ভৈরবের অবস্থানঃ ভৈরব কিশোরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান জেলা) একটি প্রসিদ্ধ নদীবন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র। ঢাকা থেকে ৮৪ কিঃমিঃ উত্তর পূর্বে মেঘনা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ভৈরব কিশোরগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলার (বর্তমান ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলা) সীমান্তবর্তী একটি থানা।এই থানার বিপরিত তীরে গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য কেন্দ্র আশুগঞ্জ।এখানে বেশ কিছু শিল্প কারখানা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অবস্থিত।এখান থেকে কিছুটা ব্যবধানে দক্ষিন দিকে ব্রাক্ষনবাড়িয়া,একটি বর্ধিষ্ণু শহর ও মহকুমা সদর।ঢাকা হতে ভৈরব আশুগঞ্জ ও ব্রাক্ষণবাড়িয়া একই রেলপথে সরাসরি সংযুক্ত।
ভৈরব একটি রেলওয়ে জংশন। ঢাকা হতে রেললাইন ভৈরব গিয়ে দুভাগে বিভক্ত হয়েছে। এর একটি লাইন ভৈরব হতে কিশোরগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহে পৌঁছেছে। অন্য লাইন ভৈরবের উপর মেঘনা সেতু পার হয়ে আশুগঞ্জের উপর দিয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়া হয়ে আখাউড়া জংশনে গিয়ে দুভাগে বিভক্ত হয়েছে। এখান থেকে একটি লাইন হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট এবং অন্য লাইন কুমিল্লা ফেনী হয়ে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে পৌঁছেছে।এই সময়ে রাজধানী ঢাকার সাথে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সরাসরি কোন সড়ক যোগাযোগ ছিলনা। শীতলক্ষা মেঘনা ও গোমতী নদী ফেরী দ্বারা অতিক্রমের ব্যবস্থা ছিল।ঢকা,চট্টগ্রাম সরাসরি সংযুক্ত ছিল রেলপথ দিয়ে। আর এই রেলপথ ভৈরবের উপর দিয়ে অতিক্রম করেছে। পাশেই মেঘনা নদী ও গুরুত্বপূর্ণ ভৈরব রেলসেতু।অবস্তানগত এবং সামরিক কৌশলগত দিক থেকে ভৈরব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাআস হতেই মুক্তিবাহিনী এবং পাকবাহিনী উভয়ই ভৈরবের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হিয়ে উঠেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভৈরবের গুরুত্ব পূর্ব থেকেই ভৈরব একটি বৃহৎ বন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ রেলোয়ে জংশন।যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এটি ছিল খুবই ঝুকিপূর্ণ একটি স্থান।ঢাকা চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি রেলপথ সংযোগ অব্যাহত রাখার জন্য ভৈরব সেতুর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।অন্যদিকে পাকবাহিনীর ঢাকা-চট্টগ্রাম সরাসরি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা,সরবরাহ লাইন বন্ধ এবং দেশের পূর্বাঞ্চলে সামরিক চলাচলকে ব্যাহত করার জন্য ভৈরব ছিল মুক্তিবাহিনীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাকবাহিনীর অবস্থানঃ
পাকবাহহিনী ২৪ মার্চ থেকে অপারেশন সার্চ লাইট কার্যকরী করার জন্য পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত পদাতিক ডিভিশনকে ঢাকায় আনয়ন করে।পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ খারিয়ানে অবস্থানরত ৯ম ডিভীশনকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়।২ এপ্রিল থেকে ৭ এপ্রিলের মধ্যে ডিভিশনটির ঢাকা আগমন সমাপ্তি ঘটে।এই ডিভিশনটির জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল শওকত রেজা।সামরিক কর্তৃপক্ষ এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই ৯ম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল শওকত রেজাকে মে মাসের মধ্যে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এলাকা শত্রু মুক্ত করার দায়িত্ব দেন।একই সঙ্গে পাকিস্তানী সামরিক সদর দপ্তর থেকে এক নির্দেশে ৯ম ডিভিশনের অধীনস্থ ২৭ তম ব্রিগেড কে ১৪ তম ডিভিশনের অধীনে ন্যাস্ত করে ময়মনসিংহের পথে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
১৪ তম ডিভিশনের অভিযান নিয়ন্ত্রন এলাকা নির্ধারিত হয় ঢাকা,যশোর ও ময়মনসিংহ অঞ্চল। ২৭ তম ব্রিগেড কে ময়মনসিংহ গন্তব্যস্তলে পৌছাঁনোর পূর্বে কুমিল্লা সিলেট সড়ক ও রেল পথ মুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।এই ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লয়াহ খান।ভৈরব আশুগঞ্জ ও লালপুর যুদ্ধের পর এই ২৭ তম ব্রিগেড ব্রাক্ষনবাড়িয়া,কসবা,আখাউড়া,সাইবাবাদ কুঠি গঙ্গাসাগর অঞ্চলের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত হয়।এই ব্রিগেডের সদর দপ্তর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া।লক্ষ্য অর্জনে ব্রিগেডটি ভৈরব বাজারে মেঘনা নদী প্রবল গতিতে অতিক্রম করে। এ তৎপরতা ট্যাঙ্ক,কমান্ডো, হেলিকপ্টার এবং জঙ্গী বিমান ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ব্রিগেডের কাছে ছিল গানবোট ও ল্যান্ডিং ক্রাপট বা জলে অস্ত্রশস্ত্র অবতরনের ব্যবস্থা।পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৭ তম ব্রিগেড ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হয়। তাদের অগ্রসর হওয়ার অবস্থানগুলো হলোঃ
ক) ব্যাটালিয়ান স্থলপথে ঢাকা-নরসিংদী ভৈরব রেললাইন বরাবর।
খ) ব্যাটালিয়ান মেঘনা হয়ে নৌপথে যাত্রা করে।
গ) পদাতিক বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য ১ টি আর্টিলারী ব্যাটালিয়ান খানাবাড়ী রেলস্টেশন অবস্থান গ্রহন করে।
ঘ) পদাতিক বাহিনীর ২ কোম্পানি হেলিকপ্টার যোগ মধ্যরচর ও সোহাগপুরে অবতরন করে অবস্থান নেয়।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থানঃ
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অতর্কিত আক্রমন করলে বাংলাদেশে অবস্থানরত ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন ইউনিট গুলি প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত হয় । সিলেটের শমসের নগরে অবস্থানরত মেজর খালেক, মোশারফের নেতৃত্বে বিদ্রোহী ৪র্থ ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় সকল ইউনিট ২৭ মার্চ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান গ্রহন করেন ।
এই বেঙ্গল সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। এদিকে ঢাকার জয়দেবপুরে অবস্থানরত ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর শফিউল্লাহর’র নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে।এই বেঙ্গল ঢাকা,টাঙ্গাইল,ময়মনসিংহ ভৈরব হয়ে ৩১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খালদ মোশারফের সাথে মিলিত হয়।তখন এই দুই বেঙ্গল সন্মিলিত ভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।তারা পাকবাহিনীর অগ্রাভিযানকে বাধা প্রদান ও একই সঙ্গে সিলেট ও কুমিল্লায় যৌথ অভিযান পরিচালনা করে।
প্রসঙ্গতঃ বলা প্রয়োজন যে যুদ্ধের এই সময়ে মুক্তিবাহিনী সুষ্ঠভাবে সংগঠিত হতে পারেনি।পাকিস্তানী বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনের মুখে বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেঘনা নদী এবং ভৈরব কে সামনে রেখে পরিকল্পনা মাফিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়।বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে সুস্থ পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা মুক্তিবাহিনীর জন্য ছিল দুঃসাহসী কাজ।
এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানগুলো হলো –
১। আশুগঞ্জে ক্যাপ্টেন নাসিম এর নেতৃত্বে এক কোম্পানি নিয়মিত সৈন্য মোতায়েন করা হয়।
২। আশুগঞ্জের ৩ মাইল উত্তরে আজবপুর নামক স্থানে একজন জেসিও’র অধীনে মোতায়েন করা হয় এক কোম্পানি নিয়মিত সৈন্য।
৩। আশুগঞ্জ থেকে ২ মাইল দক্ষিনে লালপুরে লেফটেন্যান্ট হ্লাল মোরশেদের নেতৃত্বে নিয়মিত ও অনিয়মিত সৈনিকদের সংমিশ্রণে গঠিত একটি কোম্পানিকে মোতায়েন করা হয়।এই কোম্পানির দায়িত্ব ছিল ঐ এলাকায় নৌপথে যাতে কোন শত্রু সৈন্য অবতরণ করতে না পারে তার জন্য পদক্ষেপ গ্রহন।
৪। ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন একটি মিশ্র কোম্পানিকে তিতাস নদীর পাড়ে গোকর্ণাঘাট এলাকা রক্ষার দায়িত্বে থাকেন।
৫। ক্যাপ্টেন মতিন এক কোম্পানি ইপিয়ার নিয়ে সরাইলে অবস্থান গ্রহন করেন।এই কোম্পানিকে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে গন্য করা হয়
৬। ভৈরবের ২ মাইল উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত রামনগর রেলসেতুতে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহন করে ক্যাপ্টেন মতিউরের নেতৃত্বে এক ইপিয়ার সদস্য।১৩ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া থেকে ব্রাহ্মণ বাড়িয়া আগত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলটিকে তার বাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয় এবং তাদের অবস্থান ছিল ভৈরব,আশুগঞ্জ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংযুক্ত এলাকায়।
যুদ্ধ পরিকল্পনাঃ
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অবস্থায় এটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ একটি অপরিকল্পিত আক্রমন। তবে যুদ্ধচলাকালে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সময়ে সময়ে সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার পরিবর্তন ঘটে। গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪র্থ ইষ্ট বেঙ্গল কুমিল্লার দিকে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের দায়িত্ব ছিল রেল ও সড়কপথগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আগত পাকবাহিনীকে বাধা প্রধান।
আর ২য় ইষ্ট বেঙ্গল ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব ও আশুগঞ্জ প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করে। তবে ৪র্থ ইষ্ট বেঙ্গল আইন উদ্দিন তার ডেল্টা কোম্পনী এবং ইপিয়ারের বেশ কিছু সদস্যসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান গ্রহন করে। কিন্তু এই সময়ে ১১ এপ্রিলের মধ্যে ২য় ইষ্ট বেঙ্গল থেকে ২ টি কোম্পানি সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাঠানোর ফলে এই এলাকায় সৈন্য সংখ্যার স্বল্পতা দেখা দেয়। এই স্বল্পতা পূরণের জন্য ইপিয়ার পুলিশ ও অল্প সামরিক শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। প্রতিরোধ যুদ্ধের এই পর্যায়ে সামগ্রিক অবস্থা বিচার করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডরগন অতি দ্রুত কার্যকর একটি ডিনায়াল পরিকুল্পনা কার্যকরী করে।এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল রেলসেতু, সড়কসেতু ভেঙ্গে পাকিস্তানবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করা। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভৈরব থেকে ২ মাইল উত্তর পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের উপর রামনগর সেতু ভেঙ্গে ফেলা হয়। একই সঙ্গে ভেঙ্গে ফেলা হয় কিশোরগঞ্জের কাছে রেল ও সড়ক সেতু।
যুদ্ধের বিবরনঃ
২য় ইষ্ট বেঙ্গলের এক দল সৈন্য ক্যাপ্টেন মতিউরের নেতৃত্বে পাঁচদোনা নরসিংদীতে অগ্রাভিযানরত পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিরোধ করে। পাকিবাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য প্রবল শক্তি প্রয়োগ করে। ক্যাপ্টেন মতিউর পাকবাহিনীকে ক্রমান্বয়ে বাধা দিতে ভৈরবের দিকেপিছিয়ে আসতে থাকেন। পাকবাহিনীও তাদের অনুসরন করে সন্মূখে অগ্রসর হয়। কিন্তু পূর্বেই পরিকল্পিতভাবে ভৈরবের কিছু আগে অবস্থিত পুরাতন ব্রক্ষপুত্র নদের উপর রামনাগর রেল সেতুটি নষ্ট করে ফেলা হয়। ক্যাপ্টেন মতিউর তার বাহিনী নিয়ে রামনগরে এসে অবস্থান গ্রহন করেন।
১৪ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তানি নৌবাহিনীর একটি বহর আশুগঞ্জের ২ মাইল দক্ষিনে লালপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে অবস্থান গ্রহন করে।এই সৈন্য বহর অবতরনের জন্য উপযুক্ত স্থান পর্যবেক্ষন করতে থাকে।এমনি অবস্থায় এই স্থানে পূর্ব থেকে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদের বাহিনীর দ্বারা এই নৌবহরটি লালপুরে আক্রান্ত হয়। প্রায় এক ঘন্টা উভয়ের মধ্যে গোলাগুলি চলে এবং নৌবহরটি অবস্থান পরিবর্তন করে দক্ষিণ দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়।এদিকে লালপুর আক্রান্ত হওয়ার আশংকায় সরাইলে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানি লালপুরে চলে আসে। ১৫ এপ্রিল ভোর সাড়ে পাঁচটায় ভৈরব, লালপুর ও আশুগঞ্জের মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে শুরু হয় পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণ। খানাবাড়ী রেলস্টেশনে অবস্থানরত পাকবাহিনীর আর্টিলারী ব্যাটালিয়ান এই গোলাবর্ষণ চালায়। এটা ছিল প্রি এইচ আওয়ার গোলাবর্ষণ ।এই গোলাবর্ষনের সুযোগে পাকবাহিনীর নৌবহরটি আবারও লালপুরে এসে উপস্থিত হয়।এরা মূলত গোলাবর্ষণের ছত্রছায়ায় লালপুরে অবতরনের জন্য আসছিল।নৌবহরে ছিল ২ টি গানবোট, দুটি ল্যান্ডিং ক্রাফট ও ৪ টি লঞ্চ। একই সময়ে রেলপথ ধরে পাকবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ান ভৈরবের দিকে অগ্রসর হয়।ইতিপূর্বে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান কে শত্রুদের প্রতিহিত করে তাদের অগ্রগতি বিলম্বিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে শেষ পর্যায়ে তাকে আশুগঞ্জে পিছিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়।এদিকে লালপুরে নৌবহরটি যখন আরো এগিয়ে আসে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নির্ণয়ের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় তখন মুক্তিবাহিনীর একজন সৈনিক উত্তেজনাবশত গুলি করে বসে।এই অবস্থায় পাকিস্তানী সৈন্যরা সাথে সাথে ট্যাংক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে গোলাবর্ষণ শুরু করে।জবাবে মুক্তিবাহিনীও রকেট লাঞ্চার ও মর্টার দিয়ে তাদের উপর গোলাবর্ষনের পালটা জবাব দেয়। মুক্তিবাহিনীর এই প্রচন্ডতায় পাক নৌবহর তীর থেকে অন্যত্র ভেসে যাওয়া শুরু করে। কিন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানী বিমান বাহিনী যুদ্ধে যোগদান করে। ৬ টি স্যাবর জেট ভৈরব, আশুগঞ্জ, লালপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর বোমাবর্ষণ শুরু করে। বিমান আক্রমনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করার মত কোন অস্ত্র তখন মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিলনা। বিমান আক্রমনে মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর একনাগারে ৬ ঘন্টা বিমান আক্রমন চলে।