এর আগে যেমন হয়নি, ২০১৪ সালেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। ২০১৫ সালেও হবে না। মার্চে হচ্ছে না, ডিসেম্বরেও হবে না। সচরাচর যেমনটি হয় সেটি হয়েছে এবং তেমনটিই হবে। ২০১৪ সালে প্রতি বছরের ডিসেম্বর মাসে যেমন হয় তেমন করে টিভির পর্দায় বিজয়ের মাস নামক লগো লাগানো হয়েছে, সব চ্যানেলেই মাস জুড়ে অনেক টকশো হচ্ছে, প্রায় সব পত্রিকার পাতায় প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে এবং ডিসেম্বর মাসটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানুয়ারির প্রথম দিন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের ইতিহাস যে তিমিরে থাকার সেই তিমিরেই চলে যাবে। জানুয়ারিতে কিছুটা চুপচাপ থাকার পর যথারীতি মিডিয়ায় ভাষার মাস জন্ম নেয় ফেব্রুয়ারিতে। রীতি মোতাবেক স্বাধীনতার মাস তো মার্চই সেটিও তেমনভাবেই চলছে। চলতেই থাকবে। ১৬ ডিসেম্বর পার হওয়ার যেমনটি হয় ২৬ মার্চ পার হওয়ার পর তেমনই হবে। এরপর ১ বৈশাখে নতুন বছরের লোগো ঝুলতে থাকবে। চমৎকার রুটিনমাফিক মিডিয়া জগৎ আমাদের। দিনে দিনে আনুষ্ঠানিকতায় আমরা পেশাদারিত্বও দেখাতে পারছি।

উবানের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর চার প্রধান

উবানের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর চার প্রধান

অন্যদিকে প্রথাগতভাবেই বাঙালির প্রবণতা হচ্ছে বিস্মৃতপরায়ণতা। যে কারণে আমরা পঁচাত্তরের কথা মনে রাখি না বা যে কারণে আমরা জিয়া-এরশাদের কুকীর্তির কথা ভুলে যাই, যে কারণে খালেদা জিয়ার দুঃশাসন এবং তারেক রহমানের দুর্নীতি আমাদের স্মরণেই থাকে না অথবা গোলাম আজম-নিজামী-মুজাহিদ-সাকাদের মর্যাদার আসনে বসাই, কিংবা যে কারণে আমরা ২০১৩ সালে জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতের জঘন্য সন্ত্রাস মনে রাখিনি, যে কারণে আমরা হয়ত ২০১৫ সালের আগুনে পোড়া মানুষগুলোকেও মনে রাখব না; সেই একই কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের কথাও ভুলে যাই। বিশেষ করে যদি বিষয়টি আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ব্যাপার হয় তবে দেখব যে, তারা প্রথাগতভাবে তাদের সামনে যে সব তথ্য বারবার উপস্থাপিত হয় কেবল সেগুলোই তারা মনে রাখে। এটাই স্বাভাবিকও বটে। এখন তিরিশ বছরের নিচে যাদের বয়স, এমন অনেককেই আমি কেবলমাত্র গেঞ্জি পরা জিয়াউর রহমানের ছবির কথা মনে করতে পারে বলে দেখে আসছি। এরশাদের কথা তারা একদম ভুলে না। কিন্তু যদি কেউ জয় বাংলার কথা বলে তাহলে ধরে নেয় এটি হলো আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান। এটি যে একাত্তর সালে পুরো জাতির স্লোগান ছিল এবং বাংলাদেশের মানুষ যে সারা দুনিয়ায় জয় বাংলার লোক হিসেবে পরিচিত হতো সেটি তারা একেবারে জানেই না। খোদ জিয়াউর রহমান যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে যুদ্ধ করেছেন সেটিও ওরা শোনেনি। কেবলমাত্র গণজাগরণ মঞ্চের সময় পুরো দেশ আরেকবার শুনেছে যে, জয় বাংলা কারো দলীয় স্লোগান নয়, যে কোনো দলের যে কোনো মানুষ জয় বাংলা স্লোগান দিতে পারে।

এমনিভাবে কেউ যদি বলে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনী নামক একটি বাহিনী ছিল তবে তারা অবাক হয়ে যায়। ওদের ধারণা কেবলমাত্র মুক্তিবাহিনী নামক একটি বাহিনীই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আর ধারণা হলো মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফের নাম শুনেছে এমন লোক হাতে গুনেও পাওয়া যায় না। মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ যে একই বাহিনী সেটিও তারা জানে না। আমাদের মিডিয়াগুলোও পারতপক্ষে প্রচলিত ধারণা এবং হাতের কাছের ইতিহাসের বাইরে কিছুই তুলে ধরতে চায় না। আমার মনে আছে, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম আমলে আমরা বিএলএফের একটি জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। একটি টিভি চ্যানেলের হয়ে সেই সম্মেলনের বক্তব্য একটি ডকুমেন্টারি আকারে তৈরি করে প্রচার করার জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। কিন্তু সেই চ্যানেল ডকুমেন্টারিটি প্রচার করেনি। তারা আমাদের জানিয়েছিলেন যে, এসব বিষয় নাকি স্পর্শকাতর। অথচ যদি কেউ কোনো না কোনোভাবে একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের দুয়েকটি পাতারও সন্ধান করে তবে তাকে এটি খুঁজে পেতেই হবে যে, একাত্তরের যুদ্ধটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ এবং সশস্ত্র পর্ব মাত্র। আমরা ঐতিহাসিকভাবে ভাষা আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি হিসেবে দেখলেও সে সব আন্দোলনে কোনোভাবেই একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রকাশ্য ঘোষণা বা সে সব আন্দোলনের লক্ষ্য তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল না। সে সব আন্দোলন এটি প্রমাণ করেছে যে, আমরা পাকিস্তানে যে কারণে থাকতে চেয়েছিলাম সেই কারণগুলোতে পাকিস্তান বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক অধিকারকে ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতিকলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ষাটের দশকে ভাষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন বা ছয় দফার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন নয়, একেবারে খুব স্পষ্ট করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নেতৃত্বে রেখে একদল তরুণের হাতে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস নামক একটি অতি ক্ষুদ্র সংগঠন। সেই সংগঠন একটি অতি ক্ষুদ্র কাঠামো থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে এবং কার্যত একটি সশস্ত্র লড়াই করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। মুজিব বাহিনীর জন্ম হয়েছে সেই স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের নেতৃত্বে এবং সেই বিপ্লবী সংস্থাটি ষাটের দশক থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, পরিকল্পনা করেছে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সব কাজই সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছে। আমরা যদি একপেশে না হই এবং কেবলমাত্র নয় মাসের লড়াইতেই বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে সীমিত না করি তবে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের কথা আমাদের অবশ্যই জানতে হবে। একই সঙ্গে জানতে হবে, মুজিব বাহিনী সম্পর্কে। এটি তেমন একটি বাহিনী যে বাহিনী প্রবাসী বা অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে ছিল না এবং জেনারেল ওসমানী এই বাহিনীর সর্বাধিনায়কও ছিলেন না। এই বাহিনী গঠনের বিষয়ে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সম্মত ছিলেন না। এমনকি এই বাহিনী মুক্তিবাহিনীর মতো সাধারণ বা অতি সহজীকৃত প্রশিক্ষণও নেয়নি। এই বাহিনীর পুরো বিষয়টি ছিল ভিন্ন মাত্রার। এই বাহিনীর প্রশিক্ষক মেজর জেনারেল (অব.) এস এস ওবান মনে করেন, এমন একটি বাহিনীর প্রয়োজন ছিল ভীষণভাবে। তিনি এমন মত প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইটা করার জন্য রাজনৈতিক সচেতনতাসম্পন্ন একটি বাহিনীর দরকার ছিল।

