১৯১৬ সালে ময়মনসিংহের কবি চন্দ্রকুমার দে প্রথম সেই এলাকার প্রচলিত পালাগান বা গাথাগুলি সংগ্রহ করেছিলেন। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের উত্সাহে তা পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত পালা ময়মনসিংহ গীতিকা নামেই পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৬ নাগাদ ক্ষিতীশ মৌলিক (প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা) এই ময়মনসিংহের পালাগুলির আরও একটি সম্পাদিত রূপ প্রকাশ করেন ।

প্রকাশিত হবার পরেই এই গাথাগুলি রসিক সমাজে প্রভূত সমাদর লাভ করে। কাব্যগুণ, সরলতা, বাংলার পল্লিজগতের সুর, রস, ও ঘ্রাণে সমৃদ্ধ এই সকল পালা, বাংলার লোক সাহিত্যের এক নতুন দিক খুলে দেয়। এর প্রাচীনতা নিয়ে পণ্ডিতেরা এখনও সহমত পোষণ করতে পারেন নি। লোক সাহিত্য বলা হলেও এই পালাগুলির বিশেষ বিশেষ কবিদের লিখিত রচনা। তাই এগুলি কোন সমাজের সাধারণ সম্পত্তি নয়। লোকমুখে ফিরে ফিরে, সংগ্রাহক, সম্পাদক এবং প্রকাশকদের হাত পড়ে যে এগুলি নিজের প্রাচীনতা ও স্বকীয় বিশিষ্টতা অনেকটাই হারিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন – “বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলি ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুষ্করিণী; কিন্তু ময়মনসিংহ গীতিকা পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বত উচ্ছ্বসিত উত্স, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। বাংলা সাহিত্যে এমন আত্ম-বিস্মৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয়নি ।”

মৈমনসিংহ গীতিকা গুলিতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি  সংস্কৃতিই দেখতে পাওয়া যায়। এদের বৈশিষ্ট হল এই যে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে প্রধানত ধর্মাশ্রিত হলেও এদের উপর ধর্মের প্রভাব খুবই অল্প। এগুলি অধিকাংশই  প্রণয়মূলক । এদের মধ্যে ফুটে উঠেছে পূর্ববঙ্গের পল্লী-জীবনের অপূর্ব আলেখ্য। এই পল্লী-জীবনের পটভূমিকায় বর্ণিত হয়েছে নায়ক নায়ীকাদের প্রেম ভালবাসা। এই গীতিকাগুলির মধ্যেই আমরা পেয়েছি ষোড়শ শতকের প্রথম বাঙালী মহিলা কবি চন্দ্রাবতীকে যাঁর নিজের জীবনই কিংবদন্তী হয়ে “চন্দ্রাবতী” পালায় পর্যবসিত হয়েছে। তাঁর লেখা রামায়ণ কথা একটি এমন রচনা যেখানে রামের গুণগানের বদলে সীতাদেবীর দুঃখ দুর্দশাই তিনি বর্ণনা করেছেন। একজন নারীর দৃষ্টিতে এই মহাকাব্য রচণা স্বাভাবিকভাবেই পণ্ডিত সমাজে অবাঞ্ছিত বলেই তাকে দুর্ব্বল ও অসমাপ্ত সাহিত্য আখ্যা দিয়ে সরিয়ে রাখা হয়েছিল।

বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতী একদিন পূজার জন্য ফুল তুলতে গেলে সুন্ধ্যা গ্রামের জয়ানন্দের সাথে দেখা হয়। প্রথমদর্শনেই জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর প্রেমে পড়ে যান এবং প্রেম নিবেদন করে একটি বিদায় পত্র লেখেন। তাদের বাবা-মায়ের সম্মতিতে তাদের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়। এরইমধ্যে এক মুসলমান তরুণী তাদের মধ্যে ঢুকে পরলে আসন্ন প্রণয়কাব্য করুণ উপাখ্যানে পরিণত হয়। গীতিকাব্যটি রচনা করেছেন নয়ানচাঁদ ঘোষ, আনুমানিক ২৫০ বছর আগে। নেয়া হয়েছে দীনেশচন্দ্র সেন সংকলিত মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে। মোট ৩৫৪টি ছত্র আছে এতে, দীনেশচন্দ্র সেন এগুলোকে ১২টি অঙ্কে ভাগ করেছেন।

