একাত্তরে পাকবাহিনী যে বর্বরতার নিষ্ঠুরতা চালিয়েছিল সে সম্পর্কে কোন বিবরণ লেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না।এই বর্বরতা ছিল সারা দেশ ব্যাপী।ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা।বাংলার প্রতিটি ঘরেই চলেছে এই বর্বরতা,কেউ নিজে শিকার হয়েছেন,কেউ আপনজন কে হারিয়েছে,কেউ প্রত্যক্ষ করেছে।আবার তখন যাদের জন্ম হয়নি তারাও শুনেছেন আপনজনদের কাছে।আমি এখানে শুধু কিশোরগঞ্জের ঘটে যাওয়া কিছু বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেছি।

সময় (১লা বৈশাখ)১৯৭১। স্থান ভৈরব বাজারঃ

দিনটি ছিল বৃহষ্পতিবার। সাধারনত প্রত্যুষে মানুষের ঘুম ভাঙ্গে পাখির কলকাকলীতে।কিন্তু সেইদিন ভৈরব বাসীদের জন্য সকালটা ছিল ব্যাতীক্রম ধর্মী।জঙ্গী বিমানের বিকট শব্দ,মেশিন গানের অবিরাম ব্রাশ ফায়ার ভৈরব বাসীকে সেদিন ভীত বিহব্বল অবস্থায় জাগিয়ে তুলে।বেলা যত বারতে থাকে তখন ধীরে ধিরে কমতে থাকে জঙ্গী বিমানের আনাগোনা।এক সময় একেবারেই থেমে যায়।মানুষ যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে যাচ্ছিল,ঠিক তখনই শুরু হয় এক সঙ্গে অনেক গুলো জঙ্গী বিমানের বিকট শব্দ।জঙ্গী বিমানের ছত্র ছায়ায় কয়েকটি হেলিকপ্তার এসে নামে মধ্যরচর ও শম্ভুপুর গ্রামের খেলার মাঠে।ভৈরবের গ্রামঞ্চলের এই সব সাধারণ লোকজন কোনদিন যুদ্ধ দেখেনি,ভাবিনি এই হেলিকপ্তার গুলোর ভিতরে কি থাকতে পারে।

মাঠে নেমে আসে দলে দলে মানুষ,ঠিক সেই সময় হেলিকপ্তার গুলো থেকে নেমে আসে কমান্ড বাহিনী।শুরু করে ব্রাশ ফায়ার।এবার বিপরীত মূখী হয় গ্রামের সরল মানুষগুলো।ছুটতে থাকে উর্ধশ্বাসে।ব্রাশ ফায়ার করতে করতে পিছু নেয় কমান্ড বাহিনী।পাখির মত লুটিয়ে পড়ে মানুষগুলো।কাঁচা পাকা ধান গুলো রক্তে রঞ্জিত হয়ে লাল রঙ ধারণ করতে থাকে।ইতিমধ্যে গ্রামে খবর পৌঁছে যায়।ভৈরবপুর,কমলপুর,জগন্নাথপুর সহ অন্যান্য গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতা ঘরবাড়ি ফেলে ছুটতে থাকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর দিকে। উদ্দেশ্য নদী পার হতে পারলে জীবন বাচঁবে।মূহুর্তের মধ্যে অনেক লোক জমায়েত হয়ে গেল হাল পারা খেয়া ঘাটের কাছে পানাউল্লার চরে।খেয়াঘাটে মাত্র একটি নৌকা।এতগুলো লোক পার হবে কেমন করে!পাক কমান্ড বাহিনীও প্রায় কাছে এসে গেছে প্রায়।ওপারের ইব্রাহিমের লোকজন বিষয়টি অনুধাবণ করতে পেরে বেশ কটি নৌকা নিয়ে পারাপারে এগিয়ে আসে।কিন্তু পারেনি বেশিক্ষন।