২৫ মার্চের পর পুরো দেশে যখন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার নামে যত লোক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় তাদের বাছাই করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ওরা কারা, কেন মুক্তিযুদ্ধে এসেছে এবং তারা অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে কি করবে সে সব বিষয়ে কোনো তথ্যই ছিল না। অনেক মুক্তিযোদ্ধা দলের বিরুদ্ধে জনগণের সম্পদ আত্মসাৎসহ নানা ধরনের অভিযোগ ছিল। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় সরকারের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে উগ্র ডান বা উগ্র বামপন্থীরা যেন যুদ্ধের সুযোগ না নিতে পারে। বিশেষ করে পিকিংপন্থী কম্যুনিস্টরা যাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে এটি উল্লেখ করা দরকার যে, এই পিকিংপন্থী রাজনীতিকরা আওয়ামী লীগকে আমেরিকা ও ভারতের দালাল হিসেবে গণ্য করে আসছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে ভারত তখন নকশালবাড়ী আন্দোলনে তটস্থ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান চীনের। বাংলাদেশের চীনপন্থীরা তাই পিকিংয়ের নীতিতে আস্থা রেখে পাকিস্তান-জামায়াত ও পাকবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। ওরা মুক্তিযোদ্ধা হলেও ভারত ও আওয়ামী লীগের বিপক্ষে লড়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল-মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী হাজার হাজার তরুণ আসলেই জানত না কেন তারা এই যুদ্ধে গেছে। কেন পাকিস্তানের বিপক্ষে লড়াই সেটাও অনেকেই জানত না। গ্রামের অতি সাধারণ তরুণ কখনো আবেগের বশে, কখনো চাপে পড়ে অথবা কখনো বীরত্ব প্রদর্শনের সুযোগ নেয়ার জন্য কিংবা কখনো কারো বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত-পারিবারিক প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ওদের প্রশিক্ষণে রাজনৈতিক মটিভেশনের সুযোগও ছিল না। তখন যদি একটি রাজনৈতিক আদর্শ সংবলিত বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের মূল স্রোতে অবস্থান না নেয় তবে প্রকৃত লড়াইটা কে করবে- এই ভাবনাটি বেশি ছিল স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস যারা তৈরি করেছিলেন তাদের। তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মী বাহিনীকে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করার একটি সঠিক পথও খুঁজছিলেন।

আরো একটি বিষয় মুজিব বাহিনীর উদ্যোক্তাদের বিবেচনায় ছিল। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটি যদি প্রলম্বিত হয় তবে সেই প্রলম্বিত যুদ্ধটি কারা করবে? মুজিব বাহিনীর সংগঠকরা নিজেরা মনে করতেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রলম্বিত হবে। তারা আরো ভেবেছেন, ২৫ মার্চের পর আকস্মিকভাবে যারা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এবং যারা নীতি ও আদর্শ বিষয়ে সচেতন ছিলেন না তাদের দিয়ে কি প্রলম্বিত যুদ্ধ করা যাবে? এ ছাড়াও তারা চিন্তা করেছিলেন, ট্রাডিশনাল ওয়ারফেয়ার কি প্রলম্বিত যুদ্ধের সহায়ক বা যদি ভিয়েতনামের মতো গেরিলা যুদ্ধ করতে হয় তবে তার জন্য কি মুজিব বাহিনীর মতো একটি বাহিনী গড়ে তোলা উচিত নয়?

যারা ষাটের দশকে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা তখন ভারত সরকারের কাছে পুরো বিষয়টি তুলে ধরেন এবং অনুরোধ করেন যেন এমন একটি বাহিনী গড়ে তোলা হয়, যে বাহিনীটি পুরোপুরি রাজনৈতিক আদর্শকে আত্মস্থ করে যুদ্ধ করবে। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক (মরহুম) এবং তোফায়েল আহমেদ ছিলেন এই বাহিনী গড়ে তোলার জন্য প্রথম চারজন উদ্যোক্তা। এর পরে ছিল একটি মধ্য পর্যায়ের নেতৃত্ব। এই নেতাদের মাঝে আসম রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরিফ আহমেদ, হাসানুল হক ইনু প্রমুখরা ছিলেন। এরপর ছিল আরো হাজার হাজার নেতাকর্মী। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে ছিল লাখ লাখ রাজনৈতিক কর্মী। প্রধানত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গড়ে তুলেছিলেন এই বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা বলতে গেলে এই বাহিনীর কথা না বলে পারা যাবে না।

আরো একটি বিষয় খুবই গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে যে এটিই ছিল বস্তুত বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ বা তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নিজস্ব একটি বাহিনী। প্রাসঙ্গিকভাবে এই প্রশ্নটিও উঠে আসতে পারে যে, আওয়ামী লীগ নিজেই কেন মুজিব বাহিনী নিয়ে কথা বলে না? এমনকি মুজিব বাহিনীর নেতারাও কেন প্রসঙ্গটি সামনে আনেন না? স্বাধীনতার এত বছর পরও কি আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব না?