 

১) ফুল তোলা

“চাইরকোনা পুষ্কুনির পারে চম্পা নাগেশ্বর।
ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর।।”
“আমার বাড়ী তোমার বাড়ী ঐ না নদীর পার।
কি কারণে তুল কন্যা মালতীর হার।।”
“প্রভাতকালে আইলাম আমি পুষ্প তুলিবারে।
বাপেত করিব পূজা শিবের মন্দিরে।।”
“বাছ্যা বাছ্যা ফুল তুলে রক্তজবা সারি।
জয়ানন্দ তুলে ফুল ঐ না সাজি ভরি।।
জবা তুলে চম্পা তুলে গেন্দা নানাজাতি।
বাছিয়া বাছিয়া তুলে মল্লিকা-মালতি।।
তুলিল অপরাজিতা আতসী সুন্দর।
ফুলতুলা হইল শেষ আনন্দ অন্তর।।
এক দুই তিন করি ক্রমে দিন যায়।
সকালসন্ধ্যা ফুল তুলে কেউনা দেখতে পায়।।
ডাল যে নোয়াইল ধরে জয়ানন্দ সাথী।
তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী।।
একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায়।
সেইত না মালা দিয়া নাগরে সাজায়।।

 

২) প্রেমলিপি

পরথমে লিখিল পত্র চন্দ্রার গোচরে।
পুষ্পপাতে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে।। *
পত্র লেখে জয়ানন্দ মনের যত কথা।
“নিতি নিতি তোলা ফুলে তোমার মালা গাঁথা।।
তোমার গাঁথা মালা লইয়া কন্যা কান্দিলো বিরলে।
পুষ্পবন অন্ধকার তুমি চল্যা গেলে।।
কইতে কগেলে মনের কথা কইতে না জুরায়।
সকল কথা তোমার কাছে কইতে কন্যা দায়।।
আচারি তোমার বাপ ধর্ম্মেকর্ম্মে মতি।
প্রাণের দোসর তার তুমি চন্দ্রাবতী।।
মাও নাই বাপ নাই থাকি মামার বাড়ী।
তোমার কাছে মনের কথা কইতে নাহি পারি।।
যেদিন দেখ্যাছি কন্যা তোমার চান্দবদন।
সেইদিন হইয়াছি আমি পাগল যেমন।।
তোমার মনের কথা আমি জানতে চাই।
সর্ব্বস্ব বিকাইবাম পায় তোমারে যদি পাই।।
আজি হইতে ফুলতোলা সাঙ্গ যে করিয়া।
দেশান্তরি হইব কন্যা বিদায় যে লইয়া।।
তুমি যদি লেখ পত্র আশায় দেও ভর।
যোগল পদে হইয়া থাকবাম তোমার কিঙ্কর।।”

* আড়াই অক্ষর : অতি সংক্ষিপ্ত। আড়াই অক্ষরে মন্ত্রের কথা অনেক প্রাচীন বাঙ্গালা পুঁথিতেই আছে। ময়মনসিংহের গীতি-কাব্যগুলির মধ্যে অনেক জায়গাতেই আড়াই অক্ষরে লিখিত চিঠির কথা পাওয়া যায়।

 

৩) পত্র দেওয়া

আবে করে ঝিলিমিলি সোনার বরণ ঢাকা।
প্রভাতকালে আইল অরুণ গায়ে হলুদ মাখা।। *
হাতেতে ফুলের সাজি কন্যা চন্দ্রাবতী।
পুষ্প তুলিতে যায় পোথাইয়া রাতি।। **
আগে তুলে রক্তজবা শিবেরে পূজিতে।
পরে তুলে মালতীফুল মালা না গাঁথিতে।। ***

হেনকালে নাগর আরে কোন কাম করে।
পুষ্পপাতে লইয়া পত্র কন্যার গোচরে।।
“ফুল তুল ডাল ভাঙ্গ কন্যা আমার কথা ধর।
পরেত তুলিবা ফুল চম্পা-নাগেশ্বর।।”

“পুষ্প তোলা হইল শেষ বেলা হইল ভারি।
পূবেত হইল বেলা দণ্ড তিন চারি।।
আমারে বিদায় কর না পারি থাকিতে।
বসিয়া আছেন কপিতা শিবেরে পূজিতে।।”

