‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’_ জীবনানন্দের এই অমোঘ বাণী প্রত্যেকের জীবনে একদিন সত্যি সত্যিই ধরা দেয়। কবি মনের অপরূপ বাংলা যারা সাধারণ মানুষ তাদের চোখে কী আর সবসময় পড়ে! তবে কখনও কখনও নিশ্চয় চোখে পড়ে। কিশোরগঞ্জ যে কোন পর্যটকের কাছে অপরূপ রূপের অবারিত সৌন্দর্যের ডালা নিয়ে সবসময় হাজির হয়। এখানকার প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগের সভ্যতার নিদর্শন, হাওর, বিল আর সবুজ শ্যামলিমার হাতছানিতে প্রাণ জুড়ায়।

কিশোরগঞ্জকে বলা হয় ভাটির দেশ। ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে জানা যায়- অষ্টাদশ শতকে নবাব সিরাজ- উদ্-দৌলার কাছ থেকে কিশোরগঞ্জের প্রসিদ্ধ মসলিন নির্মাতা কৃষ্ণদাস বসাক বত্রিশ পরগণার জমিদারী লাভ করেন।

কিশোরগঞ্জের সুরম্য প্রাসাদ ‘বত্রিশ’ অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়। এর পাশে আছে বিশাল দীঘি। বিকেলে এই দীঘির পাশে বেড়ানো অত্যন্ত সুখকর। আখড়াবাজার অনেক পুরনো এলাকা। এখানে আছে একটি মন্দির, আর তার পাশেই চলি্লশের দশকে প্রতিষ্ঠিত গুরুদয়াল কলেজ রয়েছে। এ এলাকার শাহী মসজিদ ও পাগলা মসজিদ দু’টি শহরের অন্যতম আকর্ষণ। হয়বৎ নগরের প্রতিষ্ঠাতা হয়বৎ খানের অধঃস্তন তৃতীয় পুরুষ জোলকরণ খানের বিবি সাহেরা এই পাগলা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। হয়বৎ নগরের দেওয়ান বার ভঁূইয়া প্রধান বীর ঈশা খাঁ’র বংশধর জমিদারদের নিবাস হিসেবে আজও খ্যাত। এখানে রয়েছে পুরনো আমলের দালান-কোঠা।

বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হওয়ার কারণে কিনা জানি না, কিশোরগঞ্জের কিছু কিছু এলাকার নাম আমাকে মুগ্ধ করেছে। এ জন্যও হয়তো ঘুরে ঘুরে দেখা হয়েছে এ জেলার অনেক কিছু। নামগুলোর দু’-একটি না বলে নিজেকে সংবরণ করতে পারছি না। যেমন : সুখিয়া, আশুতিয়া, ঘাঘর, ঝাউদিয়া, হাঁপানিয়া, বত্রিশ, চেনাসুখিয়া, এসব নামের সঙ্গে ইতিহাসের কিংবা অঞ্চলের হয়তো কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। তবে সবচেয়ে মজার হচ্ছে- বিশেষত পাকুন্দিয়া উপজেলার যে কোন এলাকায় গিয়ে সবজিভরা ক্ষেত দেখে মনে অপরূপ সবুজিয়া-শ্যামলিমা বাংলার চিত্রকল্পই জেগে ওঠে। আমার মাঝে-মধ্যে মনে হয়েছে ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থাপত্যকীর্তি, বিখ্যাত মসজিদ এসবের কিছুই না দেখে শুধু সবুজের সমারোহের বৈচিত্র্য-বিপুলত্ব দেখে, আর হাওর-বিলের ধারে বসে পাখ-পাখালির কলকাকলী উপভোগ করেই কয়েক দিন কাটিয়ে দেয়া যায়।

বাংলার প্রধান মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। এ কবির জন্মস্থান পাতুয়াইর গ্রাম। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৫ মাইল দূরে পাতুয়াইরে রয়েছে চন্দ্রাবতীর মন্দির। এ মন্দিরটি ষোড়শ শতকে নির্মিত হয়। প্রাচীন কীর্তিতে ভরপুর আরেকটি এলাকা ‘এগারো সিন্দুর’। অতীত যেন এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। এখানকার সাদী মসজিদ, দুর্গ, শিলালিপি, রাস্তাঘাট যে কোন ভ্রমণপিপাসুর তৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে দেবে। এ তৃষ্ণা মেটাতে মনে জাগবে একের পর এক প্রশ্ন আর তার উত্তর খুঁজতে ছুটতে হবে এগারো সিন্দুরের অলিগলি। সাদী মসজিদের চারকোণে ৪টি মিনার, উত্তর-দক্ষিণে একটি করে দরজা, পশ্চিম দেয়ালে ভেতরের অংশে তিনটি সুন্দর মেহরাব রয়েছে। মসজিদের পোড়ামাটির চিত্রফলক এখনও মুগ্ধ করবে যে কাউকে। এখানকার শিলাপিপিতে লেখা রয়েছে সম্রাজ শাহজাহানের আমলে ১৬৬২ সারে সাদী নামের একজন এই মসজিদ তৈরি করেন। এগারো সিন্দুর থেকে উত্তরে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে চোখে পড়বে মসজিদপাড়া। এখানকার প্রধান আকর্ষণ এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ, যেটি সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় ১৬৬৯ সালে নির্মিত হয়।

মসজিদ পাড়া থেকে আরও উত্তরে ছায়া সুনিবিড় হিমেল হাওয়ার এক গ্রাম ‘গোরাই’। সব ঋতুই এখানে মোহনীয়। এখানেও আছে একটি সুন্দর মসজিদ। কথিত আছে এ মসজিদটি শায়েস্তা খানের আমলে ১৬৮০ সালে তৈরি হয়। মসজিদের মিনার ছাড়াও পূর্ব দেয়ালে ৩টি ও উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে ১টি করে দরজা আছে।

কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরগঞ্জ ইউনিয়নের নরসুন্দা নদী তীরে ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ীর অবস্থান। এক সময় এই এলাকাটি দুর্গম জঙ্গলাকীর্ণ ছিল বলে এর নাম হয় জঙ্গলবাড়ী। বার ভূঁইয়াদের শ্রেষ্ঠ বীর ঈশা খাঁর রাজধানী হিসেবে জঙ্গলবাড়ীর নাম মিশে আছে ইতিহাসে। এখানে রয়েছে ভগ্ন দুর্গপ্রাচীর, ধ্বংসপ্রাপ্ত ঈশা খাঁর দরবার হল, প্রাচীন মসজিদ, প্রায় মাটি চাপাপড়া একটি ভবনের ভিত্তিভূমি ও তার সামনে সান বাঁধানো ঘাটের বিশাল পুকুর।

কিশোরগঞ্জের বৃহত্তম গণহত্যার স্মৃতি ধরে আছে বড়ইতলা স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালের আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে এখানে সাড়ে তিন শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। জানা যায়, ‘৭১-এর ১৩ অক্টোবর দুপুর দুইটার দিকে ট্রেনে করে একদল মিলিশিয়া ও রাজাকার এসে নামে বড়ইতলায়। তাদের একটি দল পাশের কর্শাকড়িয়াইল দামপাড়া গ্রামে ঢুকে কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তারা বিনা উস্কানিতে দামপাড়া, কড়িয়াইল, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুর, চিকনিরচর, কালিকাবাড়ি ও ভুবিরচর গ্রামের চার শতাধিক মানুষকে ধরে এনে জড়ো করে বড়ইতলায়। এ সময় খবর আসে যে, গ্রামবাসী দুই মিলিশিয়াকে হত্যা করেছে। এ গুজবের সত্যতা যাচাই না করেই শত শত মানুষকে রেললাইনের পাশে দাঁড় করিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। বড়ইতলা হত্যাকা-ে ৩৬৫জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। একমাত্র চিকনিরচর গ্রামেরই দেড় শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। অনেকেই সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু পাক হানাদারদের নির্যাতনের চিহ্ন এখনও তাদের শরীরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এলাকাবাসী বড়ইতলার নাম দেয় শহীদনগর। স্থানীয়দের উদ্যোগে নির্মিত হয় স্মৃতিফলক। ২০০০ সালে ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এখানে নির্মিত হয় ৬৬৭ বর্গফুট এলাকায় স্মৃতিসৌধ।

কিশোরগঞ্জে গেলে এই জায়গাটি না দেখে ফেরা নিশ্চয় একজন বাঙালি হিসেবে খুব বেশি যৌক্তিক হবে না।

ঢাকার গুলিস্তানে অবস্থিত মহানগর নাট্যমঞ্চের বামে যে বাস টার্মিনাল সেখান থেকে বিআরটিসি, বত্রিশসহ বেশকিছু বাস প্রতিদিন আধাঘণ্টা/৪৫মিনিট পরপর ছেড়ে যায়। বিআরটিসির বাসে নরসিংদী পেরিয়ে কিশোরগঞ্জের একটি উপজেলা পাকুন্দিয়ায় আগে পৌঁছানো সম্ভব। মাত্র ৩/৪ঘণ্টার পথ। চাইলে পাকুন্দিয়া নেমে ওখান থেকেই কিশোরগঞ্জ জেলা ঘুরে দেখা শুরু করা যেতে পারে। অথবা ওই বাসেই জেলা শহরে পৌঁছে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখা সম্ভব। যেভাবেই যে কিশোরগঞ্জে যাক না কেন, এর সবখানের সবুজের ছোঁয়া, চারদিকে হাওর-বিল আর টুকরো টুকরো বনাঞ্চল অনায়াসে তাকে মুগ্ধ করবে। আর এগারসিন্দুর রয়েছে বাড়তি চমক হিসেবে।