কমান্ড বাহিনী পৌঁছে  যায় পানাউল্লার চরে।শুরু হয় ব্রাশ ফায়ার।জীবন বাঁচাতে কেউ কেউ নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে।অনেকেই রক্ষা পায়নি।পানাউল্লার চরে সেদিন মৃতের সংখ্যা ৩০০ জন হবে বলে অনুমান করা হয়।এখানেই ঘটনার শেষ নয়।

কমান্ডো বাহিনী পানাউল্লার থেকে এগিয়ে চলে ভৈরব বাজারের দিকে। পাকবাহিনীর আরেকটি দলও আশুগঞ্জে অবতরণ করে পায়ে হেটেঁ ভৈরব ব্রীজ পার হয়ে এগিয়ে আসে ভৈরব বাজারের দিকে।উভয় দলই পথে যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে।

বন্দর নগরী ভৈরবে প্রবেশ করে দল দুটি মিলিত ভাবে মরিচপট্টি কলেজরোড, জামে মসজিদ  রোড, রানীরবাজার, টিনপট্টি, মিষ্টিপট্টি, চকবাজার, মুড়িপট্টি, হিন্দুপট্টি, বাতাসাপট্টি সহ আরো কিছু স্থানে ব্যাপক অগ্নিংযোগ করে।এই বিরান বাজারে আগুন নিভানোর মত কোন জন মানব ছিলনা।আগুন জ্বলছে সাতদিন ব্যাপী, নষ্ট হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।

সময় ২০ আগষ্ট, ১৯৭১ স্থান ভৈরব থানার মানিকদী ও চান্দের চর গ্রামঃ

বার ছিল শুক্রবার। ফজরের আযানের সময় এক জেলে বধূ কলসি নিয়ে পানি আনতে ঘাটের দিকে আসছিল। তখন আধো আলোতে গ্রামের প্রান্তসীমায় দেখতে পায় একদল হানাদার বাহিনী সারিবদ্ধ ভাবে এগিয়ে আসছে।বধূটি কলসি ফেলে চিৎকার করতে করতে গ্রামের সবলোককে জাগিয়ে তুলে। এছাড়া ফজরের আযান শুনে অনেকে জেগে উঠেছিল। এরপর যে যেভাবে পারে পালাতে শুরু করলো।পারলনা শুধু কয়েকজন প্রবীণ মুসুল্লী। তারা অজু করে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে প্রবেশ করল। হানাদার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল ভৈরব অঞ্চলের বহু অঘটনের কুখ্যাত নায়ক ক্যাপ্টেন আনোয়ার সাইফ।আনোয়ার সাইফের বাহিনী পথে ঘাটে, আশেপাশে কাউকে না পেয়ে মসজিদের ভিতর ঢুকে নামাজরত মুসুল্লিদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে এগিয়ে চলে চান্দেরপুর গ্রামে। পথে ঘাটে আত্নগোপন কারী আব্দুর রশীদের সদ্য বিবাহিত মেয়ে জামাই সহ আরো কয়েকজনকে ধরে বেয়নট দিয়ে খুচিঁয়ে খুচিঁয়ে মারে যেন গুলির শব্দে আশেপাশের মানুষ পালাতে না পারে।তবে চান্দের চর গ্রামের মানুষ ঠিকই পালিয়েছিল। পালায়নি শুধু মানিকদীর মত ঈমানদার মুসুল্লিগন।ওদের দৃঢ় প্রত্যয় ছিল অরা মুসলমান, তাই নামাজীদের কিছু করবেনা।

মানিকদীর মত চান্দের চর মানুষেরা জানেনা যে তারা কতটা হিংস্র হতে পারে। মানিকদীর মত চান্দের চর মসজিদেও পুনরাবৃত্তি হলো। ফরজ নামাজ শেষে তারা মোনাজাত করছিল।মহান আল্লাহর কাছে তারা কি ফরিয়াদ জানাচ্ছিল তা কেউ দিনও জানতে পারবেনা, তারপর একটি মাত্র বাশফায়ার।

