সোনালি আঁশ পাটের নতুন স্বপ্নযাত্রা শুরু হচ্ছে। বাংলাদেশের একদল বিজ্ঞানী পাটের জীবনরহস্য বা জিন নকশা (জিনোম সিকোয়েন্স) উন্মোচন করেছেন। এর ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী পাটের নতুন জাত উদ্ভাবন করা যাবে। পাটের গুণগত মান ও বিপুল মাত্রায় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, নতুন জাত উদ্ভাবন করা হলে পানিতে জাগ দেওয়ার সময় কম লাগবে, আঁশ দিয়ে জৈব জ্বালানি ও ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে।
বিশ্বের প্রাণরসায়ন গবেষণায়ও পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন একটি অভাবনীয় অর্জন। বিশ্বে এ পর্যন্ত ১৭টি উদ্ভিদের জীবনরহস্য উন্মোচিত হয়েছে। এই প্রথম বাংলাদেশের মতো কোনো উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীরা এ কাজে বড় সাফল্য অর্জন করলেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাইরে চীন ধানের এবং মালয়েশিয়া রাবারের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে। পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন মালয়েশিয়া-প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। ২০০৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পেঁপে ও ২০০৯ সালে মালয়েশিয়া সরকারের হয়ে রাবারের জীবনরহস্য উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। পাটের জীবনরহস্য উন্মোচিত হয় বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায়।
সামনের দিনের কাজ: জীবনরহস্য উন্মোচনের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে জাতিসংঘের আওতায় আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের (আইপিও) কাছে নিবন্ধন করানো। এক বছরের মধ্যে তা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কৃষকের জন্য উপযোগী পাটের উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে সময় লাগবে তিন থেকে চার বছর।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী কোনো উদ্ভিদের জীবনরহস্য উন্মোচনের ঘোষণা দেওয়ার তিন মাসের মাথায় তার ফলাফল উপস্থাপন করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে অন্য কোনো দেশ তার ফলাফল প্রকাশের কথা জানাতে পারে না। মাকসুদুল আলম জানান, তিন মাসের আগেই এই জন্মরহস্যের বিস্তারিত প্রকাশ করা যাবে।
মাকসুদুল আলম কয়েক বছর ধরেই মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে বসেই তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাট নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ২০০৯ সালের নভেম্বরে প্রথম আলোর বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতায় বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের রাবারের জীবনরহস্য উন্মোচন ও পাট নিয়ে গবেষণার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী মালয়েশিয়ায় মাকসুদুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে দেশে এসে গবেষণা শুরু করার আহ্বান জানান। কৃষিমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে গত ৩ জানুয়ারি থেকে তিনি গবেষণাটি পুরোদমে শুরু করেন। চলতি সপ্তাহে তাঁর গবেষণার কাজটি ৮৫ শতাংশ সম্পন্ন হয় বলে জানিয়েছেন।
পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. কামালউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এই অর্জন পাটের সোনালি আঁশের অতীত থেকে “হীরক আঁশের” ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।’ দেশের একেক অঞ্চলে একেক উচ্চতা ও পুরুত্বের পাট হয় এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন সব জায়গায় একই রকম উন্নত মানের পাট উৎপাদনের উপযোগী জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে। এর আঁশ দিয়ে কাপড় তৈরির উপযোগী মিহি সুতাও তৈরি করা যাবে।
