প্রকৃতির খেয়ালে পৃথিবীতে যেমন অনেক কিছু ঘটে, তেমনি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলে প্রকৃতি বড় অসহায় বোধ করে। আমি প্রকৃতির সহোদরা। আমার নাম মায়াদ্বীপ।

ঈশা খাঁ এই বাংলা নামের বদ্বীপের যেখানটায় তাঁর দেশের রাজধানী গড়েছিলেন, তার পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে মেঘনা নামের অপূর্ব রূপমোহিনী এক নদী। সে নদীর তীরে তোমাদের ভালোবাসার সোনামোড়া সোনারগাঁ। এই সোনারগাঁ থেকে নদীপথে চার কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর বুক চিরে এখন থেকে প্রায় শত বছর আগে একটি ভূমি জেগে উঠেছিল, যার নাম তোমরা রেখেছিলে নুনেরটেক। সমুদ্রের পানি লোনা আর মেঘনার পানি মিঠা হলেও কেন যেন নাম রাখা হয় নুনেরটেক। সেই নুনেরটেকের কোলেই আমার জন্ম প্রায় ৩৫ বছর আগে। নদীকে আমরা মা বলে ডাকি। সেই নদীর বুকে জেগে ওঠে যে চর, তার নাম নদীকন্যা। নদীকন্যা নুনেরটেকের সহোদরা বোন আমি মায়াদ্বীপ।

আমার বুকে যে তিনটি অংশ রয়েছে, তার আছে আলাদা তিনটি নাম। গুচ্ছগ্রাম, সবুজবাগ আর রঘুনার চর। আমি নিরবধি মিঠা পানির জাতক বলে আমার বুকে অবারিত ঘুরে বেড়ায় কত হাজার জলজ প্রাণী। আর তীরজুড়ে কত শত মানুষের স্বপ্ন-বেদনার ইতিহাস। ছোট্ট আমার রূপলহরিজুড়ে প্রকৃতির যে অপূর্ব সমারোহ, তার মায়াবি টানে তোমাদেরই কজন মানুষ আমার কোলে ছুটে আসে। কিন্তু আমার কোলে আশ্রয় আর মমতায় যারা রয়েছে, তারা বঞ্চিত সভ্যতার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আর প্রাপ্য থেকে। এর মধ্যে প্রধান হলো, শিক্ষার আলো।

আমি ও আমার কোলের মানুষগুলোর দুর্দশা দেখে আমাদের জাগিয়ে তুলতে, স্বপ্নবান করে তুলতে আমার নাম দেওয়া হয় মায়াদ্বীপ। নতুন এই মায়াদ্বীপের মায়ায় পড়ে ধীরে ধীরে এখানে আসতে শুরু করে দেশ-বিদেশের কত কত কল্যাণকামী মানুষ। সেই থেকে বঞ্চনায় ডুবে থাকা আমার কোলের মানুষগুলোর বুকজুড়ে ডানা মেলে বেঁচে থাকার নতুন প্রত্যয়। একদা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলো যাকে নিয়তি বলে মেনে নিত, তাদের চোখেও খেলতে থাকে নতুন নতুন স্বপ্ন।অন্ধকারে চোখ মেলে আলোর ভুবন

পৃথিবীজুড়েই শিশুরা সর্বাধিক বঞ্চনার শিকার। আর আমার কোলে জলে ও কাদায় দিনভর কলকাকলিতে মেতে থাকে যে শিশুরা, তারা তারও অধিক সুবিধাবঞ্চিত। এই শিশুদের বেড়ে ওঠা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, ভবিষ্যতের স্বপ্ন—একসময় এসবের কিছুই ছিল না। কিন্তু আমার নাম যখন দেওয়া হয় মায়াদ্বীপ, এর সঙ্গে শুরু হয় যেন হাজার হাজার মায়াস্বপ্নের জালবুনন। যাবতীয় সুবিধাবঞ্চিত এখানকার নিরক্ষর শিশুগুলোর প্রাণে আলোর শিখা জ্বালাতে সামাজিক প্রতিষ্ঠান সুবর্ণগ্রামের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে মায়াদ্বীপ জেলে শিশু পাঠশালা। এর মাধ্যমে এখানকার শিশুদের এখন দেওয়া হয় শিক্ষার আলো।

