বৃটিশ বিরোধী তথা স্বদেশী আন্দোলনে বাজিতপুরের বিপ্লবী গণ গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিপ্লবীদের মধ্যে যাদের নাম স্মরন করতে হয় তিনি হলেন বাজিতপুর যুগান্তর দলের প্রতিষ্ঠাতা নরেশচন্দ্র চৌধুরী। এই বিপ্লবী অসহযোগ এবং তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন্য সর্বপ্রথম কিশোরগঞ্জ ষড়যন্ত্র মামলার ধৃত হয়ে দীর্ঘ কারাবরণ করেন। নরেশ চৌধুরী ময়মনসিংহ স্বরাজ্য দল গঠনের সময় পুনরায় গ্রেফতার হন। দীর্ঘ কারাবাসে তার শরীর ভেঙ্গে যায়। মুক্তির কিছুদিনি পর ১৯২২৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তার মৃত্যুর পর যুগান্তর দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে বাজিতপুরে নরেশ সেবা বাহিনী এবং নরেশ স্মৃতি গ্রন্থাগার ক্লাব গঠন করা হয়েছিল। নরেশ সেবা বাহিনীর সদস্যগণ বিভিন্ন সেবা মূলক কাজে অংশগ্রহন করতেন। যেমন- অষ্টমী স্নান, দূর্গাপূজা প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা মাথায় গান্ধী টুপি পরিধান করে জনসেবায় ব্রতী হতেন। নরেশ স্মৃতি গ্রন্থাগার ও ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যুগান্তর দলের বিপ্লবী সদস্য অজিত রায় ধরনী বণিক, ব্রজেন্দ্র রায় উকিল, রামদয়াল মালী, অদু মিয়া, প্রকাশ নীল, হেম রায় প্রমূখ ব্যক্তি বর্গ। পাঠাগারটিতে অন্যান্য গ্রন্থের চেয়ে আন্দোলন, বিপ্লব ইত্যাদি বিষয়ের গ্রন্থের সংখ্যা বেশি ছিল। এসব গ্রন্থের মাঝে History of French Revolution , Autobiography of Rousseu,Speeches of voltair, প্রথম মহাযুদ্ধের ইতিহাস, জার্মানীর নবজাগরণ ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। নরেশ স্মৃতি গ্রন্থাগার কে যুগান্তর দলের সূতিকাগার বলা হতো। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর এই পাঠাগার ও ক্লাবকে বে-আইনী ঘোষনা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বাজিতপুর থানার অনুশীলন সমতির প্রধান ব্যক্তি রমেশ চন্দ্র চোধুরী অন্যতম বিপ্লবী। বিপ্লবী কর্মকান্ডে অংশগ্রহনের জন্য তিনি দীর্ঘ পচিঁশ বছর কারাদন্ড ভোগ করেন। কারাগারেও কর্তপক্ষের বিরুদ্ধে তিনি ৯০ দিন অনশন ধর্মঘট করেন।এ ছাড়া তিনি ৩৬ মাস পলাতক জীবন যাপন করেন। বাজিতপুরের বিপ্লবীদের মধ্যে তিনি বেশি নির্যাতন ভোগ করেন।