এর আগে আমরা মুজিববাহিনীর গঠন সম্পর্কে আলোচনা করেছি। তবে মুজিববাহিনী গঠন করার যে সব কারণগুলো আমরা উল্লেখ করেছি তার বাইরেও আরো কিছু বিষয় ছিল যার জন্য মুজিববাহিনী গঠন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

মুজিববাহিনীর প্রশিক্ষক ও কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) এস এস ওবান তার বইতে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন যার শিরোনাম হচ্ছে মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনী। তিনি মুজিববাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোক্তাদের মুজিববাহিনী গঠন করার বিষয়ে যুক্তিগুলো তার বইতে এভাবে তুলে ধরেন, ‘যুবনেতারা বাংলাদেশের ভেতরে তাদের বিস্তৃত সংগঠনের বদৌলতে জানতে পেরেছিলেন যে, কিছু মুক্তিবাহিনী ইউনিট কিছু বদভ্যাস রপ্ত করেছে, যাদের মধ্যে কতকে সাধারণ জনগণের ওপর লুটতরাজ করেছে এবং তাদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছে, অন্যরা ব্যক্তিগত শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে।…যদিও একটি ফোর্স হিসেবে মুক্তিবাহিনী চমৎকার কাজ করেছিল, তবু মুক্তিবাহিনীর মধ্যে কেউ কেউ ছিল নিন্দনীয় এবং তারা গোটা ফোর্সের দুর্নাম সৃষ্টি করেছিল।…তাদের আরেকটি যুক্তি ছিল যে, বাংলাদেশে মুজিববাহিনী নামটার গ্রহণযোগ্যতা হবে অপরিসীম এবং এটা শুধু তাদের সংগঠন থেকেই সহায়তা বয়ে আনবে না বরং সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও সহায়তা বয়ে আনবে।’ (ওবানের বইয়ের বাংলা অনুবাদ থেকে-পৃষ্ঠা ৪০)

জেনারেল ওবানের বক্তব্যে মুক্তিবাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগের কথা বলা হয়েছে তার পরিমাণ খুব বেশি ছিল না। আমার নিজের জানা মতে, কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধা যেমন প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধে গিয়েছিল, তেমনি রাজাকার বাহিনীতেও কেউ কেউ গিয়েছিল ব্যক্তিগত-পারিবারিক কোন্দল বা দলাদলির জন্য। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্যের বৃন্তচ্যুতির জন্যই মুজিববাহিনী গঠন করা হয়েছিল এই যুক্তিটি সঠিক নয়। জেনারেল ওবানের কাছে এটি একটি কারণ মনে হলেও আমার কাছে মনে হয়েছে মুজিববাহিনী গঠনের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল রাজনৈতিক। একাত্তরের যুদ্ধের সময় একটি রাজনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও সচেতন সশস্ত্র গেরিলাবাহিনী যারা রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে সশস্ত্র লড়াই করবে তাদের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই ছিল। মুক্তিবাহিনী সাধারণ মানুষের বাহিনী ছিল বলে এর রাজনৈতিক চরিত্র নির্ণয় করাও কঠিন ছিল। যদিও ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বাইরে তেমন কোনো বড় রাজনৈতিক শক্তি ছিল না- তথাপি আওয়ামী লীগের কর্মী হলেও সে স্বাধীনতার লড়াইয়ের অর্থ বুঝবে তেমনটি হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। বরং মুক্তিবাহিনীতে যোগদানকারী ইপিআর-পুলিশ সৈনিক এবং সাধারণ মানুষের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ভিত্তিটা ততটা স্পষ্ট ছিল না।

ষাটের দশকের নিউক্লিয়াসের কথা আলোচনায় না আনলেও এটি স্পষ্ট করে বলা যায় যে, ১৯৬৯-৭০-৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে নিয়ে যাওয়ার পেছনে সিরাজুল আলম খান ও তার সহযোগী যুব নেতৃত্ব সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। জাতির জনককে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া, জয় বাংলা স্লোগানের জন্ম দেয়া, জাতীয় পতাকা তৈরি, জাতীয় সঙ্গীত বাছাই, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রস্তাব পাস, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, পতাকা উত্তোলন, জয় বাংলাবাহিনী গঠন ইত্যাদির সবটাই এই নেতৃত্বই করেছে। ওরাই যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গেছে তখন যুদ্ধের অগ্রসেনানীর জায়গাটিতে তাদের গড়ে তোলাটাই একটি অপরিহার্য বিষয় ছিল।

সমালোচকরা বলেন, মুজিববাহিনী গঠনের ব্যাপারে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহ ছিল না। তখনকার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এমন একটি বাহিনী গড়ে ওঠুক তেমনটি চাননি বলে খোদ মেজর জেনারেল ওবান তার বইতে উল্লেখ করেছেন। মুজিববাহিনীর নেতারা তাজউদ্দিন আহমেদ শেখ মুজিবের বিপক্ষে কাজ করছেন তেমন অভিযোগও নাকি করেছেন। কিন্তু তাজউদ্দিন আহমেদে জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, তার মতো বিশ্বস্ত মুজিবভক্ত আর একটিও ছিল না। ওবান তার বইতে মুজিববাহিনী নিয়ে ভারত সরকার এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গেও নানাভাবে সংকটাপন্ন হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ওবানের বইতে মুজিববাহিনীর কৃতিত্ব হিসেবে তার চট্টগ্রাম অপারেশন্স যেমন উল্লিখিত হয়েছে তেমনি উল্লিখিত হয়েছে মুজিববাহিনীর শক্তি-সাহস, প্রজ্ঞা, মেধা ও দেশপ্রেমের বিষয়টি।

মুজিববাহিনী সম্পর্কে উইকিপিডিয়াতে বলা আছে,

Mujib Bahini was a special force created by the and composed of 60,000 young supporters of the liberation movement. It was organised with the active assistance of of the . Student League leaders and ; ; and were the organizers of this special force. It is alleged that this force was formed during the concluding part of Liberation War according to the policy of Awami League and the ally, India, aimed against the leftist freedom fighters to bar them from taking the lead in the War.

