বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ড আতিউর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ সম্প্রতি হাওর অঞ্চলের ইটনা, মিটামন ও অষ্টগ্রাম এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ‘ব্যাংকিং সম্মেলন’ এর ব্যানারে তিনটি উপজেলায়  পৃথকভাবে এ সম্মেলনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উদ্যোক্তা, ভোক্তাগণ  উপস্থিত ছিলেন। হাওর এলাকায় উদ্যোক্তা তৈরী, বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন  কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কুটির শিল্পের বিকাশ, কৃষক এবং মতস্যজীবী সম্প্রদায়কে কিভাবে সহযোগিতা দেয়া যায়, আয় বর্ধনকারি কাজে নিয়োজত করে অভিবাসন স্রোত রোধ এবং চাষে ঋন সহায়তা প্রদাণের লক্ষ্যে ব্যাংক কে সবার দোড় গোড়ায় নিয়ে যাওয়াই এ পরিদর্দশনের মূল উদ্দেশ্য। মহামাণ্য রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আব্দুল হামিদের প্রত্যক্ষ নির্দেশণায় হাওরে এ  ব্যাংকিং সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে স্থানীয় সংসদ সদস্য রেজাওয়ানুল আহমেদ তৌফিকসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। হাওরবাসির মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছে এ সম্মেলন। আশার সঞ্চার হয়েছে সর্ব সহযোগিতা বঞ্চিত হাওরবাসির মনে।

pic

 হাওর একটি অনাহরিত সোনার খনি। বিভিন্নমূখী সম্পদ, সমস্যা ও সম্ভাবনায় ভরপুর এ হাওরাঞ্চল। এতদিন শুধু হাওরের ভাসমান ও দৃশ্যমান সম্পদ আযাচিত ও অবিবেচকের মত শুধু  আহরণ করা হয়েছে। এর সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং পরিকল্পিত বহুমূখী ব্যবহার নিয়ে তেমন কোন কাজ হয়নি। এ হচ্ছে এমন একটা অঞ্চল যা বছরের ছ’মাস থাকে পানির নীচে আর বাকী ছ’মাসে ফসল উতপাদন হয় । হাওরে বছর হয় ছ’ মাসে। বলা যায়,  ছ’মাস কাজ, ছ’ মাস বেকার। প্রায় সাড়ে আট হাজার বর্গ কিলো মিটার আয়তনের হাওরে প্রায় দু’কোটি লোক বাস করে।  হাওর উন্নয়ন বোর্ড তিন বছর আগে একটি মহা পরিকল্পণা করলেও পর্যাপ্ত বাজেট ও লোকবলের অভাবে কাজ শুরু করতে পারছে না। স্থানীয় প্রকৌশল দপ্তর কিছু করার চেষ্টা করছে। কিন্ত অন্য বিভাগের সাথে সমন্বয় নাই। প্রতিষ্ঠিত বিষয় ভিত্তিক সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে কাজ কি হবে, কে জানে ?

