হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে। হাতে স্মার্টফোন। খুঁজছেন নির্দিষ্ট একটি জায়গা। এবার দরকার স্মার্টফোনের গুগল ম্যাপের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানটি খুঁজে বের করা। দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের (জিপিএস) মাধ্যমে নিখুঁত স্থানটি পেতে প্রয়োজন গুগল ম্যাপসের স্ট্রিট ভিউ-সুবিধা। আর সহজেই যাতে আপনি নির্দিষ্ট স্থানটি খুঁজে পান, সে সুবিধা নিয়ে ৪০টির বেশি দেশে বিশ্বখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগল দিচ্ছে স্ট্রিট ভিউ (www.google.com/streetview) সেবা। এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের নাম। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও জিপিএস ব্যবহারের মাধ্যমে নিখুঁত স্থান কিংবা স্থাপনা খুঁজে পাওয়া যাবে।

স্ট্রিট ভিউ-সুবিধা

গুগল স্ট্রিট ভিউ এমন একটি প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে গুগল ম্যাপস ও গুগল আর্থে প্যানারোমিক ছবি দেখার পাশাপাশি নির্দিষ্ট রাস্তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র দেখা যাবে। ২০০৭ সালের ২৫ মে চালু হয় গুগলের এই সেবা। শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে চালু হলেও এ সুবিধা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। মূলত গুগলের একটি গাড়ি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাস্তায় গিয়ে ওই স্থানের ছবি তোলে। এ জন্য বিশেষভাবে তৈরি গাড়িটিতে রয়েছে প্যানারোমিক ছবি তোলার জন্য নয়টি ক্যামেরা; যেগুলো ৩৬০ ডিগ্রি কোণে অর্থাৎ চারদিকের ছবি তুলতে পারে। সঙ্গে আছে বিশেষ লেজার ও জিপিএস-সুবিধা, যেটি ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে যেখান থেকে ছবি তোলা হলো, সেখান থেকে ছবি তোলার স্থানটির দূরত্ব কতটুকু, সেটি নির্ধারণ করে দেয়। নির্দিষ্ট একটি এলাকার ছবি তোলা শেষে ওই স্থানের তথ্য সংগ্রহ, একাধিক মান নির্বাচন শেষে যুক্ত হয় গুগল ম্যাপসে। মানচিত্রের যে স্থানে স্ট্রিট ভিউ ছবি পাওয়া যায়, সেখানে বাঁ পাশে থাকা পেগম্যান আইকনটি কমলা হয়ে যাবে।

যেসব স্থানে স্ট্রিট ভিউ-সুবিধা রয়েছে, সেখানে গুগল ম্যাপস থেকে যেকোনো এলাকার দৃশ্য জুম করে বড় আকারে দেখা যাবে। বাঁ পাশে থাকা কমলা রঙের পেগমান আইকনটি টেনে এনে মানচিত্রের নীল রং চিহ্নিত রাস্তাগুলোর ওপর বসিয়ে দিলেই সে এলাকা দেখা যাবে। গুগলের স্ট্রিট ভিউ ব্যবহারের সুবিধার্থে স্মার্টফোনের জন্য বিশেষ অ্যাপও রয়েছে। যার মাধ্যমে এ সুবিধা ব্যবহার তরা যায়।স্ট্রিট ভিউ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎস্থলের অবস্থান, নিকটবর্তী কফির দোকান, রেস্তোরাঁ, ম্যারাথন কিংবা প্যারেডের স্থান ইত্যাদি জানা যাবে খুব সহজেই। আর কোনো হোটেল কিংবা অবকাশযাপন কেন্দ্র আগে থেকে বুকিং দিতে চাইলে এবং বিশ্বের বিভিন্ন ভ্রমণ-গন্তব্য খুঁজতে চাইলেও সহজ উপায় হচ্ছে গুগল স্ট্রিট ভিউ।

