সাম্প্রতিক’কালে সব চেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত বিষয় হচ্ছে ব্লগ, ব্লগার অতঃপর নাস্তিক। আলোচনার বিষয় থাকে ব্লগ নিয়ে। আর যদি সমালোচনার বিষয় নির্ণয় করি তা হলো ব্লগার, নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের ইত্যাদি।   যারা এই ব্লগ ও ব্লগার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেন তাদের অনেকেই এই বিষয়ে নূন্যতম ধারণা রাখেন বলে প্রতিয়মান নয়। এক ইলেকট্রিক মিডিয়ায় ব্লগ নিয়ে প্রশ্ন করাতে উত্তরে জনৈক ব্যক্তি বলেন, ‘ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালায়’।   ব্লগ (Blog) একটি ইংরেজি শব্দ। এর বাংলা প্রতিশব্দ এক ধরনের অনলাইন দিনলিপি বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক পত্রিকা। সহজ ভাষায় বলতে হলে, ব্যক্তিগত ডায়েরী।

একটা সময় ছিলো মানুষ নিজের আবেগ অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার জন্য কাগজ-কলমের ব্যবহারের মাধ্যমে ডায়েরীর সাহায্য নিতো। ভ্রমন কাহিনী কিংবা নিজের অভিজ্ঞতাগুলো নিজের মত করে সাজিয়েগুছিয়ে রাখতো ডায়েরীর পাতা জুড়ে। আধুনিক যুগে এসে আধুনিকায়ন হয়েছে অনেক কিছুই। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ অনেক কঠিন কাজ সহজে করতে সক্ষম হয়েছে।   মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা…

চিঠির জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকা। রং রাঙ্গিয়ে ঢং সাজিয়ে কত কি যে লেখা। নানান রং এর খামে করে পোষ্টম্যান বা ডাকপিয়ন এসে হাতে দিয়ে যেতেন। কত উৎকণ্ঠা আর আবেগ জড়িত থাকত। গভীর রাতে ‘রানার চলছে তাই ঝুম ঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে’ এখন আর শোনা যায় না। আর সে ডায়েরী আজ আধুনিকায়ন হয়েছে। প্রযুক্তিকায়ন হয়েছে। কাগজ-কলমের জায়গা দখল করে নিয়েছে কম্পিউটারের কিবোর্ড-মাউস।

১৯৯৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর জোম ব্লার্গার ‘ওয়েবলগ’ (weblogweblog) শব্দটা প্রথম ব্যবহার শুরু করেন। পরে ১৯৯৯ সালের এপ্রিল বা মে মাসের কথা। পিটার মেরহোলজ মজা করার জন্যে তাঁর পিটারমে ডট কম (PeterMe.comom) সাইডবারে ‘ওয়েবলগ’ (weblog) শব্দটা ভেঙ্গে ‘উই ব্লগ’(we blog) হিসেবে লেখা শুরু করেন। হয়’ত তখন তিনি চিন্তাও করেননি, এই ব্লগ এতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করবে। বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করবে। মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হবে।  ঠিক তার পরপরই, পাইরা ল্যাবস-এ ইভান উইলিয়ামস ‘ব্লগচ’ শব্দটা বিশেষ্য এবং ক্রিয়া দুটো হিসেবেই ব্যবহার করা শুরু করেন এবং পাইরা ল্যাবের ব্লগার পণ্যের সাথে সম্পর্ক রেখে ব্লগার শব্দটা আজও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফিরে যাই তারও আগেরকার সময়ে।

ব্লগ, ব্লগিং বা ব্লগপোষ্ট জনপ্রিয় অর্জনের আগে ডিজিটাল মহলগুলো নানান ধরনের ছিলো যেমন, ইউজনেট (Usenet), জিনি (GEnie), বিক্স (BiX) এর মত বাণিজ্যিক অনলাইন সার্ভিস। আরও একটু পিচনে গেলে দেখা যায় কম্পুসার্ভ (CompuServe), ই-মেইল লিস্টস আর বুলেটিন বোর্ড সিস্টেমস (BBS) সার্ভিসগুলো অন্যতম।  সাধারণত ব্লগ দুই ধরনের হতে পারে।

blog-1একটি সিঙ্গেল ইউজার ব্লগ। সিঙ্গেল ইউজার ব্লগে একজন ব্যবহারকারী লিখতে পারেন আর অন্যান্য অনলাইন ব্যবহারকারীরা শুধু মন্তব্য করতে পারেন। অন্যটি মাল্টি  ইউজার ব্লগ। মাল্টি ইউজার ব্লগ হচ্ছে একটি  সোশ্যাল মিডিয়ার মত। যেখানে হাজার থেকে শুরু করে লক্ষ কোটি ব্যবহারকারী থাকবে। তাঁরা তাদের আবেগ-অনুভূতি, অভিজ্ঞতা নানান বিষয়ের লেখা পোস্ট এবং অন্যের লেখার মন্তব্যও করতে পারবে।  আবার প্রতিটি ব্লগই নিজস্ব নীতিমালায় চলে। সেখানে কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যে কোন পোস্ট, মন্তব্য ফিল্টার-মডারেট অথবা বাতিল করার ক্ষমতা রাখেন ব্লগ কর্তৃপক্ষ।   যেমন কোন ধরনের ব্যক্তি বিশেষের উপর আক্রমন করা পোস্ট, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা পোস্ট, মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করা পোস্ট, মানহানিকর পোস্ট, স্প্যাকিং, হ্যাকিং সাইবার জনিত অপরাধ পোস্ট ইত্যাদি।

ব্লগ পোস্ট করার পূর্বে স্পষ্ট লেখা থাকে ‘এই ব্লগের কোন লেখা, কমেন্ট বা কন্টেন্টের স্বত্ত্ব সর্ম্পূণভাবে সংশ্লিষ্ট ব্লগারের’। ব্লগ কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠান কোন ভাবেই কোন ব্লগারের ব্যক্তিগত লেখার দায় বহন করে না।  অন্যদিকে বাংলাদেশের আইনেও কোন ব্যবহারকারীর করা অজ্ঞাত অপরাধের জন্য সাইট পরিচালকদের দায় মুক্তি দেয়া হয়েছে।

আধুনিক সময়ের ব্লগের উৎপত্তি ঘটে অনলাইন দিনপত্রী থেকে। মানুষ তাঁর নিজের প্রয়োজনে নিজের মত করে নিজের পথ নিজেই আবিস্কার করে। যেখানে সে তাঁর নিজের আবেগ-অনুভূতি লেখালেখির মাধ্যমে প্রকাশ করবে।   ব্লগ সে রকম ছোট ছোট চিন্তা ভাবনা নিয়ে তৈরি এবং আজকে এত জনপ্রিয়। আর এসব লেখালেখির সাথে যারা তখন জড়িত ছিলেন তাঁরা বেশীর ভাগ মানুষই নিজেদের বলতেন, ডায়েরিস্টস, জার্নালিস্টস, অথবা জুমালারস ইত্যাদি।

তখন ১৯৯৪ সাল। সোয়ার্থমোর কলেজের ছাত্র জাস্টিন হল। বর্তমানে সিঙ্গেল ইউজার বা ব্যক্তিগত ব্লগিং করিয়ে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সে সময় ব্লগিং করতেন জেরি পুমেলও। জাস্টিন হল ও জেরি পুমেলকে আদি ব্লগার হিসেবে গণ্য করা হয়।  আবার সবচাইতে বেশি দিন চালু থাকা ডেব উইনার এর ওয়েবলগ স্ত্রিপ্টিং নিউজ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে।