সময় ১৮ এপ্রিল,১৯৭১ স্থান সরারচর রেলষ্টেশনঃ

ঐদিন আনুমানিক রাত ১১ টার দিকে ভৈরব বাজার থেকে হানাদার বাহী একটি ট্রেন সারারাত সরারচর রেলষ্টেশনে অবস্থান করে।রেলষ্টেশনের পাশেই রয়েছে একটি মেথরপট্টি।কয়েকজন উড়িয়া মেথর এখানে থাকে।রাত ১২ টার দিকে কয়েকজন হানাদার বাহিনী ট্রেন থেকে নেমে মেথরপট্টিতে প্রবেশ করে।তারা সারারাত প্রতিটি ঘরে তল্লাশি করে পরে ভিক্ষু নামক একজন মেথরের ঘরে পেয়ে যায় অতিবাহিত দুটি সোমত্ত মেয়ে হিংস্র হায়েনারা পিতার সামনেই মেয়ে দুটিকে সারারাত পালাক্রমে ধর্ষন করে।এহেন নিষ্ঠুর নির্যাতনে মেয়ে দুটি পরবর্তীতে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল।

পরদিন সকালে কয়েকজন হানাদার সেনা সরারচর বাজার এলাকা থেকে কৃষ্ণ চন্দ্র সাহা ও কয়েকজন কিশর কে ধরে নিয়ে যায়।২০/২৫ দিনপর কিশোরগণ সরারচর ফিরে আসে। কৃষ্ণ চন্দ্রের মুখে জানা যায় এদেরকে হানাদার বাহিনীর বিকৃতরুচির সমকামীতার স্বীকার হতে হয়েছিল।

সময় ৪ মে ১৯৭১, স্থান বাজিতপুরঃ

সেদিন ভোর রাতে ভৈরব বাজার থেকে ট্রেনযোগে পাকবাহিনীর একটি বড় দল সরারচর রেলষ্টেশনে এসে পৌঁছে।ইতিপূর্বেই কয়েকটি ট্রাক ষ্টেশনের পূর্ব দিকে অবস্থান করে।সূর্য উঠার আগেই পাক-সেনার দলটি ট্রাক যোগে বাজিতপুর ডাকবাংলার সামনে চলে যায়।এরপর এখানে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং হয়,এরপর দলটি তিনভাগে বিভক্ত হয়ে একদল চলে যায় দিঘীর পার পাটুলীর দিকে,অপর দলটি যায় ঘাগটিয়ার দিকে এবং শেষ দলটি প্রবেশ করে বাজিতপুর পৌর এলাকায়।কিছুক্ষনের মধ্যে গুলির সংগে ভেসে আসে মানুষের আর্তচিৎকার।

বাজিতপুর পৌর এলাকায় যে বাহিনী প্রবেশ করেছিল,তারা যেখানে যে অবস্থায় যাকে পেয়েছে তাকে ধরে এনে বাশঁমহলে জড়ো করেছে। তাদের লক্ষ ছিল হিন্দু প্রধান এলাকার প্রতি।অপর যে দুটি দল ছিল তারাও হিন্দু অধ্যূষিত এলাকায় হানা চালিয়েছিল।ধরে এনেছে অনেককে,আবার যারা পালাতে চেয়েছিল তাদের কে গুলি করে হত্যা করেছে।ধরার পর নির্বিচারে ঘরের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়।বাজিতপুর ঘাগটিয়া গ্রামে বহু পুরাতন ঐতিহ্যবাহী আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।হত্যা করা হয় আশ্রমে আশ্রয়রত বেশ কিছু নিরীহ মানুষকে।পৌর এলাকার নিতার কান্দি গ্রামের দাঁতের ডাক্তার,সর্বজন প্রিয় নরেশচন্দ্র সেন কে তার বাড়ির সামনেই গুলি করে হত্যা করে।গুলি খেয়ে তিনি বেচেঁ গিয়েছিলেন,অসহ্য যন্ত্রনায় যখন আর্তচিতকার দেয় তখন পাক সেনারা তাকে টেনে নিয়ে একটি গর্তে ফেলে তাকে জীবন্ত অবস্থায় মাটি চাপা দেয়।