“আজিত বিদায় লো কন্যা জনমের মত।”
চন্দ্রার হাতে দিল আরে সেই পুষ্পপাত।।
পুত্র নাইসে নিয়া কন্যা কোন কাম করে।
সেইক্ষণ চল্যা গেল আপন বাসরে।।

* আবে … … … মাখা : অরুণদেবের স্বর্ণ বর্ণ মেঘ ভেদ করে ঝিলমিল করছে। তিনি হলুদ দ্বারা স্নাত হয়ে উদিত হয়েছেন। এখানে বিয়ের সময় বর-কন্যাদের হলুদ দ্বারা স্নাত হওয়ার কথা বোঝান হয়েছে।
** পোথাইয়া : পোহাইয়া
*** “না” অর্থশূন্য হলেও এখানে “হ্যাঁ” অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে মূলত কথাটার উপর জোর দেয়ার জন্য।

 

৪) বংশীর শিবপূজা, কন্যার জন্য বরকামনা

পুষ্পপাত বান্ধি কন্যা আপন অঞ্চলে।
দেবের মন্দির কন্যা ধোয় গঙ্গার জলে।।
সম্মুখে রাখিল কন্যা পূজার আসন।
ঘসিয়া লইল কন্যা সুগন্ধি চন্দন।।
পুষ্পপাতে রাখে কন্যা শিবপূজার ফুল।
আসিয়া বসিল ঠাকুর আসন উপর।।

পূজা করে বংশীবদন শঙ্করে ভাবিয়া। *
চিন্তা করে মনে মনে নিজ কন্যার বিয়া।।
“এত বড় হইল কন্যা না আসিল বর।
কন্যার মঙ্গল কর অনাদি শঙ্কর।।
বনফুলে মনফুলে পূজিব তোমায়।
বর দিয়া পশুপতি ঘুচাও কন্যাদায়।।
সম্মুখে সুন্দরী কন্যা আমি যে কাঙ্গাল।
সহায়-সঙ্গতি নাই দরিদ্রের হাল।।”

এক পুষ্প দিল বাপে শিবের চরণে।
ঘটক আইবে শীঘ্র বিয়ার কারণে।।
আর পুষ্প দিল বাপ বড়ঘরের বর।
“আমার কন্যার স্বামী হউক দেব পুরন্দর।।”
আর ফুল দিল বাল কুলশীল পাইতে।
বংশ বড় ভট্টাচার্য্য খ্যাতি রাখিতে।।
বর মাগে বংশীদার ভূমিতে পড়িয়া।
“ভাল ঘরে ভাল বরে কন্যার হউক বিয়া।।”

* বংশীবদন : সম্ভবত বংশীদাসের সম্পূর্ণ নাম ছিল বংশীবদন।

৫)  চন্দ্রার নির্জ্জনে পত্রপাঠ

পূজার যোগার দিয়া কন্যা নিরালায় বসিল।
জয়ানন্দের পুষ্পপাত যতনে খুলিল।।
পত্র পইড়ে চন্দ্রাবতীর চক্ষে বয়ে পানি।
কিবা উত্তর দিব কন্যা কিছুই না জানি।।
আর বর পড়ে পত্র চক্ষে বয় ধারা।
“এমন কেন হইল মন শুকের পিঞ্জরা।।
দেখি শুনি সেই ডাল ফুল তুল্যা আনি।
বয়স হইছে এখন হইলাম অরক্ষীনি।।
জৈবন আইল দেহে জোয়ারের পানি।
কেমনে লিখিব পত্র প্রাণের কাহিনী।।
কিমতে লিখিব পত্র বাপ আছে ঘরে।
ফুল তুলে জয়ানন্দ ভালবাসি তারে।।
ছোট হইতে দেখি তারে প্রাণের দোসর।”
সেই ভাবে লেখে কন্যা পত্রের উত্তর।।
“ঘরে মোর আছে বাপ আমি কিবা জানি।
আমি কেমনে দেই উত্তর অবলা কামিনী।।”