অন্যদিকে বাংলাপিডিয়াতে বলা হয়েছে,

Mujib Bahini was formed during the . It was mainly composed of activists drawn from the and its student front Chhatra League. It had enlisted about 5000 members who were posted out to four sectors with a 19-member central command. Initially, the sector commanders operated from Barrackpur, Shiliguri, Agartala and Meghalaya of India. Tofail Ahmed, Sirajul Alam Khan, Abdur Razzak and were the central commanders with Moni acting as the commander-in-chief. This force was trained under the direct supervision of Major General Uban of India at Deradun hills.

The was not said to have been informed about the formation and training programmes of Mujib Bahini. Besides, the Bahini never made formal declaration of allegiance to the Mujibnagar government. So, controversies were created within and outside the Bangladesh government-in-exile regarding the formation of Mujib Bahini. For resolving this dispute, some senior civil and military officials of India like DP Dhar and General Manek Shaw mediated between the Bangladesh government and the Mujib Bahini leaders. The government of India provided the Bahini with one C-4, one N-12 and an old Dakota along with trucks and jeeps.

Many believe that Mujib Bahini was formed to face the emergence of any alternative leadership in the event the liberation war was prolonged. Others think that the leaders of Mujib Bahini created this force because they were not satisfied with the working of Mujibnagar government and were suspicious about the activities of the rightist faction of the Awami League.

In the battlefield, the Mujib Bahini fought shoulder to shoulder with other freedom fighters. It carried out daring raids into the Pakistani occupation army’s positions in the south, the south-west and some areas around Dhaka. It was especially trained in guerrilla warfare and was equipped with comparatively better weapons.

The concept of Mujib Bahini appears to have been developed in the middle of 1960s. It remained as an academic theme for a long time within the confines of Dhaka University and among some nationalist intellectuals. It is the core members of the Mujib Bahini who forged the Sarbadaliya Chhatra Sangram Parishad and who enunciated eleven-point programme in 1969. They also led the mass uprising of 1969. It is this group which led the nationalist struggle for independence from 1 March 1971, declared independence on 3 March at Paltan Maidan and organised subsequent preparations for an eventual War of Liberation. [Helal Uddin Ahmed]

মুক্তিযুদ্ধটি শেষ হওয়ার চার দশক পার হওয়ার পরও এই বাহিনী সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না। ভবিষ্যতে হয়ত আরো কম তথ্য পাওয়া যাবে। এরই মাঝে মুজিববাহিনীর দুজন সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনি ও আব্দুর রাজ্জাক মারা গেছেন। মুজিববাহিনীর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত কাজি আরেফও আর নেই। নেই ড. আফতাব আহমদসহ আরো অনেক সদস্য ও নেতা। বাকিরা জীবিত থাকলেও তারা এসব বিষয়ে তেমন কোনো কথা বলেন না। আমি নিজে এই বাহিনীর অতি সাধারণ একজন কর্মী ছিলাম বলে আমি স্মরণ করতে পারি যে, এই বাহিনী গঠনের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক যুদ্ধ করা, যার রণকৌশল হতো গেরিলা কায়দার। জেনারেল ওবান গেরিলা যুদ্ধের বিশেষজ্ঞ ছিলেন বলেই তাকে এই বাহিনী সংগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। একাত্তরে আমার তো আর দিল্লির খবর জানার ক্ষমতা ছিল না। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ের চাইতে দিল্লির দূরত্ব যেমন বেশি ছিল তেমনি ছিল অতি নিচু পর্যায়ের একজন ক্ষুদ্র দেশপ্রেমিক তরুণের দিল্লির লাড্ডুর খবর পাওয়ার ক্ষুদ্রতা। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যে বন্ধুরা ছিল তাদের সঙ্গেও থাকতে পারতাম তবে হয়ত এখন ব্যাখ্যা করতে পারতাম ওবান কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যা বলেছেন। আমি পাহাড়ে বসে এমন কথাই শুনেছিলাম যে, আমাদের যুদ্ধটি দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং আমাদের ভারতে থেকে নয়, নিজের দেশে থেকেই যুদ্ধ করতে হবে। আমাকে এটিও বলা হয়েছিল যে, ভারতের অস্ত্র নিয়েও যুদ্ধ করা যাবে না- আমাদের দেশের ভেতরে থেকে পাকিস্তানিদের হাতিয়ার কেড়ে নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। এমনকি দেশের ভেতরেই প্রশিক্ষণ এবং দেশের ভেতর থেকেই যোদ্ধা সংগ্রহ করার লক্ষ্য দিয়েই আমাদের দেশের ভেতরে আসতে বলা হয়েছিল। আমার বন্ধুরা ১৬ ডিসেম্বরের আগেই ঢাকা পৌঁছে গিয়েছিল এবং ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে বিভিন্ন ধরনের সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের অপারেশন করেছিল। মুজিব বাহিনীতে দশ থেকে ষাট হাজার পর্যন্ত মানুষ যুক্ত ছিল বলে মনে করা হয়। এদের অনেকেই দেশের ভেতরে যুদ্ধ করলেও বস্তুত যুদ্ধটা ব্যাপকভাবে করার সময়টা যখন ডিসেম্বর মাসে এসে যায় তখন তো ভারত সরাসরি যুদ্ধেই জড়িয়ে পড়ে।