তিনটি দলই বহু নারী পুরুষ কে ধরে এনে বাশঁমহলে জড়ো করে। সংখ্যায় ৩০০ থেকে ৩৫০ হবে। প্রত্যককে হাত পা শক্ত অরে বেধে ট্রাকে তোলা হয়।ট্রাক গুলো সিএন্ড ডি রোড দিয়ে সরারচরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। যাওয়ার পথে বেশ কিছু মানুষ কে হত্যা করে কটি স্থানে রাস্তার পাশে মানুষগুলি কে ফেলে রাখা হয়।এদের সংখ্যা ছিল ২০ জন।বাকী লোকগুলো কে ট্রেনে করে ভৈরবের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।অদ্যাবধি তাদের আর কোন সন্ধান পাওয়য যায়নি।

সময় ২৭ আগষ্ট,১৯৭১,স্থান বাজিতপুর থানার সরারচর এলাকাঃ

ঐদিন সকালে সরারচর হাইস্কুলে রহিমা ছাত্রাবাসে অবস্থানরত পাক  মিলিশিয়া বাহিনীর একটি দল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি দল কামালপুর গ্রামে গিয়ে গিরিন্দ্র ডাক্তার,রবীন্দ্র সাহা পরে মীরাপুর গ্রামে গিয়ে রায় মোহন সাহা ও কয়েকটি বাড়িইতে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করে।শুধু তাই নয় তারা কামালপুরের গিরিন্দ্র ডাক্তার,গোবিন্দপুরের রাজেন্দ্র আচার্য্য,পুত্র গণেশ আচার্য্য প্রত্রৌত্র আচার্য্য ও ঐ গ্রামের দীণেশ চন্দ্র সাহা সহ ১৮ জন লোককে বন্দী করে নিয়ে আসে।

অপর দলটি পাথারিয়া কান্দি গ্রামে গিয়ে বাজিতপুর কলেজের প্রাক্তন ভিপি বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ছিদ্দিকুর রহমানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।সেখান থেকে চলে যায় তৎকালীন সরারচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম মতিউর রহমানের বাড়ীতে।প্রবেশপথেই তারা এলোপাথারী গুলি শুরু করে।গুলিতে মতিউর রহমানের শিশুপুত্র আহত হয় ও বেশ কিছু গবাদি পশু মারা যায়।বাড়ীতে তখন মতিউর রহমানের পৌঢ় পিতা ছাড়া আর কোন বয়স্ক লোক ছিলনা।

সময় ৪ সেপ্টেম্বর,স্থান অষ্টগ্রাম থানাঃ

সেদিন সকালের দিকে পাক সেনারা অষ্টগ্রামের বাসিন্দা তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা মৎসজীবি সমবায় সমিতির বিশিষ্ট কর্মকর্তা কৃষ্ণধন দাস তার পুত্র বাজিতপুর কলেজের ছাত্র কৃপা সিন্ধু দাস কেআর্মি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে আসে।প্রথমে মামুলি জিজ্ঞাসাবাদ।তারপরই শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন।পিতা পুত্রের আর্তচিৎকারে তখন অষ্টগ্রামের মাটিও প্রকম্পিত হয়ে উঠে।তারপর পিতার সামনেই পুত্রকে মাটিতে শোয়ানো হয়।পরক্ষনেই পিতার সামনে জবাই করা হয় পুত্রকে।এখানেই শেষ নয়,দেহ থেকে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে তুলে দেয়া হয় পিতার দুহাতে। টপ টপ করে রক্ত ঝরছে পিতার দেহ গড়িয়ে মাটিতে।পিতার চোখে কোণ পানি নেই।অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নিজের ঔরষজাত আপন সন্তানের মুখটি। বর্বতার যবনিকা হয় নদির তীরে।পাক সেনা বাহিনীর নির্দেষে কৃষ্ণধন পুত্রের খন্ডিত মস্তকটি নিয়ে এগিয়ে যান,নদির তীরে তাকে দাঁড় করানো হয়।তারপর একটি মাত্র গুলি।পুত্রের খন্ডীত মস্তকটি বুকে চেঁপে ধরে ঢলে পড়েন নদীতে।এবার বুঝি চিরশান্তি পেয়েছেন তিনি।