যত না মনের কথা রাখিল গোপনে।
পত্রখানি লেখে কন্যা অতি সাবধানে।।
চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী করি মনের দিকে চাইয়া।
জয়ানন্দ মাগে বর ধর্ম্ম সাক্ষী দিয়া।। *
শিবের চরণে কন্যা উদ্দেশে করে নতি।
পত্র পাঠাইয়া দিল কন্যা চন্দ্রাবতী।।
পুষ্প তুলিতে কন্যা আর নাহি যায়।
এই মতে সুখে দুঃখে দিন বইয়া যায়।।

* জয়ানন্দ মাগে বর : জয়ানন্দকে বরস্বরুপ পেতে প্রার্থনা করল।

 

৬) নীরবে হৃদয় দান

বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে চম্পা-নাগেশ্বর।
পুষ্প তুলিতে কন্যা আইল একেশ্বর।।
“তোমারে দেখিব আমি নয়ন ভরিয়া।
তোমারে লইব আমি হৃদয়ে তুলিয়া।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা আছে মালতী-বকুল।
আঞ্চল ভরিয়া তুলব তোমার মালার ফুল।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে রক্তজবা-সারি।
তোমারে করিব পূজা প্রাণে আশা করি।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে মল্লিকা-মালতী।
জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার মতন পতি।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে কেতকী-দুস্তর।
কি জানি লেখ্যাছে বিধি কপালে আমার।।”
এইরূপে কান্দে কন্যা নিরালা বসিয়া।
মন দিয়া শুন কথা চন্দ্রাবতীর বিয়া।।

 

৭)  বিবাহের প্রস্তাব ও সম্মতি

একদিন ত না ঘটক আইল ভট্টাচার্য্যের বাড়ী।
“তোমার ফহরে আছে কন্যা পরমা সুন্দরী।।
কুলে শীলে তুমি ঠাকুর চন্দ্রের সমান।
না দেখি এমন বংশ এথায় বিদ্যমান।।
বয়স হইল কন্যা রূপে বিদ্যাধরী।
ভাল বরে দেও বিয়া ঘটকালি করি।।”
“কেবা বর কিবা ঘর কহ বিবরণ।
পছন্দ হইলে দিব মনের মতন।।”
ঘটক কহিল “সুন্ধ্যা” গ্রামে ঘর। *
চক্রবর্ত্তী বংশে খ্যাতি কুলিনের ঘর।।
জয়ানন্দ নাম তাঁর কাত্তিক কুমার।
সুন্দর তোমার কন্যা যোগ্য বর তার।।
দেখিতে সুন্দর কুমার পড়ুয়া পণ্ডিত।
নানা শাস্ত্র জানে বর অতি সুপণ্ডিত।।
সূর্য্যের সমান রূপ বংশের দুলাল।
সুখেতে থাকিব কন্যা জানি চিরকাল।।
পশ্চিমাল বাতাসে দেখ শীতে লাগে কাটা।
এখন ধইরাছে দেখ মধ্যি গাঙ্গে ভাটা।।
আম আগছে নয়া পাতা ধরিয়াছে বউল।
এই মাসে বিয়া দিতে নাহি গণ্ডগোল।।

করকুষ্টি বিচারিয়া সম্বন্ধ মিলায়।
ভালা বরে কন্যা বিয়া দেওয়া বড় দায়।।
কুষ্টি বিচারি কৈল “সর্ব্ব সুলক্ষণ।
বরকন্যার এমন মিল ঘটে কদাচন।। **
কুষ্টিতে মিলিছে ভাল যখন এই বরে।
এই বরে কন্যাদান করিব সুস্থরে।।” ***

* সুন্ধ্যা : সুন্ধা নদীর তীরের গ্রাম
** কদাচন : কদাচিৎ
*** সুস্থরে : নিশ্চয়

 

৮ ) বিবাহের আয়োজন

সম্বদ্ধ হইল ঠিক করি লগ্ন স্থির।
ভাল দিন হইল ঠিক পরে বিবাহের।।
দক্ষিণের হাওয়া বয় কুকিল করে রা।
আমের বউলে বস্যা গুঞ্জে ভ্রমরা।।
নয়া পাতা যত গাছে নয়া লতা ঘিরে।
ভাল দিন ঠিক হইল শঙ্করের বরে।।
সেই ত দিনে হইব বিয়া সর্ব্ব সুলক্ষণ।
পানখিল দিয়া করে বিয়ার আয়োজন।।
পাড়ার যতেক নারী পান খিলায়।
যতেক নারীতে মিলি তাঁর গান গায়।।

