রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহারে জমি ও পরিবেশের নানা ক্ষতিতে  পরিবেশবান্ধব কেঁচো সার প্রস্তুত শুরু হয়েছে। প্রস্তুত পদ্ধতি ও দাম কম হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে এ সার ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এসব সার প্রস্তুতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাওয়া ২১ পরিবার এরই মধ্যে আত্মনির্ভরশীল হতে শুরু করেছে। এর সঙ্গে জমি ও ফসল গ্রহণ করছে নিরাপদ খাদ্যের স্বাদও।

কেঁচো সারের সুফল পাওয়ায় এবং কেঁচো সার চাষ লাভজনক হওয়ায় তা জেলায় দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এতে রাসায়নিক সারের ওপর থেকে চাপ কমছে, সৃষ্টি হচ্ছে গ্রামীণ নারীদের আত্মকর্মস্থানের সুযোগ। তিনি জানান, ইন্টারনেটে পাওয়া কেঁচো সারের বিভিন্ন দিকের ওপর একটি প্রবন্ধ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে। এরই অংশ হিসেবে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও আর্থিক সহযোগিতায় শিবপুর উপজেলার সৈকারচর গ্রামের ‘গ্রামীণ নারী কৃষক দারিদ্র্য বিমোচন আত্মকল্যাণ মহিলা সমবায় সমিতি’র ২১ জন সদস্যকে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় গত জুন মাসে।

এর দেড় মাস পর থেকেই প্রতিটি হাউস থেকে একেকজন নারীকর্মী মাসে অন্তত ১০-১২ হাজার টাকা আয় করছেন। সৈকারচর গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব রমিজা বেগম জানান, দিনমজুর স্বামীর সামান্য আয় দিয়ে চার মেয়ে নিয়ে ছয়জনের সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হতো। কিন্তু কেঁচো সার প্রস্তুত শুরুর পর এখন কষ্ট অনেকটাই দূর হতে শুরু করেছে। প্রথম দেড় মাসে এক হাউসের কেঁচো সার বিক্রি করে আয় হয়েছে সাড়ে ১১ হাজার টাকা। রমিজা বেগম বলেন, ‘কেঁচো সার আনগর ভাগ্য বদলাইয়্যা দিছে। কোনো দিনও ভাবি নাই টেহা কামাই করুম। এহন এই টেহা সংসারেও খরচ করতে পারছি।’

স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শুধু রমিজা বেগমই নয়, এ স্বল্প সময়ে সাফল্য পেয়েছেন সৈকারচর গ্রামের ২১ জন ছিন্নমূল মহিলা। কেঁচো সারের জনপ্রিয়তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে জেলার অন্য উপজেলাগুলোতেও। ইতিমধ্যে জেলার চারটি উপজেলার শতাধিক ছিন্নমূল নারী কেঁচো সারের চাষ করছেন। এতে গ্রামীণ ছিন্নমূল মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রাসায়নিক সারের মতো পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ হওয়ায় এলাকার কৃষিজমিতে কেঁচো সারের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটিতে প্রোটিনের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। কেঁচো সার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা বাড়ে, বিপরীতে রাসায়নিক সারের মতো প্রোটিন কমে না। তাই এ সার জমি ও পরিবেশের জন্য অনেক উন্নত।

কেঁচো সার চাষ পদ্ধতি

উৎপাদন

বাড়ির সব ধরনের জৈব আবর্জনা যেমন_কলাগাছ, কচুরিপানা, গাছের ঝরাপাতা, আগাছা প্রভৃতির সঙ্গে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ গোবর মিশিয়ে কুচি কুচি করে কেটে পলিথিন ব্যাগে ভর্তি করে ছায়াযুক্ত স্থানে ১০-১২ দিন রেখে দিন। একটি ছায়াযুক্ত উঁচু স্থানে ৫ ফুট বাই ৭ ফুট উচ্চতার ইট-বালু দিয়ে হাউস তৈরি করুন। আবর্জনা মেশানো গোবর হাউসের ভেতর ঢেলে আনুমানিক ৫০০ কেঁচো ছাড়ুন। ওপরে কিছু নারিকেল পাতা দিয়ে তার ওপর চট দিয়ে ঢেকে দিন। শুকনো মৌসুমে প্রয়োজনে ছয়-সাত দিন পর পর এক থেকে তিন কেজি পানি ছিটিয়ে দিন। এ অবস্থায় পরিচর্চা করলে কেঁচোগুলো আবর্জনা খেয়ে কেঁচো সারে পরিণত করবে। হাউস থেকে সার উঠিয়ে শূন্য দশমিক ৫ সেন্টিমিটার বা ১ ইঞ্চির পাঁচ ভাগের এক ভাগ ছিদ্রযুক্ত চালনি দ্বারা চেলে সার ও কেঁচো আলাদা করতে হবে। সারকে ফসলে এবং কেঁচোকে আবার নতুন সার তৈরির কাজে ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া গামলা পদ্ধতি, ঘের পদ্ধতি, রিং পদ্ধতিতে কেঁচো সার উৎপাদন সম্ভব।