 প্রথম সময়কার ব্লগগুলো ছিলো সাধারণ ওয়েবসাইটের হাতে বানানো উপকরণ। তবে সময়ের সাথে সাথে বিপরীতক্রমে পোস্ট করা ওয়েব প্রবন্ধগুলো লেখা বা দেখভাল সহজ করার জন্য বিবর্তিত কৌশলগুলোই প্রকাশ ব্যবস্থাটা বড়সড় একটা জনগোষ্ঠির হাতে চলে যায়। যারা প্রযুক্তিতে অতটা দক্ষ নয়, তবে বেশ সহজযোগ্য ব্যবহারের জন্য গড়ে তোলা হয়। আর এতে করেই শেষমেষ আলাদা ধরনের একটা অনলাইন প্রকাশনা গড়ে ওঠে। যাকে আমরা অতি চেনা পরিচিত চেহারার মত করে বলি ব্লগ।   উদারণ টানলে, কিছু কিছু ব্রাউজার নির্ভর সফটওয়্যারের ব্যবহার এখন ব্লগের একটা নিতান্তই মামুলি ব্যাপার। ব্লগ হোস্টিং করার জন্য আছে ব্লগ হোস্টিং সার্ভিস, এছাড়াও এগুলো সফটওয়্যার কিংবা নিয়মিত ওয়েব হোস্টিং সার্ভিস ব্যবহার করেও চালানো যায়।

১৯৯৭ সালের দিকে ব্লগিং শুরু করেন দ্য মিস্যানথ্রোপিক বিচ। তারা নিজেদের অনলাইন উপস্থিতির নাম দিয়েছিলো জাইন।  শুরুটা হয়েছিলো বেশ ধীরগতিতে। ১৯৯৯ সাল থেকে ব্লগের ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। ১৯৯৮ সালে ব্রুস আবেলসন ওপেন ডায়েরি নামান, এতে করে দিনের পর দিন হাজারো দিনলিপি বাড়তে থাকে। ওপেন ডায়েরির উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিলো, পাঠক মন্তব্য। এটাই ছিলো প্রথম ব্লগ কমিউনিটি।

আর এখানে পাঠকেরা অন্য লেখকের ব্লগ অন্তর্ভূক্তিতে মন্তব্য করতে পারতেন।  একই সালের মার্চে লাইভ জার্নাল দিয়ে শুরু করেন ব্র্যাড ফিটজপ্যাট্রিক।জুলাই মাসে এন্ড্রু স্মেলস কোন ওয়েবসাইটে একটা ‘খবর পাতা’ রাখার বিকল্প হিসেবে জন্ম দেয় ‘পিটার ডট কম’। সেপ্টেম্বর এ এসে আবার দিনপত্রীমূলক কমিউনিটির ওপর জোর দেওয়া হয় ‘ডায়েরিল্যান্ড’ দিয়ে। ইভান উইলিয়ামস এবং মেগ হুরিহান (পাইরা ল্যাবস) ব্লগার ডট কম চালু করেন আগষ্ট মাসে।

ব্লগগুলো বেশীরভাগই কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়সম্পর্কিত ধারাবিবরণী উপর খবরাখবর জানায়। অনেকগুলো ব্লগ আবার বেশীমাত্রায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনলাইন দিনপত্রী বা অনলাইন দিনলিপি সমুহ। একটা নিয়ম মাফিক ব্লগ লেখা, ছবি, অন্য ব্লগ, ওয়েব পেজ আর এ বিষয়ের অন্য মাধ্যমের লিংকের সমাহার।  ব্লগ পাঠকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়াময় ছাঁচ মন্তব্য করার সুবিধা বেশীরভাগ ব্লগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক।   প্রায় ব্লগই মূলত লেখার উপর আকীর্ণ। অনেকগুলো ব্লগ আবার জোর দেয় শিল্প (আর্ট ব্লগ), ছবি (ফটোব্লগ), ভিডিও (ভিডিও ব্লগিং), সঙ্গীত (এমপিথ্রিব্লগ), আর অডিওর (পডকাষ্টিং) উপর।মাইক্রোব্লগিং একটু অন্য ধরনের।

মাইক্রোব্লগিং এ খুব ছোট ছোট পোষ্ট থাকে, যেমন Twitter,   ২০০৫ সালে সামহোয়্যারইন ব্লগের হাত ধরে বাংলা ব্লগের শুরু। হাটি হাটি পা পা করে পেরিয়েগেলো অনেকগুলো বছর। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন ব্লগ সাইড। অর্জন করছে জনপ্রিয়তা। সবার মাঝে তৈরি হয়েছে ভালোবাসার সেতু বন্ধন। একে অপরকে জানতে সক্ষম হয়েছে। তথ্য আদান-প্রদান করতে পেরেছে, পারছে। অজানা অনেক ইতিহাস সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে।

