মালতি রানী দেবী৷ জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানায় ১৯৮২ সালে৷ মালতির জন্মের সময় তার বাবা সন্তোষ চন্দ্র পণ্ডিত ছিলেন কাপড়ের দোকানদার৷ চার ভাই বোনের মধ্যে মালতির ভাই তার দু বছরের বড়, এছাড়া আছে মালতির ছোট দুই বোন৷ মালতির জন্মের সময় সংসারের আর্থিক অবস্থা ভালোই ছিল, কোনো কিছুর অভাববোধ হয়নি কখনও৷ নিয়তির নির্মম পরিহাসে মালতির বয়স যখন পাঁচ তখন মালতি পোলিও রোগে আক্রান্ত হন৷ কিন্তু সচেতনতার অভাব এবং কুসংকারাচছন্ন থাকার ফলে তার পরিবারের লোকজন তাকে কোনো ডাক্তার না দেখিয়ে বরং ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি ও তাবিজ-কবজের চিকিৎসা করায়৷ মালতি বিছানায় অসার হয়ে পড়ে থাকে৷ তিন বছর প্রচণ্ড কষ্ট ভোগ করার পর মালতি আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকেন এবং তার বাম পায়ের চলার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়৷ ফলে তিনি পঙ্গুত্ব বরণ করেন৷ মালতি যখন সুস্থ হয়ে উঠলেন, তখন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়৷ অনেকেই পরিবারের এই দুর্গতির জন্য মালতিকে দায়ী করে৷ তারা সবসময় মালতিকে অলক্ষ্মী, অপয়া বলে ডাকতো৷

মালতির অসুস্থতার সময় তার আরো একটি বোন হয়৷ সংসার খরচ চালানোর জন্য পরিবারের সবাই মিলে বিড়ি বানানোর কাজ শুরু করে৷ পড়াশুনায় প্রচ আগ্রহ থাকার কারণে মালতিও স্কুলে যাওয়া শুরু করেন৷ ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতেন বলে সহপাঠীরাও অনেক সময় তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো৷ কিন্তু মালতি দমেননি৷ স্কুল থেকে আসার পর মালতিকে সংসারের কাজে মাকে সবসময় সাহায্য করতে হতো আর বিড়ি বানানো চলতো রাত পর্যন্ত৷ মালতির পরিবারের সদস্য আরও একজন বাড়লো৷ বাবার আয়ে কোনো রকমে সংসারের খাবার খরচ চলে৷ তিনবেলা পেটভরে খাবার জুটতো খুব কম দিন৷ এমনিভাবে মালতি যখন অষ্টম শ্রেণিতে ওঠেন তখন থেকে মালতি প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন৷ মাসে ৩০০ দিয়ে একটি ডিপিএস খোলেন৷ সকালে স্কুলে যাবার আগে দুইটা স্কুল থেকে আসার পর সংসারের কাজ শেষ করে আবার বিকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলত প্রাইভেট পড়ানো৷ অষ্টম শ্রেণিতে থাকার সময় মালতি টিএলএম (গণশিক্ষা কার্যক্রম) থেকে পনের দিনের একটি প্রশিক্ষণ নেন৷ এই প্রশিক্ষণ তার পড়াশুনার দক্ষতা আরো বাড়ে৷ সংসারের নানা সমস্যায় মালতির মা বীণা রানী কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন৷ ফলে সংসারের সব দায়িত্ব মালতির কাঁধে এসে পড়ে৷ বাবার আয়ে সংসারের খাবার খরচ কোনো রকম চলত আর মালতিকে দিতে হতো ছোট দুই বোনের পড়ার খরচ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস৷

মালতির ভাই এসএসসি পাশ করার পর ঢাকা চলে যায় এবং সেখানে চাকরি করে কিছু টাকা সংসারেও দিতো৷ এইদিকে মালতির বয়স বেশি হলেও একটি পা নষ্ট থাকায় তার বিয়ে হচেছ না৷ তাই ছোট বোনদের বিয়ে নিয়েও মানুষ নানা কথা বলতো৷ মালতি যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী, তখন তার ছোট বোনের বিয়ে হয়৷ ছোট বোনের বিয়ের পর মালতি তার প্রাইভেট পড়ানো আরো বাড়িয়ে দেন৷ সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকতেন, ফলে নিজের পড়াশুনার ক্ষতি হয় এবং তিনি এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করতে ব্যর্থ হন৷ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এই পর্যায়ে মালতিকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেয়৷ সংসারের যাবতীয় কাজ আর টিউশনি এইভাবে সর্বক্ষণ নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতেন৷ বড় হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে না হওয়ায় এলাকার লোকজন মালতিকেই দায়ী করে৷ কিছুটা স্থির হওয়ার পর মালতি আবার এসএসসি পরীক্ষা দেন কিন্তু আবারও অকৃতকার্য হন৷ তৃতীয় বারের মাথায় ২০০৪ সালে মালতি এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেন৷ এসএসসি পাশের পর মালতি এইচএসসি তে ভর্তি হন৷