সাবধানতা

পিঁপড়া, উইপোকা, তেলাপোকা, গুবরেপোকা, মুরগি ও বিভিন্ন পাখি কেঁচোর শত্রু। এগুলো কোনো কীটনাশক দিয়ে মারা যাবে না। তবে হাউসের চারদিকে কীটনাশক দেওয়া যাবে। ব্যবহৃত গোবরের সঙ্গে ছাই, বালু, ভাঙা কাচ ইত্যাদি রাখা যাবে না। মুরগি ও পাখির আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য হাউসের ওপর ঢাকনা দিয়ে রাখবেন। কেঁচোকে জীবিত ও সক্রিয় রাখতে হাউসে বেশি পানি দেওয়া যাবে না, আবার পানি শুকিয়ে ফেলাও যাবে না। চালনি দিয়ে চালার সময় হাউসে নির্দিষ্ট জাত ছাড়া অন্য জাতের কেঁচো থাকলে তা আর পরে সার তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে না।

বৈশিষ্ট্য

এ সারে গাছের অত্যাবশ্যকীয় ১৬টি খাদ্য উপাদানের ১০টিই বিদ্যমান। এ ছাড়া এর মধ্যে গাছের অত্যাবশ্যকীয় কয়েকটি হরমোন ও এনজাইম রয়েছে, যা গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও ফলের বর্ণ, গন্ধ, স্বাদসহ অন্যান্য গুণগত মান উন্নত রাখে। কেঁচো সার বীজের অঙ্কুরোদ্গমে সহায়ক। এ সার ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন খরচ কমে। সব ফসলেই ব্যবহারযোগ্য। বেলে-দোআঁশ মাটিতে এর কার্যকারিতা বেশি। ফলদ গাছ বা উঁচু জমির ফসলে পর পর তিনবার কেঁচো সার ব্যবহার করলে ডিম থেকে উৎপন্ন কেঁচো ওই স্থানে নিজে থেকেই সার উৎপাদন করতে থাকে। ফলে পরবর্তী দু-তিনটি ফসলে সার ব্যবহার না করলেও চলে।

পুষ্টিমান

জৈব পদার্থ দিয়ে সাধারণ সার তৈরির পরিবর্তে কেঁচো সার তৈরি করলে এর পুষ্টিমান সাত থেকে ১০ গুণ বাড়ে। সুহৃদ বাংলাদেশ কর্তৃক কুমিল্লা জেলায় উৎপাদিত কেঁচো সারের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাগারে রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর মধ্যে জৈব পদার্থ ২৮ দশমিক ৩২ ভাগ, নাইট্রোজেন ১ দশমিক ৫৭ ভাগ, ফসফরাস ১ দশমিক ২৬ ভাগ, পটাশিয়াম ২ দশমিক ৬০ ভাগ, ক্যালসিয়াম ২ ভাগ, ম্যাগনেসিয়াম দশমিক ৬৬ ভাগ, সালফার দশমিক ৭৪ ভাগ, আয়রন ৯৭৫ পিপিএম, ম্যাংগানিজ ৭১২ পিপিএম, বোরন ০.০৬ ভাগ, জিঙ্ক ৪০০ পিপিএম, কপার ২০ পিপিএম রয়েছে।

ব্যবহার

পেঁপে, কলা, লেবু, পেয়ারা প্রভৃতি ছোট আকারের ফলদ গাছে বছরে একবার প্রতি গাছের গোড়ায় চারদিকে গোল নালা কেটে গাছপ্রতি পাঁচ কেজি কেঁচো সার দিয়ে ওপরে মাটিচাপা দিতে হবে। শাকসবজির জমিতে কেঁচো সার মিশিয়ে বীজ বা চারা লাগাতে হবে। ধান, পাট প্রভৃতি জলাবদ্ধ অবস্থায় জন্মানো ফসলে বিঘাপ্রতি ৫০ কেজি কেঁচো সার শেষ চাষ-মইয়ের আগে জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। ফুল গাছে গাছপ্রতি ৫০ থেকে ২০০ গ্রাম সার চারা লাগানোর সময় গাছের গোড়ায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে চারা লাগাতে হবে।

-কালের কন্ঠ