যদি এমন হতো যে, যুদ্ধটা প্রলম্বিত হয়েছে- যেমনটি হয়েছিল ইন্দোচীনে, তবে তার গতিপ্রকৃতি এবং প্রকৃত রাজনৈতিক পোলারাইজেশন কিন্তু অন্যরকম হতে পারত। মুক্তিবাহিনী একটি রাজনৈতিক বাহিনী না হওয়ার ফলে মুক্তিযুদ্ধের পরে এই বাহিনী তার রাজনৈতিক লড়াইটা শেষ করতে পারেনি। মনে করা হয়ে থাকে যে, নয় মাসের জন্য খণ্ডকালীন একটি কাজে আমরা যোগ দিয়েছিলাম এবং নয় মাস পর সেই কাজটি শেষ হয়ে গেল; যেন একটি প্রকল্প শেষ হলো। মনে করা হয়ে থাকে যে, নানা স্থান থেকে আসা মানুষরা একটি কাজ সম্পন্ন করে আবার তাদের স্ব স্ব কাজে ফিরে গেল। আমি মনে করি, আমাদের ক্ষেত্রেও এই ঘটনাটা ঘটেছিল। জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করে এই মানুষদের একটি সংগঠিত বাহিনীতে একত্রিত করার চেষ্টা ছিল বটে। কিন্তু একদিকে রক্ষীবাহিনীতে অতি সামান্য সংখ্যক যোদ্ধাকে ঠাঁই দেয়া সম্ভব হয়েছিল এবং অন্যদিকে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর সেই প্রচেষ্টা একবারেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পরপরই এদের সংগঠিত করে রাখার তেমন জোরালো কোনো প্রচেষ্টা ছিল না। কেবল মুজিব বাহিনীর একটি অংশ রাজনৈতিকভাবে জাসদ হিসেবে সংঘবদ্ধ হয়েছিল। জাসদ গঠন সঠিক ছিল কিনা সেটি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে তবে এর বাইরে বিশেষ করে আওয়ামী লীগে মুজিব বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে একত্রিত করার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনীতির জন্য একটি বড় মুষ্টাঘাত ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি সচেতন এই মুজিববাহিনীর প্রায় পুরোটাই জাসদ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে এবং যে মুজিবের নামে এই বাহিনীর জন্ম হয়েছিল সেই মুজিবের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। অন্যথায় মুজিববাহিনী স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতির একটি কেন্দ্রবিন্দুই থেকে যেতে পারত, যেমনটা তারা স্বাধীনতার আগে ছিল।

জাসদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি তার বইতে মুজিববাহিনী সম্পর্কে লিখেছেন, “মনি-সিরাজ-রাজ্জাক-তোফায়েল- এই চার যুবনেতা বসে ছিলেন না। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় ব্যানার্জি নামের এক ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়। তার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানের দেখা হয়। তিনি ছিলেন স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের ইন্সপেক্টর জেনারেল। তাকে অপ্রচলিত (গেরিলা) যুদ্ধের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেখা হতো। তাকে বাংলাদেশের তরুণদের বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়। জেনারেল উবান স্বাধীনভাবেই তার দায়িত্ব পালন করার প্রতিশ্রæতি পেয়েছিলেন। তাকে জবাবদিহি করতে হতো ভারত সরকারের সচিব রামেশ^র নাথ কাওয়ের কাছে। কাও ছিলেন একই সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এরও (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং) পরিচালক। সংস্থাটি ১৯৬৮ সালে সিআই এ (যুক্তরাষ্ট্র) এবং এমআই সিক্স (যুক্তরাজ্য)-এর আদলে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এর প্রথম প্রকল্পটির নাম ‘বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে অসামান্য সাফল্য, তার পেছনে ‘র’-এর অবদান ছিল অনেকখানি।”

নানা সমীকরণে ভারতের সেনাবাহিনীর এমন একটি বাহিনীর প্রয়োজন ছিল যেটি রাজনীতি সচেতন, মুজিবের অনুগত, সাহসী ও প্রজ্ঞাবান। অন্যদিকে ২ মার্চের আগে যারা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে চাননি।

এ প্রসঙ্গে উবানের বক্তব্য এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে :

“গোলযোগের অশান্ত দিনগুলোতে আমরা একদল নিবেদিতপ্রাণ যুবনেতার কথা জানতে পারলাম, যারা বাংলাদেশে বেশ পরিচিত। তারা হলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। তাদের মনে হলো অত্যন্ত অনুপ্রাণিত করতে অথবা মরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তাদের নেতৃত্বে গ্রহণযোগ্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, অস্থায়ী সরকার এদের তেমন মর্যাদা দিতে প্রস্তুত ছিল না। তারা চাইছিলেন, এরা মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে ও যুদ্ধে অংশ নেবে। কিন্তু এই যুব নেতাদের তাতে দৃঢ় আপত্তি ছিল। (মুজিবের প্রতি তাদের গভীরতার আনুগত্যের ও নৈকট্যের কারণে তারা সবাই পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জেল খেটেছেন মুজিবের সঙ্গে) তারা মুজিববাহিনী নামে অভিহিত হতে পছন্দ করলেন। তারা তাদের পুরনো সহকর্মীদের ক্যাডার হিসেবে বেছে বেছে সত্যায়িত করলেন।

ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারি শ্রী আর এন কাও এ সময় আমার ঊর্ধ্বতন সিভিলিয়ান কর্মকর্তা ছিলেন। আওয়ামী লীগের যুব উইংয়ের নেতৃত্বে এবং খোদ সংগঠনটি সম্পর্কে বিস্তারিত গোয়েন্দা তথ্য জানার সুযোগ তার হয়েছিল। তার গভীর উপলব্ধি ছিল যে, তিনি আমার তত্ত্বাবধানে যে যুবনেতাদের দিয়েছিলেন, কেবল তাদের দ্বারাই আসল কাজটি হবে এবং তাদের বাংলাদেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর রাজনৈতিক অঞ্চলে কাজ করার জন্য বিশেষ মর্যাদা দেয়া দরকার। তিনি তাদের প্রতি অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীদের ঈর্ষার কথা জানতেন তাদের আপসহীন মনোভাবের জন্য এবং মন্ত্রীদের উচ্চাকাক্সক্ষা ও অভিসন্ধির জন্য।”