জয় জুকার গীত আর বাজে ঢুল।
উঠানে আকিল কত নানান জাতি ফুল।।
আধিয়া পুছিয়া সবে পানখিল দিয়া। *
আয়োজন করে সবে উতযোগ হইয়া।।
বিবাহের যত কিছু করে আয়োজন।
যতেক দেবতাগণের করিল পূজন।।
পূজিল শঙ্করে আগে দেব অনাদি।
অন্তরে যাহার নাম রাখিয়াছে বাধি।।
একে একে কৈল পূজা যত দেব আর।
শ্যামাপূজা একাচূড়া বনদূর্গা মার।।

আদিবাস হইল শুভ বিয়ার পূর্ব্বদিনে।
ক্রিয়াকাণ্ড আদি যত হইল সুবিধানে।।
চুরপানি ভরে সবে উঠিয়া প্রভাতে।
গীত জুকার যত হইল বিধিমতে।।
আব্যধিক করে বাপে মণ্ডপে বসিয়া।
তার মাটি কাটে যন্ত সধবা মিলিয়া।।
সেই দা মাটিতে ইটা তৈয়ার করিয়া।
পঞ্চ নারী মিলি দিল তৈল লাল দিয়া।।
আব্যধিক হইল শেষ জানি এক মতে।
সোহাগ মাগিল আর মায় বিধিমতে।।

আগে চলে কন্যার মায় ডালা মাথায় লইয়া।
তার পাছে কন্যার খুড়ি লোটা হাতে লইয়া।।
তার পরে যত নারী গীট জুকারে।
সহাগ মাগিল কত বাড়ী বাড়ী ফিরে।।

* পানখিল : পানের খিলি। বাংলাদেশে বিয়ের অনুষ্ঠানে পান খাওয়ার প্রচলন প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে।

 

৯)  মুসলমান কন্যার সাথে জয়চন্দ্রের ভাব

পরথমে হইল দেখা সুন্ধা নদীর কূলে।
জল ভরিতে যায় কন্যা কলসী কাকালে।।
চলনে খঞ্জন নাচে বলনে কুকিলা।
জলের ঘাটে গেলে কন্যা জলের ঘাট লালা।
“কে তুমি সুন্দরী কন্যা জলের ঘাটে যাও।
আমি অধমের পানে বারেক ফির‍্যা চাও।।
নিতি নিতি দেখ্যা তোমায় না মিটে পিয়াস।
প্রাণের কথা কও কন্যা মিটাও মনের আশ।।
পরকাশ কইরা কইতে নারি মনের ধর।
তুমি কন্যা এই জগতে প্রাণের দোসর।”

সরমে মরণ আইল কথা কওয়া দায়।
জলের ঘাটে গিয়া নাগর উকিজুকি চায়।।
লিখিয়া রাখিল পত্র ইজল গাছের মূলে।
এইখানে পড়িব কন্যা নয়ন ফিরাইলে।।
“সাক্ষী হইও ইজল গাছ নদীর কূলে বাসা। *
তোমার কাছে কইয়া গেলাম মনের যত আশা।।
এইখান আসিব কন্যা সুন্দর আকার।
এই পত্র দেখাইও আমার সমাচার।।
অন্ধকারের সাক্ষী তোমরা চান্দ আর ভানু।
এইখানে আসিবে কন্যা সোনার বরণ তনু।।
সোনার বরণ তনু কন্যা চম্পকবরণী।
তার কাছে কইও আমার দুঃখের কাহিনী।।
ফির‍্যা আসে জলের ঢেউ পায়ের কাছে খাড়া।
এইখান বসিয়া আমি দেখিন পশরা।।”

ভাবিয়া চিন্তিয়া নাগর যুক্তি স্থির কৈল।
কালি প্রাতে তুলতে ফুল পুষ্পবনে গেল।।
যে খান ফুট্যাছে ফুল মালতী-মল্লিকা।
ফুট্যা আছে টগর-বেলি আর শেফালিকা।।
হাতেতে ফুলের সাজি কপালে তিলক-ছটা।
ফুল তুলিতে যায় কুমার মনে বিন্ধ্যা কাঁটা।।

