ইরান অত্যন্ত শক্তিশালী ও কার্যক্ষম মৌলিক কোষ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বলে সম্প্রতি খবর প্রকাশিত হয়েছে। ইরানের রোইয়ান নামক গবেষণা সংস্থা এই শক্তিশালী মৌলিক কোষ তৈরির কথা ঘোষণা করে। এ খবর প্রকাশিত হওয়ায় চিকিৎসা ও বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণায় ইরানের অসাধারণ সাফল্যের দিকে আরো একবার সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বিজ্ঞান মেলায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্ভাবন ও বিজ্ঞান-গবেষণা আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যগুলো তিন ঘন্টা ধরে পর্যবেক্ষণ করেন। এই বিজ্ঞান মেলা বা প্রদর্শনীতে মহাশুণ্য, বিমান, পরমাণু, জ্বালানী, ন্যানো প্রযুক্তি, পরিবেশ সুরক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং নতুন জ্বালানীসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে ইরানী বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন সাফল্য ও তাদের গবেষণামূলক প্রকল্পগুলো সর্বসাধারণের জন্য তুলে ধরা হয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা রোইয়ান গবেষণা কেন্দ্রের নির্মিত মৌলিক কোষ ও শক্তিশালী মৌলিক কোষ তৈরির প্রকল্পও পরিদর্শন করেন।

ইরানের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিম চামড়া তৈরি করেছেন। এ ছাড়াও ইরানী বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী মৌলিক কোষ তৈরি করতে সক্ষম হওয়ায় ইরান এ ক্ষেত্রে বিশ্বের ৫ টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। রোইয়ান গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা এর আগে ভ্রুণের মৌলিক কোষ তৈরি করতে সক্ষম হন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত খ্যাতনামা সাময়িকী বা নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রোইয়ান গবেষণা কেন্দ্রের এসব সাফল্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলো আই. এস. পি বা শক্তিশালী মৌলিক কোষ নির্মাণে ইরানের সাফল্যের কথা স্বীকার করেছে। ফলে ইরান এক্ষেত্রে বিশ্ব অঙ্গনে জার্মানী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীনের পরই নিজের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে সক্ষম হলো।

শক্তিশালী মৌলিক কোষ থেকে এই কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায় এবং এর মাধ্যমে মানব দেহের প্রতিটি অঙ্গের কোষই তৈরি করা যায়। আর এভাবে এ কোষের মাধ্যমে মৌলিক ভ্রুণ কোষগুলোকে কার্যক্ষম করা সংক্রান্ত অনেক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এ ছাড়াও মৌলিক কোষের মাধ্যমে জেনিটিক চিকিৎসা, ওষুধের মান উন্নয়ন, ভ্রুণের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করা ও বংশগতি বা জিন সংক্রান্ত গবেষণা করা যায়।
মৌলিক কোষ ও শক্তিশালী মৌলিক কোষ নির্মাণ গবেষণা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে জটিল বা অত্যাধুনিক ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই প্রযুক্তি গত কয়েক দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে, বিশেষ করে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নষ্ট হয়ে-যাওয়া কাঠামো মেরামত ও বিভিন্ন অঙ্গের জোড়া লাগানোর কাজে বড় ধরণের বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। ভ্রুণের মৌলিক কোষ এমন কিছু প্রাথমিক কোষ যেগুলো বিভিন্ন কোষে রূপান্তরিত হবার ক্ষমতা রাখে। গবেষণাগারের পরীক্ষায় দেখা গেছে ভ্রুণের মৌলিক কোষ শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত বা আঘাত-প্রাপ্ত অংশের কাঠামোয় জোড়া লেগে যায়। জোড়া লেগে যাবার পর কোষগুলো ঐ বিশেষ অঙ্গের কোষে পরিণত হয়। এ ছাড়াও এই কোষগুলো থেকে নতুন অনেক কোষ তৈরি করা যায় এবং নতুন এই কোষগুলোকে শরীরের বিভিন্ন অংশের কাঠামোয় ব্যবহার করা যায়। মৌলিক কোষগুলো এতো শক্তিশালী যে সেগুলো সংখ্যা বৃদ্ধির সময় ও বিভিন্ন অঙ্গে বা স্থানে প্রতিস্থাপনের সময় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। আর এইসব কারণেই রোইয়ান গবেষণা কেন্দ্রের আবিস্কার বা সাফল্যগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কথায় ইরানের এসব সাফল্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে ইসলামী এ দেশটির জন্য আরো অনেক বড় সাফল্য বয়ে আনতে পারে।

এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ইরানের নতুন উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত মেলায় প্রদর্শিত ৫১ টি প্রকল্পের মধ্যে কেবল একটি প্রকল্পের কথা বলেছি। এ ধরণের যে কোনো একটি সাফল্যই একটি দেশ বা জাতির জন্য মহা-গৌরবের বিষয়। এ জন্যেই দেখা যায় পাশ্চাত্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে কোন অগ্রগতির খবর শীর্ষ সংবাদে পরিণত হয় এবং পাশ্চাত্যের সাফল্য হিসেবে এ ধরণের অগ্রগতির কথা ব্যাপক মাত্রায় প্রচারিত হয়। অন্যদিকে নতুন প্রযুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল ও তৃতীয় বিশ্বের পার্থক্য ক্রমেই বেড়ে চলছে। ফলে বিংশ শতকের উন্নত বিশ্বকে আজ “অতি অগ্রসর বিশ্ব” এবং “হাই-টেক প্রযুক্তির অধিকারী” বলা হয়। এ বিষয়টি আজ স্পষ্ট বাস্তবতা হিসেবে ফুটে উঠেছে। বিশ্বের বহু দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এই ব্যবধান বা বৈষম্যের শিকার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর একক কর্তৃত্ব বজায় রাখার নীতি এবং এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর বৈষম্য ও অবিচারের কারণেই এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল ও তৃতীয় বিশ্বের ব্যবধান বা বৈষম্য দূর করার ওপর সব সময়ই জোর দিয়ে আসছেন। আসলে আত্মবিশ্বাস ও অধ্যাবসায় বা অব্যাহত কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে একচেটিয়া কর্তৃত্বের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব। এমনকি এ ক্ষেত্রে দর্শনীয় সাফল্য অর্জনও সম্ভব। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এক বছর আগেও রোইয়ান গবেষণা কেন্দ্র পরিদর্শন করে বলেছিলেন, বিজ্ঞান ও গবেষণাই অগ্রগতি অর্জনের চাবিকাঠি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আয়ত্ব করাকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক যাত্রা হিসেবে অভিহিত করেন এবং এ যাত্রাকে প্রাথমিক পর্যায়েই সীমিত না রাখার আহ্বান জানান।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেন, কোনো কোনো বৃহৎ শক্তি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে একচেটিয়া কর্তৃত্বাধীনে রাখতে চাইছে এবং বিশ্বকে উন্নত ও পশ্চাদপদ এ দুই অংশে চিরকালের জন্য বিভক্ত করে রাখতে আগ্রহী। কিন্তু জাতিগুলোর জাগরণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের ওপর চাপিয়ে রাখা এই আধিপত্যকামী ব্যবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব। আর এক্ষেত্রে সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রতিভা ও উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী ইরানের মুসলিম জাতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। রোইয়ান গবেষণা কেন্দ্রের ইরানী গবেষকদের বিস্ময়কর সব সাফল্য ঐ কাঙ্ক্ষিত আত্মবিশ্বাস, প্রতিভা ও শক্তিমত্তারই প্রমাণ ।