এক শ্রেণীর মানুষ এখনো সংবাদ মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল। যেখানে সংবাদ পরিবেশকের উপরই নির্ভর করে পুরো সংবাদের এপিট ওপিট। কিন্তু ব্লগের লেখা একান্ত নিজের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ।

এখানে থাকে না কমার্শিয়াল চিন্তা ভাবনা, থাকে না কোন ধরনের ভয় উৎকণ্ঠা, থাকে না রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। এখানে জীবনের নানান রংগুলো নিজের মত করে একান্ত ভাবনায় শব্দ বর্ণের বর্নীল সাজে সাজিয়ে তুলে।  ব্লগার অন্য কোন গ্রহ থেকে আসা অদ্ভুত ধরনের প্রাণী নয়, নয় কোন জড় পদার্থ। ব্লগার এ গ্রহেরই একজন।   হ্যাঁ! ব্লগার একজন মানুষ। যিনি ব্লগে লেখেন বা ব্লগ পরিচালনা করেন তাকে ব্লগার বলা হয়।

বিশ্বে বহু আলোচিত ব্যাক্তিবর্গ ব্লগে লেখালেখি করেন। কারো নিজের একান্ত ব্লগ আছে, যেখানে সে নিজে লেখালেখি করেন। আবার লক্ষ লক্ষ ব্লগার সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করেন।   আর ব্লগার কোন এক গোষ্ঠির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, নয় কোন জাতি, ধর্ম, বর্ণের মধ্যে আবদ্ধ। বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ ব্লগ ব্যবহার করেন। যারা লেখালেখি পছন্দ করেন মূলত তারাই তাদের নিজের একান্ত প্রয়োজনে ব্লগ সাইড তৈরি করেন, লেখেন এবং অপরকে লেখার সুযোগ করিয়ে দেন।

উদাহরণসরূপ বলতে হয় ডা. জাকির নায়েকের কথা। তিঁনি নিজে ব্লগে লেখেন, ব্লগে পোস্ট করা অপরের লেখা ও মন্তব্য পড়েন। ব্লগ সাইডটি সবার জ্ঞানার্থে উল্লেখ্যিত (zakirnaikblog.blogspot.com)।

 ব্লগে ব্লগার তাঁর খাটি আবেগটুকু কম্পিউটারের কিবোর্ডের সহায়তায় আলাদা আলাদা বর্ণগুলোকে যুক্ত করে নিজের মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে ব্লগপোস্ট এর মাধ্যমে অনলাইনে ছড়িয়ে দেন। অগনিত ব্লগার পোস্ট করা লেখা পড়ে আবার তাঁর নিজের মতামত প্রকাশ করে মন্তব্য করার মাধ্যমে। বাংলাদেশের একঝাক তরুণ-তরুণী আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতিকে এক অভূতপূর্ণ ভাবে নতুন দিগন্তের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে তাও এই ব্লগ ব্যবহারের মাধ্যমে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০১৩ সালে এসে জাতির করণীয় নিয়ে আজ মহা জাগরণ তৈরি করেছে। বিশ্ব দেখছে অবাক দৃষ্টি নিয়ে। ভাবছে, বাঙ্গালী তরুণ-তরুণী’রা তাদের কৃষ্টি-ক্যালচার, ঐতিহ্য-ইতিহাস ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি কখন কোথায় কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, ভূলে যায়নি কিভাবে বীর-বাঙ্গালী গর্জে উঠতে হয়।

Blog2

আর এ গর্জে ওঠা, তিন মিনিটের জন্য পুরো জাতি থমকে দাঁড়ানো এবং প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে জনগণ যখন সকল অপশক্তি বিরুদ্ধে এক কাতারে, তখন শুরু হয় আবার স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রোপাগান্ডা।  ধর্মকে পূঁজি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা। সহজ সরল মানুষের ধর্মানুভূতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। ব্লগ, ব্লগার অতঃপর আস্তিক-নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের শব্দের বেড়াজালে জড়িয়ে জাতিকে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা। যে চেষ্টা হয়েছিলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও।

নাস্তিক একটি সংস্কৃত ও বৈদিক শব্দ। নাস্তিক বাংলার কোন শব্দ নয়। বাংলায় নাস্তিককে এথিস্টের সমর্থক মনে করা হয়। আমি মনে করি, যারা নাস্তিক শব্দটাকে বাংলা ভাষায় অর্ন্তভূক্ত করেছেন, তারা সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সে কারনে নাস্তিক বলতে সংস্কৃতে যা বুঝায়, বাংলায় তা বুঝানো হয় না।

আর এই সরলীকরণ ধর্মতত্ত্বের জন্য একটা বিরাাট সমস্যা, কারণ সংস্কৃতে নাস্তিক কে নীরেশ্বরবাদী বুঝায় না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যারা নাস্তিক শব্দটা আবিস্কার করেছে তাদের জন্যও নাস্তিক শব্দ ব্যবহার যথেষ্ট অস্বস্থিকর বলে প্রতিয়মান।  তবে ধর্মতাত্ত্বিক এই জটিল সমস্যা আশু সমাধান কিভাবে অন্তত এই মুহুর্তে আমার জানা নেই।   হিন্দু ধর্মতত্ত্বে নাস্তিক তাদেরকেই বুঝায়, যারা বেদের অপৌরুষেয়তায় বিশ্বাস করে না। অর্থাৎ নাস্তিক বেদকে ঐশ্বরিক গ্রন্থ মনে করে না। এর মানে এই নয় যে নাস্তিক’রা নিরীশ্বরবাদী বা ধর্মদ্রোহী।   হিন্দুদের মধ্যে যাযক পন্থীরা ধর্ম পালন করেও নাস্তিক্যবাদের চর্চা করতে পারেন। তাঁরা বেদের পশুঘাত, শ্রদ্ধাদিক্রিয়া এবং ব্রাক্ষমনের শ্রেষ্ঠত্ব মানেন না। হিন্দু ধর্মের মতে ভারতীয় দর্শনের মধ্যে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মও নাস্তিক দর্শন।

 নাস্তিক শব্দটা প্রথমে এক শ্রেণীর মানুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অবহেলা ও ঘৃণা প্রকাশের জন্য ব্যবহার করত; যা আজও বিদ্যমান।  তবে আস্তিক-নাস্তিক’দের মাঝে হাজার বছর ধরে চলে আসা তীক্ষ্ণ বিতর্ক হিন্দু ধর্মের ভিতরের কঠোরতা পরিবর্তন করেছে।  ভারতবর্ষের অহিংসার দর্শন নাস্তিক’দের অবদান। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব হওয়ার অবদান এই নাস্তিক’দের।  নাস্তিক’দের কারনেই হিন্দু ধর্ম সংস্কার এবং এর ফলে মানব জীবনের আদর্শ উন্নত হয়েছে।  আবার যুক্তি-তর্ক বিদ্যাও নাস্তিক’দের অবদান।  এথিস্টদের নিরীশ্বরবাদী বলার ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে, কারন বৌদ্ধরা নিরীশ্বরবাদী।

তাহলে নাস্তিক আসলে কি?
নাস্তিক বা এথিজম হলো স্রষ্টার অস্তিত্বহীনতা। তাঁরা বিশ্বাস করে যে, স্রষ্টা বলতে কিছু নেই। আসমান, জমিন, গ্রহ-তারা এ সবই প্রকৃতির দান। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে। প্রকৃতির কোনো নিয়ন্ত্রক নেই, স্রষ্টা নেই।   এথিজম’রা আসমানী কিতাব পবিত্র কোরআন শরীফ সহ কোনো ধর্মগ্রন্থ্যকে মানে না। সহজ ও সরল কথায় বলতে গেলে স্রষ্টার অস্তিত্বহীনতার বিশ্বাসের নাম নাস্তিকতা।   যদি কোন ব্যক্তি ইসলামের জরুরী বিষয়কে মান্য করে, কিন্তু গোনাহগার। তাহলে ঐ গোনাহের কারণে লোকটিকে কাফের বলা হারাম। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে কড়া ধমকী এসেছে।

