২০০৮ সাল থেকে Information Technology Enabled Services (ITES) নিয়ে কাজ করছি। এই ইন্ড্রাষ্ট্রির অনেককেই আমি ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি ও জানি। যেসকল উদ্যোক্তারা আমার সমসাময়ীক সময় বা তারও আগে থেকে এ ধরনের উদ্যোগে জড়িত আছেন তাদের অনেকের সাথে প্রায়ই আমার যোগাযোগ হয়, কথা হয় এই সেক্টরের বিভিন্ন খুটিনাটি বিষয় নিয়ে। যাদেরকেই জিজ্ঞেস করি – সবাই কেমন জানি একটু গম্ভীর থাকেন। কথা বার্তায় বিষাদের সুর। যারা আগে নিজের ব্যবসা নিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলতো তারাও চুপসে গেছেন, এর মধ্যে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন, বেসিসের সদস্য ছিলো এমন কেউ কেউ এই ধারা থেকে হঠাৎ হারিয়ে গেছেন, পুরাতন উদ্যোক্তাদের মাঝে কেউ আর তেমন উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছেন না ইকমার্স নিয়ে। বেশীরভাগ উদ্যোক্তার সার্বিক অবস্থাটা এমনই কঠিন যে – না পারছেন তারা ভালো কিছু করতে, না পারছেন স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে, আবার বিনিয়োগের কথা চিন্তা করে ছেড়ে দিতেও পারছেন না।
ইকমার্স উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ এখন কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন ছেড়ে ইনভেষ্টর খুঁজে কোন রকম টিকে থাকার চেষ্ঠায় লক্ষ্য স্থির করেছেন। সাম্প্রতিক কালে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে কিছু আনুমানিক ধারনা নিয়ে ট্রেডবডি গুলো থেকে কেউ কেউ বলছেন – দেশে ই কমার্স বেইজ ট্রার্গেট ইউজার (প্রবাসী সহ) আনুমানিক ২০ লাখের মত, তাদের তথ্যমতে ই-কমার্স সাইট ও ই-কমার্স বেইজ বানিজ্যের সাথে জড়িত (ফেইসবুক পেইজ সহ) উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ৫ হাজারের কাছাকাছি। যদি তাই হয়, তবে ২০ লাখ ইউজার গ্রুপের মার্কেটে পন্য ও সেবা নিয়ে কাজ করছে ৫ হাজার প্রতিদ্বন্দ্বী –পরিবেশটা মোটেও সামঞ্জস্য পূর্ন নয়।
নিঃসন্দেহে ইকমার্স ভিত্তিক ব্যবসা দেশে অগ্রসর হচ্ছে, অনেক নতুন উদ্যোক্তা আসছে, আবার হারিয়েও যাচ্ছে, সর্বপরি অগ্রগতির যাত্রাটা খুবই মন্থর। এখনো চারপাশ ঘিরে আছে আত্মঘাতী বিভিন্ন সমস্যা। যতক্ষন একজন উদ্যোক্তার কাছে কাঁচা টাকা থাকবে ততক্ষন ইকমার্স ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে উদ্দীপনার সাথে, ধীরে ধীরে টাকার সংকট হলো তো ব্যবসা নাজুক পরিস্থিতিতে পড়বে। কেননা এই ক্ষেত্রটি এখনো এমন কোন স্থিতিশীল পর্যায়ে আসেনি যে – একজন ক্ষুদ্র উদোক্তা এখানে এসে সহজেই টিকে থাকতে পারবে।
বলাই যায়, আমাদের দেশে ই-কমার্স বা ডিজিটাল কমার্স এখনো এক্সপ্রিমেন্ট পর্যায়েই রয়ে গেছে, এখানে নেই পর্যাপ্ত গবেষনা, নেই অভিজ্ঞ জনবল, আছে তথ্যের সংকট, সীমাহীন বিজ্ঞাপন মূল্য, দেশীয় রিসোর্সের অভাব, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার সীমাবদ্ধতা, অপ্রতুল ব্যাংকিং সুবিধা।
তার উপর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জংগী হামলার আতংক, অনাকাংখিত জাতীয় কোন সংবাদ এটাকে আক্রান্ত করছে হরহামেশায়। বরং নতুন ও স্বল্প পুজির উদ্যোক্তারা এখানে সহজেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে কারন এই খাতে শহর কেন্দ্রিক ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়ভার অধিক এবং যথাযথ দক্ষতাও আমাদের পর্যাপ্ত ভাবে নেই।
