেছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর তাদের শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু সেখানে কি বর্বরতা দেখলাম জানেন?

৩২ নম্বর রোডের মুখে পাহারারত আর্মিরা পাঞ্জাবী আর্মির চেয়েও নিষ্ঠুরভাবে তাদের বুট দিয়ে লাথি মারছে এবং রাইফেল-বন্দুকের বাঁট দিয়ে বুকে, ঘাড়ে, পিঠে, মাথায় যে যেভাবে পারছে, মারছে। থেতলে দিচ্ছে! সেই মা-বোনদের আর্তনাদ চিৎকার সহ্য করা যায় না! আমাদের মা-বোনরা-শিশুরা সেখানে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তাদের হাতের সাদা, লাল ফুল পিচের রাস্তার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। এক জননী বাচ্চাদের আগলাতে যাচ্ছে দেখে এক ‘শয়তান’ বুট দিয়ে তার গলায় চেপে দাঁড়িয়ে তার জিভ বের করে ফেলেছে। এমন পাপিষ্ঠ, দেখে মনে হয় মাতৃগর্ভে যেন এদের জন্ম হয়নি! পাকসেনাদের মতো এ রকম অত্যাচার যখন চলছিল, তখন গাড়ি থেকে দ্রম্নত নেমে আমি এপ্রোন পরা অবস্থায় সচিবালয়ের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে দু’হাত দিয়ে আগলে সেই আহত মা-বোন ও শিশুদের সেখান থেকে সরিয়ে আনি। আর আহত কয়েকজনকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে আসি।”

খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের শ্বেত সন্ত্রাসে ও নির্যাতনে সচিবালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, মতিঝিল, ব্যাংক, কোর্ট, কর্পোরেশনসহ সমগ্র রাজধানী ঢাকা কম্পমান এবং রাজধানীর মোড়ে মোড়ে ট্যাঙ্ক, ঢাকার সকল রেজিস্টেন্স ব্যর্থ প্রায়। তখন ঢাকার সচিবালয়ের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের যুবলীগের দুর্ধর্ষ কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা এসএম ইউসুফের যোগাযোগ হয়ে যায়। চট্টগ্রামে আন্ডারগ্রাউন্ড তিনি খুনীদের বিরুদ্ধে অনেক সফল অপারেশন চালাচ্ছিলেন।

চট্টগ্রামে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল, টাঙ্গাইলে যেমন বীর কাদের সিদ্দিকীর রেজিস্টেন্স খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছিল। টাঙ্গাইল থেকে বীর কাদেরীয়া বাহিনীর এক লিফলেট এসে পৌঁছায় শাহবাগের বিসিএস একাডেমীর প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে। তার ঠেলায় বঙ্গভবন দুলে ওঠে। সচিবালয় কেঁপে ওঠে। জেনারেল ওসমানী তখন খুনী মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা। তিনি বিডিআরের ডিজি ব্রিগেডিয়ার খলিল সাহেবকে ফোন করে এক ঘণ্টার মধ্যে কয়েক ট্রাক বিডিআর আনালেন বঙ্গভবনের চারপাশে দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলার জন্য। বঙ্গভবনে খুনী মোশতাকের পিআরও (‘৭২ সাল থেকে মন্ত্রী মোশতাকের পিআরও পদে কর্মরত ছিল) কুমার শংকর হাজরা ও আমি দেখলাম যে, “বঙ্গভবনের ভেতরে কাদের সিদ্দিকীর আতঙ্ক ঢুকে গেছে। বঙ্গভবনের সর্বত্র খুনীরা কাদেরীয়া বাহিনীর ভূত দেখছে। বঙ্গভবনে গাছের পাতার ফাঁকে পাখি উড়লেও গুলি করছে তারা। বঙ্গভবনের পুকুরে মাছ লাফানোর শব্দ হলে কয়েক ডজন সশস্ত্র বিডিআর পুকুরের চারপাশে মোতায়েন করা হলো পানির মধ্যে কাদেরীয়া বাহিনী ডুব মেরে আছে কিনা তা নিষ্পলক চোখে পাহারা দেবার ও গুলি করার জন্য।

