জেলার ইটনা-মিঠামইনের হাওরাঞ্চলে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর আগাম বন্যার করাল গ্রাসে এ এলাকার মানুষের মুখের হাসি হারিয়ে গেছে। হাওর ও জলাভূমিগুলোর বিপন্নপ্রায় পরিবেশের উন্নয়নে দীর্ঘদিনেও কোন ধরনের পদক্ষেপ গৃহীত না হওয়ায় প্রায় প্রতিবছর আগাম বন্যার কারণে কৃষক সোনালী ধান ঘরে তুলছে পারছেনা। আগাম বন্যা আর প্রাক-মৌসুমী ঢলে এলাকাবাসীর জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ইরি-বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় জমির ফসল হারিয়ে হাওরের কৃষক এখন সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে। হাওরপাড়ের মানুষরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। অকাল বন্যা, মৌসুমী বেকারত্ব এবং দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে তাই হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনধারা বদলে যাচ্ছে।

ব্যাংক ঋণ ও মহাজনী ঋণের ভারে জর্জরিত হাওরের অনেক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক মহাজনের চড়া সূদের টাকায় জমি চাষ করেছিলেন। জমিতে সেচ, সার, কীটনাশক দেওয়াসহ নানা উৎপাদন ব্যয় মিটিয়ে সোনালী ফসল ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন তারা। কিন্তু বাঁধ ভাঙ্গা পানিতে চোখের সামনেই নিমিষে তলিয়ে যাওয়া সবুজ ধানের সাথে তলিয়ে গেছে তাদেরও সেই স্বপ্ন। তাই সন্তানহারা বাবা-মায়ের মতোই আহাজারি করছেন নিঃস্ব কৃষাণ-কৃষাণী।

ইটনা এবং মিঠামইন উপজেলায় প্রায় ৭ লক্ষাধিক লোকের বাস। মোট জনসংখ্যার আশিভাগ লোকই একাধারে কৃষি এবং মৎস্যজীবি। মাছ ধরাটা পূর্বে একটি সমপ্রদায়ভূক্ত পেশা থাকলেও ফি বছরের আগাম বন্যা, খরা, প্রকৃতি এবং সরকারের চরম উদাসীনতায় এলাকার সাধারণ কৃষকও বর্ষায় জীবন ধারণের জন্য মাছ ধরা পেশায় যুক্ত হয়। ঘোলা মাছের খনি হিসেবে পরিচিত এখানকার হাওর ও জলাভূমিগুলোর অবস্থা এখন দিনকে দিন খারাপ পর্যায়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এখানে কোন মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র এখনো গড়ে ওঠেনি। ভাসমান পানিতে অবাধে মাছ ধরার অধিকার বঞ্চিত মানুষগুলো মাছের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তী থেকেও বঞ্চিত হন। তাই এ পেশায়ও মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে।

এ এলাকার চাষযোগ্য যে পরিমাণ জমি রয়েছে, তাকে পরিকল্পনা মাফিক কাজে লাগাতে পারলে হাওরাঞ্চলের চেনা দৃশ্যপটটা এতো সহজে বদলে যেতনা। উপজেলা দু’টিকে হবিগঞ্জ জেলা থেকে পৃথক করা সুরমার শাখা নদী মৃতপ্রায় কালনী’র অগভীরতার সুযোগ নিয়ে কালনীর পাড় ডুবে অথবা কালনী’র তীরঘেঁষা বাঁধ ভেঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা পানি হাওরে ঢোকে। ফাল্গুণ-চৈত্র কিংবা বৈশাখের প্রথমে এ আগাম বন্যায় মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তলিয়ে যায় হাওরের পর হাওরের পাঁকা-আধা পাঁকা ধানী জমি। যে কৃষক প্রায় সোনালী হয়ে আসা ধানী জমির আ’লে বসে নির্ভাবনার স্বপ্ন বুনত, সে কৃষক আজ গামছার খুঁটে চোখের পানি মোছে।

একটি সাক্ষাতকারঃ

ইটনা ও মিঠামইন উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে মানুষের অসহায়ত্ব আর দুর্দশার চিত্রই কেবল মিলছে। চারদিকে থৈ থৈ করা বর্ষায় মানুষ এখনো স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করতে পারছেনা। টানা বর্ষণের পর আফালে হাওরের গ্রামগুলোতে যে ভাঙন শুরু হয়েছে সে ভাঙন মোকাবেলার প্রস্তুতি ও সক্ষমতা হাওরের মানুষ গত চৈত্রের অকাল বন্যার সময়েই হারিয়ে ফেলেছে। আফালে ভাঙন কবলিত হাওরের গ্রামগুলোতে মানুষের অস্ফুট গোঙানি আর নিরব হাহাকারে থমকে আছে বাতাস। বর্ষায় প্রকৃতির এ অটো-ভেকেশনে তাই মানুষজন কাজের খোঁজে ছুঁটছে ঢাকা শহরের নূরের চালা, কচুক্ষেত, ধামালকোট, ইব্রাহীমপুরের বস্তি কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, সিলেটের ভোলাগঞ্জশহ দেশের নানা প্রান্তে। বছরের ৬ মাস কর্মহীন থাকা এ মানুষগুলোর কেউ কেউ হাওরে নিজ গ্রামে হয়তো ফিরবে আবার অনেকেই ফিরবেনা। সমপ্রতি এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত ২০ বছরে এভাবে হাওরের নিজগ্রাম ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গার বাসিন্দা হয়েছেন প্রায় ২ লক্ষ হাওরের মানুষ।

অথচ এ এলাকার সম্পদ এবং সম্ভাবনাকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে পারলে এটি দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসাবে খুব সহজেই নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে পারতো বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। অবহেলিত এ হাওর জনপদের জন্য সরকারের কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় প্রায় প্রতিবছর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিনষ্ট হয় বোরা ধান। কৃষকদের পুনর্বাসনসহ তাদের ফসল যেন স্থায়ীভাবে রক্ষা পায় সেজন্য নদী খনন, বাঁধ-ভেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং আগামী বছর বোরো আবাদ যেন সরকারি সহায়তায় করতে পারেন- এ দাবি হাওরবাসীর।

লিখেছেনঃ আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ
+ ৮৮-০১৭১৪-৩৫৪৯৫০