বিগত দিনে অনলাইন ভিত্তিক অনেকগুলো ক্লাসিফাইড সাইট হঠাৎ করে মিডিয়া গরম করে বিজ্ঞাপনে মেতেছিলো, যাদের অনেককেই এখন সেভাবে আর দেখা যাচ্ছেনা, তাদের বিজ্ঞাপন শেষ হয়েছে তো ইউজার ট্রাফিকও নেমে গেছে। কোটি কোটি টাকা, শ্রম বিনিয়োগ করেও কেউ যেনো কোন ভাবেই একটা স্থিতিশীল জায়গায় আসতে পারছেনা, লাভজনক অবস্থাতো অনেক পরের কথা।
অন্যদিকে মেধাভিত্তিক সফটওয়ার, এপ্লিকেশন কিংবা গেইমিং ডেভলপমেন্ট শিল্পের রপ্তানী বাজারটি অনেক প্রশস্থ যার চাহিদা আছে সারা বিশ্বেই। ঐ বাজারটিতে আমাদের কিছু উদ্যোক্তাও প্রতিদ্বন্ধিতা করছে, কেউ আবার ইর্ষনীয় পর্যায়ে ভালো করছে। তবে দেশীয় ইকমার্সের দিকে তাকালে দেখি, নিজেদের ক্ষুদ্র বাজারটিকে প্রতিষ্ঠা করতেই আমরা হিমশিম খেয়ে খাচ্ছি। আমাদের এখানে এমন কোন উদ্যোগ সহসাই খুব একটা চোখে পড়েনা যা দেশ ছাপিয়ে নিজেদের পন্য বা সেবা বহিঃবিশ্বে পৌছে দিবে অতি স্বল্প সময়ে। এমন পরিস্থিতিদের অদুর ভবিষ্যতে আমাদের দেশ থেকে আলীবাবা, আমাজন.কম এর মত একটি কোম্পানী গড়ে উঠার পরিবেশ বর্তমানে কতটুকু আছে তাই এখন যাচাই করে দেখার সময় এসেছে। এখন বাধ্য হয়েই আমাদের কে খুঁজতে হবে আসল সমস্যা গুলো কি কি। টিকে থাকার মত নিরাপদ পরিবেশ নির্ধারন করা না গেলে এখানে কোন উদ্যোগই হালে পানি পাবেনা। আমাদের উদ্যোক্তারা হতাশ হয়ে একদিন হঠাৎ হারিয়ে যাবে।
বিগত দিনে মোবাইল ব্যাবহারের ক্ষেত্রে যে অরাজকতা চলছিলো তা সে সময়ে আওয়ামীলীগ সরকারের ছোট্ট কয়েকটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তে ব্যাপক বিপ্লব ঘ্টাতে পেরেছে। কয়েক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোটি কোটি মানুষের কাছে মোবাইল পৌছে গেছে, গতি এসেছে নিত্য কাজে।
তেমনি এখন ইকমার্স সেক্টরের জন্য সরকার ও ট্রেড বডিকে কিছু সক্রিয় ভূমিকা শীগ্রই নিতে হবে। এই সেক্টরটা এখনো থমকে আছে যেভাবে বিকশিত হবার আশা আমরা করেছিলাম তার কাছাকাছি লক্ষ্যেও আমরা পৌছাতে পারিনি। হাজার হাজার উদ্যোক্তার – কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ মুখ থুবরে পরার আগেই সেক্টরটিকে বাঁচাতে হবে। আমি আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্ঠায় ইকমার্সের কিছু অন্তরায় ও সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্ঠা করেছি মাত্র, পরবর্তীতে যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করার সুযোগ হয় তখন হয়তো পর্যলোচনা আরো বিস্তৃতি পাবে।
১। আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ব্যাপক ভাবে বাড়াতে হবে, যার কোন বিকল্প নেই। এজন্য নুন্যতম দামে হাই স্পীড ব্যান্ডউইথ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ITES কোম্পানী গুলোকে বিশেষ রেটে ব্যান্ডউইথ দিতে হবে। ইন্টারনেট ও ইন্টারনেট ভিত্তিক সেবা উল্লেখযোগ্য হারে বিকশিত না হবার অন্যতম কারনগুলো মধ্যে একটি হচ্ছে দেশের মোবাইল অপারেটরদের ডাটা বিক্রয়ে সেচ্চাচারিতা, আপারেটর গুলো ব্যান্ডউইথ কিনে জনগনের কাছে উচ্চ দামে ডাটা বিক্রি করে, যার ফলে ইন্টানেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছেনা, প্রযুক্তির সুফল জনগনের দ্বারগোড়ায় পৌছাচ্ছে না। মোবাইল অপারেটর গুলোর এহেন সেচ্চাচারিতা বন্ধ করতে প্রয়োজনে ইন্টানেটের সহজ লভ্যাতার লক্ষ্যে দেশ ব্যাপী ডাটা অপারেটরের সংখ্যা বাড়াতে হবে ।