বঙ্গভবনের ছাদেই শুধু না, বঙ্গভবনের ভেতরে বড় বড় আম গাছের ডালে ডালে এসএলআর/স্টেনগান হাতে বিডিআরকে তুলে দেয়া হয়েছে কাদেরীয়া বাহিনীকে খোঁজার ও গুলি করার জন্য।” এদিকে সচিবালয়ে দৌড়াদৌড়ি ও তল্লাশি শুরু হলো কাদের সিদ্দিকীর লিফলেটের সন্ধানে। প্রেসিডেন্ট মোশতাকের ফটোগ্রাফার আমির খসরু (গবর্নর মোনেম খানের আমল থেকে বঙ্গভবনে নিয়োজিত) বঙ্গভবনের দোতলা থেকে নেমে এসে এমএসপির রুমে আমাকে পেয়ে ডেকে নিয়ে জানালেন যে, “বঙ্গবন্ধুর খুনী মাজেদ-ফারুক-ডালিমরা কাদেরীয়া বাহিনী ঢাকা প্রবেশ করেছে শুনে বঙ্গভবনের দোতলায় তাদের শয়ন কক্ষে গিয়ে আতঙ্কে সিদ্ধ হয়ে নোংরা-অশ্লীল মুখ খিস্তি করছে আর মদের বোতল খুলে ঢক ঢক করে মদ গিলছে। কাদের সিদ্দিকীর পায়ের ধুলাও আসেনি ঢাকায়, তার লিফলেট ঢাকায় এসে পড়ায় বঙ্গভবন ও সচিবালয়ে সেদিন ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছিল।

অপরদিকে, চট্টগ্রামের রেজিস্টেন্সের নায়ক এসএম ইউসুফ, সেই দুর্ধর্ষ কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা, যিনি চট্টগ্রাম সেক্টরে ১৯৭১ সালে মুজিব বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়ায় বাধাদান করার কারণে সেখানে এক মেজরকে রিভলবারের মুখে হ্যান্ডসআপ করিয়েছিলেন (‘৭১-এর সেক্টর কমান্ডাররা তাঁর নাম জানেন ও ঘটনা জানেন)। ১৫ আগস্টের পর খুনীদের বিষয়ে ঢাকার কোন প্রেসে তখন হ্যান্ডবিল বা কোন লিফলেট ছাপা সম্ভব হচ্ছে না। সবাই আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপছে। অথচ লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর মুখ্য সচিব আমার মামা রুহুল কুদ্দুস বার বার লিফলেট বিতরণের কথা, বিশেষ করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিতরণের জন্য আমাকে ফোনে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। আমি যখন ঢাকার অবস্থা বললাম। তখন তিনি চট্টগ্রাম থেকে লিফলেট ছাপানোর ব্যবস্থা করে ঢাকায় পাঠান। (চট্টগ্রাম দক্ষিণ আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট এই লিফলেট ছাপানোর জন্য লন্ডন থেকে রুহুল কুদ্দুসের নির্দেশ পান। তিনি এটা চট্টগ্রামের এক প্রেস থেকে ছাপিয়ে মনি ভাইয়ের বিশ্বস্ত ইউসুফকে দেন বলে ইউসুফ আমাকে পরে জানিয়েছেন।) এই লিফলেট ইউসুফের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনযোগে মুখে শাকের আঁটি দিয়ে ৪ বস্তা ২ রকমের লিফলেট তিনি ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারুকের সরকারকে উৎখাত করে মুক্তিযুদ্ধের সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান সম্বলিত সেই লিফলেট ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনে ঠিকমতো ডেলিভারি হয়েছিল। আমার নামে বঙ্গভবনের ঠিকানায় সেই লিফলেটের বস্তা পাঠানোয় কমলাপুর কর্তৃপক্ষ তা না দেখেই ডেলিভারি দিয়ে দেয় (ছাত্রনেতা এসএম ইউসুফ লিফলেটটি লেখেন)।