* ইজল : হিজল গাছ

 

১০)  দুঃসংবাদ

ঢুল বাজে ডাগর বাজে জয়াদি জুকার।
মালা গাঁথে কুলের নারী মঙ্গল আচার।।
এমন কালে দৈবেতে করিল কোন কাম।
পাপেতে ডুবাইল নাগর চৈদ্দ পুরুষের নাম।।
কি হইল কি হইল কথা নানান জনে কয়।
এই যে লোকেরা কথা প্রত্যয় না হয়।।
পুরীতে জুড়িয়া উঠে কান্দনের রোল।
জাতিনাশ দেখ্যা ঠাকুর হইল উতরুল।।
“কপালের দোষ, দোষ নহে বিধাতার।
যে লেখ্যা লেখ্যাছে বিধি কপালের আমার।।
মুনির হইল মতিভ্রম হাতীর খসে পা।
ঘাটে আস্যা বিনা ঝড়ে ডুবে সাধুর না।।”
পাড়া-পড়সি কয় “ঠাকুর কইতে না জুয়ায়।
কি দিব কন্যার বিয়া ঘটল বিষম দায়।।
অনাচার কেল জামাই অতি দুরাচার।
যবনী করিয়া বিয়া জাতি কৈল মার।।”
শিরেতে পড়িল বাজ মঠের মাথায় ফোড়।
পুরীর যত বাদ্যভাণ্ড সব হৈল দূর।।
ধুলায় বসিল ঠাকুর শিরে দিয়ে হাত।
বিনাদোষে হইল যেন শিরে বজ্রপাত।।

 

১১) চন্দ্রার অবস্থা

“কি কর লো চন্দ্রাবতী ঘরেতে বসিয়া।”
সখিগণ কয় কথা নিকটে আসিয়া।।
শিরে হাত দিয়া সবে জুড়য়ে কান্দন।
শুনিয়া হইল চন্দ্রা পাথর যেমন।।
না কান্দে না হাসে চন্দ্রা নাহি বলে বাণী।
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী।।
মনেতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে।
জানিতে না দেয় কন্যা জল্যা মরে মনে।।

এক দিন দুই দিন তিন দিন যায়।
পাতেতে রাখিয়া কন্যা কিছু নাহি খায়।।
রাত্রিকালে শর-শয্যা বহে চক্ষের পানি।
বালিশ ভিজিয়া ভিজে নেতের বিছানি।।
শৈশবের যত কথা আর ফুলতুলা।
নদীর কূলেতে গিয়ে করে জলখেলা।।
সেই হাসি সেই কথা সদা পড়ে মনে।
ঘুমাইলে দেখিব কন্যা তাহারে স্বপনে।।
নয়নে না আসে নিদ্রা অঘুমে রজনী।
ভোর হইতে উঠে কন্যা যেমন পাগলিনী।।
বাপেত বুঝিল তবে কন্যার মনের কথা।
কন্যার লাগিয়া বাপের হইল মমতা।।
সম্বন্ধ আসিল বড় নানা দেশ হইতে।
একে একে বংশীদাস লাগে বিচারিতে।।

চন্দ্রাবতী বলে “পিতা, মম বাক্য ধর।
জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর।।
শিবপূজা করি আমি শিবপদে মতি।
দুঃখিনীর কথা রাখ কর অনুমতি।।”

অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে।
“শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে।।”*

* জয়ানন্দকে ভুলে যেতে চন্দ্রাবতী রামায়ণ লিখেছিলেন, কিন্তু মুদ্রিত হয়নি। এটার পাণ্ডুলিপি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে আছে।

