৩১শে মে, ১৯৯৯…দিনটি অবিস্মরণীয় বাংলাদেশের জন্য। বিশবকাপে বাংলাদেশের খেলা হচ্ছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ করেছিল ২২৩/৯ (৫০ ওভার)। ৪৪ ওভারে পাকিস্তানের অবস্থা ১৬১/৯। আমি তখন জাম্বিয়ায়। টানটান হয়ে বসে আছি টেলিভিশনের সামনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে। আমাদের জয়টা এই সময়ে প্রায় অবধারিত ছিল। তারপরও ক্রিকেট বলে কথা! এর মধ্যে লুসাকার সব বাংলাদেশীর মধ্যে ফোনাফুনি হয়ে গেছে, যদি বাংলাদেশ জিতে যায় তাহলে সবাই এক হয়ে যাবো কোনও এক রেস্তরাঁয়। ব্যাটিং ক্রিজে ছিল শোয়েব আখতার, বল হাতে ছিল নাইমুর রহমান দুর্জয়। দুই বল হয়ে গেছে। তৃতীয় বল হলো, শোয়েব অফ-এ ড্রাইভ করেই রান নিতে ছুটলো।

bD_cricket

ব্যস্‌, ফিল্ডার কে ছিল মনে নেই…তড়িৎ গতিতে বল তুলেই ছুড়ে দিল সোজা খালিদ মাহমুদ সুজনের হাতে। সুজন তার চেয়েও দ্রুত স্ট্যাম্প ভেঙ্গে দিল। ওদিক থেকে সাকলাইন ক্রিজ ছুঁতে ব্যর্থ হলো। এই সময় অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারনা হলো। গ্যালারী থেকে সব বাংলাদেশী দর্শক বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত মাঠে ঢুকে পড়লো। যদিও আম্পায়ার তার আঙ্গুল তুলেনি, তিনি পর্দায় দেখানোর জন্য সংকেত দিলেন। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত তৃতীয় আম্পায়ারের উপর ছেড়ে দিলেন। কিন্তু এটা যে আউট তা দর্শকদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। আমাদের খেলোয়ারদের শারীরিক ভাষাও তাঁরা ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছে। আর তাই এই বাধ-ভাঙ্গা জোয়ার! একটু পরই পর্দায় ঠিকই ভেসে উঠলো ‘আউট’। লাফিয়ে উঠলাম। আইসিসি’র পূর্ণাঙ্গ কোন সদস্যের বিরুদ্ধে প্রথম জয় সেও আবার পাকিস্তান! পাকিস্তান বধ দিয়ে আমাদের বিজয়ের যাত্রা শুরু। আবার ফোনাফুনি করে আধা ঘণ্টার মধ্যে লুসাকার সব বাংলাদেশী Longacres-এ L. A. Ranch Restaurant-এ জড়ো হয়ে যাই। তখন রাত সাড়ে আটটার মত হবে। ওদের আগেই ফোন করে বলে দেয়া হয়েছিল প্রায় একশ জনের ব্যবস্থা রাখতে। আমি আমার camcorder নিয়ে হাজির হলাম (আজও আমার কাছে সেদিনের দৃশ্যগুলো সযত্নে রক্ষিত আছে)। আমি যেয়ে খোঁজ করলাম বাংলাদেশের একটা পতাকার ব্যবস্থা করা যায় কি না।

সৌভাগ্যবশতঃ ঐ রেস্তরাঁর টেবিলম্যাট আর ন্যাপকিন ছিল সবুজ আর লাল। আমি ম্যাটের উপর লাল ন্যাপকিন পিন দিয়ে আটকিয়ে রেস্তরাঁর প্রবেশ পথে ঝুলিয়ে দিলাম। যদিও মাঝের লাল সূর্যটা চারকোণা হয়ে গেল এবং এটা একটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু সেদিন সবাই এটাকে মেনে নিয়েছিল। আফ্রিকান ম্যানেজার-ওয়েটাররা আমাদের কান্ড-কারখানা দেখে তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইলো। একেতো জাম্বিয়ায় ক্রিকেট খেলা হয় না, তার উপর জিতলেও এমনটি হতে পারে ওরা ভাবতে পারেনি। পুরো রেস্তরাঁ সেদিন আমাদের উল্লাসে মুখর ছিল। বিদেশে বাংলাদেশীরা বসবাস করে একটা বিভাজনের ভেতর। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সেদিন সব বিভাজন ভুলে সবাই এক হয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের এমন এক ধ্রুপদী জয়ে।