সময় ২৬ আগষ্ট ১৯৭১ স্থান মিঠামইনঃ

ঐ দিন নিকলী আর্মি ক্যাম্প থেকে কয়েকটি মোটর লঞ্চ ও গান বোট যোগে এক দল পাক সেনা মিঠামইন বাজারে এসে চারিদিক ঘেরাও করে ফেলে।পাক সেনারা মিঠামইন বাজারের আশেপাশের গ্রামগুলোও ঘেরাও করে ফেলে। একসংগেই শুরু হয়   লুটপাট,অগ্নি সংযোগ ও গুলিবর্ষন।দিশেহারা মানুষ এমনকি গবাদিপশুও ভিত হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে।কেউ জীবন দিয়েছে গুলির আঘাতে, কেউ জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে। বেঁচেছে অল্পসংখ্যক মানুষ।এমনকি গবাদি পশুও জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে।

সময় ১ সেপ্টম্বর ১৯৭১,স্থান মিঠামইন ঘাগড়া ইউনিয়নের ধুবাজুড়া গ্রামঃ

সেদিন ছিল বুধবার। সেদিন সকালে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার ফুরহান আলীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী ধুবাজুরা গ্রাম ঘেরাও করে গ্রামের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক-আঃ আজিজ ভূঞা ও তার দুই পুত্র আঃমান্নান ভূঞা ও রোকজ্জামান ভূঞা ও সিদ্দিক ভূঞা ও চেয়ারম্যান আঃ গনি ভূঞা ও তার দুই পুত্র সহ আরো ২০ জন নিরীহ  মানুষ কে বন্দী করে।ঘটনাস্থলেই ফুরকান আলীর নির্দেশে আঃআজিজ ভূঞা ও আঃগনির দুই পুত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়।এরপর ১৭ জনকে প্রথমে তেলিখাই (কান্দিপাড়া)কুখ্যাত দালাল সাহেব বাড়ীতে।সেখান থেকে ১৭ ধৃত ব্যক্তকে নিয়ে ফরকান আলীর দল ইটনা থেকে নৌকাযোগে নিকলী আর্মি ক্যাম্পের দিকে রওনা হয়।ইটনা হাওরে গিয়ে মত পালটে ফেলে,১৭ জন কে কোরবানীর পশুর মত সবাই কে জবাই করে হাওরের অথৈ পানিতে টুকরা টুকরা করে ভাসিয়ে দেয়া হয়।

সময় ৬ সেপ্টম্বর,স্থান নিকলী থানার গুরই গ্রামঃ

সেদিন সকালের দিকে ক্যাপ্টেন ফিরোজের নেতৃত্বে পাক সেনার একটি দল লঞ্চযোগে নিকলী সদর থানা থেকে গুরই গ্রামে আসে। এসেই তারা মুক্তিবাহিনীর বাধাঁর সন্মুখীন হন।প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর গুলিতে দুজন পাক সেনা মৃত্যু বরণ করে।পরপরই পাক বাহিনী প্রচন্ড আক্রমন করে।মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপত্তার স্বার্থে পশ্চাদপসারণ করতে থাকে। পাকবাহিনী গ্রামে ঢুকেই এলোপাথারি গুলি শুরু করে।এরপর শুরু হয় অগ্নি সংযোগ।গুলিতে জৈনক কেস্ত মিয়ার স্ত্রী নিহত হয়।পাকসেনারা পলায়নপর এয়াকুব আলী নামক ব্যক্তিকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে হত্যা করে।তারপর গ্রামের আশেপাশে তল্লাশি চালিয়ে ২৪ জনকে ধরে নিয়ে এক সাথে রশিতে বেধে ব্রাশফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করে।