১২)  শেষ অঙ্ক

নির্ম্মাইয়া পাষাণশিলা বানাইলা মন্দির।
শিবপূজা করে কন্যা মন কর স্থির।।
অবসরকালে কন্যা লেখে রামায়ণ।
যাহারে পড়িলে হয় পাপ বিমোচন।।
জন্মথ থাকিব কন্যা ফুলের কুমারী। *
একনিষ্ট হইয়া পূজে দেব ত্রিপুরারী।।
শুধাইলে না কয় কথা মুখে নাহি হাসি।
একরাত্রে ফুটা ফুল ঝুইরা হইল বাসি।।
এমন কালেতে শুন হইল কোন কাম।
যোগাসনে বৈসে কন্যা লইয়া শিবের নাম।।
বম্‌ বম্‌ ভোলানাথ গাল-বাদ্য করি।
বিহিত আচারে পূজে দেব ত্রিপুরারী।
বৈশাখ মাসেতে হয় রবি খরতর।
গাছেতে পাকিল আম অতি সুবিস্তর।।
বারতা লইয়া আসে পত্রে ছিল লেখা।
চন্দ্রাবতী সঙ্গেতে করিতে আইল দেখা।।
এই পত্রে লিখিয়াছে দুঃখের ভারতী।
জয়ানন্দ দিছে পত্র শুন চন্দ্রাবতী।
পত্রে পড়ীল কন্যা সকল বারতা।
পত্রেতে লেখ্যাছে নাগর মনের দুঃখ কথা।।
“শুনরে প্রাণের চন্দ্রা তোমারে জানাই।
মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হইছে ছাই।।
অমৃত ভাবিয়া আমি খাইয়াছি গরল।
কন্ঠেতে লাগিয়া রইছে কাল-হলাহল।।
জানিয়া ফুলের মালা কালসাপ গলে।
মরণে ডাকিয়া আসি আন্যাছি অকালে।।
তুলসী ছাড়িয়া আমি পূজিলাম সেওরা।
আপনি মাথায় লইলাম দুঃখের পসরা।।
জলে বিষ বাতাসে বিষ না দেখি উপায়।
ক্ষমা কর চন্দ্রাবতী ধরি তোমার পায়।।
একবার দেখিব তোমায় জন্মশেষ দেখা।
একবার দেখিব তোমার নয়নভঙ্গি বাঁকা।।
একবার শুনিব কন্যা মধুরসবাণী।
নয়নজলে ভিজাইব রাঙ্গা পা দুইখানি।।
না ছুঁইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।
পুণ্যমুখ দেখ্যা আমি জুড়াইব অন্তরা।।
শিশুকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের মালা।
তোমারে দেখিতে কন্যা মন হইল উতালা।।
জলে ডুবি বিষ খাই গলায় দেই দড়ি।
তিলেক দাড়াইয়া তোমার চান্দমুখ হেরি।।
ভাল নাহি বাস কন্যা এই পাপিষ্ঠ জনে।
জন্মের মতন হইলাম বিদায় ধরিয়া চরণে।।
এই দেখা চক্ষের দেখা এই দেখা শেষ।
সংসারে নাহিক আমার সুখশান্তির লেশ।।
একবার দেখিয়া তোমার ছাড়িব সংসার।
কপালে লেখ্যাছে বিধি মরণ আমার।।”
পত্র পড়ি চন্দ্রাবতী চক্ষের জলে ভাসে।
শিশুকালের স্বপ্নের কথা মনের মধ্যে আসে।।
এক বার দুই বার তিন বার করি।
পত্র পড়ে চন্দ্রাবতী নিজ নাম স্মরি।।
নয়নের জলে কন্যার অক্ষর মুছিল।
এক বার দুই বার পত্র যে পড়িল।।
“শুন শুন বাপ আগো শুন মোর কথা।
তুমি সে বুঝিবে আমি দুঃখিনীর ব্যথা।।
জয়ানন্দ লেখে পত্র আমার গোচরে।
তিলেকের লাগ্যা চায় দেখিতে আমারে।।”
“শুন গো প্রাণের কন্যা আমার কথা ধর।
একমনে পূজ তুমি দেও বিশ্বেশ্বর।।
অন্য কথা স্থান কন্যা নাহি দিও মনে।
জীবন মরণ হইল যাহার কারণে।।
নষ্ট হইল পুজার ফুল ছুঁইল যবনে।
না লাগে উচ্ছিষ্ট ফল দেবের কারণে।।
আছিল গঙ্গার জল অপবিত্র হইল।
বিধাতা সাধিছে বাদ সব নষ্ট হইল।।
তুমি যা লইছ মাগো সেই কাজ কর।
অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর।।
পত্র লিখি চন্দ্রাবতী জয়ের গোচরে।
