ঈদের লম্বা ছুটিতে বন্ধুচক্রের সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ‘কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়?’ ঈদের আগের দিন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিই আমাদের নিজেদের জেলাটাই ভাল করে ঘুরে দেখব। আগেই বলে রাখি আমাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগন্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানার ঐতিহাসিক এগারসিন্দুর গ্রাম। ঈশা খাঁ, মানসিংহের যুদ্ধ হয়েছিল আমাদের গ্রামে। আমরা প্ল্যান করলাম ভাটি অঞ্চলে নদী পথে ঘুরব। কিন্তু বাড়ি থেকে কেউ ই সারা পেলামনা। বরং বিভিন্ন হুমকি, ভয় ভীতি দেখিয়ে আমাদের নিরস্ত করার চেষ্টা চলল। এক বন্ধু তো এসে বলেই বসল সে যেতে পারবেনা। বাড়ি থেকে রাজি করানো যাচ্ছেনা কারণ ওখানে নাকি কিছুদিন পর পর লঞ্চ/ট্রলার ডুবি হয় শিয়ালের লেজ কাটার মতো সে নিরন্তন চেষ্টা করতে লাগল আমাদের ট্যুর বাতিল করতে কিন্তু আমরা সাত বন্ধু অনড়। সিদ্ধান্তনুযায়ী বাড়ির কাউকে না জানিয়ে আমরা স্হানীয় বাজারে পরদিন সকাল ৭.৩০ টায় একত্রিত হলাম (যদিও আসার কথা ছিল ৬.০০ টায়, কিন্তু তিন রূপ সচেতন’র জন্য দেরী হয়ে যায়)। বাজার থেকে কটিয়াদীর পথে যাত্রা করি পিকআপ ভ্যানে। ২০ মিনিটে কটিয়াদী পৌঁছে নাসতা সেরে নিই। এবার আমদের যেতে হবে কুলিয়ারচর যেখানে আমরা লঞ্চ পাব।

কটিয়াদি থেকে সিএনজি অটোরিক্সা নিয়ে চলে যাই কুলিয়ারচর। সময় খুব বেশি না লাগলেও ভাড়া কিন্তু কম নয়। তিনশ’ টাকা করে লাগল প্রতি অটোরিক্সা  কুলিয়ারচর বাজারে এসে অবাক হলাম। ‘মাছে ভাতে বাংগালী’ প্রবাদটি শুধু বইয়ে পড়েছি, আজ তার প্রমাণ মিলল। প্রচুর মাছ পাওয়া যায় এই কুলিয়ারচর বাজারে। সব ই নদীর মাছ। দামও খুব বেশী না। সদ্য নদী থেকে তোলা জ্যান্ত মাছ গুলো যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। মাছ দেখে আমরা এতোই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে মনে হচ্ছিল ট্যুর বাতিল করে বাজেটের পুরো টাকাটা দিয়ে মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরি।কিন্তু ভয়কে জয় করার দীপ্ত প্রয়াস আমাদের লঞ্চে উঠতে বাধ্য করল। দু’তলা লঞ্চটা তেমন আহামরি কিছু না। লঞ্চ চলতে শুরু করার পর আমরা যেন আবিস্কার করলাম এক নতুন বাংলাদেশ।

বিমোহিত দৃষ্টিতে দেখতে থাকলাম নদীমাতৃক বাংলার রূপ। সত্যি কথা বলতে কি বঙ্গোপসাগর ছাড়া এতো পানি আগে কখনো দেখিনি। দৃষ্টিসীমার সবটুকু জুড়ে শুধু পানি আর পানি!!!! মাঝে মাঝে ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা আর দ্বীপ সদৃশ গ্রাম। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অসীম শ্রদ্ধায় মাথা নত করি। কি অপরূপ রূপে তিনি সাজিয়েছেন আমাদের বাংলাদেশকে!!!  দ্বীপের মতো গ্রাম গুলো একটা থেকে অন্যটা পৃথক। এতো পানির ভিতর গ্রামগুলো টিকে আছে খুব শক্তিশালি পাকা বাধের কারনে। লঞ্চগামী এক অষ্টগ্রাম বাসীর (হাসান )কাছে শুনলাম বিভিন্ন এনজিও সংস্হা বিনামূল্যে এসব বাধ দিয়ে গ্রাম রক্ষার কাজ করছে। ‘বর্ষায় নৌকা, হেমন্তে পাও’ কথাটি এই এলাকার জন্য সম্পূর্ন প্রযোজ্য। নদীপথ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে গিয়ে বসলাম চালক মামার সাথে। সে জানাল আমরা চারটি নদী যথাক্রমে কালী, কালণী, ঘোরাউত্রা এবং ধলেশ্বরী পাড়ি দিয়ে অষ্টগ্রাম পৌঁছুব। মধ্যে পরবে চারনদীর মোহনা যেখানে এই চার নদী মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। চৌমোহনার কাছে এসে এক বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হলাম। এখানে চার নদীর পানি চার রংয়ের। কোন পানির সাথে কোন পানি মিলেনা!!!!

প্রায় তিন ঘন্টা পর আমরা এসে পৌছুলাম অষ্টগ্রাম লঞ্চঘাট। ঘাটের পাশেই সরকারি ডাকবাংলো। লঞ্চে পরিচিত হওয়া হাসানের পরামর্শে ফোন করি বাংলোর কেয়ারটেকার রন্জন ভাইকে। উনি সাথে সাথে লোক পাঠিয়ে আমাদের থাকার ব্যবস্হা করেন……….।
চলবে………… (পূর্বে সামহ্যোয়ারইনব্লগে প্রকাশিত)