হাওরবাসি মূলত কৃষিজীবী (৫৩.৬৭%), সারা বছর কোন কাজ করে না এমন লোকের পরিমাণ (২৮.৫%), ব্যবসায়ী (১২.৫২), অকৃষিজীবী (১২.১৩%), শ্রমজীবি (৬।৪১%), চাকুরী (৫.৬৫%), বিদেশী প্রেরিত টাকার উপর নির্ভরশীল (৩.৪১%), মতস্যজীবী (২.৫৯%), পরিবহণে (২.৩৯%) এবং সবচেয়ে কম ১.৩৩% মানুষ শিল্প কারখানায় কাজ করে। এ থেকে হাওরবাসির কর্ম, পেশা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সরকার দেশে ৮টি ইপিজেড (Export Proceeding Zone, EPZ)  এবং কয়েকটি শিল্পপার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হাওরের কয়েকটি স্থানে ইপিজেড বা শিল্প পার্ক স্থাপন করা যেতে পারে। সস্তা শ্রম, অনেক কর্মঠ কর্মী বাহিনী, সহজ নৌ যোগাযোগের জন্য এখানে বিনিয়োগ বেশ লাভ জনক হবে। নদী খননের মাটি দিয়ে নদীর পাড়ে এবং ‘আভুরা সড়ক’র সংযোগ স্থানে এগুলো গড়ে তোলা যেতে পারে। উতপাদন মূখী কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা উদ্যোক্তা তৈরীর জন্য প্রয়োজন– স্থানীয় সম্পদের পর্যাপ্ত প্রাপ্যতা, পুজি, প্রায়োগিক প্রযুক্তি,  পরিবেশ, পৃষ্টপোষকতা, জনশক্তি ও বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন । হাওরাঞ্চলে শিল্পপার্ক স্থাপনে যথেষ্ট উপযুক্ততা ও উপকরণ বিদ্যমান। হাওরে আছে গ্যস, সাদা মাটি, চুনা পাথর, নুড়ি পাথর, বালি, পাথর, ক্লে, গ্লাস বালি । তাছাড়া কয়লা, পিট কয়লা, ক্রুয়েড অয়েল ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়া যায় । দেশে উতপাদিত মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের ৯০% আহরিত হয় হাওরাঞ্চল হতে। শুনতে ভাল লাগলেও অবাক হবার বিষয় একটি সারকারখানা এবং একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরী ছাড়া  গ্যাস ভিত্তিক কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান হাওরে গড়ে উঠেনি। হাওরের গ্যাস হাওরের বুক চিড়ে সারা দেশে জ্বালানী ও বিদ্যুত দিলেও হাওরাঞ্চল কিন্ত অন্ধকারেই রয়েছে।

গ্যাসের সংযোগ, বিদ্যুত সরবরাহের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, ভৌত অবকাঠামো এবং পরিবেশ তৈরী করে দিবে সরকার। ব্যাংক ঋন নিয়ে বিনিয়োগ কারিদের পার্শ্বে দাঁড়াবে। দেশে চালু প্রায় সব শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত কাঁচা মাল বিদেশ হতে আমদানী করা হয়। এখানে বরং সহজে বন্দর হতে মালামাল আনা নেয়া যাবে। হাওরে উতপাদিত লক্ষ লক্ষ টন ধান কে কেন্দ্র করে চাতাল কল এবং উপজাত দিয়ে রকমারি পণ্য সামগ্রী তৈরীর কারখানায় বিশাল কর্মজজ্ঞ সৃষ্টি  হতে পারে । ধান চালের বিশাল ‘সাইলো’ এবং বিশাল বাজার ব্যবস্থাপণা সৃষ্টি হবে। আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের একটা বিরাট অংশ হাওর ইপিজেডে স্থানান্তর করা যেতে পারে। সিমেন্ট, সিরামিক, চামড়া, টেক্সটাইল, ওষধ শিল্প স্থাপনের একটা অপার সম্ভাবনা হাওরে রয়েছে। নৌ-শিপয়ার্ড কারখানা গড়ে উঠতে পারে। হাওরের কিছু এলাকায় পাদুকা শিল্পের প্রসার ঘটেছে। অনুকুল পরিবেশ ও বিনিয়োগে পুঁজি পেলে