পুষ্পদূর্ব্বা লইয়া কন্যা পশিল মন্দিরে।
যোগাসনে বসে কন্যা নয়ন মুদিয়া।
একমনে করে পূজা ফুলবিল্ব দিয়া।।
শুকাইল আঁখির জল সর্ব্ব চিন্তা দূরে।
একমনে পূজে কন্যা অনাদি শঙ্করে।।
কিসের সংসার কিসের বাস কেবা পিতামাতা।
পূজিতে তুলিল কন্যা শৈশবের কথা।
জয়ানন্দ চুলি কন্যা পূজয়ে শঙ্করে।
একমনে ভাবে কন্যা হর বিশ্বেশ্বরে।
শান্তিতে আছয়ে কন্যা একনিষ্ঠ হইয়া।
আসিল পাগল জয়া শিকল ছাড়িয়া।।
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী তোমারে শুধাই।
জীবনের শেষ তোমায় একবার দেখ্যা যাই।।
আর না দেখিব তোমায় নয়ন চাহিয়া।
দোষ ক্ষমা কর কন্যা শেষ বিদায় দিয়া।।”
কপাটে আঘাত করে শিরে দিয়া হাত।
বজ্রের সমান করে বুকেতে নির্ঘাত।।
যোগাসনে আছে কন্যা সমাধিশয়নে।
বাহিরের কথা কিছু নাহি পশে কানে।।
পাগল হইয়া নাগর কোন কাম করে।
চারিদিকে চাহিয়া দেখে নাহি দেখে কারে।।
না খোলে মন্দিরের কপাট নাহি কয় কথা।
মনেতে লাগিল যেমন শক্তিশেলের ব্যথা।।
পাগল হইল জয়ানন্দ ডাকে উচ্চৈস্বরে।
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী দেখা দেও আমারে।।
না ছুঁইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।
ইহজন্মের মতন কন্যা দেও মোরে সাড়া।।
দেবপূজার ফুল তুমি গঙ্গার পানি।
আমি যদি ছুই কন্যা হইবা পাতকিনী।।
নয়ন ভরে দেখ্যা যাই জন্মশোধ দেখা।
শৈশবের নয়ান দেখি নয়ানভঙ্গি বাঁকা।।”
না খোলে মন্দিরের দ্বার মুখে নাহি বাণী।
ভিতরে আছরে কন্যা যৈবনে যগিনী।।
চারি দিকে চাইয়া নাগর কিছু নাহি পায়।
ফুট্যাছে মালতীফুল সামনে দেখতে পায়।।
পুষ্প না তুলিয়া নাগর কোন কাম করে।
লিখিল বিদায়পত্র কপাট উপরে।
“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী।।
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত।
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত।।”
ধ্যান ভাঙ্গি চন্দ্রাবতী চারিদিকে চায়।
নির্জন অঙ্গন নাহি কারে দেখতে পায়।।
খুলিয়া মন্দিরের দ্বার হইল বাহির।
কপাটে আছিল লেখা পড়ে চন্দ্রাবতী।
(এই লাইনটি নেই)
অপবিত্র হইল মন্দির হইল অধোগতি।
কলসী লইয়া জলের ঘাটে করিল গমন।
করিতে নদীর জলে স্নানাদি তর্পণ।।
জলে গেল চন্দ্রাবতী চক্ষে বহে পানি।
হেনকালে দেখে নদী ধরিছে উজানি।। **
একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাহি কেহ।
জলের উপরে ভাসে জয়ানন্দের দেহ।।
দেখিতে সুন্দর নাগর চান্দের সমান।
ঢেউয়ের উপর ভাসে পুন্নুমাসীর চান।।
আঁখিতে পলক নাহি মুখে নাই সে বাণী।
পারেতে খাড়াইয়া দেখে উমেদা কামিনী।। ***
স্বপ্নের হাসি স্বপ্নের কান্দর নয়ান চান্দে গায়।
নিজের অন্তরের দুষ্কু পরকে বুঝান দায়।।

* জন্মথ : আজন্ম আইবড়
** ধরিছে উজানি : উজান বয়ে চলছে
*** উমেদা : উন্মত্ত

তথ্য ও সুত্রঃ

     

  • মৈমনসিংহ গীতিকা
  • wikipedia.org
  • milansagar.com
  • uzbuk.blogspot.com