কবি দামোদর দাস, রঘুসুত, নয়ানচাঁদ ঘোষ এবং শ্রীনাথ বানিয়া রচিতঃ

 

কঙ্ক ও লীলা || ৮ ||  গোপন দীক্ষা

জুহরী জহর চিনে বেনে চিনে সোনা |
পীর প্যাগাম্বর চিনে সাধু কোন জনা ||
পীরের অদ্ভুত কাণ্ড সকলি দেখিয়া |
কঙ্কের পরাণ গেল মোহিত হইয়া ||
সর্ব্বদা নিকটে কঙ্ক ভক্তিপূর্ণ মনে |
চরণে লুটায় তার দেবতার জ্ঞানে ||
তার পর জাতি ধর্ম সকলি ভুলিয়া |
পীরের প্রসাদ খায় অমৃত বলিয়া ||
দীক্ষিত হৈলা কঙ্ক যবন পীরের স্থানে |
সর্ব্বনাশের কথা কঙ্ক কিছুই না জানে ||
জাতি-ধর্ম নাশ হইল রটিল বদনাম |
পীরের নিকটে কঙ্ক শিখিয়ে কালাম ||
পীরের নিকটে যায় কেউ নাহি জানে |
গতায়তি করে কঙ্ক অতি সংগোপনে ||
ভক্তি-মুক্তি-তন্ত্র-মন্ত্র-দেহ মন প্রাণ |
অচিরে গুরুর পদে কৈল সমর্পণ ||
গুরুতে বিশ্বাস আর গুরু ইষ্ট ধন |
দামোদর দাস কহে এই ভক্তের লক্ষণ ||

 

কঙ্ক ও লীলা  || ৯ || সত্যপীরের পাঁচালী

দেখিয়া শুনিয়া পীর,          কঙ্কেরে করিলা স্থির,
উপযুক্ত ভক্ত এহি জন |
সত্যপীরের পাঁচালী,          কঙ্কেরে লিখিতে বলি,
একদিন হৈল-অদর্শন ||
গুরুর আদেশ মানি,          লিখিয়া পাঁচালী আনি,
পাঠাইলা দেশে আর বিদেশে |
কঙ্কের লিখন কথা,              ব্যক্ত হৈল যথা তথা,
দেশ পূর্ণ হৈল তার যশে ||
কঙ্ক আর রাখাল নহে,          কবিকঙ্ক লোক কহে,
শুনি গর্গ ভাবে চমত্কার |
হিন্দু আর মোসলমানে,      সত্যপীরে উভে মানে,
পাঁচালীর হৈল সমাদর ||
যেই পূজে সত্যপীরে,            কঙ্কের পাঁচালী পড়ে,
দেশে দেশে কঙ্কের গুণ গায় |
বুঝি কঙ্কের দিন ফেরে,          রঘুসুত কহে ফেরে,
দুঃখিতের দুঃখ নাহি যায় ||

 

কঙ্ক ও লীলা  || ১০ ||  কঙ্ককে জাতিতে তোলা

জানিয়া শুনিয়া কানে,          ভাবে গর্গ মনে মনে,
নহে কঙ্ক সামান্য মানব |
ভক্তিমান অতি ধীর,          গর্গ কৈলা মনে স্থির,
কঙ্ক ঘরে তুলিয়া লইব ||
পণ্ডিত সমাজী গণে,          একত্র করিয়া ভণে,
“এই কঙ্ক ব্রাহ্মণ-তনয় |
জ্ঞন মানে নাহি রয়,          চণ্ডালের অন্ন খায়,
ঘরে নিতে নাহিক সংশয় ||”
এতেক শুনিয়া নন্দু,          আর যত গোড়াহিন্দু,
কয় সবে মাথা নাড়াইয়া |
“আমরা সম্মত নহি,          আরও শুন সবে কহি,
লহ কঙ্কে মোদের ছাড়িয়া ||
জন্মিয়া চণ্ডালের অন্ন খায় যেই জন |
যে তারে সমাজে তুলে নহে সে ব্রাহ্মণ ||
অনাচারে জাতি নষ্ট, নষ্ট হয় কুল |
মটিতে পড়িলে কেহ নাহি তুলে ফুল ||”
আর এক দল ভয়ে গর্গে ডরাইয়া |
গর্গের কথায় শুধু গেল সায় দিয়া ||
আদেখা হইলে গর্গ করে কত ফন্দি |
কঙ্কে না তুলিতে গর্গে করে অন্দি সন্দি ||
কত তর্ক-যুক্তি গর্গ সকলে দেখায় |
তবু নাহি সে বিধি দিল পণ্ডিতসভায় ||
কেহ বলে তুলি  ঘরে কেহ বলে নয় |
এই মতে নানা স্থানে বহু তর্ক হয় ||
চারি দিকে দাউ দাউ অনল জ্বলিল |
জ্বলিলেন গর্গ মুনি কঙ্ক ভস্ম হইল ||
এমন সুখের ঘর পুড়ে হল ছাই |
নিয়তি খণ্ডিতে পারে হেন সাধ্য নাই ||
আছিল চণ্ডাল কঙ্ক হইল ব্রাহ্মণ |
কঙ্কেরে নাশিতে যুক্তি করে দ্বিজগণ ||

 

কঙ্ক ও লীলা  || ১১ ||  কঙ্কের বিরূদ্ধে ব্রাহ্মণগণের ষড়যন্ত্র

নানামত ভাবি তারা উপায় করিল |
মাপের চোখেতে যেন ধুলা-পড়া দিল ||
রটে কঙ্ক নহে শুধু চণ্ডালের পুত |
মোসলমান পীরের কাছে হৈল দীক্ষিত ||
হিন্দু যত সবে কঙ্কে মোসলমান বলি |
কেহ ছিড়ে কেহ পুড়ে সত্যের পাঁচালী ||
জাতি গেল মোসলমানের পুঁথি নিয়া ঘরে |
যথাবিধি সবে মিলি প্রায়শ্চিত্ত করে ||
আর এক কথা রটে না যায় কথন |
“কঙ্কেরে সঁপেছে লীলা জীবন-যৌবন ||”
সন্ধ্যামন্ত্র নাহি ঝানে বেদাচারহীন |
দুরন্ত দুর্জন যারা সমাজেতে ঘৃণ ||
মদ্য-মাংস খায় সদ্য পাষণ্ড-আচার |
জন্মি ব্রাহ্মণ-কুলে যত কুলাঙ্গার ||
মিথ্যা বদনাম তারা দিল রটাইয়া |
“কলঙ্কী হইয়াছে লীলা কুল ভাঙ্গাইয়া ||”
একে ত কুমারী কন্যা অতি শুদ্ধমতী |
কলঙ্ক রটাইল তার যত দুষ্টমতি ||