আজ বিশ্বকাপে টাইগারদের ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠায় সারা দেশে যে আনন্দ বয়ে যাচ্ছে তা দেখে পনেরো বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল। তখন বাংদেশের অবস্থা দেখতে পারিনি কিন্তু টেলিভিশনের খবরে দেখেছিলাম। সেই ছোঁয়া আজ বাংলাদেশে বসে পেলাম। পুরো বাংলাদেশ যেন এক হয়ে গেছে আজ। কিন্তু এই একাত্মবোধ কি থাকবে আমাদের মাঝে চিরকাল! মৌলিক বিষয়গুলোতে আমরা তো প্রায় মোটা দাগে বিভাজিত। এই বিভাজন যতদিন থাকবে ততদিন আমরা আমাদের সাফল্যের তরী তীরে ভিড়াতে পারব কিনা সন্দেহ। আর এই বিভাজনের কারনেই হয়তো যা কিছু অর্জন হবে সবই কেবল ক্ষনিনের জন্য, শুধুই বর্তমানের… আগামীকালের জন্য থাকবে না কিছুই। এমন বিভাজনে কখনও সেই প্রতিশ্রুতি তৈরি হতে পারে না, কোন উদ্দীপনা নিরন্তর ধারন করা যেতে পারে না যা আমাদের পূর্ণ সম্ভ্রম এনে দেবে। আর তাই সম্ভবতঃ আমরা সাফল্য পেয়েও ধরে রাখতে পারি না।

আর তাই বুঝি রমিজ রাজা-রা আজেবাজে মন্তব্য করতে পারে, নাসির জামশেদের মত অখ্যাত পাকিস্তানী ক্রিকেটারও টিজ মেরে টুইট করার সাহস পায়…যারা আজও আমাদের কাছে সবদিক থেকে লজ্জাবনত। যাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কোন দিনও বন্ধ হবে না।

এতো মৃত্যু, দগ্ধ মানুষের এতো হাহাকার আমাদের একটুও মানবিক করে তুলতে পারে না! এক কাতারে সবাই দাঁড়িয়ে বলতে পারে না…এমন আঁধার ঘেরা অচলায়তন চাই না। অথচ একটি মাত্র জয়, তাও সেই হাজার মাইল দূরে ছোট্ট এক খেলার মাঠে, আমাদের পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের সবাইকে কেমন এক কাতারে নামিয়ে নিয়ে এলো! একই আনন্দে লক্ষ প্রাণ দোলে, দোদুল দোলে দোলনায়! এরকম এর আগেও অনেকবার হয়েছে এই ক্রিকেট শিল্পকে নিয়েই। কিন্তু আবার আমরা ফিরে গেছি সেই বিভক্তির অবস্থানে। আর তাই সম্ভবতঃ বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে, হারিয়ে গেছে আমাদের অর্জনগুলো। আমি ভাবি এই রকম বিজয় যদি আমাদের এক কাতারে নামিয়ে আনতে পারে, সকল জরা ভুলিয়ে দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ যদি কোনভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেতে পারে তাহলে কি আমরা চিরদিনের জন্য সব ভুলে এক হয়ে যাবো? সব ভেদাভেদ ভুলে যাবো! যদি তাই হয় তাহলে আমার দু’হাত সৃষ্টিকর্তার কাছে উত্থিত রইলো…ওদেরকে শক্তি দাও, এমন একটা বিজয় যেন ওরা ছিনিয়ে আনতে পারে যা আমাদের গ্লানিমুক্ত করবে; আলোর দুয়ার খুলে দেবে। আমরা আমাদের সম্ভ্রম, আমাদের গৌরব ফিরে পাবো।  সেই মহেন্দ্রক্ষনের অপেক্ষায় রইলাম।