ঢাকায় গুগলের গাড়ি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুগলের স্ট্রিট ভিউ-সুবিধা চালু রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও এসেছে গুগল স্ট্রিট ভিউর গাড়ি। ৪১তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগর চট্টগ্রামে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেছে স্ট্রিট ভিউর গাড়িটি। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উত্তরা থেকে যাত্রা শুরু করে গাড়িটি। গুগলের স্ট্রিট ভিউর লোগো ও ওয়েবসাইটের ঠিকানাযুক্ত ব্র্যান্ডেড এই গাড়িটি এখন চলছে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায়। গুগল মানচিত্রে বাংলাদেশের পথঘাট, আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান ও বিভিন্ন ভালো রেস্তোরাঁর অবস্থান তুলে ধরবে গুগল স্ট্রিট ভিউ। বিশেষ ক্যামেরা বসানো গাড়িটির তোলা প্যানারোমিক ছবির মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের আগ্রহী ব্যবহারকারীরা খুব সহজে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার ছবিও দেখতে পাবেন। পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকেরা পাবেন বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের দিকনির্দেশনা। একই সঙ্গে গুগলে দেওয়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশি পণ্যের প্রচারও বাড়ানো যাবে এর মাধ্যমে।

এরই মধ্যে ঢাকার রাস্তায় এক মাস ধরে ছবি তুলে যাচ্ছে গুগল স্ট্রিট ভিউর দুটি গাড়ি। একজন দলনেতার নেতৃত্বে দুজন দুটি গাড়ির দায়িত্বে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশে। নির্দিষ্ট রাস্তা ধরে প্রতিদিন গাড়ি দুটি চলতে থাকে আর স্থান ও পথঘাটের ছবি তুলতে থাকে বিশেষ ক্যামেরা। ঢাকার রাস্তায় এমন গাড়ি দেখে হঠাৎ থেমে যান অনেক পথচারী। এমনই এক পথচারী বেসরকারি চাকরিজীবী মোমেনুল আরমান। তিনি বলেন, ‘গুগলের গাড়ি দেখেই দাঁড়ালাম।’ বিস্তারিত জানার পর আগ্রহী এ পথচারী খুব খুশি হলেন বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি দেখে। মোমেনুল আরমানের মতো অনেকেই পথে এ গাড়ি দেখে কিছু সময় দাঁড়িয়ে যান।শুরুতে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য এ সুবিধা পাওয়া গেলেও খুব শিগগিরই অন্যান্য এলাকার জন্য চালু হবে এই সুবিধা। সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে গুগলের গাড়িটি ঘুরবে অন্যান্য বিভাগীয় কিংবা জেলা শহরেও।

বাংলাদেশের পথে

গত ৯ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের রাস্তায় গুগলের স্ট্রিট ভিউ গাড়ি চলার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। আনুষ্ঠানিক সেই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, গুগল এশিয়া প্যাসিফিকের পাবলিক পলিসি অ্যান্ড গভর্নমেন্ট রিলেশন বিভাগের পরিচালক অ্যান লেভিন, গুগলের এমারজিং মার্কেটিং অ্যাট গুগল এশিয়া প্যাসিফিকের প্রধান জেমস ম্যাকলার, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনাসহ অনেকে। সেখানে স্ট্রিট ভিউর বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন বাংলাদেশের জনগণের নানা ধরনের প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করবে বলে আশা প্রকাশ করেন অতিথিরা। এই প্রযুক্তি-সুবিধার কারণে বাংলাদেশে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়বে বলেও আশাবাদী অনেকেই। গুগলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, স্ট্রিট ভিউর ছবিগুলো বাংলাদেশের ব্যস্ত রাস্তাকে নতুন আঙ্গিকে দেখার সুযোগ করে দেবে। সেই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগ ও পর্যটক—এ দুটোকেই বাংলাদেশের দিকে আকৃষ্ট করবে। এ ছাড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গ্রাহকদের মানচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে স্ট্রিট ভিউ যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি অবদান রাখতে পারে।

গুগল ম্যাপে পরবর্তী সময় বাংলাদেশের ৩৬০ ডিগ্রি প্যানারোমিক ছবি দেওয়া হবে। এ ছাড়া এই প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর জন্য সব ধরনের সুবিধা বজায় রাখে বলে জানানো হয়। এ ছাড়া এতে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা কঠোরভাবে অনুসরণ করার পাশাপাশি গুগল মুখমণ্ডল ও গাড়ির নম্বর প্লেট ঝাপসা করার একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যেন সেগুলোকে শনাক্ত করা না যায়। আবার ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে তাঁদের কোনো ছবি ঝাপসা করার অনুরোধ পেলে গুগল তা গুরুত্বসহ বিবেচনা করে।