হাওরবাসি নিজেরাই নতুন নতুন ক্ষেত্র খুজে বের করে কারখানা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ, লোহা  ভিত্তিক নিত্য ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রী,  ভ্যালু এডেড খাদ্য প্রস্তুত, আসবাবপত্র তৈরীসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির কারখানা গড়ে উঠবে। স্বর্ণকার, কর্মকার,  মিস্ত্রীরা তাদের প্রসার বাড়িয়ে আড়ত গড়বে । বড় বড় নামি দামী প্রতিষ্ঠানও তাদের কারখানা হাওর ইপিজেডে স্থানান্তর করবে। বিদেশী বিনিয়োগে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে হাওর এলাকা হতে পারে একটা মোক্ষম স্থান । বিশাল জায়গা,  জনশক্তি,  জ্বালানী সবই তো বিদ্যমান । আইটি পার্কও (IT Park)  এখানে সহজে স্থাপন হতে পারে। আউট সোর্সিং, প্রিন্টিং, প্যাকেজিং শিল্প হতে পারে এখানে । তথ্য প্রযুক্তির ‘ল্যান্ডিং ল্যান্ড’ থাকবে হাওরে।  দরকার একটু সত ইচ্ছা, উদ্যোগ ও নেক নজর । ‘হাওর উন্নয়ন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে । হাওর এলাকায়  বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট ‘বিসিক অঞ্চল’  স্থাপন করা যেতে পারে। এস এম সি ব্যাংকের শাখা থাকবে হাওরে। মানব সম্পদ উন্নয়নে বিভিন্নমূখী প্রশিক্ষণের জন্য প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। এখানে ছোট ছোট কুটির শিল্প, হস্ত শিল্প, শীতল পাটি, বাঁশ, মৃত্তিকা শিল্প, মতস্য প্রত্রিয়াজাতকরণ, ভ্যালু এডেড পণ্য, গ্রামীণ ব্যবহার্য দ্রবাদি, প্লাস্টিক দ্রব্য সামগ্রী দিয়ে হরেক রকমের পণ্য উতপাদিত হবে। মাশরুম, মধু চাষের অনুকুল পরিবেশ, এখানে অনেক নারী পুরুষের কর্মসংস্থান তৈরী হবে।  এ সবকে কেন্দ্র করে হাওরাঞ্চলে কর্মোদ্যম, প্রাণ চাঞ্চল্য, উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাবে, পজিটিভ পরিবর্তন ঘটবে জীবনে, তৈরী হবে সমৃদ্ধ হাওরাঞ্চল, সোনার বাংলাদেশ।

হাওরবাসির জীবন জীবিকা, স্বপ্ন, বিয়ে,  ধর্ম-কর্ম প্রধানত ধান চাষ, উতপাদন, বিপিনন এবং মাছ ধারা,  বিক্রি কাজের উপর নির্ভরশীল। এখানে লোক আছে, কাজ নাই, সম্পদ আছে, ব্যবহার নাই। সুদিনের (শুকনো সময়) শেষে, বন্যায় ফসল তলিয়ে গেলে বা কাজের অভাবে হাওরবাসি কৃষক বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘরের দরজায় ‘খিল’ দিয়ে দেশান্তরি হয় । বর্ষার ছ’মাসে একটা কানা কড়িও আয় রোজগারের উপায় নাই। এ অবস্থার উন্নয়নে সকল বিভাগের সম্বনিত কার্যকর কর্মোদ্যোগ অপরিহার্য । হাওরে তিন হাজারেরও বেশী জল মহাল রয়্ছে। কৃষি, মতস্য বিভাগ এগিয়ে আসবে নতুন জাত, প্রযুক্তি নিয়ে, সুরক্ষা দেবে সরকার, উতপাদন ব্যয়ের বিনি্যোগের  নিশ্চয়তা দেবে ব্যাংক। শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি তৈরী করতে কৃষি ও মতস্য নিয়ে আবর্তিত হাওরবাসির জীবনমান উন্নয়নে প্রথমত এগুলোকে নিয়েই আগাতে হবে। হাওরে এখনো মাত্র একটি ফসল ধান আবাদ হয়। মাছ শুধু আহরণ করা হয়,  চাষ হয় না । প্রচলিত পুরাতন পদ্ধতিতে। প্রযুক্তির ছোঁয়া এখনো তেমনভাবে লাগে নাই। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সম্প্রসারণ বিভাগ ‘হাওর কৃষি’র বহুমূখীকরণ প্যাটার্ন দিবে, চাষে উদ্ধুদ্ধকরণে প্রদর্শণী প্লট করবে, হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেবে । হাওরের বিভিন্ন জায়গায় সহজেই দু’টি/তিনটি ফসল আবাদ করা যাবে। প্রদর্শণী প্লটে আবাদ করে উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে উতসাহ যোগাতে হবে।  শুধু মাত্র ধান চাষ নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। উচ্চ মূল্য  ও উচ্চ খাদ্যমাণ সমৃদ্ধ  ফসল (High value and high nutrious added crops) চাষ করতে হবে। সব্জী, তেল, মশল্লা , ডাল জাতীয় ফসল বলতে গেলে হাওরে চাষ হয় না।

চরের অবস্থা, ভূমির গঠন হাওর থেকে উন্নত নয়। তারপরপও প্রযুক্তির ছোয়ায়, সহযোগিতার হাত বাড়ানোতে বহুমূখী উন্নয়ন হচ্ছে। গতানুগতিক জড়তায় আড়ষ্ট হাওর কৃষককে জাগিয়ে তুলতে হবে- প্রযুক্তির সাথে, প্রগতির পথে । একজন হাওর ভূমিপুত্র হিসাবে আমার অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারি যে, বহুমূখী ফসল চাষে কৃষকের ব্যাপক আগ্রহ আছে। যে কয়েকটি কারণে তারা প্র্যাক্টিসে যেতে পারছেনা,  সে গুলো হলোঃ প্রথমত উদাহরণ সৃষ্টিকারি ফসলের জাত/বীজ, প্রযুক্তি, পুজির অভাব। দ্বিতীয়ত সে সময়ে কর্ষন ও সেচ সুবিধার অভাব। ভূর্তকী মূল্যে সরকার সর্বত্র কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার প্রদাণ করছে। অনেক দামী এ সব যন্ত্র হাওর কৃষকের সামর্থ নাই,  নগদ টাকায় ক্রয় করে। ব্যাংক সমূহ এক্ষেত্রে সহায়তা দিতে পারে। উতপাদিত ধান সংরক্ষণ, বিপিনন, ধান হতে চাল বানানো-রাইসমিল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কর্মকান্ডে সহায়তার হাত বাড়িয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে পারে। এগুলোকে কেন্দ্র করে আরো অনেক কর্মসংস্থান তৈরী হবে। স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু জার্মানী হতে বিশেষ বিমানে করে হাজার হাজার সেচ যন্ত্র-পানির পাম্প হাওরে প্রায় বিনামূল্যে, নামমাত্র ভাড়ায় প্রদাণের ফলেই আজ হাওরের বিরাট বিশাল গোচারণ ভূমি চাষাধীনে এসেছে। সারা দেশে ফসল উতপাদন বেড়েছে তিন গুণ, আর হাওরে পরিমানে (Volume of production)  উতপাদন বেড়েছে ছ’ গুণ । খামার যান্ত্রিকীকরণ এবং সেচসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যুতের সংযোগ থাকতে হবে। এবার উচ্চমূল্য এবং উচ্চ খাদ্যমানের ফসল উতপাদনের মাধ্যমে আর্থিকভাবে আধিক লাভের সুযোগ এসেছে।  ফল এবং এ ফসল আবাদ বা মাছ,  মুক্তা চাষ বৃদ্ধি, উদ্ধুদ্ধকরণ ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে ধান চাষী হাওর কৃষকের গরীবি চেহারাটার আমূল পরিবর্তন ঘটানো যাবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের হাওর আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপন অপরিহার্য । শস্য / ফল প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট স্থাপনে সহায়তামূলক সহযোগিতা অপরিহার্য । হাওর বলতে গেলে বৃক্ষ শূণ্য । কিছু এনজিও শুধু হিজল গাছ লাগানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন ।