গবেষণায় যারা যুক্ত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) ও বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সংস্থা ডাটা সফট যৌথভাবে গবেষণার কাজটি করেছে।
গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই ও ইউনিভার্সিটি সায়েন্স মালয়েশিয়ার কাছ থেকে। গবেষণার বিভিন্ন স্তরে প্রায় দুই কোটি তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই তথ্য ব্যাখ্যা করতে প্রয়োজন পড়েছে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মিনি সুপার কম্পিউটারের। ৪২টি কম্পিউটার একসঙ্গে যুক্ত করে মিনি সুপার কম্পিউটার তৈরি করা হয়।
২০০৮ সালে দেশের ৪২ জন বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদকে নিয়ে তৈরি ‘স্বপ্নযাত্রা’ নামক একটি উদ্যোগের মাধ্যমে এই গবেষণার সূত্রপাত। পরে ২০১০ সালে নতুন উদ্যোমে আবারও গবেষণাটি শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুজীব বিভাগের ১১ জন গবেষক ও ডাটা সফটের ২০ জন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তথ্য বিশ্লেষণের কাজগুলো করেছেন।
শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও ডাটা সফটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব জামান তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কাজগুলো তত্ত্বাবধান করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা, বেসরকারি সংস্থার প্রযুক্তিবিদ্যা ও সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে কাজ করে কীভাবে সফল হতে পারে, পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন তার একটি বড় উদাহরণ। গবেষণার পরবর্তী ধাপে সহায়তা করার জন্য তিনি পাটকলগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
মাকসুদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গবেষণার একটি স্তর আমরা শেষ করেছি। পরবর্তী ধাপে বীজ তৈরির আগ পর্যন্ত আমাদের আরও নিষ্ঠার সঙ্গে সবাই মিলে কাজটি করতে হবে। ভবিষ্যতে এমন জাতের পাট উদ্ভাবন করা সম্ভব, যার আঁশ দিয়ে জৈব জ্বালানি তৈরি করা যাবে। এতে দেশের জ্বালানি সমস্যার সমাধানও অনেকাংশ সম্ভব হবে।’
মাহবুব জামান বলেন, ‘বিশ্বে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে পাটের আঁশের পরিবর্তে কেনাফ ব্যবহূত হচ্ছে। আমরা এমন জাত উদ্ভাবন করতে পারব, যার মাধ্যমে কেনাফের আন্তর্জাতিক বাজার দখল করা সম্ভব।’
জিনোম সিকোয়েন্স কী: মাত্র চারটি অক্ষর এ, সি, জি ও টি দিয়ে তৈরি হয় আমাদের সবার জীবনের গল্প। সামান্য অণুজীব থেকে শুরু করে বহুকোষী মানুষ সবার ক্ষেত্রেই একই বিষয়। বাংলা ভাষার ৫০টি বর্ণ নিয়ে যেমন সব ভাষা লেখা হয়, তেমনি কোটি কোটি এ, সি, জি, টি-এর বিন্যাস সমাবেশে লেখা আছে সব প্রাণের নীলনকশা জিনোম। একটি প্রাণীর জিনোমে লেখা থাকে তার সব বৈশিষ্ট্য। তাই জিনোম অনুক্রম জানতে পারলে কোন অংশটি পরিবর্তন করলে কোন ধরনের ওই প্রাণীর মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব, তা বের করা যাবে।
পাট বাংলাদেশে প্রধান অর্থকরী ফসল হলেও এখনো এই ফসলটির জিন সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রকৃতিতে পাট চাষ করতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিশেষ করে পাটের আঁশ জাগ দেওয়ার জন্য পানি নিয়ে প্রতিবছরই সমস্যা দেখা দেয়। জীবনরহস্য উম্মোচন হওয়ায় নতুন জাতের পাটবীজ উদ্ভাবন সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পেঁপে। এখন এমন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা পোকামাকড়ের আক্রমণ সহ্য করতে পারে। ফলে উৎপাদন বেড়ে ওই অঞ্চলের আয় বেড়ে গেছে। মালয়েশিয়ায় রাবারের ক্ষেত্রে একই ধরনের সফলতা এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে ইউরোপের বাজারে পলিথিন, প্লাস্টিক ও কৃত্রিম তন্তুজাত পণ্যের ব্যবহার কমে আসছে। প্রাকৃতিক আঁশের ব্যবহার্য পণ্যের চাহিদা বাড়ছে।