যুব নেতাদের সম্পর্কে উবানের ধারণা ছিল অত্যন্ত উঁচু। বিএলএফের প্রধান দুই নেতা সম্পর্কে তার মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। শেখ ফজলুল হক মনি সম্পর্কে তিনি বলছেন : ‘হালকা-পাতলা গড়নের মানুষটি যেন এক জ¦লন্ত মশাল। তাদের স্বাভাবিক নেতা বলে মনে হতো তাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এবং যে কোনো আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিলেন তিনি। তোফায়েল ও রাজ্জাক তাকে শ্রদ্ধা করতেন। সিরাজও তা করতেন, কিন্তু মাত্র অল্প পরিমাণে। প্রায়ই আলোচনা গরম হয়ে উঠত। সিরাজ অপেক্ষা করতে চাইতেন না। কিন্তু সব সময় তারা একটা টিম হয়ে কাজ করতেন এবং যৌথ নেতৃত্বের ভালো উদাহরণ তুলে ধরতেন। তিনি র‌্যাডিকেল ধ্যানধারণা পোষণ করতেন। আপসহীন মনোভাবের ছিলেন। যুদ্ধ করতেন বাঘের মতো। কাজ করতেন নিবেদিতপ্রাণ ক্রীতদাসের মতো। একসঙ্গে অনেকদিন তিনি না খেয়ে না ঘুমিয়ে শুধু চায়ের ওপর থাকতে পারতেন। বক্তৃতা দিতে তিনি পছন্দ করতেন না। কথা এমন বলতেন যে, বোঝা যেত তিনি কাজের লোক, কথার নয়। তৃণমূল কর্মীর মতো তিনি কথা বলতেন। তিনি প্রচার অপছন্দ করতেন। মুখ বুজে কাজ করে যেতে চাইতেন। চিরকুমার। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার ধরন ছিল আক্রমণাত্মক। তিনি এমন মানুষ যাঁকে ভালোবাসতে হয়। তিনি আত্মোৎসর্গের প্রতীক। আমার শুধু এই ভয়ই ছিল যে দারিদ্র্যমুক্তির পথের ধীরগতিতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারবেন না এবং হয়ত রূঢ় ও অগ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে অপ্রিয় হয়ে যাবেন।

মহিউদ্দিন আহমদ রিখেছেন, ‘বিএলএফের (তখনো মুজিব বাহিনী নামকরণ হয়নি) প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছিল উবানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের (এসএফএল) একদল প্রশিক্ষকের হাতে। এর দুটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছিল, একটা দেরাদুনের চাকরাতা, অন্যটি আসামের হাফলং। প্রশিক্ষণার্থী বাছাই করার জন্য চারটি ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এগুলোর অবস্থান ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য ব্যারাকপুর। আঞ্চলিক অধিনায়ক ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। তার সহকারী ছিলেন নূরে আলম জিকু। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ট্রানজিট ক্যাম্প ছিল জলপাইগুড়ির কাছে পাংগা নামক স্থানে। এই অঞ্চলের অধিনায়ক ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তার সহকারী ছিলেন মনিরুল ইসলাম। মধ্যাঞ্চলের ক্যাম্প ছিল মেঘালয়ের তুরা শহরে। এই অঞ্চলের অধিনায়ক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। তার সহকারী ছিলেন সৈয়দ আহমদ। পূর্বাঞ্চলের (ঢাকাসহ) ক্যাম্প ছিল আগরতলায়। এই অঞ্চলের অধিনায়ক ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। সহকারী ছিলেন আ স ম আব্দুর রব। কাজী আরেফ ছিলেন বিএলএফের গোয়েন্দা প্রধান। বিএলএফের পক্ষ থেকে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার কাজটি করতেন শাজাহান সিরাজ। চার যুবনেতা নিজেদের নতুন নামকরণ করলেন। তারা নতুন নামেই অনেক জায়গায় নিজেদের পরিচয় দিতেন। নামগুলো সংক্ষেপে ছিল মনো (মনি), সরোজ (সিরাজ), রাজু (রাজ্জাক) ও তপন (তোফায়েল)। বিএলএফের চার আঞ্চলিক অধিনায়ককে লে. জেনারেল মর্যাদা ও প্রটোকল দেয়া হয়েছিল।

প্রশিক্ষণার্থী বাছাই করা হতো মূলত ছাত্রলীগের সদস্যদের মধ্য থেকে। এ ছাড়া শ্রমিক লীগের অনেক সদস্যকেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজটি শুরু হয় মে মাসের শেষ সপ্তাহে এবং তা একটানা চলে অক্টোবর পর্যন্ত। প্রশিক্ষণ ছিল ছয় সপ্তাহের। প্রশিক্ষণে হালকা ও মাঝারি অস্ত্র চালনা, বিস্ফোরক তৈরি ও পরিকল্পনা- এই তিনটি বিষয়েই গুরুত্ব দেয়া হয়। মোট কতজন প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন, তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি। উবানের হিসাব মতে সংখ্যাটি ১০ হাজার। প্রকৃত সংখ্যাটি ছিল সাত হাজার। নির্দেশ ছিল, প্রশিক্ষণ শেষে দেশের ভেতরে গিয়ে প্রত্যেক সদস্য আরো ১০ জনকে প্রশিক্ষণ দেবেন এবং এভাবেই ৭০ হাজার সদস্যের একটি যোদ্ধা বাহিনী গড়ে উঠবে। দেশের ভেতরে গিয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের খুঁজে বের করা, চারটি বেইস ক্যাম্প চালানো, প্রশিক্ষণার্থীদের বেইস ক্যাম্পে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা ইত্যাদির খরচ মেটানোর জন্য ৭৬ লাখ টাকার একটা বাজেট তৈরি করে উবানের হাতে দেয়া হয়। বরাদ্দ হয়েছিল ৭০ লাখের কিছু বেশি। কয়েক কিস্তিতে টাকাটা দেয়া হয়।

অস্ত্র চালনার পাশাপাশি রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছিল। ছাত্রলীগের চারজন নেতাকে প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়মিত রাজনৈতিক পাঠ দেয়ার জন্য বাছাই করা হয়। তারা হলেন হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আ ফ ম মাহবুবুল হক ও মাসুদ আহমেদ রুমি। তারা সবাই ছিলেন সিরাজপন্থী।