পবিত্র কোরআন শরীফ এ সুরা নিসার ৯৪ আয়াতে মহান আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন আল্লাহ্’র পথে সফর কর, তখন যাচাই করে নিও এবং যে, তোমাদেরকে সালাম করে তাকে বলো না যে, তুমি মুসলমান নও। তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদ অন্বেষণ কর, বস্তুত: আল্লাহ্’র কাছে অনেক সম্পদ রয়েছে। তোমরাও তো এমন ছিলে ইতিপূর্বে; অত:পর আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। অতএব, এখন অনুসন্ধান করে নিও। নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের কাজ কর্মের খবর রাখেন’।

আবার হাদিসে রাসুল (স.) থেকে বর্ণিত, ‘যে ব্যক্তি কাফের না তাকে কাফের বললে, সেই কুফরী নিজের দিকে প্রত্যাবর্তন করে’। (বুখারী সহীহ-৫৬৯৮)

আর কুফরী সম্পর্কিত, ‘যখন কোন বিষয়ে ৯৯ ভাগ সম্ভাবনা থাকে কুফরীর, আর এক ভাগ সম্ভাবনা থাকে, কুফরী না হওয়ার। তাহলে মুফতি ও বিচারকের জন্য উচিৎ হল কুফরী না হওয়ার উপর আমল করা। কেননা ভূলের কারণে এক হাজার কাফের বেচে থাকার চেয়ে ভূলে একজন মুসলমান ধ্বংস হওয়া জঘন্য’। (শরহু ফিক্বহুল আকবর-১৯৯)

সুতরাং কারো কোন কাজে সন্দেহ হলেই তাকে কাফের, মুরতাদ, নাস্তিক ইত্যাদি বলে প্রচার করা হারাম।  কাফের ও মুরতাদ হওয়ার জন্য নাস্তিক হওয়া জরুরী নয়। বরং নাস্তিক না হয়েও কাফের বা মুরতাদ হতে পারে। কিন্তু নাস্তিক হলেই কাফের হয়ে যায়। আর যদি মুসলমানিত্ব থেকে নাস্তিকতার দিকে যায় তাহলে সে মুরতাদ হয়ে যায়।

আরও একটু পরিস্কার করে বললে, কাফের হলেই তাকে নাস্তিক হতে হবে এমন কোন শর্ত নেই। কারণ কাফের হল ইসলামের জরুরী বিষয়ের কোন একটি অস্বীকার করা। আর নাস্তিক মানে স্রষ্টাই অস্বীকার করা।  তাহলে কোন ব্যক্তি ইসলামের জরুরী কোন বিষয়কে অস্বীকার করে যদি স্রষ্টা আছে মানে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি কাফের কিন্তু নাস্তিক নয়।   আর এ কথার হিসাব মিলাতে গেলে খ্রীষ্টান নাস্তিক নয়। নয় ইহুদীরাও। হিন্দু বৌদ্ধরাও নাস্তিক নয়। কারণ তারা সবার স্রষ্টা আছেন একজন এই মর্মে বিশ্বাস করেন।

আমি মনে করি, যে কোন বিষয়ের উপর মন্তব্য করার আগে তা ভালো করে পর্যবেক্ষন করা অতি জরুরী। কারণ, ধার করা তথ্য শয়তানেরও হতে পারে। পৃথিবীর শুরু থেকে ষড়যন্ত্রের শুরু। শান্তির ধর্ম ইসলামকে অশান্তিতে বিষাক্ত করার ষড়যন্ত্র, আস্তিক-নাস্তিকের নামে মানবতাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র, ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মানুভূতিকে পূঁজি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার ষড়যন্ত্র, ধর্মে ধর্মে দাঙ্গা সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র বিশ্ব জুড়ে আজও বিদ্যমান।  মানুষ, মানবতা, মানবপ্রেম কে সমুন্নত রাখতে হলে আমাদের সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

লেখক :
ব্লগার কবীর চৌধুরী তন্ময়, 
সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম-বোয়াফ