জনিদপুর গ্রামের প্রখ্যাত রায় পরিবারের অজিত রায় ছিলেন যুগান্তর দলের সদস্য। যুগান্তর দলের প্রথম কাতারের ১৮ জন সদস্যের মধ্যে অজিত রায় ও বাজিতপুরের ধরণী বনিক ছিলেন অন্যতম। অজিত রায় ১৯২৬ সালে মেট্রিক পাশ করে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তি হন। আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যয়ন কালে কোতায়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অপমান করার জন্য অজিত রায় কে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়এবং এখানেই তার ছাত্র জীবনের সমাপ্তি ঘটে।তখন থেকেই তিনি সম্পূর্ণ ভাবে বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িত হন। তাকে যুগান্তর দলের পক্ষ থেকে ময়মনসিংহ , ঢাকা এবং ফরিদপুর অস্ত্রভান্ডারের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অজিত রায় সর্বমোট ২৩ বছর কারাবরণ করেন। প্রথমে তিনি ১৭ বছর কারাবাস করেন চন্দন নগরের রাজাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করার মামলায়। পরে গৌরীপুর ট্রেন থেকে র‌্যালি ব্রাদার্সের ২৬ হাজার টাকা লুট করার অপরাধে তাকে আরো ৬ বছর কারাবরণ করতে হয়। অজিত রায়ের ভাই শিশির রায়ও যুগান্তর দলের সদস্য হিসেবে অনেক বিপ্লবী কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করেছেন।পরে দুই ভাই-ই কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সঙ্গে সার্বিক সংযুক্ত হয়েছিলেন। অজিত রায়দের বাড়ীই ছিল বিপ্লবী কর্মকান্ডের ঘাঁটি। বলতে গেলে বছরের অধিকাংশ সময় পানি বেষ্টিত জনিদপুর গ্রামের এই বাড়িটি একদিকে যেমন নিরাপদ আশ্রয়ের উপযোগী ছিল, অন্যদিকে সাস্থ্য নিবাসের জন্য ছিল উপযোগী। তাই যুগান্তর দল ও অনুশীলন সমিতির সদস্যগণ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এখানে চলে আসতেন। কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সময় এই বাড়িটি বিপ্লবীদের ট্রেনিং , ক্যাম্প হিসাবেও ব্যবহার করা হতো।

স্বদেশী আন্দোলনে বাজিতপুরে বিপ্লবী কর্মীর সংখ্যা ছিল অনেক। তাদের মধ্যে বাজিতপুরের ধরণী বনিক, দীনেশ বনিক, প্রকাশ নীল, মনীন্দ্র চৌধুরী, চট্টগ্রামের ইন্দু দাস, সরিষাপুরের শ্রীধর গোসাই ,পল্টু গোঁসাই, হিলচিয়ার নবদ্বীপ সাহা ও সুরেশ চন্দ্র সাহা,সাদির চর গ্রামের হরিবল ঠাকুর, সরারচরের ক্ষিতীষ রায়, গোবিন্দ কর প্রমূখ ব্যাক্তি বর্গ বিভিন্ন মেয়াদে আন্দামান ও অন্যান্য স্থানে দ্বীপান্তর দন্ড ভোগ করেন। কখনো মহারাজ কখনো কালিচরণ কখনো বা নমামি ছদ্ম নামে পরিচিত অনুশীলন দলের অন্যান্য ব্যাক্তিত্ব ট্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর বাড়ি বাজিতপুর থানার সীমান্তবর্তী কুলিয়াচর থানার কাপাসাটিয়া গ্রামে।

প্রাথমিক পর্যায়ে স্বদেশী আন্দোলনের কর্মপদ্ধতিতে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। বিশেষ করে সমিতির সদস্যগণকে কালো মন্দিরে বিশুদ্ধ হিন্দুধর্ম মতে আদ্য-অন্ত ইত্যাদি ৪ টি স্তরে দীক্ষা দেয়া হতো। ১৯০২ খ্রীঃ স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলেও প্রথম দিকে ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক। ১৯০৫ খ্রীঃ বঙ্গ ভঙ্গের পর এদেশে এই আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। বঙ্গভঙ্গ কে তৎকালীন মুসলিম সমাজ তাদের অনুকূলে হয়েছে বলে বিবেচনা করে নিয়েছিল। তাই স্বদেশী আন্দোলনে মুসলমানদের অংশগ্রহন একান্তভাবেই সীমিত ছিল। তবে একথাও সত্য যে স্বদেশী আন্দোলনই পরবর্তীতে স্বাধিকার আন্দোলনে পরিণত লাভ করেছিল। স্বদেশী আন্দোলনের সময়কে অগ্নিযুগ বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় থানা পর্যায়ে সর্বাধিক সংখ্যক বিপ্লবী ছিল বাজিতপুর থানায়।