সময় সঠিক তারিখ জানা যায়নি। স্থান নিকলী থানাঃ

দামপাড়া গ্রামের জেলে,সুত্রধর কর্মকার ও কিছু শ্রেনীর দরিদ্র পরিবার পাকবাহিনীর দালাল তেকু মিয়ার আশ্বাসে নিশ্চিত জীবন যাপনের জন্য কলেমা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। কয়েক দিন পর তেকু মিয়া জানান নিকলী সদরে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর প্রধান মেজর দুরবানী এই সংবাদে সুখি হয়ে এদের সংগে মিলিত হয়ার একান্ত ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।একথা শুনে ইসলাম ধর্ম গ্রহন কারী ৫০/৬০ লোক জন নতুন পাঞ্জাবি পাজামা টুপি পড়ে নৌকা যোগে টেকু মিয়ার সাথে নিকলী আর্মি ক্যাম্পে যায়। মেজর দূরবানী শুধু তাদের কে এক নজর দেখে।এরপর কিসের ইঙ্গিত দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল।এর পর সাথে সাথে পাকসেনারা তাদের কে লম্বা রশি দিয়ে হাত পা শক্ত করে বেধে ফেলে।এরপর তাদের চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে থাকে। ২ টি খুঁটিতে রশির একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত বাধেঁ।

এর কিছু ক্ষনের মধ্যেই সবার হাতপা ব্যথা শুরু হয়। এরমধ্যে কয়েকজন কিশোরও ছিল। এমনি অবস্থায় সন্ধ্যা প্রাক্কালে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার আঃহোসেন ৮/১০ সঙ্গী নিয়ে পশুর মত বাধা মানুষগুলোকে টেনে হেচঁড়ে শশ্নানে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে খুব একটা সময় নেয়নি তারা। রাজাকার দল তাদের কে বেয়নেট দিয়ে খুচাঁতে থাকে।মর্মবিদারক আর্তচিৎকারের সঙ্গে ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্তে শ্বশ্নান রঞ্জিত হয়ে যায়। এরপর জবাই করা পাখির মত মানুষ গুলোকে স্তুপাকারে ফেলে রেখে চলে যায়। বেয়নেতের এমন নির্মম আঘাতের পরও ৮/১০ জন কিশোর বেচেঁ যায়।তারপর একটি দীঘল রাত গলাগলি করে মৃত আর জীবিত মানুষ একসাথে পার করে।সূর্য উঠার পর আবার রাজাকার হোসেন বড় নৌকা নিয়ে সেখানে আসে। সকলকে মৃত ভেবে টেনে হিচঁড়ে নৌকায় তুলে।মাঝ নদীতে ফেলে দেয়া হয় ময়লা আবর্জনার মত। এত কিছুর পর ২ জন ১০, ১২ বছরের দুজন কিশোর বেচেঁ যায় সেখান থেকে। তাদের ভাষা মত অপরাপর জীবিত কয়েকজন দাঁত দিয়ে তাদের হাত পায়ের বাধঁন খুলে দিয়েছিল।কিন্তু তারাও বাচঁতে পারেনি। এ হত্যাকান্ডের ৩৫ জনের নাম ও ঠিকানা পাওয়া গেছে।

