১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারি এক সরকারি ঘোষণায় বলা হয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন আহবান করেছেন ।কিছুটা দেরীতে হলেও অধিবেশন আহবান করায় পিডিপি,ন্যাপ, (মোজাফফর) এই ঘোষণাকে স্বাগত জানায় ।আওয়ামী লীগ এই ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন মন্ত্যব করেনি ।তবে অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করে দেয় ।খুশি হয় বাঙালিরা ।সকলেই আগ্রহ ভরে অপেক্ষায় থাকে ।

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই পহেলা মার্চ দুপুর একটায় এক বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান ৩মার্চ আনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন স্হগিত ঘোষনা করেন ।ঐ সময় হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের পার্লমেন্টারি বোর্ডের সভা চলছিল ।ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই হোটেল পূর্বাণীর সামনে জনতার ঢল নামে ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনতার উদ্দশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে ২মার্চ ঢাকায় ও ৩মার্চ সমগ্র বাংলাদেশে হরতাল আহবান করেন ।৩মার্চ সারাদেশের মত বাজিতপুরেও সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয় ।৭মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর বাজিতপুরে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য পরিষদ গঠন করা হয় ।এই সময় ছাত্রদের মাঝে যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন,তাদের মাঝে অন্যতম ছিলেন-ছাত্রলীগের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান,শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আঃকরিম,রফিকুল ইসলাম, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মিজবাহ উদ্দিন আহমেদ,মুস্তাফিজুর রহমান, আঃরহমান বোরহান,ছাত্র ইউনিয়নের শেখ এ কে এম নূরুন্নবী,মোঃ হাবিবুর রহমান, আহমদ আলী্‌,ফরিদ আহাম্মদ সহ আরো অনেকে ।তখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মরহুম এডভোকেট ফারুক ওমর ঢাকা থেকে এসে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে বিশেষ সভা সমাবেশ করতেন ।

মার্চ মাসের মাঝা মাঝি সময়ে বাজিতপুরে ৭০ এর প্রাদেশিক পরিষদে বিজয়ী MPA  জনাব মনজুর আহমেদকে সভাপতি এবং বাজিতপুর থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন  সম্পাদক মরহুম ওয়াজেদ আলী শাহ-কে (মুসা মিয়া)সাধারন সম্পাদক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় । সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য সদস্যগণ ছিলেন-বলিয়ারদী ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব আঃ হাই,পৌ্র কমিশনার সদু মিয়া,বিশিষ্ট রাজনৈ্তিক ব্যক্তিত্ব ইন্দ্র ভূষণ চক্রবর্তী,শহীদ ইন্দু দাস,রাধেশ্যাম চৌধুরী,অধ্যাপক ইয়াকুব আলী ও অধ্যাপক আঃমজিদ,কৃষক নেতা আনিসুর রহমান ও বিশিষ্ট সাংবাদিক ইনসাফ উদ্দিন ।বাজিতপুরের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই কমিটির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ।সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে MPA মনজুর আহমেদ এর বাড়ীতে একটি সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম খোলা হয় এবং সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয় প্রবীণ রাজনৈ্তিক ব্যক্তিত্ব ইন্দ্রভূষণ চক্রবর্তীকে ।বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব শহীদ ইন্দু দাসের তও্বাবধানে বাজিতপুর ডাকবাংলার মাঠে উৎসাহী যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্হা করা হয় ।সামরিক প্রশিক্ষক ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য শহীদ হোসেন আলী ও আঃ সাওার ।এক পর্যায়ে বাজিতপুর থানা থেকে ১৮টি রাইফেল এনে যুবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করা হয় ।ঐ সময় বাজিতপুরের অফিস আদালতসহ সরকারি যাবতীয় কাজকর্ম সংগ্রাম পরিষদের তও্বাবধানে পরিচালিত হতো ।২৬মার্চ বাজিতপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা উওোলন করা হয় ।বাজিতপুরের মত সরারচরেও সরারচর হাই স্কুলের শিক্ষক শাহ মজলুল হককে সভাপতি করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় ।কমিটির অন্যান্য সদস্যগণের মাঝে মাছিমপুরের আবুল হাশেম,ধুবিপাথরের ইসমাইল ব্যানার্জী,সরারচর ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মরহুম মতিউর রহমান ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পতিত পবন সাহা ছিলেন অন্যতম ।

এদিকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তৎকালীন মেজর (পরে মেজর জেনারেল) কে,এম শফিউল্লাহ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল নিয়ে ২৭ মার্চ কিশোরগঞ্জ শহরে সদর দপ্তর স্হাপন করে অবস্হান নেন ।অন্যদিকে ২৮ মার্চ তৎকালীন ক্যাপ্টেন নাসি্মের (পরে লেঃ জেনারেল) নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরো একটি দল জয়দেবপুর সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ ঘোষনা করে ট্রেনযোগে ভৈ্রববাজার এসে অবস্হান গ্রহন করেন ।একই সময়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ ঘোষনা করে তৎকালীন মেজর (পরে বিগ্রেডিয়ার) খালেদ মোশারফ একদল সেনা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্হান নেন ।এই সময় মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পর্যন্ত শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা গড়ে তোলা হয় ।এই ব্যবস্হাকে আরো সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মেজর শফিউল্লাহ তার সেনা সদর কিশোরগঞ্জ থেকে সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় স্হানান্তর করেন ।সেখানে তিনি স্হানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করে উন্নততর সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্হা গ্রহণ করেন ।ক্যপ্টেন নাসিম তার বাহিনী নিয়ে আশুগঞ্জে গিয়ে অবস্হান নেন ।এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নরসিংদী এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে এক প্রতিরোধ যুদ্ধে পশ্চাদাপসারণ করে তৎকালীন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) EPR বাহিনী নিয়ে ভৈ্রববাজারে এসে অবস্হান নেন।মেজর শফিউল্লাহ ১৩ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া থেকে সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একদল মুক্তিযোদ্ধাকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করার জন্য ভৈ্রববাজারে প্রেরণ করেন ।

১৪ এপ্রিল ভোর থেকে পাকবাহিনী স্হলপথ,নৌপথ ও আকাশ পথে ভৈ্রববাজারে ত্রিমুখী আক্রমন করে ।ভৈ্রবের মধ্যেরচর শম্ভুগঞ্জ,সোহাগপুর ও আশুগঞ্জে হেলিকপ্টার থেকে প্রচুর ছত্রী সেনা নামানো হয় ।ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান স্বল্প সংখ্যক সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অসম সাহসিকতার সাথে লালপুরে পাকবাহীনির ত্রিমুখী আক্রমণের মোকাবেলা করেন ।বিশাল পাকবাহীনির সঙ্গে স্বল্প সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বেশীক্ষন যুদ্ধ করা সম্ভব নয় ।দুপুর দুইটার দিকে বাধ্য হয়ে তিনি তার সেনা দল নিয়ে ভৈ্রববাজার-ময়মনসিংহ রেললাইন দিয়ে পায়ে হেটে কুলিয়ারচর গিয়ে সেখান থেকে নৌপথে মূল বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হতে চলে যান ।পরবর্তীতে মেজর শফিউল্লাহ ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের এই প্রতিরোধ যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক যুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন ।ভৈ্রববাজার দখল প্রতিষ্ঠার পর পাকবাহীনি ১৯ এপ্রিলের মধ্যে কুলিয়ারচর,বাজিতপুর,কটিয়াদী থানা সহ কিশোরগঞ্জ সদরে দখল প্রতিষ্ঠা করে নেয় ।

লেখকঃ  মোঃআব্দুল বাকের, বাজিতপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস