অগ্নিঝরা মার্চে দেশ মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে যে কয়জন সাহসী বীর সন্তান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ১৯২৭ সালে নরসিংদী জেলার বেলাব থানার উজিলাব গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জম্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নওয়াব আলী মুন্সী ও ছমিনা বেগমের একমাত্র সন্তান। অভিজাত পরিবারে জম্মগ্রহণ করেও তিনি বাল্যকাল থেকেই মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। নিজ গ্রাম চর আমলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ শেষে কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর হাইস্কুলে ভর্তি হন।
উক্ত বিদ্যালয় থেকেই ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ঐতিহ্যবাহী গুরুদয়াল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় পিতার অসুস্থতার খবরে গ্রামে ফিরে আসেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি পরিবাবের হাল ধরেন এবং গ্রামের কৃষক-মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ফলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই পড়ালেখার ইতি ঘটে। বিপ্লবী অখিল দাস, ধরণী বাবু, ফয়েজ মাস্টারের হাত ধরে জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। আভিজাত্যের গন্ডি ছেড়ে তিনি কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে ধান উৎপাদনে নতুন পদ্ধতি সংযোজিত হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি এদেশে প্রথমবারের মত জাপানি পদ্ধতিতে ধাণ চাষ করে প্রতি একরে ১২০ মন ধান ফলিয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেন। তাঁর এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি জাপানের ‘ফার্মার একচেঞ্জ প্রোগ্রামে’আমন্ত্রণ পান। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই বিপ্লবী কৃষক নেতার। কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর মোনায়েম খানের নির্দেশে তার এই যাত্রা বাতিল করা হয়।
জাপান সফর বাতিল হলে তিনি নতুন উদ্যামে কৃষি কাজে মনোযোগ দেন এবং নিজে ভূ-স্বামী হওয়া সত্ত্বেও কৃষকদের সংগঠিত করে ভূ-স্বামীদের শোষণ-নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৫৬ সালে কৃষকদের স্বার্থবিরোধী ইজারা প্রথা চালু হলে তিনি প্রথম এই প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। নরসিংদীর বেলাব বাজারের লাখ মানুষের সমাবেশ থেকে কর্তৃপক্ষকে ইজারা প্রথা বাতিলের দাবি জানান। প্রশাসন এই দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করে কমরেড হাইকে ধরার জন্য ২০ হাজার টাকা পুরস্কার ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের ঘোষণা করে। পুরষ্কার ঘোষণা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের এই কন্ঠস্বরকে যখন পুলিশ ধরতে ব্যর্থ হয় তখন প্রশাসন কৃষকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। সাধারণ মানুষের প্রিয় নেতা কৃষকদের জীবন রক্ষার্থে আদালতে অত্মসমার্পণ করেন। পাকিস্তানী সামরিক সরকারের নির্দেশে কমরেড হাইকে ঢাকা কারাগারে প্রেরণ করা হয়। নরসিংদীর রায়পুরা, বেলাব, মনহরদী, শিবপুর ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব, কুলিয়ার চর এবং কটিয়াদিসহ বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়ে কমরেড হাইকে মুক্তির দাবিতে গণআন্দোলণ। তীব্র আন্দোলনের কাছে সরকার শেষ পর্যন্ত মাথানত করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৬৯ সালে তাকে মুক্তি প্রদান করে।
দীর্ঘ ১৩ বছর কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে থেকে তিনি বিপ্লবের নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হন। ১৯৬৯ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে চলমান গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গড়ে তোলেন কৃষকদের নিয়ে বিপ্লবী সংগঠন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হলেও তিনি অন্য কমিউনিস্টদের মত ভিন্ন ফ্রন্ট খুলে অথবা পাকিস্তানীদের সহযোগীতা না করে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। তিনি একধারে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, পৃষ্ঠপোষক, যোদ্ধা। তাঁর বাড়িতেই গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। উক্ত ক্যাম্পে প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা তাঁর পৃষ্ঠপোষকাতায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ওই এলাকায় তিনি ‘মেজর হাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। তার বাড়িকে বলা হত ‘মিনি ক্যান্টমেন্ট।’ বেলাব যুদ্ধে শহীদ সুবেদার আবুল বাশার ৭টি গরু গাড়ি বোঝাই করা অস্ত্রশস্ত্রসহ সদলবলে উক্ত মিনি ক্যান্টমেন্টে মুক্তিযুদ্ধের প্রথমথেকেই অবস্থান করছিলেন। ওই দলে ছিলেন সুবেদার হাকিম, কমান্ডার আবদুল বারিক (ইপিআর ফুলদী, ৩), আবদুল কাদির, নায়েক সুবেদার গফুর, নায়েক সুবেদার আকমল, লেফটেন্যান্ট রউফ (ভৈরব) সুবেদার বাশার এখান থেকেই নরসিংদী জেলার বেলাব থানার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি পাকিস্তানীদের সহযোগী রাজাকাররা দীর্ঘদিন থেকেই লক্ষ্য করছিল। তারা পাক বাহিনীকে নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধাদের তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত করছিল। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের দিকে পাক বাহিনীর সাথে বেলাব বাজারের যুদ্ধে সুবেদার বাশার শহীদ হলে মেজর হাই নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশন্ত্রে বলিয়ান পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে ২৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হলে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাৎসরণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে হাই এর স্বপ্নের মিনি ক্যান্টমেন্ট রাজাকারদের সহযোগীতায় পাকবাহিনী জ্বালিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের এই সফল বীর সৈনিক মেজর হাই দেশ স্বাধীণ হওয়ার পরও স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে তার আন্দোলন চালিয়ে যান। তিনি ১৯৭২ সালে বেলাব বাজারে কৃষক সমাবেশের আয়োজন করেন। উক্ত সমাবেশে ১ লাখেরও বেশী কৃষক ও ক্ষেতমজুর জমায়েত হয়েছিল। হাই এর এমন জনপ্রিয়তায় নব্য মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিবিধরা আতংকিত হয়ে পড়ে। তারা রক্ষীবাহিনীর কাছে হাই’র বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে। রক্ষী বাহিনী হাইকে গ্রেফতার করে নারায়ণপুর ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং আমুষিক নির্যাতন করে। জননেতা মণি সিংহের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই ঘটনা অবহিত হয়ে রক্ষী বাহিনীর প্রধান ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামানকে নির্দেশ দেন হাইকে সসম্মানে মুক্তিপ্রদানের। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই হাইকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মস্কো প্রেরণ করা হয়।
কমরেড হাই শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা বা কৃষক নেতা ছিলেন না, তিনি একাধারে নরসিংদী অঞ্চলের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রনায়ক ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি নাটকে অভিনয়, গান রচনা ও গান গাইতেন। স্বাধীনতার পর তিনি কাফেলা নাটকের মুনসির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বলে মৌলবাদীরা তাকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছিল। তিনি ধর্মান্ধ মৌলানাদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে সর্বশেষ তারা হাই’র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়। এই মহান বিপ্লবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, কৃষক নেতা মেজর হাই ২০০৭ সালের ১১ মার্চ আশি বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক বিপ্লবী অধ্যায়ের অবসান ঘটে। নরসিংদী বাসী হারায় এক বীর মুক্তিযোদ্ধা কৃষক নেতাকে।
লিখেছেনঃ মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার,
শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়