কলেজে ভর্তির পর মালতি কম্পিউটার শেখার জন্য হাবিবুর রহমান বর্ণালীর কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন৷ এখানে কম্পিউটার শেখার সময় মালতি জানতে পারেন, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট থেকে উজ্জীবক প্রশিক্ষণ হবে৷ মালতিও ‘৬৬১তম’ ব্যাচে উজ্জীবক হিসাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ প্রশিক্ষণ শেষে মালতি তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক করেন৷ সেই লক্ষ্যে তিনি ঢাকা গিয়ে ‘বিউটিফিকেশনে’ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ প্রশিক্ষণ শেষে কটিয়াদি আসার পর মালতি প্রথমে নিজের পরিচিতদের মাঝে পার্লারের কাজগুলো করতেন৷ এর মধ্যে এইচএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য মালতি ফরম পূরণও করেন৷ কিন্তু হঠাৎ করে বাধার সৃষ্টি হয়৷

মালতির ছোট বোন সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য বাপের বাড়িতে চলে আসে৷ ছোট বোনের প্রতি সকল দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মালতির পক্ষে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া আর সম্ভব হয়নি৷ পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর মালতি বাড়ির পাশের এক পার্লারে কাজ নেন; সেটি ছিল তার বান্ধবীর৷ পাশাপাশি টিউশনিও চলতে থাকে৷ বান্ধবীর সাথে মনের মিল না হওয়ায় মালতি নতুন একটি পার্লারের দোকান দেন৷ কৃষি ব্যাংক থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এবং অনামিকা নামে এক বান্ধবীর সাথে যৌথ উদ্যোগে পার্লারটি প্রতিষ্ঠা করেন৷ দোকানের সম্পূর্ণ টাকা মালতি দিয়েছিলেন৷ কথা ছিলো, অনামিকা ধীরে ধীরে তার অংশের টাকা শোধ করে দেবেন৷ কিন্তু অনামিকা প্রতিমাসে মারতির কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন৷ তাই তার অংশের টাকা কোনোদিনই শোধ করা হয়নি৷

এমনিভাবে একটি বছর পার হয়ে যায়৷ পার্লারের দোকান চালাতে গিয়ে মালতির সাথে পরিচয় হয় রাজশাহীর ছেলে সুমন সাহার৷ দু’জনে নতুন সংসারের স্বপ্ন দেখেন৷ কিন্তু সুমনের বাবা, মা বা পরিবারে কেউ না থাকায় বাধ সাধে মালতির পরিবার৷ কিন্তু এবার আর বহুদিনের লালিত স্বপ্নকে মালতি ব্যর্থ হতে দেননি৷ পরিবারের অমতে নিজের পছন্দের মানুষটিকে বিয়ে করেন৷ পরিবার থেকে বিচিছন্ন মালতি স্বামীকে নিয়ে আলাদা বাসায় ভাড়া থাকেন৷ বিয়ের পর স্বামীর সাথে দোকানের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পর স্বামী তাকে পরামর্শ দেয় শেয়ারের টাকা নিয়ে কথা বলার জন্য৷ স্বামীর পরামর্শে অনামিকার সাথে এ নিয়ে কথা বলায় আবারও সমস্যার সৃষ্টি হয়৷ এদিকে মালতি আগে যে পার্লারে কাজ করতেন, তা ব্যবসায়ে লোকসানের সম্মুখীন হয় ও বন্ধ হয়ে যায়৷ মালতি চেয়েছিলেন সে দোকানটি কিনতে৷ দোকানের মালিক শেষ পর্যন্ত তার দোকানটি মালতিকে বিক্রি করেননি৷ এদিকে অনামিকার সাথেও ব্যবসায়ীক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়৷

ফলে মালতি এবার একাই একটি পার্লারের দোকান দেন কটিয়াদি মহিলা কলেজের সামনে৷ পূর্বের দোকানের মালামাল অনামিকা ও মালতি দু’জনে ভাগ করে নেন৷ ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে মালতি তার ‘বকূয়া বিউটি পার্লার’ উদ্বোধন করেন৷ নতুন দোকান নিয়ে মালতি নতুনভাবে সংগ্রামে নামেন৷ পার্লারের পিছনেই তার বাসা৷ বর্তমানে পার্লার থেকে মালতির মাসিক আয় ২৫০০ টাকা৷ এছাড়া তার প্রাইভেট পড়ানো থেমে যায়নি৷

মালতি এখন তার অসম্পূর্ণ পড়াশুনা আবারও নতুন করে শুরু করতে চান৷ মালতি এইচএসসি পরীক্ষা দেবার প্রত্যাশা করছে৷ তার স্বপ্ন, দোকানটা আরও বড় করবে ও সুন্দর করে সাজাবে৷

লিখেছেনঃ  নায়লা হক দীনা