সময় ১০ ই মে স্থান কটিয়াদীঃ

ঐ দিন শেষ রাতে পাকসেনা বাহিনীর সদস্যগণ কটিয়াদী থানার বাঘরাইট,হালুয়া পাড়া ও বেতের গাও গ্রাম ঘেরাও করে ১৯ জন ব্যক্তিকে ঘরে কটিয়াদী থানা সদরে নিয়ে আসে। ক্যাম্পে এনে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় বাজার সংলগ্ন আড়িঁইয়াল খাঁ নদীর তীরে।১৯ জন কে একসঙ্গে লাইন করে দাঁড় করানো হয়। এরপর সাথে সাথেই ব্রাশ ফায়ার।১৯ জনই নদীতে লুটিয়ে পড়ে।এর মধ্যে ৬ জন অলৌকিক ভাবে বেঁচে যায়।এদের মধ্যে বাফগরাইট গ্রামের হাজী জাহিদুল হক সম্পূর্ন অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যায়।

সময় জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ স্থান পাকুন্দিয়াঃ

চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি থানার বাসিন্দা ডঃ অমূল্য ছিলেন পাকুন্দিয়া থানার মেডিকেল অফিসার।অমূল্য চক্রবর্তীর তিন ছেলে ও দুই মেয়ে এবং স্ট্রীকে নিয়ে সংসার।জুন মাসের প্রথম দিকে পাকসেনারা পাকুন্দিয়া থানায় একটি অপারেশনের সময় ডঃ অমূল্য সেনের পরিবারের সকল সদস্যকে ধরে কিশোরগঞ্জ শহরে তাদের মূল ক্যাম্পে নিয়ে আসে।কিশোরগঞ্জ পাক আর্মিদের নেতৃত্বে তখন নারী লিপ্সু মেজর দূরবানী।অমুল্য চক্রবর্তীর স্ট্রী ও দুই মেয়েকে মেজর দূরবানী নিজের কাছে রেখে দেয়।অমূল্য চক্রবর্তী ও তার দুই ছেলেকে ধূলদিয়া রেলওয়ে ব্রীজ বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।কিন্তু অমূল্য চক্রবর্তীর ছেলে বকুল নিতান্ত ছোট হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

মেজর দূরবানী কিছুদিন পর সেখান থেকে নিকলোতে চলে যায়।সঙ্গে নিয়ে যায় অমূল্য চক্রবর্তীর স্ট্রী ও দুই মেয়েকে।নিকলী থানা হানাদার মুক্ত হওয়ার পর বাংকারে বেশ কজন উলঙ্গ নারীর গলিত  লাশ পাওয়া যায়।তবে চেনার কোন উপায় ছিলনা।বকুল চক্রবর্তী বর্তমানে চাকুরীরত।সে অদ্যাবধি মা কিংবা বোনের কোন সন্ধান পাননি।

সময় ১৬ আগষ্ট,স্থান হোসেনপুর থানার কুড়িঘাটঃ

১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস।স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পাকবাহিনীর নির্দেশে মন্দির মসজিদ গুলোতে বিশেষ মোনাজাতের ব্যবস্থা করা হয়।তারই অংশ হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায় ১৬ আগষ্ট রাত্রে আখড়ায় নাম কীর্তনের আয়োজন করে।ঐ রাতে হিন্দু সম্প্রদায় নারী পুরুষ সকলে সমবেত হয়ে সারারাত ব্যপী কীর্তন করে যখন ঘরে ফেরার আয়োজন করে ঠিক তখনই পাকসেনারা আখড়া ঘেরাও করে ফেলে তারপর ১৫৩ জন নারী পুরুষ কে ধরে নিয়ে যায় কুড়িঘাটে।প্রথমে একটি গুদাম ঘরে সকলকে আটকে রাখা হয়।তারপর একে একে বের করে নদী হাতে নিয়ে গিয়ে একে একে সবাই কে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

সময় ২৫ মে,১৯৭১ স্থান তাড়াইল থানার নগরফুল গ্রামঃ

ঐদিন রাতে পাকবাহিনীর একটি দল নগর ফুল গ্রাম ঘেরাও করে গ্রামের নিরীহ কৃষক শরৎ সরকার,জগৎ সরকার,সুরেন্দ্র সরকার,সুভাষ ভৌমিক,নরেষ ভৌমিককে ধরে কিশোরগঞ্জ সেনাক্যাম্পে নিয়ে আসে।সারাদিন নির্যাতন করে পরদিন রাতে সিদ্ধেস্বরী ঘাট বধ্যভূমিতে নিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।