৪৬০ প্রজাতির গাছ মিঠা পানিতে জন্মাতে পারে । হাওরের পানিতে আর্থিকভাবে মূল্যবান, ফলদ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে ।  ছোট, ছোট উদ্যোক্তাকে ঋন দিয়ে, প্রযুক্তি দিন, প্রশিক্ষিত করুন। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করা সংগ্রামী, সাহসী, ভাটির বীর পুরুষদের পুজি আর প্রযুক্তি প্রদাণ করুন, পথের বাঁধা সরিয়ে ফেলুন, মানূষ কে এগোতে দিন। নিজেরাই নিজেদের পথ খুজে, তৈরী করে নিবে। দাদনের ছোবল হতে কৃষকদের রক্ষার ব্যবস্থা করে দেন। দাদন তাদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়, মহাজনের কাঁচা-পয়সা, লুলুপ দৃষ্টি কেড়ে নেয় সুখ, আমার বোনের নাকের নোলক । সহজে,  নির্বিঘ্নে চাহিদা মোতাবেক দালালের ফাঁফড় গিরি ছাড়া ব্যাংক ঋন প্রদাণের ব্যবস্থা করুন । কয়েক বছরের মধ্যই তাদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। গত বছর আমি একটি গ্রামে প্রাপ্ত কৃষি ঋন ও দাদনের পরিমানের উপর জরিপ চালানোর চেষ্টা করেছিলাম। ইটনা উপজেলার পশ্চিম দিকের কয়েকটা ইউপি’তে এক টাকাও ঋন দেয়া হয় নাই। নাগালের বাইরে যোগাযোগ বিহীন ব্যাংকের অবস্থান, দুরত্ব, কাঙ্খিত পরিমান টাকা, সময় মত না পাওয়া, ফেরত দিয়ে আবার ঋন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা না থাকা, সময় ক্ষেপণ, বার বার আসা যাওয়ার বিড়ম্বনায় কৃষক ব্যাংকমূখী হয় না । ঋন পরিশোধে তাগাদা কম বলে আদায়ের পরিমাণও কম। কৃষক বান্ধব কর্মকর্তা দিয়ে ব্যাংকের শাখার সংখ্যা বাড়াতে হবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরের এ মহতি উদ্যোগকে বাস্থবায়নে ঋনদান, প্রয়োগ ও আদায় কার্যক্রম গভীরভাবে মনিটরিং করতে হবে । ক্যাম্পেইন করতে হবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগকে আমি শেরে বাংলার ঋন শালিসী বোর্ডের সাথে তুলনা করবো না। তবে হাওর কৃষককে দাদনের করাল ছোবলের নাগাল হতে রক্ষা করে স্বাবলম্ভী ও আত্ন প্রত্যয়ী করবে নিঃসন্দেহে । সবই নির্ভর করছে এর সঠিক বাস্থবায়নের উপর।

হাওরের সবচেয়ে বড় সম্পদ আর বড় সমস্যা হচ্ছে এর পানি। পানিকে কেন্দ্র করে হাওরবাসির সুখ, দুঃখ, জীবন,  জীবিকা অনেকটাই নির্ভরশীল। এ পানিকে ব্যবহার করে হাওরবাসির জীবন ধারার আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব। খোদার অপার রহমত মিঠা পানির ‘একক ওয়াটার বডি’ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নাই। হাওরে গ্রামগুলো স্বাধারণ ভূমি হতে মাটি কেটে ১০-১২ ফুট উচু ভিটা তৈরী করা হয়। হাওরাঞ্চলে মোট ১৫,৩৭৪টি গ্রামে  ৩,২, ৪ ৩৯০ পরিবার (Haousehold) রয়েছে, তাদের বসত ভিটার আয়তন ৩,০৩,১২০ হেক্টর, যা হাওরের মোট আয়তনের ১২% । এ সব বসত ভিটায় কৃষি, সব্জি, হাঁস মরগী পালনের প্রযুক্তি ছড়ায়ে দিতে হবে । লোক সংখ্যা বাড়ছে, বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট হাটি/গ্রাম তৈরীতে মূল্যবান জমি ব্যবহৃত হচ্ছে, ভিটে রক্ষায় অতিরিক্ত ব্যয় বহণ করতে হয়। এককভাবে হাওরে গ্রাম সৃজন করাও দুরহ, ব্যয় বহুল এবং অধিক জমি নষ্ট হয় ।  