image_120130413064744

পণ্ডিত শিরাজী

বাংলার প্রকৃতি, আবহাওয়া, ঋতুবৈচিত্র্য ও কৃষিকাজের সময়সূচি এখনো বাংলা মাস বা বঙ্গাব্দের সঙ্গে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ। আমরা যখন রোদ-বৃষ্টি, ঠাণ্ডা-গরমের কথা বলি তখন ‘কালবৈশাখী’, ‘আষাড়ের বর্ষণ’  ‘শ্রাবণের ধারা’  ‘ভাদ্রের তালপাকা গরম’, ‘শরতের মেঘ’, ‘মাঘ মাসের শীত’ কিংবা ‘ফাল্গুনের হাওয়া’ প্রভৃতি শব্দগুলো ব্যবহার করি। এতেই বোঝা যায় বাংলা সন বা সাল আমাদের জীবনে, ঐতিহ্যে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে কীভাবে মিশে আছে।

অন্তরঙ্গভাবে এই যে বাংলা সালের সঙ্গে মিশে যাওয়া, প্রত্যেক বছর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বাংলা সনকে স্মরণ করা কে উদ্ভাবন করেছিলেন? আমরা যদি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাই তাহলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ইংরেজি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে।

ওই বছর দিল্লির সিংহাসনে বসেন মুঘল সম্রাট আকবর। আরবি হিজরি সন অনুসারে চলতে থাকে রাজকার্য। অর্থাৎ রাজ্যের হিসাব-নিকাশ, কর্মচারীদের বেতন, খাজনা আদায় প্রভৃতি। একদিন রাজ্যের হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কয়েক জন সম্রাট আকবরের কাছে গেলেন। বললেন, “মহারাজ আমাদের ধর্ম-কর্ম সম্পর্কিত অনুষ্ঠানে আরবি অর্থাৎ হিজরি সাল ব্যবহার করতে ইচ্ছে হয় না। তাই আপনি আমাদের একটি পৃথক সাল নির্দিষ্ট করে দিন।” এর কিছুদিন পরেই আবার অসন্তোষ দেখা দিলো সম্রাটের রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে। সম্রাটের কাছে তারা তাদের আবেদনে জানান, জাঁহাপনা সৌর পদ্ধতিতে হিজরি সালের কিছু ত্রুটি এবং চান্দ্র সালের কারণে ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের সময়কাল নির্দিষ্ট রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এমন অবস্থায় আপনি হিজরি এবং চান্দ্র বর্ষের সমন্বয়ে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক নতুন সালের প্রবর্তন করে দিন। যাতে নির্র্দিষ্ট দিন বা সময়ে আমরা জমির খাজনা পরিশোধ করতে পারি।

সম্রাট আকবর ছিলেন রাজ্যের সুশাসক এবং ধর্মমতের ব্যাপারে উদার। বিষয়টির গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করলেন। এটি নিয়ে আলাপ করলেন তার সভাসদ আবুল ফজলের সঙ্গে। আবুল ফজলের পরামর্শে সম্রাট কঠিন এই কাজটি সম্পাদনের দায়িত্ব দিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ সুপণ্ডিত আমির ফতুল্লাহ শিরাজীর ওপর। পণ্ডিত শিরাজী বিষয়টি নিয়ে অনেক গবেষণা করলেন। তারপর হিজরি সালকে অক্ষুন্নণ্ণ ও অপরিবর্তিত রেখে উদ্ভাবন করলেন বাংলা সনের। জমা দিলেন সম্রাটের কাছে। সম্রাট আকবর পণ্ডিত শিরাজীর উদ্ভাবিত বাংলা সনকে গ্রহণ করলেন। সালটা ছিল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ। তারিখ ১০/১১ মার্চ।

এখানে উল্লেখ্য শিরাজীর প্রচেষ্টায় ৯৬৩ হিজরির মুহররম মাসের শুরু থেকে বাংলা বর্ষের অর্থাৎ ৯৬৩ অব্দের সূত্রপাত হয়। যেহেতু ৯৬৩ হিজরির মুহররম মাস বাংলা বৈশাখ মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, সেহেতু তিনি চৈত্র মাসের পরিবর্তে বৈশাখ মাসকেই বাংলা বর্ষের প্রথম মাস হিসেবে বিবেচনা করেন। চৈত্র ছিল শক বা শকাব্দ বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস যা সে সময় বঙ্গে ব্যবহৃত হতো।

আরেকটি মজার ব্যাপার হলো সম্রাট আকবর যখন বাংলা সন প্রবর্তন করেন তখন গ্রেগোরিয়ান বা ইংরেজি সাল এবং হিজরি বর্ষের মধ্যে পার্থক্য ছিল ১৫৫৬- ৯৬৩ = ৫৯৩ বছর। এই ৫৯৩- এর সঙ্গে আমরা যদি নতুন বাংলা সন যোগ করি তাহলে বর্তমান ইংরেজি সাল পাবো। কীভাবে, এখন সেটা বলি। নতুন বাংলা সন ১৪২০-এর সঙ্গে ৫৯৩-এর যোগ করলে দাঁড়ায় ১৪২০+৫৯৩ = ২০১৩, অর্থাৎ ইংরেজি ২০১৩ সাল। বাংলা সন গণনার ক্ষেত্রে এত সহজ একটি সমীকরণ আবিষ্কার করার জন্য সালাম আমির ফতুল্লাহ শিরাজী। সালাম সম্রাট আকবর। স্বাগতম বাংলা ১৪২০।

সুত্রঃ বাংলানিউজ২৪