সময় ২৩ এপ্রিল, স্থান কিশোরগঞ্জ শহরঃ

কিশোরগঞ্জ শহরের আশেপাশে বেশ কটি বধ্যভূমি ছিল।এরমধ্যে একটি বধ্যভূমি ছিল নরসুন্দা নদীর তীরে সুগার মিল ঘাট। ২৩ এপ্রিল সকালে ক্যাপ্টেন কুখারীর নেতৃত্বে একদল পাকসেনা সগড়া গ্রাম ঘেরাও করে।সগড়া পন্ডিত বাড়ী থেকে ইন্দ্রজিত পন্ডিত সহ ৮ জন ঐ পরিবারের এবং বেশ কিছু ব্যক্তিকে ধরে ফেলে।ধৃত ব্যক্তিদের কে দুটো রশিতে বেধে রাজপথে চাবকাতে চাবকাতে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আসে।ক্যাম্পেও তাদের কে অকথ্য নির্যাতন করা হয়।তারপর রাত ১২ টার দিকে আরো কিছু বন্দী সহ মোট ১০৩ ব্যক্তিকে সুগার মিল ঘাটে নিয়ে গুল করে নদিতে ফেলে দেয়া হয়।

বরই তলায় কিশোরগঞ্জ জেলার সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডটি চালানো হয়েছিল ১৫ অক্টোবর ১৯৭১। দিনটা ছিল বুধবার। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৫ কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত ঐ গ্রামটীতে ট্রেনযোগে একদল পাকসেনা এসে পৌঁছায়। হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায়বরইতলা সহ আশেপাশের গ্রাম চিকনীরচর,দামপাড়া,কালিকাবাড়ি,কড়িয়াল,তিলকনাথপুর,গোবিন্দপুর,ভুরিরচর থেকে ৪০০-৫০০ জন লোক এনে জড়ো করে।উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচারণা।ঐ সময় কিছু পাকসেনা রাজাকারদের নিয়ে গ্রামের ভিতর ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষন পর একজন রাজাকার ছুটে এসে জানায় দুজন পাকসেনা নিখোঁজ হয়ে গেছে।খবরটা শুনে কোন প্রকার সত্যাতা যাচাই না করে হানাদার বাহিনী জড়ো করা লোকদের রেললাইনের দুপাশে সারি করে দাঁড় করায়। তারপর কেউকে বেয়নট দিইয়ে খুঁচিয়ে,আবার কাউকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে।

এ হত্যা যজ্ঞে ৩৬৫ জন নিরীহ গ্রামবাসী মৃত্যুবরণ করে।এ পর্যন্ত ১৫৪ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে।পরবর্তীতে বরইতলা গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে শহীদ নগর।

শুধু কিশোরগঞ্জ শহরই নয়,কিশোরগঞ্জ জেলার প্রতিটি থানায় ছিল পাকবাহিণীর অসংখ্য বধ্যভূমি। ভৈরবের মেঘনা ব্রীজের নিচ্ব যে কতশত লোককে হত্যা করা হয়েছে,তার হিসাব আর কোন দিনই পাওয়া পাওয়া যাবেনা। এছাড়া বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে যে হত্যাকান্ড চালানো হয়েছে তার বর্নণা এ ক্ষুদ্রপরিসরে দেয়া সম্ভব নয়। কিশোরগঞ্জে বরইতলা গ্রামে রেললাইনে দাঁরো করিয়ে ৩৬৫ জন ব্যক্তিকে একই সময়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে সেই ঘটনাই তো একটা ইতিহাস।যে ঘটনা মাইলাই হত্যাযজ্ঞকেও ম্লান করেও দেয়।

লিখেছেনঃ মুহম্মদ বাকের