কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে অবস্থিত আধুনিক স্থাপত্যের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন “শহীদী মসজিদ”। এ মসজিদটি এ অঞ্চলের ইতিহাসের এক বিরল নিদর্শন। মসজিদটির নাম ‘শহীদী মসজিদ” এ নামকরণ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কৌতূহলের অন্ত নেই। মূল শহরের প্রাণকেন্দ্রে মসজিদটির অবস্থান। শহীদী মসজিদের ইতিহাস খুব পুরনো না হলেও এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। মসজিদটিকে আধুনিকরূপে নির্মাণের ক্ষেত্রে যিনি অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি হলেন হযরত মাওলানা আতাহার আলী (রহঃ)। তিনি সিলেট জেলার বিয়ানী বাজার থানার ঘুঙ্গাদিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ও দ্বীনদার পরিবারে ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৌলভী আযীম খান-মায়ের নাম আতেরাহ বিবি। লোকশ্রুতি যে, মাওলানা আতাহার আলী (রহঃ) এর পূর্ব পুরুষগণ ইরানী ছিলেন। ঘটানাচক্রে তার বংশের এক পূর্ব পুরুষ নাম তার আশেক খান মতান্তরে হায়বত শাহ ইরান হতে ভারত বর্ষে এসে এক বছর দিল্লিতে অবস্থান করেন এবং পরে বাংলাদেশে আগমন ও বসবাস শুরু করেন।

ইল্‌ম অর্জনের সমৃদ্ধ হযরত মাওলানা আতাহার আলী (রহঃ) এর যোগ্যতা ও খ্যাতি চারদিক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তিনি বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিচক্ষণতার সাথে দায়িত্ব পালন শেষে কিশোরগঞ্জের বৌলাই-জমিদার বাড়িতে আসেন এবং পরবর্তীতে হয়বতনগরের দেওয়ান বাড়ি মসজিদের পেশ ইমাম ও শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমামের দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, কিশোরগঞ্জ শহরের পূর্বপ্রান্তে অদ্বিতীয় বড় ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ অবস্থিত। ধীরে ধীরে মাওলানা সাহেবের সুনাম-সুখ্যাতি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

দেওয়ান বাড়ি ছেড়ে নিজ বাড়ি ফেরার মানসে যখন তিনি ষ্টেশন অভিমুখে রওয়ানা হলেন তখন পুরান থানা রাস্তার উপর ডঃ শরফুদ্দীন (বাদশাহ মিয়া), মাওলানা ছাইদুর রহমান, মৌলভী আমির উদ্দীনসহ কয়েকজন সম্মানীত ব্যক্তি তাকে দু’একদিনের জন্য এখানে অবস্থানের আবেদন করেন। তারপর এখানকার একটি ছোট মসজিদে ইমামতির মধ্য দিয়ে কিশোরগঞ্জে স্থায়ী বসবাস এবং কীর্তিময় জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেন। বর্তমান কালের জনবসতিপূর্ণ পুরান থানাটি ছিল তখন অনেক নির্জন। শহীদী মসজিদের পশ্চিমাংশের ছোট একটি অংশ ‘পুরান থানা মসজিদ’ নামে পরিচিত ছিল। মাওলানা আতাহার আলী পুরান থানার এ মসজিদে আসেন ১৯৩৮ সালে। তার ওয়াজ নসিহত ও ধর্মোপদেশের কল্যাণে মুসুল্লীদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকায় মসজিদ সম্প্রসারণের প্রয়োজন দেখা দেয়।

এদিকে মাওলানা আতাহার আলী (রহঃ) এর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় দেখতে দেখতে ছোট্ট মসজিদটি এক সুবিশাল ও আজিমুশশান মসজিদে পরিণত হলো। যদিওবা তিনি সম্প্রসারণ কাজে বহু কঠিন সমস্যাবলীর সম্মুখীন হন। কিন্তু সকল প্রতিবন্ধকতার সম্মুখেই তিনি ছিলেন অপ্রতিরোদ্ধ। এরপরই মসজিদটি ঐতিহাসিক মসজিদে রূপান্তরিত হয় এবং নামকরণ করা হয় “শহীদী মসজিদ” নামে।

মসজিদের নির্মাণ সমাপ্তির পর তিনি ১৩৬৪ বাংলা সনের ৮ই কার্তিক মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এক অভূতপূর্ব বিশাল সুউচ্চ পাঁচতলা মিনারের ভিত্তি স্থাপন করেন।

মিনারের প্রত্যেক তলাকে সম্পূর্ণ পৃথক ও সু-প্রশস্ত কক্ষ রূপে ভিন্ন ভিন্ন কাজের উপযোগী করে নির্মাণ করেন। যেমন প্রথম তলায় লাইব্রেরী। দ্বিতীয় তলায় পাঠাগার। তৃতীয় তলায় রচনালয় এবং চতুর্থ তলায় সুধীর আসরের জন্য নির্ধারণ করে। মূলতঃ এর সুবিশাল উচ্চ স্থাপনা শুধু প্রদর্শনীর জন্যই নয়। গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদনের জন্য উপযুক্ত করেই গড়া হয়েছে পাঁচতলা মিনার। পাঁচতলার উপর অত্যন্ত সুন্দর করে গম্বুজ তৈরি করা হয়, যাতে আজানের সুর হ্নদয়স্পর্শী হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মসজিদের সংস্কারমূলক অবদানের ফলশ্রুতিতে মাওলানা আহাতার আলী (রহঃ) এর কাছে সর্বসাধারনের আনাগোনা বেড়ে যায়।

যার অকৃত্রিম ভালোবাসায় নিরলস প্রচেষ্টায় সেই ছোট্ট মসিজদটি বিশালাকার ধারণ করেছে এবং অত্যন্ত ভাব গাম্ভীর্য নিয়ে বুক ফুলিয়ে কিশোরগঞ্জের মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে সেই মহান পুরুষ মাওলানা আতাহার আলী (রহঃ) ১৯৭৬ ইং সনের ৬ অক্টোবর পরলোকগমন করেন।