সঙ্গে সঙ্গে আমার কোলে বেড়ে ওঠা নিয়তিনির্ভর মানুষগুলোর প্রাণে সুবর্ণগ্রামের পক্ষ থেকে গড়ে তোলা হচ্ছে সব ধরনের জনসচেতনতা। ফলে এই নিয়তিনির্ভর মানুষগুলো এখন তাদের জীবনসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করে নিচ্ছে সঠিক বাস্তবতার বোধও। এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন দেশের কয়েকজন খ্যাতিমান তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং প্রকৃতি ও মানবদরদি ব্যক্তি। এখন আমার কোলে জলে ও কাদায় বেড়ে ওঠা শিশুগুলো পাঠ নিচ্ছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের।

বালুখেকোদের দৌরাত্ম্য
খরস্রোতা মেঘনা থেকে তিলে তিলে পলি-বালু সংগ্রহ করে আজ আমি মায়াদ্বীপ। আমাকে ভালোবেসে আমার বুকে দেড় হাজার মানুষের বসবাস, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা। কিন্তু কিছু বালুখেকো আমার বুকে আঁচড় বসিয়েছে। কয়েক মাস ধরে আমার বুকের পাশ থেকে ড্রেজার দিয়ে রাত-দিন তুলে নেওয়া হচ্ছে বালু। এর ফলে ভাঙতে শুরু করেছে আমার চারপাশ। ফলে এখানে বসবাস করা মানুষগুলো পড়েছে চরম অস্তিত্বহীনতায়। এভাবে আর কিছুদিন যদি বালুখেকোরা বালু উত্তোলন অব্যাহত রাখে, তাহলে আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। আমাকে রক্ষা করতে আমার বুকে বসবাস করা মানুষগুলো জেলা প্রশাসনের আহ্বানে সম্মিলিতভাবে গত ১০ ডিসেম্বর প্রতিরোধ গড়ে তোলে বালুখেকোদের বিরুদ্ধে।

কিন্তু তারা অনেক ক্ষমতাবান, এত ক্ষমতাবান যে দেশের মানুষ তাদের নাম জানে, অনেকে ভয়ও পায়। তাদের ইচ্ছায় বাধা দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে বালুখেকোরা আমার বুকে বসবাস করা সব মানুষের বিরুদ্ধে ঠুকে দেয় ষড়যন্ত্রের মামলা। এর পর থেকেই আমার দেড় হাজার সন্তান নিরাপত্তাহীনতা আর গ্রেপ্তার-আতঙ্কে অনিশ্চিত জীবন কাটাচ্ছে। তাদের স্বাভাবিক জীবনের পদে পদে নেমে এসেছে ভয়, শঙ্কা আর অনিশ্চয়তা। এই দেড় হাজার মানুষকে শুধু উচ্ছেদই নয়, পুরো মায়াদ্বীপকেই তারা বিলীন করে দিতে চায়। তাদের বালু দরকার, মানুষ দরকার নেই। কিন্তু এই দ্বীপে মানুষ না থাকলে তো আমি মায়াদ্বীপও থাকব না।
এই পরিস্থিতি থেকে আমার দেড় হাজার সন্তান ও তাদের স্বপ্নকে বাঁচাতে আর তাদের জীবনধারণ ও বসবাস নিশ্চিত করতে আমি সোনারগাঁবাসীসহ দেশবাসীর কাছে আকুল আবেদন করছি। আমি তোমাদের মায়াদ্বীপ, আমাকে বাঁচাও। আমার অস্তিত্ব রক্ষায় আমার পাশে দাঁড়ান: ফেসবুক গ্রুপ—মায়াদ্বীপ বাঁচান।

লিখেছেনঃ শাহেদ কায়েস: কবি, শিক্ষক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠক।
লেখাটি প্রথম আলোতে প্রকাশিত