এই লিফলেট ঢাকায় আসার পর সচিবালয়ের বীর তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মুজিবনগর সেলের প্রধান সিনিয়র সহকারী সচিব রাখাল দা’র কলাবাগানের স্টাফ কোয়ার্টারে আমরা গোপন বৈঠকে বসি। সে বৈঠকে হাজির ছিলেন তথ্য অফিসার গাজী মনসুর স্যারের অফিসার, খুনী মোশতাকের অফিসার কুমার শংকর হাজরা, তাজউদ্দীন স্যারের অফিসার আলী তারেক, নজরুল ইসলাম স্যারের অফিসার আমি এবং শেখ ফজলুল হক মণি ভাইয়ের দুই বিশ্বস্ত অফিসার ফকীর আব্দুর রাজ্জাক এবং শফিকুল আজিজ মুকুল (দৈনিক বাংলার বাণী বন্ধ হয়ে গেলে সরকারী সিদ্ধান্তে এই তিন সাংবাদিক তথ্য অফিসার হিসেবে সরকারী চাকুরিতে যোগ দান করেন)। আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় ও বয়োজ্যেষ্ঠ রাখাল দা’ সেই গোপন বৈঠকে আমাদের পবিত্র কোরান শরিফ এবং ত্রিবেদী ও হাজরাকে পবিত্র গীতা ছুঁয়ে এই মর্মে শপথ করান যে, আমাদের কেউ ধরা পড়লে আমরা ‘৭১-এর বীর শহীদদের মতো আমাদের জীবন দেব, কিন্তু একে-অন্যের নাম বলব না। এই বৈঠকের কোন গোপনীয়তা ফাঁস করব না বা আমাদের সহযোদ্ধাদের কারও নাম প্রকাশ করব না। বৈঠকে ঠিক হয়, এই লিফলেট ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, বঙ্গভবন ও ঢাকার সচিবালয়ে গোপনে গভীর রাতে ছড়িয়ে দিতে হবে। ঠিক হয় বঙ্গভবনে কুমার শংকর হাজরা, সচিবালয়ে আলী তারেক, ত্রিবেদী, রাজ্জাক ও মুকুল এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গাজী মনসুর ও আমি বিতরণ করব। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ২৭ ও ২৮ আগস্ট আমরা দু’জন এক সঙ্গে রেকি করি সুশীল বাবুর জলপাই রঙের টয়োটা গাড়ি নিয়ে। কিন্তু ২৯ আগস্ট যখন লিফলেট সামনের ও পেছনের সিটে ভরা হয় তখন জায়গার অভাবে রাখাল দা’ একজনকে যেতে বলেন। তখন প্রশ্ন ওঠে কে সে? রাখাল দা’ মনসুরকে প্রশ্ন করেন তারা কয় ভাই। মনসুর বলে তারা দুই ভাই। আমাকে প্রশ্ন করলে আমি বলি আমরা ছয় ভাই। রাখাল দা’ তখন সিদ্ধান্ত দেন “মুসা যাবে”। আমি তখন জোরে জোরে আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করি এবং আমার চোখে তখন আমার প্রিয় জননীর মুখ ভেসে ওঠে।

কিন্তু কিছুটা ভুল প্ল্যানিংয়ের কারণে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ঢাকার সর্বত্র সে লিফলেট বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। প্রথম প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুসের (তিনি তখন লন্ডনে চিকিৎসাধীন) স্নেহভাজন মতিঝিলের এক হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রী সুশীল বাবুর আর্মির জলপাই রঙের নতুন টয়োটা গাড়ি নিয়ে ২৯ আগস্ট রাত ১০টায় গাড়িভর্তি লিফলেট নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকি। ড্রাইভার জানতো না লিফলেটে কি আছে। এর আগে ২ দিন ক্যান্টনমেন্টের ভেতর আমরা রেকি করি। দেখা যায় যে, রাত ১০টার পর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের রাসত্মাঘাট ভয়ে-আতঙ্কে জনশূন্য হয়ে যায়। অফিসার ও জওয়ানরা যে যার কোয়ার্টারে ঢুকে পড়ত রাত ১০টার আগেই। তাই পূর্ব পরিকল্পনা মতো রাত ১০টার দিকে আমি ক্যান্টনমেন্টের গেটে সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ স্যারের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্টের নাম করে (খালেদ মোশাররফ স্যারের ‘কড’-এর দেয়া পাস নিয়ে) সু্যটেড বুটেড হয়ে ঢুকে পড়ি। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের জনশূন্য রাসত্মায় ড্রাইভারকে ফুল স্পিডে গাড়ি চালাতে বলে পেছনের সিটে বসে আমি দু’হাতে পাগলের মতো লিফলেট দু’দিকে ছুড়ে দিতে থাকি। খুনী মোশতাক-ডালিম-ফারম্নকদের উৎখাতের আহ্বান সংবলিত লিফলেট ছড়িয়ে আমি ক্যান্টনমেন্টের উত্তরে অফিসার কোয়ার্টারের গেটের দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে সমর্থ হই। (সে গেটটি জেনারেল মাহবুবুর রহমান যখন আর্মির চীফ হন, তখন তা বন্ধ করে দেয়া হয়।) ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আমি কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হইনি_এটা আমার সৌভাগ্য বলতে হবে। তবে তখনকার বাসত্মব অবস্থা ছিল এরূপ যে, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে রাত ১০টার পর রাস্তা জনশূন্য হয়ে যেত। আর্মিরাও ভয়ে ব্যারাক থেকে বের হতো না। যত কিছু সিকিউরিটি একটিভিটিজ, তখন সব কিছু ছিল বঙ্গভবন ও নাজিমউদ্দীন রোডে বন্দী ৪ জাতীয় নেতাকে নিয়ে।

