ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের শাটল হ্যাঙারের বাইরে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলো এই দুই বুড়ো। দুই স্পেস শাটলের মুখোমুখি হবার ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। তবে, কি তাদের নিয়তি নির্ধারিত ছিলো? ভেইকেল অ্যাসেমব্লি বিল্ডিং-এ ঢোকার আগে এন্ডেভার এবং হ্যাঙারে ঢোকার পূর্বে ডিসকভারি মুখোমুখি দেখা হবার এ দৃশ্যটি নাসার কর্মকর্তাদেরও আবেগ ছুঁয়ে গেছে।

ঠিক যেনো অবসরে যাওয়া দুই হেভিওয়েট বক্সার মিলে স্মৃতিচারণ করছে এমন দৃশ্য নাসার কর্মকর্তাদেরও আর কখনও দেখার সুযোগ মিলবে না বলেই সবাই সারি বেধে এ দৃশ্য দেখার জন্য দাঁড়িয়ে গেছেন।

(ছবি: ডিসকভারি এবং এন্ডেভার মুখোমুখি কিছুক্ষণ)

ডিসকভারি আর এন্ডেভারের জন্য আলাদা আলাদা থাকার স্থান নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ডিসকভারির স্থান হবে ভার্জিনিয়ার স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউট-এর হ্যাঙারে আর এন্ডেভার লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া সায়েন্স সেন্টারে।

এদিকে, আরেক মহাকাশযান আটলান্টিসও সম্প্রতি তার শেষ যাত্রা সম্পন্ন করেছে। আটলান্টিস কিছুদিন এখনো কেনেডি স্পেস সেন্টারে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হবে। আটলন্টিসের শেষবারের ভ্রমণের মাধ্যমেই  মহাকাশ যাত্রার শাটল যুগ শেষ হলো

(ছবি: নাসার কর্মকর্তারা শাটলের সামনে দাঁড়িয়ে। আটলান্টিস কেনেডি স্পেস সেন্টারে চলে যাচ্ছে প্রদর্শনীর জন্য। তা দাঁড়িয়ে দেখছে ডিসকভারি। আটলান্টিস এখানেই থেকে যাবে, আর ডিসকভারি এখনি চলে যাচ্ছে অবসরে)

পেছনে ফিরে দেখা:


অ্যাটলান্টিস’এর অন্তিম যাত্রা

দুর্ঘটনা:
নাসার গবেষকরা এক বছরে ৫০ বার শাটল ফ্লাইটের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু কখনোই বছরে ৯ বারের বেশি মহাকাশ যাত্রার জোগাড়-যন্তর করতে পারেনি। খরচ আর দুটি মারাত্মক শাটল দুর্ঘটনা তাদের সে পরিকল্পনায় বাধ সেধেছে। ১৯৮৬ সালে ধ্বংস হয় চ্যালেঞ্জার এবং ২০০৩ সালে আরেকটি দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয় কলাম্বিয়া। এ দুর্ঘটনা দুটিতে ১৪ জন নভোচারী প্রাণ হারিয়েছিলেন।

(ছবি: বিদায় বন্ধু! আর দেখা হবে না। যার যার পথে চলেছে ডিসকভারি এন্ডেভার)

 

সমাপ্তিতে আটলান্টিস কেনেডি স্পেস সেন্টারের মাটি স্পর্শ করছে)

 


তিন দশকের মার্কিন মহাকাশ ফেরি কর্মসূচি শেষ হতে চলেছে৷ অ্যাটলান্টিস সেই কর্মসূচির শেষ স্পেস শাটল৷

 

৩০ বছর ধরে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার খরচের এসব বুড়োদের বিদায়ের পর নতুন শাটলযুগের শুরু হয়েছে যাকে বলা হচ্ছে প্রাইভেট যুগ। ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র তৈরি করার কাজ শেষ হয়েছে৷ কাজেই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মাল পাঠানোর দায়িত্ব নেবে এবার নাসা’র পরিবর্তে স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস এবং অর্বিটাল সায়েন্সেস কর্পোরেশন, এই দু’টি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি৷ ২০১২ সালের পর থেকেই মহাকাশে তাদের বাণিজ্যিক ফ্লাইট শুরু হবে। যদিও এক্ষেত্রেও বোয়িং ও অপরাপর মার্কিন কোম্পানি একটি স্পেস ট্যাক্সি তৈরির কাজে সরকারি বিনিয়োগ পাচ্ছে৷ এবং সে ট্যাক্সিও ২০১৫ সালের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা৷

শাটলের বিকল্প
কিন্তু শাটল বন্ধ করে দেয়ায় নভোচারীরা এখন কীভাবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র বা আইএসএস’এ যাবেন, এই প্রশ্ন সবার৷ নাসা বলছে, এক্ষেত্রে আপাতত রাশিয়ার সাহায্য নেয়া হবে৷ তাদের ‘সয়ুজ’ নামক মহাকাশযানটি ব্যবহার করা হবে৷ এভাবে চলতে হবে তিন বা চার বছর৷ নাসা’র আশা, এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাত নতুন মহাকাশযান তৈরি করে ফেলবে৷ সেজন্য কাজও চলছে৷ নাসা এসব যান তৈরিতে চারটি কোম্পানিকে আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে৷