ব্যবহারকারীদের জন্য টিপস

পৃথিবীর আকর্ষণীয় বিভিন্ন স্থান যেমন পর্যটনকেন্দ্র, বিখ্যাত স্থান, ভবন, স্থাপত্য বের করতে পারেন স্ট্রিট ভিউর মাধ্যমে।
কোথাও ভ্রমণে গেলে আগে থেকেই দেখে নিন পরিবহনের ব্যবস্থা, বিনোদনের স্থান অথবা সমুদ্রসৈকত কত দূর ইত্যাদি।
প্রবাসী বন্ধুদের দেখাতে পারেন আপনি কোথায় থাকেন, কোথায় কাজ করেন, কোথায় বনভোজন করলেন কিংবা আপনার এলাকার মুদি দোকানটি কোথায়!
দারুণ কোনো রেস্তোরাঁ কিংবা পছন্দের দোকান খুঁজে পাচ্ছেন না! নির্দিষ্ট রাস্তায় যান আর স্ট্রিট ভিউর মাধ্যমে রাস্তার মোড়সহ অন্য স্থানগুলোর ছবি দেখে খুঁজে পেতে পারেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বিষয়ে পড়াশোনা কিংবা জানতে চাইলে নেওয়া যাবে স্ট্রিট ভিউর সাহায্য। এর মাধ্যমে ভার্চুয়াল-পদ্ধতিতে শেখা যাবে।
নিয়মিত কাজগুলোকে ভার্চুয়ালভাবে সাজাতে পারেন। কোনো অনুষ্ঠান, আয়োজন ইত্যাদি সময়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ম্যাপ-সুবিধা কাজে লাগাতে পারেন। পাশাপাশি কোথায় হাঁটার রাস্তা, কোথায় খেলার মাঠ—এসবও চিহ্নিত করতে পারেন।
কোনো সম্পদ কেনার আগে কিংবা ভাড়া নেওয়ার আগে ওই স্থানে আগেই ভার্চুয়াল ভ্রমণ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আগেই জেনে নিতে পারবেন ওই স্থান সম্পর্কে।
বাড়ি বদলের ক্ষেত্রে আগে থেকেই জেনে নিতে পারেন আশপাশের বাজার, পার্ক, রাস্তা, বাসস্ট্যান্ড, শপিং মল, পার্কিংয়ের সুবিধার কথা।
সাহায্যকারী কিংবা পরিচর্যাকারীরা স্ট্রিট ভিউর মাধ্যমে বিল্ডিংয়ের খোঁজ নিতে পারেন, যেখানে হুইলচেয়ার ওঠানামা করানো কিংবা সিঁড়ি এড়ানোর সুবিধা রয়েছে।
আপনার বাসার কেউ হেঁটে বিদ্যালয়ে গেলে তাকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার কাজটি করতে পারেন স্ট্রিট ভিউ ব্যবহার করে। এ ছাড়া কোথাও শিক্ষাসফরে গেলে সে অবস্থানটিও জেনে খোঁজখবর নিতে পারেন।

একনজরে গুগল স্ট্রিট ভিউ

শুরু: ২৫ মে ২০০৭
দেশ: ৪০
প্রথম দেশ: যুক্তরাষ্ট্র
১২ মে ২০০৮: ম্যানহাটানে ব্যস্ত রাস্তায় পরীক্ষামূলক ছবি তোলার প্রযুক্তি চালু
১৬ এপ্রিল ২০০৮: গুগল আর্থে পূর্ণাঙ্গভাবে যুক্ত হলো স্ট্রিট ভিউ-সুবিধা
২ জুলাই ২০০৮: যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ফ্রান্স ও ইতালিতে স্ট্রিট ভিউ চালু
৪ আগস্ট ২০০৮: অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মেট্রোপলিটন এলাকার মূল এলাকা স্ট্রিট ভিউতে যুক্ত
১ ডিসেম্বর ২০০৮: নিউজিল্যান্ডে স্ট্রিট ভিউ-সুবিধা চালু
১০ জুন ২০০৮: গুগল কারে নতুন প্রযুক্তির সুবিধা যুক্ত
৯ এপ্রিল ২০০৯: পূর্ণাঙ্গ পর্দায় স্ট্রিট ভিউ দেখার সুবিধা চালু
এপ্রিল ২০১০: দোকান, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন স্থাপনার ভেতরের অংশ দেখার সুবিধা চালু
৩০ অক্টোবর ২০১২: গুগলের গ্যালাক্সি নেক্সাস স্মার্টফোনের সাহায্যে প্যানারোমা ছবি তুলে গুগল ম্যাপসে শেয়ার করার সুবিধা চালু

Prothom alo