২য় পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ আগস্ট দিবাগত রাতে সচিবালয়ে ও বঙ্গভবনে উক্ত লিফলেট বিলি করার দায়-দায়িত্ব মুজিবনগর-মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ছিল। তা তাঁরা পুরোপুরি করতে পারেননি। ওই রাতে বঙ্গভবনে লিফলেট বিতরণের দায়িত্ব ছিল কুমার শংকর হাজরার। হাজরা ৭-৮শ’ লিফলেট বঙ্গভবনের নিচতলার মুখ্য সচিবের পিএ-এর রুমে ও আশপাশের প্রশাসনিক কয়েকটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রুমে ফেলে রাখতে সমর্থ হয়। অন্যান্য উল্লিখিত তিনজন অফিসারের দায়িত্ব ছিল সচিবালয়ে লিফলেট বিতরণের। ওই রাতে তারা লিফলেট নিয়ে পিআইডির গাড়িতে সচিবালয়ের ভেতরে রাত ১০টায় তারা ঠিকই ঢুকেছিলেন। কিন্তু আগের রাতে ক্যান্টনমেন্টে লিফলেট বিতরণ হওয়ায় সচিবালয়ে এনএসআই এবং এসবির অস্বাভাবিক উপস্থিতি টের পেয়ে সচিবালয়ের ২নং নয়তলা ভবনের ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কলাপসিবল গেটের ভেতরে কিছু লিফলেট তারা ছুড়ে দিয়ে দ্রুত সচিবালয়ের মসজিদের ওজুখানার পাশের টিনের ছোট দরজা দিয়ে প্রেসক্লাবের পেছনের ডোবা দিয়ে পালিয়ে যেতে তাঁরা সমর্থ হন (‘৭৫ সালে সচিবালয়ের মসজিদের পশ্চিমের বর্তমান সচিবালয় লিংক রোড ছিল না এবং প্রেসক্লাবের পেছনে বড় ডোবা ছিল)। কিন্তু সবিচালয়ের এই ব্যর্থতার সেই পরিণতি ভোগ করতে হয় সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মুজিবনগর সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী রাখাল ভট্টাচার্যকে। এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই জেনারেল জিয়ার নির্দেশে আর্মির গোয়েন্দারা রাখাল দা’কে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে এবং পরবর্তীতে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। কারাগারেও বর্বরভাবে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। কিন্তু কোন মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে তিনি মুখ খোলেননি।

ক্ষুদিরামের ন্যায় এই মহান দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার রাখাল দা কারাগারের নির্যাতন শেষে হাসপাতালে হস্তান্তরের কয়েকদিনের মধ্যে হাসপাতালেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমার মনে পড়ে, ১৮ আগস্ট রাখাল দা’র সঙ্গে টেলিফোনে আমার ও প্রণোদিৎ দা’র কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, “মুসা কিছু একটা করো। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলবে, আর আমরা বেঁচে থাকব তা হয় না…”। এইটুকু বলে তিনি কাঁদছিলেন। তাঁর সেই কান্নার মর্যাদা বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন। রাখাল দা’র নাম সচিবালয়ের মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের কাছে চিরকাল প্রাতঃস্মরণীয় নাম হয়ে থাকবে।

তাঁর নেতৃত্বে সেদিন বঙ্গভবন ও সচিবালয়ের ক’জন তরুণ বীর মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রুখতে জীবন বাজি ধরেছিলেন তার সুদূরপ্রসারী পরিণতি ঘটেছিল যা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। প্রথমত, নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র বেড়াজাল ভেদ করে আতঙ্কগ্রস্ত মৃত্যুপুরী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বহিরাগত কেউ সামরিক-বেসামরিক অফিসারদের পক্ষে আহ্বান সংবলিত লিফলেট ছড়িয়ে আসতে পারে কোন জওয়ান ও অফিসার এমনটা ভাবেনি বা বিশ্বাস করেনি। দ্বিতীয়ত, উক্ত লিফলেট ৩০ আগস্ট প্রত্যুষে ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন রাস্তায় পেয়ে জওয়ান ও অফিসাররা উক্ত লিফলেট তারা নিজেরা দিয়েছে বলে প্রচার চালায়। তার মূল কারণ, খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অহঙ্কারে এমন উন্মত্ত হয়ে ওঠে যে, সৈনিকদের কাছে তাদের স্ব স্ব রেজিমেন্টের সিনিয়র কমান্ডিং অফিসার কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেলদের অবজ্ঞা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ডাস্টবিনের মল-মূত্রের বস্তুতে পরিণত করে!! সেজন্য মানসম্মানে আঘাত পড়ায় ভেতরে ভেতরে সেনা অফিসাররা আগুন হয়েছিল ও টগবগ করে ফুটছিল।

লেখকঃ
বাংলাদেশ উইস ফ্রিডমের রচয়িতা,
মুক্তিযোদ্ধা মুসা সাদিক