ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা উপমহাদেশের প্রথম র‍্যাংলার ব্যরিস্টার আনন্দমোহন বসুর মতো জ্ঞানতাপসের জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামে হলেও ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ইটনা, মিঠামইনের হাওরাঞ্চলে কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বসু পরিবারের হেমেন্দ্র মোহন বসু, মোহিনী মোহন বসু, দেবেন্দ্র মোহন বসু প্রমূখ কোলকাতায় শিক্ষা লাভ করে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। এছাড়া ইটনার উর্বর মাটিতে জন্ম নেওয়া অমলহোম রায় এবং ডঃ নীহার রঞ্জন রায় যথাক্রমে ‘আলোকিত বাঙ্গালি’ এবং ‘পদ্মাভূষণ’ খেতাব অর্জন করেছেন।

 বিত্তশালী কিছু মানুষ এবং জমিদার নন্দন ছাড়া ভাটি এলাকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অজ্ঞানতার অন্ধকারেই নিমজ্জিত ছিল। উপেক্ষিত এইসব মানুষদের জন্য ইটনারই আরেক কৃতি সন্তান ব্যারিষ্টার ভূপেশ চন্দ্র গুপ্ত ১৯৪৩ সনে নিজ আবাস ভূমে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাঁর স্বর্গীয় পিতার নামে নামকরণ করলেন, ‘ইটনা মহেশচন্দ্র শিক্ষা নিকেতন’। এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গোটা ইটনা, মিঠামইনের হাওরের মানুষের মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়।

জানা যায় অনেক পূর্বেই ভূপেশ গুপ্তের পিতা মহেশচন্দ্র গুপ্ত ইটনায় একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার মনোবাসনা প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু তখনও তিনি দেওয়ানদের সেরস্তায় নায়েবের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকায় মনিবের সম্মতি ব্যতিত কিছু করা সম্ভাব ছিলনা। সামন্ত জমিদার অধ্যষিত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মত শিক্ষার মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টির প্রতিবন্ধকতা এখানেও বিদ্যমান ছিল। মহেশচন্দ্র গুপ্তের ঐকান্তিক চেষ্টায় অবশেষে ১৯০৪ সনে স্থাপিত হয় একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র। এই চিকিৎসা কেন্দ্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য দেওয়ানদের প্রদত্ত অনুদান ছিল মাসিক ২৫টাকা, পক্ষান্তরে মহেশগুপ্তদের অনুদান ছিল মাসিক ৩৬ টাকা।

 অবস্থাদৃষ্টেই প্রমাণ হয় যে, গুপ্তপরিবারের তখন রমরমা অবস্থা, আর দেওয়ানদের জমিদারীতে লেগেছে ভাটা। সেই ভাটার টানে ভেসে গেছে কাঞ্চন, কিন্তু কৌলিন্যটুকু মজবুত করে ধরে রেখেছিলেন। এ সময় মহেশ গুপ্তের হাতী কেনার বাসনা জাগে, কিন্তু এখানেও দেখা দেয় কৌলিন্যের প্রশ্ন। মনিবের হাতী নেই, নায়েব কি করে হাতী চড়বেন! শেষপর্যন্ত তিনি একটি হাতী কিনে দেওয়ান সাহেবকে উপহার দিয়ে অতঃপর নিজের জন্য হাতী কিনলেন। মহেশগুপ্ত এরূপ কৌশল তিনি খুঁজে বের করতে পারেননি বলে জীবদ্দশায় তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। বিংশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি সময় সর্বশেষ দেওয়ানের মুতউল্লী সাহেব যখন পূর্ববঙ্গ জমিদার এসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসাবে জমিদারদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে ব্যস্ত, সেই সময় মহেশচন্দ্র গুপ্তের সুযোগ্য পুত্র ব্যারিষ্টার ভূপেশচন্দ্র গুপ্ত পিতার লালিত বাসনাকে বাস্তবায়িত করলেন। সূচীত হল ইটনা মহেশচন্দ্র শিক্ষা নিকেতনের সূর্বণ ইতিহাস।

স্কুল প্রতিষ্ঠার পর ভূপেশচন্দ্র গুপ্ত এর সকল দায়দায়িত্ব স্বীয় ভ্রাতা নরেশচন্দ্র গুপ্তের হাতে অর্পন করেন। প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন শিলুন্দিয়ার শ্রী ধীরেন্দ্র চৌধুরী। অতঃপর ভূপেশগুপ্ত তাঁর বৃহত্তর কর্মক্ষেত্র কোলকাতা প্রত্যাবর্তন করেন। দেশবিভাগের পর তিনি ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ফলে তাঁর সম্পর্কে ইটনাবাসীর আর কিছু জানার তেমন সুযোগ ঘটেনি। সীমিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে যেটুকু জানাগেছে তাতে দেখা যায় তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা হিসাবে ভারতের কেরালা রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৫২ সন থেকে একটানা ২২ বৎসর রজ্যসভার সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি শুধু রাজনীতিবিদ অথবা আইনজীবীই ছিলেন না তিনি ছিলেন একাধারে দক্ষ পার্লামেন্টারীয়ান, সুলেখক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী এবং একজন স্থপতি। ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র দৈনিক স্বাধীনতার তিনি সম্পাদক মল্ডলীয় সভাপতি ছিলেন। ইংরেজী এবং বাংলায় রচিত তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রহ গুলোর মধ্যে ‘ফ্রীডম এন্ড দি সেকেন্ড ফ্রন্ট’ টেরার অফ বেঙ্গলে ‘ফাইভ ইয়ারস্ প্লান; এ ক্রিটিক বি-গ-লুট অন্যতম।

ভূপেশচন্দ্রগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত ইটনা মহেশচন্দ্র শিক্ষা নিকেতনের মাধ্যমে ভাটি এলাকার মানুষের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষার যে দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, হাওর এলাকার প্রধান এবং প্রাচীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে শিক্ষাবিস্তারে  প্রতিষ্ঠানটি আজো সমান অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে।

আশরাফুল ইসলাম