এ অবস্থায় ‘সমন্বিত গ্রাম সৃজন’ করা যেতে পারে। নদীর ধারে, নদী খননকৃত মাটি দিয়েই ভাল যোগাযোগ স্থানে তা স্থাপন করা যেতে পারে। বহুতল বিশিষ্ট বিল্ডিং, স্কুল, কলেজ, চিকিতসা সেবাসহ নাগরিক সকল সুবিধা থাকবে। সকল সম্প্রদায় এখানে থাকবে। এ গ্রামের সাথে থাকবে অনেক অনেক আভুরা পুকুর। বর্ষার পানিতে এর পাড় ডুবে যাবে না। সারা বছর মাছ-হাস,  মুক্তা চাষ হবে, পাড়ে থাকবে উচ্চ মূল্যার ফল ফলাদির গাছ, গরু বাছুর, জৈব গ্যাস প্লান্ট । সৌর শক্তি বহুমূখী নতুন নতুন সম্ভাবনাময় কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করবে ।

‘জলপুরী’ বা ‘জলনগরী’ রুপে রুপান্তর সমন্বিত এ গ্রাম গুলো হবে এক একটা পর্যটনের সুস্থ বিনিয়োগ কেন্দ্র বিন্দু । একে কেন্দ্র করে সারা বছর ব্যাপী মহা কর্মজজ্ঞের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বন্যা বা খরায় হাওর কৃষককে সুরক্ষা দিবে এ ‘সমন্বিত গ্রাম’ । শহরে রিয়েল স্টেট বা আবাসন  ব্যবসা যাঁরা করেন, এ লাভ জনক এ ব্যবসায় নিঃসন্দেহে বিনিয়োগ করতে আগিয়ে আসতে পারে। হাওর উন্নয়ন বোর্ড, জেলা বা উপজেলা পরিষদ এ ‘সমন্বিত গ্রাম সৃজন’ করে আগ্রহীদের মাঝে উপযুক্ত মূল্যে বরাদ্দ দিতে পারে। ব্যাংকগুলোকে এ কর্মকান্ডে সর্বোত সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়াতে হবে।  নতুন যুগের সৃষ্টি করবে এ ‘সমন্বিত গ্রাম  সৃজন ’ প্রকল্প । টিলাসম উঁচু হাওর-গ্রাম (১৫,৩৭৪টি) তৈরীতে গ্রামের চারি পাশে খননকৃত কয়েক লক্ষ পুকুর, ডোবা, গর্ত বা পাগার রয়েছে। যার অধিকাংশই বর্ষাকালে পানিতে ডুবে যায়। এগুলোও কর্মসৃজন বা কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর অধীনে খনন করে মৌসুমী/ বছর ব্যাপী মাছ, মুক্তা চাষ, হাঁস, গবাদি পশু, ফল ফলাদির গাছ,  গৃহস্থালি কাজ বা সম্পূরক সেচের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। চাষের পুকুরে উতপাদিত মাছের পরিমাণ হচ্ছে- হাওরে উতপাদিত মোট মাছের  ২.৬৪% অংশ মাত্র। এর ফলে মাছের উতপাদন বাড়বে কয়েক গুণ। এ পুকুর, ডোবা গুলো বর্ষার প্রারম্ভে বৃষ্টির পানি ধারণ করে নদীর উপর পানির চাপ কমিয়ে অকাল ও আগাম বন্যাকে প্রলম্বিত করে ফসল রক্ষা করবে।

হাওরের মিঠা পানিকে আমরা উতপাদন মূখী তেমন কোন কাজেই লাগেতে পারছি না। পানি ছয়-সাত মাস হাওরে থাকে।  সোনার রেনুসম প্রতি ফোটা এ পানি থেকে মূল্যবান রুপালী সম্পদ আহরণ করা সম্ভব।  মাছ, হাস, ঝিনুক,  মুক্তা চাষ, জলজ উদ্ভিদ, জলজ ফসল-সব্জী, পর্যটন, বিনোদনে ব্যবহারের কার্যকরি উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় নাই। আয় বর্ধনকারি বা কর্মসংস্থানের প্রধান উতস হতে পারত হাওরে মাছ চাষ। এত দিন সরকার, মহাজন,  সবাই ‘ধরিব মাছ, খাইব সুখে’ বিভোর ছিল। মাছ ধরায় দাদনে বিনিয়োগ মিললেও মাছ চাষে কোন উদ্যোগ ছিল না। হাওরে মুক্ত জলাশয়ের পানিতে মাছ-মুক্তা চাষ নিয়ে অদ্যাবদি কোন গবেষণা নাই, স্বীকৃত কোন পদ্ধতিও উদ্ভাবিত হয় নাই। দেশের বিভিন্ন স্থানে পানিবিহীন শুষ্ক ভূমিতে মতস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হলেও, ‘হাওর মতস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ প্রতিষ্ঠিত হয় নাই।  