১৫ এপ্রিল ভোরে এক ঝাঁক এম আইও ৮ হেলিকপ্টার আশুগঞ্জ ও আজবপুরের মাঝামাঝি সোহাগপুরে পাকিস্তানী ছত্রীসেনা নামাতে শুরু করে। হেলিকপ্টার অবতরনে বাধা দেওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন নাসিম বিমান আক্রমন উপেক্ষা করে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমজি পোস্টের কমান্ডার আব্দুল হাই রেলপথের উপর স্থাপিত উন্মুক্ত পরিখা থেকে শত্রু দের উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু শত্রুর ৮৩ মি,মি আর্টিলারী গান থেকে নিক্ষিপ্ত গোলা সরাসরি আব্দুল হাইকে আঘাত করলে ঘটনাস্থলে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
এক পর্যায়ে শত্রুরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ঘিরে ফেলে। এখানে উভয়পক্ষের মধ্যে এক ঘন্টা হাতাহাতি যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধে ক্যাপ্টেন নাসিম ও লেফটেন্যান্ট হেলাল আহত হলে যুদ্ধক্ষেত্রে এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। অবস্থা বুঝে অধিনায়ক মেজর শফিউল্লাহ সৈন্যদের নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যায় আঁধারের আড়ালে ক্যাপ্টেন নাসিম সরাইলে সরে আসতে সক্ষম হয়। সফিউল্লার নির্দেশ অনুযায়ী পুরো বাহিনী নিরাপদ স্থানে সরে যায়। অপরদিকে পাক নৌবহরটি তিতাসের মুখে সৈন্য নামিয়ে দেয়। দ্বিমুখী আক্রমনের মুখে অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয় দেখে ক্যাপ্টেন মতিন সন্ধ্যায় রেলপথ বরাবর হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছেন। সেখান থেকে তিনি তার বাহিনী সরাইলে স্থানান্তর করেন। অবশেষে সৈন্যরা ৮ মাইল হেঁটে শাহবাজপুরে অবস্থান গ্রহন করে। পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমনের মুখে ক্যাপ্টেন মতিউরের পক্ষে নদীর পশ্চিমে অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়ায় এবং মেঘনা সেতু ও নদী পারাপারের পথ অপর তীর পাকবাহিনীর করায়ত্ব হওয়ায় মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে উত্তর দিকে ভৈরব ও ময়মনসিংহ রেলপথ ধরে ক্যাপ্টেন মতিন তার বাহিনীসহ কুলিয়ারচরে পৌঁছেন। পরে চাতালপাড় হয়ে তিনি মূল বাহিনীর সাথে মিলিত হন।
ভৈরব যুদ্ধের মানচিত্র – ১৯৭১
১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সংঘটিত ভৈরব-আশুগঞ্জ ও লালপুর যুদ্ধ ছিল সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রথম প্রহরের একটি পূর্নাঙ্গ লড়াই।পরিস্থিতি ও অবস্থানের বিবেচনায় এই যুদ্ধের জয় পরাজয় নির্ণয় খুব দুঃসাধ্য কাজ।এই যুদ্ধে পাকবাহিনী তাদের লক্ষ অর্জনে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনী পিছু হটে নিরাপদ স্থানে অবস্থান গ্রহন করে। মুক্তিবাহিনীর হটে যাওয়ার কারনসমুহ গুলো হলোঃ
সামগ্রিক পরিস্থিতিঃ
সময়ের বিবেচনায় সামগ্রিক পরিস্থিতি মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে ছিলনা। ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনীর আকস্মিক আক্রমনে সাধারণ মানুষ হত বিহম্বল হয়ে পড়ে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলো ছিল অনেকটা আত্নরক্ষা অবস্থানে।ফলে বলা যায় যুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থতি মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে ছিলনা।
প্রয়োজনীয় অস্ত্রের অভাবঃ
যুদ্ধের পর্যায়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলোকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত প্রয়োজনীয় এবং যথেষ্ট পরিমানে অস্ত্র তাদের হাতে ছিলনা। একমাত্র ৭৫ মিঃমিঃ আর আর এমজি,আর এল ও কিছু মর্টার ছিল তাদের সম্বল। সৈনিকদের নিজস্ব প্রয়োজনীয় অস্ত্র ছিলনা, এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটতে হয়।