সয়ুজ
শাটল যুগের অবসানের পর আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে যাতায়াত করার জন্য রাশিয়ার সয়ুজ মহাকাশযানের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বাকি দেশগুলির মহাকাশচারীদের নির্ভরতা অনেক বেড়ে যাবে৷ ঐ যান আকারে অনেক ছোট৷ মাত্র ৩ জন মহাকাশচারী বহন করতে পারে সয়ুজ৷ বেশি মালপত্র নেওয়ারও উপায় নেই এই যানে৷ তা সত্ত্বেও বহু বছর ধরে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বাহন হিসেবে কাজ করে চলেছে রাশিয়ার সয়ুজ৷ সয়ুজ’ই নির্ভরযোগ্য বাহন হিসেবে থেকে গেছে।

এমপিসিভি
অবশ্য এর ফলে যে অর্থ বেঁচে যাচ্ছে তার থেকে একটা অংশ ব্যয় করা হচ্ছে এমন এক মহাকাশযান তৈরির কাজে, যেটি মানুষকে চাঁদ বা মঙ্গলগ্রহে নিয়ে যাবে৷ এর নাম দেয়া হয়েছে ‘এমপিসিভি’, যার পুরোটা করলে দাঁড়ায় ‘মাল্টি-পারপাস ক্রু ভেইকল’৷ নাসা আশা করছে, এই যানে করে ২০৩০ সাল নাগাদ মঙ্গল গ্রহে যাওয়া যাবে৷ এক সঙ্গে মোট চারজন যাতায়াত করতে পারবেন এই যানে৷

সবার আগে ড্রাগন
সবার আগে যে মহাকাশযানটি তৈরি হতে পারে তার নাম ‘ড্রাগন’৷ স্পেসএক্স নামের একটি কোম্পানি এটি তৈরি করছে৷ গত বছর কোম্পানিটি বেসরকারি খাতের প্রথম কোম্পানি হিসেবে অর্বিটে মনুষ্যবিহীন একটি মহাকাশযান পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল৷ এবং এ বছর তারা আইএসএস’এ কার্গো মিশন শুরুর পরিকল্পনা করছে৷ স্পেসএক্স আশা করছে তাদের মহাকাশযান ড্রাগন ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করতে পারবে৷ একসঙ্গে মোট সাতজন নভোচারী বহন করতে পারবে ড্রাগন৷ এখন পর্যন্ত যে পরিকল্পনা তাতে ড্রাগন ল্যান্ড করবে বা নামবে সাগরের পানিতে৷ তবে স্পেসএক্স বলছে, ভবিষ্যতে ড্রাগন যেন মাটিতে নামতে পারে সে চেষ্টা তারা করছে৷ ড্রাগন তৈরিতে সহায়তা হিসেবে নাসা ইতিমধ্যে স্পেসএক্সকে প্রায় ৭৫ মিলিয়ন ডলার অর্থ দিয়েছে৷

সিএসটি – ১০০
বোয়িং তৈরি করছে স্পেসক্রাফট ‘সিএসটি-১০০’৷ ২০১৫ সালে মধ্যে এটি মহাকাশ ভ্রমণে যাবে। এটি সাতজন নভোচারী বহন করতে পারবে৷ বোয়িং বলছে, মূলত আইএসএস’এ নভোচারী পাঠানোই এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলেও ‘স্পেস ট্যুরিজম’, অর্থাৎ, মহকাশে পর্যটক পরিবহনেও কাজে লাগানো হতে পারে সিএসটি-১০০ কে৷ এই যান তৈরিতে নাসা এখন পর্যন্ত প্রায় ১১০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে৷ জানা গেছে, প্যারাসুটের সাহায্যে মাটিতে নামবে সিএসটি-১০০৷

ব্লু অরিজিন
নাসার সাহায্য নিয়ে মহাকাশযান তৈরি করছে এমন আরেকটি কোম্পানি ‘ব্লু অরিজিন’৷ তারা যে যান তৈরি করছে তার নামও একই ৷ ব্লু অরিজিনে যাতায়াত করতে পারবেন সাতজন নভোচারী৷ নাসার কাছ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৬ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়েছে ব্লু অরিজিন কোম্পানি৷

ওরিয়ন
স্পেস শাটল’এর বিকল্প হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে ওরিয়ন নামের এক মহাকাশযানকে৷ প্রচলিত অর্থে ঠিক মহাকাশফেরি বলা যাবে না এই যানকে৷ কারণ রকেটের মাধ্যমেই উৎক্ষেপণ করা হবে ওরিয়ন’কে৷ রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমাতে ওরিয়ন’কে প্রস্তুত করে তোলার কাজ চলছে৷ মহাকাশচারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা যাতে হুমকির মুখে না পড়ে, সেই বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে৷ ইতিমধ্যেই ওরিয়নকে ঘিরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে৷ যেমন মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নিউ মেক্সিকো মরুভূমির এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা হয়েছে, জরুরি বা আপৎকালীন অবস্থায় মহাকাশযানের আরোহীদের কীভাবে নিরাপদে উদ্ধার করা যায়।

মূলঃবিডিনিউজ24.com