২। এই খাতে উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় তা হলো – টার্গেট ইউজারদের কাছে পৌছাতে তারা বাধ্য হন বিদেশী ওয়েব সাইট গুলোতে বিজ্ঞাপন চালাতে, যেখানে রয়েছে ডলারের বিনিময়ে বিজ্ঞাপন চালানোর সীমাবদ্ধতা। আর পাশাপাশি দেশীয় অধিক ইউজার ট্রাফিক সম্পন্ন ওয়েব সাইট গুলোর বিজ্ঞাপনের উচ্চ হার এখন এক অসহনীয় পর্যায়ে এসে ঠেকেছে সাথে ১৫% ভ্যাটের চাপতো রয়েছেই। যেখানে অনেক উদ্যোক্তা কয়েকবার বিজ্ঞাপন চালিয়ে আশানুরোপ ফল না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন। এখনো দেশীয় অনলাইন বিজ্ঞাপন সংস্থা গুলো কাংখীত লক্ষ্য পুরন করতে পারেনি তাই অতি সত্তর গুগুল, ফেইসবুকের মত প্রতিষ্ঠান গুলোর বিকল্প আমাদের তৈরী করতে হবে, অথবা তাদেরকেই আলোচনার মাধ্যমে আমাদের দেশে অফিস স্থাপন করিয়ে দেশীয় টাকার বিপরীতে সহজেই যেন আমাদের উদ্যোক্তরা বিজ্ঞাপন পরিচালনা সুযোগ পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
৩। আগামী ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশীয় ইকমার্স প্রতিষ্ঠান গুলোর বিজ্ঞাপনের উপর ভ্যাট মওকুফ ও দেশীয় অনলাইন / অফলাইন পত্রিকা ও ডিজিটাল মিডিয়া গুলোতে ইকমার্স প্রতিষ্ঠান গুলো যেনো সহনীয় মূল্যে বিজ্ঞাপন দিতে পারে তার জন্য উচিত একটি বিশেষ সুব্যাবস্থা করা। এজন্য সরকার ও ট্রেড বডি বিশেষ ভুমিকা রাখতে পারে।
৪। ট্রেডবডি গুলোর মূল্যায়নে যে সকল দেশীয় প্রতিষ্ঠান তুলনামূলক ভাবে ভালো করছে তারা যেনো সহজ শর্তে রাষ্ট্রীয় ও প্রাইভেট ব্যাংক থেকে সল্প সুদে কম সময়ের মধ্যে ঝামেলাহীন আর্থিক সহযোগিতা পায় তা নিশ্চিত করা।
৫। দেশীয় কোম্পানী গুলোর ওয়েব হোষ্টিং এর জন্য বাংলাদেশে – শেয়ার, ভিপিএস, ডেডিকেটেড, ক্লাউড সার্ভার ও মান সম্মত সাপোর্টের ব্যাপক অভাব রয়েছে কিংবা নাই বললেই চলে। আমাদের বেশীরভাগ উদ্যোক্তাই বাধ্য হয়ে বিদেশী সার্ভারে নিজেদের ওয়েব হোষ্ট করছেন এক্ষেত্রে সহনীয় মূল্যে আন্তর্জাতিক মানের সাপোর্ট ও সার্ভিস সুবিধা সম্পন্ন ডাটা সেন্টার বাংলাদেশেই গড়ে তুলতে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিতে আমাদের এখনি উদ্দ্যোগী হতে হবে।
৬। আমাদের ডাক বিভাগকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে কিংবা ডাকবিভাগ ও প্রাইভেট যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে সারা দেশে একটি আধুনিক বিপনন ব্যবস্থা চাইলে এখনি তৈরী করা সম্ভব।
৭। তথ্য প্রযুক্তি খাতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও তার ব্যাকাপ প্রত্যেকটি জেলা / উপজেলা পর্যায়ে নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় ভাবে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিতে এখনি উদ্যোগ নিতে হবে।
সর্বোপরি দেশের বাজারে শহর কেন্দ্রীক ইকমার্স কোম্পানী গুলো প্রতিনিয়ত নিজেদের পরিচালনা খরচ, উচ্চ হারে বিজ্ঞাপন প্রদান, পন্য ডেলিভারী সহ নানান ক্ষেত্রে বিরুপ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন, নিজেদের এই বিরুপ পরিবেশে টিকিয়ে রাখার জন্য কখনো কখনো লোকাল বাজারের চেয়ে অনলাইনে পন্যের / সেবার মূল্য বৃদ্ধি করতে বাধ্য হচ্ছেন যার ফলে কিছুতেই আশানুরুপ বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছেনা। আমি মনে করি একটি নিরাপদ ও সুস্থ প্রতিযোগিতা পুর্ন বাজার গঠনের লক্ষ্যে আলোচ্য বিষয় গুলো নিয়ে কাজ করলে আমাদের দেশীয় ইকমার্স শিল্প দ্রুত বিকশিত হবে।
জি, এম ফ্রেজার
সি,এই,ও – বিবাহবিডি ডট কম