খাচা,  খাড়ি, নেট প্রযুক্তি প্লাবিত এলাকায় মাছ চাষ হতে পারে। ভাসান পানিতে সব্জি চাষ প্রযুক্তি দিতে হবে। বাকৃবি’তে  ‘হাওর কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে ।  তিন-চার হাজার লিটার পানি দিয়ে এক কেজি চাল উতপাদন হলেও দাম কিন্ত মাত্র অর্ধ শত টাকা। কিন্ত সমপরিমাণ পানি হতে উতপাদিত মাছের দাম হবে কয়েক শত টাকা। হাওরের মুক্ত জলাশয়ে চারিদিগ হতে বিভিন্ন প্রজাতির অবাদে চড়ে, বেড়ে উঠবে এ সব পোনা। কয়েক মাস মাছ ধরা যাবে না, এ সময় বেকার হাওর মতস্য জীবীদের ভাতা বা বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বর্ষার নির্ধারিত সময়ের পর এবং শুষ্ক মৌসুমে  বিল/ জল মহাল হতে ধরা মাছে সংশ্লিষ্ট এলাকার মতস্য জীবীদের ন্যায় সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠায় হাওরে মাছের প্রাচুর্য্য নিশ্চিত করবে।

হাওরে মাছ চাষ উতসবের আর একটি মহা কর্মযজ্ঞের স্বপ্ন আমার চোখে ভাসছে। তা হচ্ছে,  হাওরে তৈরী হতে যাওয়া ‘আভুরা সড়ক’ কে কেন্দ্র করে। এ সড়কের দু’ পার্শ্বে গ্রাম সৃজন হবে, বসতি গড়ে উঠবে, মাছ-মুক্তা চাষের নতুন নতুন পুকুর সৃষ্টি হবে, হাস-পোল্ট্রি পালন হবে,  গরু বাছুর লালন হবে,  ফলে ভরা গাছ  থাকবে, লাউ এর ডগা পানিতে নূয়ে ছুঁয়ে থাকবে।

সমস্যা যেখানে যত বড়, সমাধানের পথও তত বিস্তৃত  হয় । হাওরে সবচেয়ে কম সংখ্যক মানুষ শুধুমাত্র (১.৩৩%) শিল্পে এবং শুধুমাত্র (২.৫৯%) মানুষ মতস্য জীবী হিসাবে জীবীকা নির্বাহ করে । সুতরাং এ দুইটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও কর্ম সৃজনের  সুযোগও অনেক বেশী।  বর্তমান আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০১ সালে ‘হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করে। দ্বিতীয় মেয়াদে তারা ২০ বছর ব্যাপী ১৭টি বিষয়ে ১৫৩ টি প্রকল্প বাস্থবায়নে ২৭ হাজার ৯৬৩ কোটি ৫ লক্ষ টাকার মহা পরিকল্পণা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ মহা পরিকল্পণা বাস্থবায়নে ৭টি মন্ত্রণালয়ের ৩৫ টি প্রতিষ্ঠান কাজ করবে। আশার কথা, এই প্রকল্প গুলো যথাযতভাবে বাস্থবায়িত হলে হাওরাঞ্চলের কাঙ্খিত উন্নয়ন ঘটবে । শত বছর আগে সস্তা ও উর্বর জমি, বিল ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরু এবং সুন্দর পরিবেশের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে হাজার হাজার পরিবার হাওরে এসে বসতি গড়ে তুলেছিল । কিন্ত বর্তমানে কর্মসংস্তানের অভাব এবং ফি বছর ফসলহানিতে হাওরে অভিবাসনের উলটো স্রোত বইছে । আমাদের আশা, প্রস্তাবিত এ মহা কর্মজজ্ঞ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সৃষ্ট কর্মসংস্থানের ফলে হাও্রাঞ্চল হবে শান্তি ও উন্নয়নের তীর্থ ভূমি ।