আর্টিলারী ফায়ারের অভাবঃ
মুক্তিবাহিনীর হাতে আর্টিলারী ফায়ারের ব্যবস্থা ছিলনা মুক্তিবাহিনীর কাছে বিমান বিধ্বংসী কামান না থাকায় বিমান আক্রমন যেমন মোকাবেলা করা যায়নি, তেমনি হেলিকপ্টারযোগে ছত্রী সেনা নামানোর বিষয়টিতেও বাধা দেয়া সম্ভব হয়নি। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর বিমান আক্রমন হওয়ার পর পিছু হটা ছাড়া মুক্তিবাহিনীর জন্য কোন বিকল্প ছিলনা।
যোগাযোগের অভাবঃ
ভৈরব, আশুগঞ্জ, লালপুর যুদ্ধে লড়াইরত বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলোর মাঝে কোন যোগাযোগ ছিলনা। বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীকে মোকাবেলা করতে কোম্পানির সাথে আরেকটি কোম্পনীর যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ওয়্যারলেস সেট সবসময় কার্যকরী ছিলনা। বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হয়েছে রানার বা বার্তা বাহকের উপর। যোগাযোগের অভাবের কারনে যুদ্ধে সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।এই জন্য এই যুদ্ধে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি শিথিল হয়ে পড়েছিল।
সংরক্ষিত বাহিনীর অভাবঃ
যে কোন যুদ্ধে সংরক্ষিত শক্তি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভৈরব, আশুগঞ্জ, লালপুর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কোন সংরক্ষিত শক্তি ছিলনা। সরাইলে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন মতিন এক ইপিয়ার নিয়ে প্রাথমিক পরিকল্পনায় রিজার্ভ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এই কোম্পানির উপর দায়িত্ব ছিল যুদ্ধ ব্যাপক আকার ধারণ করলে তালশহর ও গোকর্ণঘাট এলাকায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।কিন্তু যুদ্ধের পরিস্থিতিগত কারনে এই কোম্পানি লালপুর অবস্থান পরিবর্তন করায় আক্রমনে নিয়োজিত পুরো বাহিনী সংরক্ষন বা রিজার্ভ বিহীন হয়ে পড়ে।
পাকবাহিনীর অবস্থান বিশ্লেষনঃ
এটা বলাই বাহুল্য যে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ। তাদের আক্রমন ছিল পরিকল্পিত। তাই তাদের মনোবল ছিল দৃঢ় ও উন্নত।ভৈরব আশুগঞ্জ,লালপুর যুদ্ধে পাকিবাহিনী ত্রিমুখী আক্রমন চালায়। জল স্থল বিশেষতঃ বিমান আক্রমনের ফলে যুদ্ধেরপরিস্থিতি পাকবাহিনীর অনুকূলে চলে যায়। তাদের যুদ্ধ জয়ের কারন ছিল প্রচুর যুদ্ধ সরঞ্জাম ব্যবহার।এই যুদ্ধে পাকবাহিনীরছিল আক্রমনাত্নক ভূমিকা। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী বা বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলো ছিল রক্ষনাত্নক ভূমিকায়।
সামগ্রিক বিচারে বলা যায় যে,আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে সংঘটিত এই যুদ্ধে অবস্থান গত কারণেই পাকিস্তান বাহিনী জয়লাভ করে। মুক্তিবাহিনী কোন নেতৃত্ব বা নির্দেশ ছাড়াই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে এক সর্বাত্নক যুদ্ধেই লিপ্ত হয়। নানামুখি প্রতিকুলতা ও পাকবাহিনীর বিমান অক্রমনের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন, যে মনোবল দেখিয়েছেন, তা জাতির ইতিহাসে একটি অবিস্মরনীয় ঘটনা, মুক্তিযোদ্ধাদের এই অকুতোভয় লড়াই পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল। একই সঙ্গে পরবর্তী সময়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পনা মাফিক আক্রমন পরিচালনায় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের কে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
Trackbacks/Pingbacks