আওয়ামী লীগের নেতারা প্রথাগত সরকার-পদ্ধতির বাইরে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ পাননি। তাদের অনেকেই মনে করতেন, দলের মধ্যকার ‘চরমপন্থী যুবকদের হঠকারী কার্যকলাপের’ ফলেই তাদের ভারতের মাটিতে এত কষ্ট করতে হচ্ছে। এ জন্য তারা বিএলএফের ব্যাপারে খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। সেক্টর কমান্ডাররা, যারা অস্থায়ী সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন, বিএলএফের ব্যাপারে তাদেরও অনেক ক্ষোভ ছিল। তারা যুবকদের জন্য যার যার সেক্টরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তাদের হাতে সম্পদ ছিল অপ্রতুল। অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ছিল না বললেই চলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা পাঁচ-ছয় দিনের একটা মামুলি প্রশিক্ষণের পর তরুণদের নামমাত্র অস্ত্র দিয়ে দেশের ভেতরে পাঠিয়ে দিতেন। তারা চেয়েছিলেন বিএলএফ আলাদা বাহিনী হিসেবে না থেকে তাদের কমান্ডে থাকুক। তারা এটা বুঝতে অক্ষম ছিলেন যে বিএলএফ প্রথাগত সেনাবাহিনী নয়, এটা একটা রাজনৈতিক সংগঠন। তাজউদ্দীন বিএলএফের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কিন্তু তিনি না পারতেন এদের তার নিয়ন্ত্রণে আনতে, না পারতেন এদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে। তিনি ভালো করেই জানতেন, বিএলএফ ছিল শেখ মুজিবের নির্দেশিত একটি ‘অপশন’। এ প্রসঙ্গে এক আলাপচারিতায় আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন:

১৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাদের চারজন- মনি ভাই, সিরাজ ভাই, আমি আর তোফায়েলকে ডাকলেন।

ব্রিফিং দিলেন : ‘ওরা আমাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না, তোমার প্রস্তুতি সংঘবদ্ধ করো, সশস্ত্র বিপ্লব করে দেশ স্বাধীন করতে হবে।’ তাজউদ্দীন ভাই একা উপস্থিত ছিলেন। আরো বললেন, আমি না থাকলে এই তাজউদ্দীন হবে তোমাদের নেতা।”

মহিউদ্দিন আহমদ তার বইতে মুজিববাহিনী সম্পর্কে বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন। বিশেষ করে মুজিব বাহিনী গঠন ও তার কার্যক্রম নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হতে পারে। তার মতে, ভুল বোঝাবুঝির জন্য মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মাঝে বেশ কয়েক স্থানে সংঘাত হয়। বিশেষ করে তিনি ২ নম্বর সেক্টরের কথা উল্লেখ করেছেন।

তিনি লিখেছেন, ‘বিএলএফের পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে মেজর খালেদ মোশাররফের বাহিনীর কোনো বোঝাপড়া ছিল না। মনি ছিলেন তাজউদ্দীন সরকারের প্রচণ্ডরকম বিরোধী। তাঁর অভিযোগ ছিল, খালেদ তাঁর সেক্টরে বামপন্থী ছাত্রদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিচ্ছেন। দেশের অন্য তিনটি অঞ্চলে এ ধরনের কোনো সংঘাত ছিল না। সে সব অঞ্চলে তাঁরা সবাই পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করতেন। দেখা গেছে, অনেক জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান নেতা ছিলেন বিএলএফের কমান্ডার। খুলনা, যশোর, বগুড়া, রংপুর- এসব জেলায় বিএলএফের জেলা ও মহকুমা কমান্ডারা সব মুক্তিযোদ্ধারই নেতৃত্ব দিয়েছেন। সে সব জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোনো বিভাজন ছিল না।’

২ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের বাহিনীর সঙ্গে বিএলএফের একটি দলের সংঘর্ষ হয়েছিল। বিষয়টি সুরাহা করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী আইনউদ্দিনের কাছে গেলে তিনি বাংলাদেশ সরকারের একটা চিঠি দেখান। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমাদের সরকারি বাহিনীর অনুমতি ছাড়া কেউই সশস্ত্র অবস্থায় দেশের ভেতরে যেতে পারবে না। এ ব্যাপারে উবানের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লে. জেনারেল অরোরার কথা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, সীমান্তের ভেতরে ২০ মাইল পর্যন্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনী কার্যকর থাকবে এবং বিএলএফ দেশের অভ্যন্তরে দায়িত্ব পালন করবে। দেশের ভেতরে যাতায়াতের জন্য সীমান্তে বিএলএফের সদস্যরা নির্দিষ্ট কয়েকটা করিডর ব্যবহার করবেন।’

বামপন্থীদের ব্যাপারে প্রবাসী সরকারের উৎকণ্ঠা ছিল। বামপন্থীদের অভিযোগ ছিল, বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে বামপন্থী, বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। বিএলএফের নেতারাও সতর্ক ছিলেন, যাতে বামপন্থীরা ভাতরীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র না পায়।

এই প্রসঙ্গে আমরা জেনারেল ওবানের বই থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারি; ওবান লিখেছেন-

“যুবনেতাগণ : স্যার, আমরা আশা করিনি আপনারা নকশালপন্থী ও মার্ক্সবাদীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রপাতি দেবেন, যাতে আমরা গত ২৫ বছরে যা অর্জন করেছি তা বরবাদ হয়ে যায়। উবান : আপনারা এসব কী বলছেন?

যুবনেতাগণ : আপনি বলতে চান আপনি জানেন না যে নকশালপন্থীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রপাতি দেয়া হচ্ছে… (একটা জায়গার নাম বলে) জায়গায় এবং ভারতীয় কর্মকর্তারা তাঁদের নেতাদের প্রথম শ্রেণির ভারতীয় হোটেলে রাখছেন ও তাঁদের সঙ্গে গল্পগুজব করছেন।

উবান : আমি এমন আজগুবি কথা আগে শুনিনি। আমি সব সময় ভেবেছি, শত্রুর দালাল আমাদের মধ্যে ভাঙন ধরাবে। এখন বলেন, আপনাদের মধ্যে এসব গুজব কারা ছড়াচ্ছে?

যুবনেতাগণ : আমরা আমাদের নিজেদের চোখে দেখেছি এবং নিজেদের কানে শুনেছি। আমাদের মন ভেঙে গেছে। দয়া করে খবর নিন এবং আমাদের আপনার সরকারের পলিসি জানান। রাশিয়াপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির কথা না হয় বোঝা যায়, তারা পুনর্গঠিত হলে যা কিছু হোক কেবল কাগজে-কলমে বিদ্যমান থাকবে। কিন্তু চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি?

