m_1343_68927জুতা তৈরীর কাঁচামাল আর নতুন জুতায় ঠাসা প্রয়োজনের তুলনায় ছোট একটি ঘর। জানালা নেই, কিংবা থাকলেও মালামালের ঠাসাঠাসিতে জানালা বন্ধ। প্রায় অন্ধকার এই কক্ষে একটি ১০০ পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাতিটাই আলোর একমাত্র সংস্থান। বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা নেই, এর উপর আবার বৈদ্যুতিক বাতির তাপে কক্ষের গড় তাপমাত্রা ৩৩ – ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। কক্ষের ঠিক মধ্যখানে একটি সিলিং ফ্যান অনবরত ঘুরতে থাকলেও ঘরের তাপ বের হবার জন্য পর্যাপ্ত নয়। ঘরের ভিতর উৎপাদন কাজে নিয়োজিত লোহা লক্কর আর যন্ত্রপাতির শব্দে কান ঝালা-পালা। এরই মধ্যে কয়েকটি শিশু দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। জুতার আপার সোল তৈরীর কাজ, অথবা কাটিং নয়তো সিল মারার কাজ। এ সকল শিশুর বয়স ৮/৯ কিংবা ১০/১২ বছর। সকাল ৭-টা থেকে কাজ শুরু, চলে বিরামহীনভাবে রাত ৮-টা পর্যন্ত, কখনও অনেক রাত্রি পর্যন্ত। কাজ শেষে কারখানার মধ্যেই মালামালের সাথে এবং বড় শ্রমিকদের সাথে ঘুমানোর আয়োজন।

এভাবে সকলের অজান্তেই এই শিশুরা অল্প বয়সে পরিবার থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আপনজনদের আদর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মনোকষ্টে ভোগে; কিন্তু উপায় নেই। এ বয়সে ওদের স্কুলে যাবার, খেলাধুলা করার এবং সময়মতো ঘুমানের কথা ছিল। কিন্তু দরিদ্র পিতার সংসারের বোঝা তুলে নিতে হয়েছে ঘাড়ে। মাস শেষে নগদ টাকা পাওয়া যায় – মা বাবা তাতেই খুশি। শিশুর সুন্দর ভবিষ্যত তাদের কাছে মুখ্য নয়। কারখানার বাইরে ওদের বয়েসী শিশুরা খেলাধুলা করে, দল বেঁধে স্কুলে যায়। ওরা পড়ে, খেলে, বিশ্রামের সময় পায় আর সময়মত ঘুমায়। পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড় পরে। ওরা বড় হবার স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন বোনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক এবং বড় অফিসার হবার। জুতা কারখানার শিশুরা শুধুই চেয়ে থাকে আর নতুন জুতোয় গাঁথুনি দিয়ে যায় অন্যকে সাজাবার জন্য। ওদের স্বপ্ন দেখতে মানা, ওরা অনেক বেশি ব্যস্ত, হাতে অনেক কাজ। আরও আছে মাদক-গন্ধময় কৌটো ভরা জুতোর আঠা, যে আঠায় নেশা হয়, মাথা ঝিমঝিম করে। জুতোর আঠা নিয়ে নেশায় বুদ হয়ে থাকে ওদের সঙ্গীরা। আঠার তীব্র ঝাঁঝে অনেক শিশু রাতে ঘুমাতে পারে না, ধীরে ধীরে নেশার জগতে পা বাড়ায় কোমলমতি এই শিশুরা।

m_1343_35393শুধু তাই নয়, বিপদজনক মেশিনারিজ দিয়ে কাজ করতে গিয়ে কেউ কেউ আঘাত পায়, হাত-পা কাটে। কারখানা ঘরের বৈদ্যুতিক সেটিংস ভাল মানের নয়। প্রায়শই কম খরচে অপরিকল্পিতভাবে ঝুলন্ত তারের সাহায্যে নিম্নমানের বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। যে কারণে মারাত্মক দুর্ঘটনাও ঘটে মাঝে মাঝে। আর এসব দুর্ঘটনায় শিশুদেরই বেশি ক্ষতি হয়।
সাধারণ সময়ে ১২-১৩ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। ঈদ আর পূজা-পার্বণে জুতার কাটতি বাড়ে, কাজও বাড়ে শিশুদের। তখন ২০-২২ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। ওদের ঘাম ঝরিয়ে কারখানার মালিকের আয় বাড়ে, কারখানার প্রসার হয়, শুধু পরিবর্তন নেই এই শিশুদের। কারখানার পরিবেশেরও কোন উন্নতি হয় না। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে থাকতে জণ্ডিস, আমাশয়, ডায়রিয়া, মেরুদণ্ডের ব্যাথা, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, জ্বর সঙ্গী হয় ওদের। শিশুদের চিকিৎসার জন্য মালিকপক্ষের কোন দায়ভার নেই। বরং অসুস্থ্য হলে চাকরিটাই শেষ। ওদের কোন চাকুরী চুক্তি নেই, নেই কোন নিরাপত্তার গ্যারান্টি। মালিকের লোকেরা যখন তখন গালাগাল করে, মারে। কারো কাছে নালিশ জানাবার জায়গা নেই। জুতা কারখানার মালিকরা সংঘবদ্ধ বিত্তশালী শ্রেণীর। আইনও তাদের সাথে সখ্য। তারা শিশু অধিকার জানে না এবং মানে না। কারখানায় অনেক শিশু কাজ করে, নিজেরাই নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা শোনে, বলে। ওরা এক দুষ্টচক্রের দুর্ভেদ্য শিকলে বন্দী। চাকরী ছাড়লে সংসারের সবাইকে নিয়ে উপোস করতে হবে, তাই ইচ্ছে না থাকলেও কারখানা মালিকের অত্যাচার সয়ে যায়। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কারখানা মালিকরা বেশি সংখ্যায় শিশুদেরকে কাজে নিয়োগ দেয়। ওদের দিয়ে বেশি কাজ করানো যায়, নামমাত্র মুজুরি দিলেই চলে, কখনও শুধু পেটে-ভাতে। এজন্য তারা বড়দের চেয়ে শিশুদেরই নিয়োগ করতে বেশি উৎসাহী। এলাকা থেকে শিশুদের সংগ্রহ করে কারখানায় ভর্তি করার জন্য মালিকের দালাল আছে। তারা বাবা-মাকে প্ররোচিত করে শিশুদেরকে কাজে নিয়ে আসে, অনেক সময় স্কুল থেকে ছাড়িয়ে।

কাজে যাওয়া-না যাওয়া শিশুর ইচ্ছাতে হয় না। শিশুরা খেলতে চায়, আনন্দ চায়, পড়তে চায়, কিন্তু তারা তা পারে না। তারা কারখানার অস্বাস্থ্যকর আর বিপদজনক পরিবেশে কাজ করতে চায় না, কিন্ত তা তারা পারে না। তাদেরকে বাবা-মা, সমাজ, কিংবা জুতা কারখানার মালিকরা যেভাবে খুশি চালায়, তাদেরকে সেভাবেই চলতে বাধ্য করা হয়। শিশুরা পুতুল নিয়ে খেলতে ভালবাসে। খেলনা পুতুলদের ও এই শিশুদের মতই হাত-পা আছে, আছে মুখ-মাথা। তাদের আমরা যেভাবে খুশি চালাতে পারি, ইচ্ছে হলে ছুঁড়ে ফেলেও দিতে পারি। পুতুলদের কিছুই বলার নেই। ভৈরবে জুতার কারখানায় নিয়োজিত শিশুরাও কি তবে এক ধরনের পুতুল? ওরা কি মানুষ নয়? ওদের কষ্ট যেন শিশু অধিকার বা শিশু শ্রমের নিষিদ্ধ আইনকে স্পর্শ করতে পারে না। স্পর্শ করুক এটা হয়ত অনেক শিশু শ্রমিকও চায় না, কারণ তারা জানে, তারা কাজ না করলে তাদের অভুক্ত থাকতে হবে। তাই বলে কি সঠিক পূর্ণ বাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে অবহেলিত এই শিশুদের আলোকিত মানুষ তৈরি করার দায়িত্ব কেউ নেবে না?