এ জেলার মাটির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে লোক সংস্কৃতি। সখিনা, মলুয়া, মাধবী, মালঞ্চী কইন্যার অঞ্চল কিশোরগঞ্জ। ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন যে হারাণো গীতিকা সম্পদকে উদ্ধার করে ইংরেজীতে অনুবাদ করে আমাদেরকে বিশ্বের কাছে বরেণ্য করে তুলেছেন তার চুয়াল্লিশটি গীতিকার মধ্যে ত্রিশটি আমাদের পূর্ব ময়মনসিংহের।

কিশোরগঞ্জ জঙ্গলবাড়ীর কোচ রাজা লক্ষন হাজরা, সুশংরাজ রঘুপতি আর এগারসিন্দুর বেবুদ রাজার কাহিনী কিংবদন্তী। বাংলা সাহিত্যের মঙ্গল কাব্যের প্রথম রচয়িতা দ্বিজবংশী দাসের পূন্যভূমি এ কিশোরগঞ্জ। তাঁরই কন্যা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আদি মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। তিনিই রামায়নের সার্থক অনুবাদকারী ফোকলোর কাব্যের নায়িকা।

ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিগর্ভা কিশোরগঞ্জের বীরত্বগাঁথা আর বীর সন্তানদের নাম ইতিহাসের বিশাল অধ্যায়। এ অধ্যায়ের ভূবন কাপানো নাম-মহারাজ তৈলোক্যনাথ, ব্যারিষ্টার ভূপেশগুপ্ত, নগেনসরকার, বিবরেন চক্রবর্তী, জমিয়াত আলী, গঙ্গেশ সরকার, ওয়ালীনেওয়াজ খান, রেবতী বর্মনসহ অসংখ্য খ্যাতিমান স্বাধীনতা সংগ্রামী এ জনপদের বীর সন্তান।

ভাষা ও সংস্কৃতিঃ

ভাষাঃ প্রমিত ভাষা রীতির বাইরে অঞ্চলভেদে প্রত্যেক দেশেই একটি নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার এমন অনেক উপজেলা আছে যেগুলোতে আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রে অনেক বৈপরিত্য লক্ষ্য  করা যায়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে কিশোরগঞ্জের নিজস্ব ভাষা রীতি এ অঞ্চলের মানুষকে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে।

এ জেলার ভাষা রীতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় মানুষেরা অতীতকালের শব্দ বর্তমান কালের বাক্যে ব্যবহার করে থাকে। যেমন-খাইতামনা, যাইতামনা, ধরতামনা, করতামনা ইত্যাদি। এসকল শব্দ শুদ্ধ ভাষায় সাধারনতঃ অতীতকালে ঘটিত অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন-(সাধু ভাষায়) ‘আমি বাড়ীতে খাইতামনা’ (চলিত ভাষায়) ‘আমি তার বাড়ীতে খেতামনা’। কিন্তু কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে এই সকল শব্দ বর্তমানকালে ঘটমান অর্থে কথ্য ভাষায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন-আমি খাইতামনা (আমি খাবোনা), আমি যাইতামনা (আমি যাবোনা)।

কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি জেলার দূরবর্তী হাওররর উপজেলা অষ্টগ্রামের স্থানীয় অধিবাসীদের একটি নিজস্ব ভাষা আছে, যা একমাত্র স্থানীয় অধিবাসী ব্যতীত অন্যের পক্ষে বুঝে উঠা কঠিন। এ ভাষার স্থানীয় নাম ‘ছহুম ভাষা’। ছহুম ভাষার কিছু উদাহরণ নিম্নরুপ-টাইঙ্গা-সিগারেট বা বিড়িঃ ‘সাইর‌যারে টাইঙ্গা বেড়অ’ অর্থাৎ আমাকে একটা সিগারেট বা বিড়ি দাও। এছাড়াও জেলার অনেক কাপড়ের দোকান ও জুতোর দোকানগুলোতে মালিক-কর্মচারীরা একটি দুর্বোধ্য সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে থাকে। মূলতঃ ব্যবসায়িক গোপনীয়তা রক্ষার তাগিদ থেকেই এ ভাষার উদ্ভব। কবে এবং কিভাবে এ সাংকেতিক ভাষার সৃষ্টি তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও সুদীর্ঘকাল ধরে পুরুষানুক্রমিকভাবে দোকানগুলোতে এ ভাষার প্রচলন বলে জানা যায়।

সংস্কৃতিঃ ঐতিহ্যের প্রাচীনতা থাকলেও কিশোরগঞ্জ জেলায় সংস্কৃতি চর্চার সর্বগামী ব্যাপকতা খুব একটা প্রাচীন নয়। মূলতঃ উনবিংশ শতকের শেষদিকে এ অঞ্চলের মানুষ ব্যাপক সংস্কৃতি চর্চায় ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে। বড় বড় ব্যবসা কেন্দ্র এবং বানিজ্যিক এলাকাকে ঘিরেই এ জেলায় সংস্কৃতি চর্চার বলয় গড়ে উঠে।

কিশোরগঞ্জ জেলায় নাট্যাভিনয়ের সূচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন ধারণা পাওয়া যায়না। তবে উনবিংশ শতকের ষষ্ঠ দশকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমন্ত্রিত শিল্পীরা ভৈরবে এসে যাত্র পালা ‘রামলীলা’ পরিবেশন করেছিল বলে জানা যায়। অন্যদিকে ১৮৮৩ সালে নিকলী থানায় বিদেশী বণিকদের মাধ্যমে নাট্যাভিনয়ের প্রথম সূত্রপাত ঘটার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ১৯৩৫ সালে টাঙ্গাইল মহকুমার অধিবাসী নাট্য পাগল জনৈক রমনী প্রসাদ তালুকদার নিকলী উপজেলায় স্থানীয় আরো কিছু সংস্কৃতি বোদ্ধা ব্যক্তিকে নিয়ে ‘নিকলী থিয়েটার’ নামক একটি নাট্য সংগঠন গড়ে তোলেন। আপাদমস্তক নাটক পাগল এই মানুষটি নিকলী থিয়েটারের ব্যানারে কৃষ্ণকীর্তন, রাধাকৃষ্ণসহ পৌরানিক কাহিনী নির্ভর অনেক নাটক মঞ্চায়ন করেছেন।

 
বিংশ শতকের ত্রিশের দশকে ভৈরবের বেনীমাধব ভট্রাচার্য ‘ভৈরব অপেরা’ নামে একটি যাত্রা দল গঠন করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা উপলক্ষে যাত্রাভিনয়ের আয়োজনে ভৈরব অপেরা ছাড়াও কলকাতা থেকে যাত্রাদলকে আমন্ত্রন জানিয়ে আনা হতো।

 ১৯৪৮ সালে কতিপয় শিক্ষিত সংস্কৃতি কর্মীর সমন্বয়ে ভৈরবে হয় ‘ইয়ং ম্যানস প্রগ্রেসিভ এসোসিয়েশন’ ঐ বছর মহেদ্র গুপ্তের নাটক ‘টিপু সুলতান’ মঞ্চস্থ হয়। এতে সহ-নায়িকার ভূমিকায় বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং কথা সাহিত্যিক মিল্লাত আলী যথাক্রমে রুনী বেগম ও সুফিয়ার চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। এ দু’জন প্রথিতযশা ব্যক্তি ভৈরবে ‘আযান’ নাটকেও নারী চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন।

 স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কিশোরগঞ্জের সংস্কৃতির আঙ্গিনায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। জেলার আর্টস কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে নব উদ্দীপনায় এখানে নাটক ও সঙ্গীতের সুবাতাস বইতে শুরু করে। নবান্ন উৎসব শেষে পালাগান, বাউলগান, নাটক, লাঠিখেলা,  যাত্রাপালার আসর বসতে থাকে। এখনও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে প্রখ্যাত বাউল সঙ্গীত শিল্পীদের এনে সারা রাতব্যাপী বাউল গানের আসর বসে। শিশু একাডেমী জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করার জন্য আগামী দিনের কুশলী শিল্পী সৃষ্টিতে একটি গুরুত্বপূর্ন সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

সর্বোপরি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কিশোরগঞ্জ এক গৌরবান্বিত জেলার নাম। নাটক, যাত্রাপালা, রেডিও, টেলিভিশন, এমনকি চলচ্চিত্রেও কিশোরগঞ্জ জেলার অবদান অনস্বীকার্য।