শাহ আবদুল করিমের এই গানে আমরা ঘাটু গান সম্পর্কে জানতে পাই। তবে দুঃখের বিষয় মূল গানে ঘাটু শব্দ থাকলেও এখনকার অনেক গানে ঘাটু শব্দের স্থলে পল্লী গান/মুর্শিদী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কেন ঘাটু শব্দ বাদ দেয়া হয়েছে তা এক রহস্য। আমাদের লোকসঙ্গীত অনেক বৈচিত্র্যময় ছিল তা ঘাটু গান দেখলে বোঝা যায়। আজকে চলুন ঘাটু গানের সাতকাহন জেনে নেই।

“আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটু গান গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।”

ঘাটু গান (Ghatu Gaan): ‘ঘাটু গান’-এর উচ্চারণ নিয়ে অঞ্চলভেদে ভিন্নতা রয়েছে। কোথাও কোথাও শব্দটিকে ঘাঁটু, ঘেটু, ঘেঁটু, গেন্টু, ঘাডু, গাড়ু, গাঁটু বা গাডু বলা হয়। তবে নেত্রকোনা অঞ্চলে এটি ’ঘাটু’ এবং ’গাডু’ নামেই বহুল প্রচলিত। একটু শিক্ষিত জনরা ‘ঘাটু গান’ বলেন। সুনামগঞ্জ এলাকার জলসুখা গ্রামের বাউল আখড়ায় প্রথম ঘেঁটু গান শুরু হয়। সুনামগঞ্জ ছাড়াও নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ময়মনসিংহ এবং গোটা হাওড় অঞ্চল ছিল এই গানে আবাসভূমি।

‘ঘাটু গান’ এর নামকরণের ইতিহাসও একেক জনের বর্ণনায় একেক রকম। সাধারণের ধারণা, ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে গাওয়া হতো বলে এর নাম হয়েছে ঘাটু গান। নেত্রকোনার স্থানীয় লোক সাহিত্য সংগ্রাহক গোলাম এরশাদুর রহমান তার ’নেত্রকোনার লোকগীতি পরিচয়’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন: “ঘাটু নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয়ভাবে আদিকালের সমঝদারদের বক্তব্য ছিল- কৃষ্ণের বাঁশির ঘাট শব্দ থেকে ঘাটু নামকরণ হয়। কারণ ঘাটু ছেলেটিকে মূলত নাচে ও গানে নিয়ন্ত্রণ করে বাঁশি’’।

ঘাটু গানে প্রধান আকর্ষণ ঘাটু চরিত্র। একজন সুন্দর কিশোর মেয়ের সাজে সজ্জিত হয়ে নৃত্য করত। ঘাটু ছোকড়াদের মাথায় লম্বা চুল রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। তারা চুলে বেণী ও খোঁপা বাঁধতেন। উকিল মুনশীর নাম অনেকেই শুনেছেন। তিনি শৈশবে ঘাটু গানের ঘাটু ছিলেন। তাছাড়া আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও ঘাটু গানের (লেটো গান) দলে ছিলেন।

ঘাটু গানের মূল বিষয়বস্তু ছিল রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলা। চিরায়ত এ প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করেই রচিত হতো ঘাটু দলের গান। আসরে উঠে ঘাটু প্রথমে বন্দনা গাইতেন। এরপর প্রেম, প্রেমতত্ত্ব, মান, অভিমান, বিচ্ছেদ, মিলন, সন্ন্যাস প্রভৃতি বিষয় অবলম্বন করে প্রবাহিত হতো তার গীতধারা। শ্রী কৃষ্ণের মথুরা গমনের পর অথবা তার সান্নিধ্য না পেয়ে রাধার বিরহ উপলক্ষ করে রচিত বিচ্ছেদ গানগুলোতে পরিলক্ষিত হতো চিরন্তন বেদনার সুর। অনেকের মতে, ছম ঘাটু গানের রাধা-কৃষ্ণের বিরহ সঙ্গীত থেকেই নেত্রকোনার অন্যান্য লোক সংগীতে ‘রাই ধারা’ ও ‘শ্যাম ধারা’র উদ্ভব। ছম জাতীয় মূরলী শ্রেণীভুক্ত একটি ঘাটু গান :

আমার মনের বেদন
সে বিনে কেউ জানে না
কালা যখন বাঁজায় বাঁশি
তখন আমি রান্তে বসি
বাঁশির সুরে মন উদাসী
ঘরে থাকতে পারি না
আমার মনের ……..।

হিন্দু ধর্মের রাঁধা-কৃষ্ণ কাহিনীই ঘাটু গানের মূল প্রতিপাদ্য হলেও এক পর্যায়ে ইসলাম ধর্মের নানা বিষয়সহ নর-নারীর সাধারণ প্রেম-বিরহ এবং সমসাময়িক বিষয়বস্তুও উঠে আসে ঘাটু গানে। কারণ, হিন্দু-মুসলিম উভয় সমপ্রদায়ের লোকজনই ছিল ঘাটু গানের দর্শক-স্রোতা। ইসলাম ধর্মের নানা কাহিনী নিয়ে রচিত গানগুলো কোথাও কোথাও লেটো গান নামে পরিচিত।

ঘাটু গানে ধীরে ধীরে কদর্যতা ঢুকে যায়। হাওড় অঞ্চলের সৌখিনদার লোকের ঘাটুদের ভাড়া করে বাসায় আনা শুরু করলো। তাদের সাথে রাত কাটানো শুরু করলো। প্রকাশ্য এই সমকামিতা সেই সময় স্বীকৃত ছিল। ঘেঁটুপুত্র রাত্রিযাপন করে শৌখিনদের সঙ্গে। শৌখিনদারের স্ত্রী চোখের জল ফেলেন; তিনি ঘেঁটুপুত্রকে দেখেন তার সতীন হিসেবে।এই নিয়ে গান আছে…

“আইছে সতিন ঘেঁটুপুলা
তোরা আমারে বাইন্ধা ফেল
পুব হাওরে নিয়া…”

বৃটিশ শাসন আমলে এবং বৃটিশরা চলে যাবার পরেও ঘেঁটু গান এর আসর হত। তবে এই গান আজ বিলুপ্ত। সম্প্রতি হুমায়ুন আহমেদ ঘেঁটু গানের উপর ভিত্তি করে ”ঘেঁটু পুত্র কমলা” নামে একটি চলচিত্র বানিয়েছেন।

সুত্রঃ লোরক