জেনারেল উবান যুবনেতাদের মনোভাব আর এন কাওকে জানালেন। কাও উবানকে অবাক করে দিয়ে বললেন যে, বাস্তবিকই মওলানা ভাসানীর লোকজন কোনো এক স্থানে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করা হচ্ছে না। তাঁরা ভাসানীর লোকদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মস্ত সম্পদ হিসেবে দেখছেন। কাও উবানকে পরামর্শ দিলেন, ‘দয়া করে আপনার যুবনেতাদের বলুন যে পছন্দ না করলেও এটা তাদের গিলতে হবে। আমরা তাদের সমর্থন দেব শুধু সামগ্রিক প্রকল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে, একটা স্বাধীন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে নয়।’ উবান যুবনেতাদের বললেন যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এমন সবাইকে সাহায্য করছে তাদের নিজেদের অস্থায়ী সরকারের সুপারিশ অনুযায়ী। কিছু অবাঞ্ছিত লোক এর সুযোগ নিতে পারে এবং এ কারণে তাদের দিগুণ সতর্ক থাকতে হবে।”

মহিউদ্দিন আহমেদ মুজিববাহিনীর ভেতরের অনেক তথ্য দিয়েছেন এবং এর ফলে এই বাহিনীটি সম্পর্কে অনেক ভালো ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

আলোচনায় ভাসানীপন্থী বা চীনের প্রতি অনুরক্তদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার কিঞ্চিত আভাষ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন ঘরানার অংশগ্রহণ করার বিষয়ে তেমন কোনো আলোকপাত নেই। গত ২৩ মার্চ ২০১৫ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায় যে, ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও একটি বিশেষ গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। খবরে বলা হয়, “মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিবাহিনী গঠনের শুরু থেকে ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেন। একাত্তরের মে মাসে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন ‘সশস্ত্র সংগ্রামে নিজ উদ্যোগে পরিপূর্ণ অংশগ্রহণের’ সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ বিশেষ গেরিলাবাহিনী গঠন করা হয়। ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের সাহায্যের ফলে গেরিলাবাহিনী প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পায়।

বিশেষ গেরিলাবাহিনীর প্রশিক্ষণ নেয়ার প্রধান স্থান ছিল ভারতের আসাম রাজ্যের তেজপুরে। এ ছাড়া ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রতিবেদন অনুসারে, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে প্রায় ১৭ হাজার তরুণ মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেন। এর মধ্যে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন প্রায় ১২ হাজার, বিশেষ গেরিলা বাহিনীতে ছিলেন প্রায় পাঁচ হাজার।”

খবরে এই বাহিনীর সদস্যদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। খবরটিতে বলা হয়, “মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য। এতে বলা হয়, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলাবাহিনীর সদস্যদের রাষ্ট্রীয় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া বর্তমানে এক অসম্মানজনক ও অমর্যাদকর অবস্থায় রয়েছে। এ কার্যক্রম দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তির সংহতিকে দুর্বল করছে।

সমাবেশে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর একমাত্র জীবিত সদস্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে সম্মাননা জানানো হয়। তবে ৯৩ বছর বয়সী এ রাজনীতিক অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বাংলাদেশ বাম রাজনীতির বিকাশ ও মুক্তিযুদ্ধসহ এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অবদানের কথা স্মরণ করে মোজাফফর আহমদকে এ সম্মাননা দেয়া হচ্ছে।

সমাবেশে প্রবীণ রাজনীতিক অজয় রায়, সিপিবির উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান, বিশেষ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার শাহ আলমসহ শতাধিক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন। পরে একটি মিছিল দোয়েল চত্বর-প্রেসক্লাব ঘুরে পল্টন মোড়ে শেষ হয়।”

বস্তুতপক্ষে ১৯৭১ সালে একটি সর্বজনীন মুক্তিযুদ্ধ হলেও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনসহ আরো অনেকেই তাদের নিজস্ব পরিচিতি নিয়ে বিশেষভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। মুজিববাহিনী তেমন একটি বাহিনী। স্বাধীনতার এত বছর পরও এই বাহিনীর কোনো স্বীকৃতি নেই। এই বাহিনীর কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও বেশির ভাগই কোনো ধরনের স্বীকৃতিও পাননি। অনেকেই সনদপত্রের জন্য আবেদনও করেননি।

মুজিববাহিনীর এই অবস্থার জন্য সবার আগেই বলতে হবে যে, এই বাহিনীর সদস্যরা স্বাধীনতার পরপরই রাষ্ট্রীয় আনুক‚ল্যের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করে। প্রথমে এদের বৃহৎ অংশটি জাসদে যোগ দেয়। পঁচাত্তরের পর জিয়াউর রহমান সবার আগে জাসদকে বিপন্ন করে। এরপর এরশাদ একটি জগাখিচুড়ি অবস্থায় দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে কোনো তাল সামলাতে পারেনি। বেগম জিয়া কোনোভাবেই মুজিববাহিনীর প্রতি সদয় হবেন এমনটি ভাবা যায় না। এমনকি বর্তমান সরকারও মুজিববাহিনীকে তার প্রাপ্য সম্মান প্রদানে আগ্রহী হবে সেটিও মনে করা যায় না। ফলে আমার ধারণা মুজিববাহিনী নামক এই বাহিনীটি স্বীকৃতিহীন একটি যোদ্ধালীগই হয়ে থাকবে। লীগ বলছি এ জন্য যে, দেশের বিদ্যমান রাজনীতিতে এই বাহিনীটিকে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবেই নিজেদের পরিচিত করতে হবে। কারণ ওরা জিয়া-এরশাদের রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মানসিকতায় নেই।

খুশি হতে পারতাম যদি মুজিব বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হতো। এখনো তোফায়েল আহমেদ ও সিরাজুল আলম খান বেঁচে আছেন। সিরাজুল আলম খান রাজনীতিতে হারিয়ে গেলেও তোফায়েল অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে রাজনীতিতে আছেন। আমি অন্তত তার কাছে প্রত্যাশা করি যেন তিনি তার হাতে গড়া বাহিনীর সদস্যদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদাটুকু দিয়ে যেতে পারেন।

মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট।