গত ২১ মে মস্কোতে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক সহযোগিতাবিষয়ক কাঠামো চুক্তির আওতায় রূপপুরে প্রস্তাবিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সহযোগিতার ব্যাপারে আলোচনা হয়। বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় প্রস্তাবিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ সফর ছিল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (বিএইসি) সূত্রে জানা যায় ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দলে বিএইসির চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেন, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শওকত আকবর এবং শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, আইন, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা ছিলেন।

জানা গেছে, রাশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কো-অপারেশনের (রোসাটোম) মহাপরিচালক সার্গেই কিরিয়েনকো বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের এ সফর নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রুশ প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলকে রাশিয়ার বেশ কয়েকটি পারমাণবিক কেন্দ্রে নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা দেখানোর বিষয়ে আলোচনা হয়।

পারমাণবিক শক্তি কমিশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, পাবনায় দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। রাশিয়ার সহযোগিতায় ২০১৭ সাল নাগাদ রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এই কাঠামো চুক্তির ভিত্তিতে চূড়ান্ত পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

জানা যায়, প্রস্তাবিত রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা) ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ খরচের সিংহভাগ অভ্যন্তরীণ তহবিল থেকে দেওয়া হবে এবং বাকি খরচ আসবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অথবা সহজ ঋণ হিসেবে আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছ থেকে।

উল্লেখ্য, রাশিয়ার সঙ্গে স্বাক্ষরিত কাঠামো চুক্তিতে নকশা, পারমাণবিক বিদ্যুৎ ও গবেষণা চুল্লী নির্মাণ এবং পরিচালনা, পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহ, ব্যয়িত পারমাণবিক জ্বালানি ও বর্জ্য ফিরিয়ে নেওয়া, কেন্দ্র পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য জনবল প্রশিক্ষণ এবং সক্ষমতা সৃষ্টি, পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রুশ ফেডারেশনের গবেষণা, জনবল প্রশিক্ষণ, উদ্ভাবনীমূলক চুল্লী প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম অনুসন্ধানের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।

চুক্তিতে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে চুক্তিতে পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যৌথ কর্মসূচি বাস্তবায়নে উভয়পক্ষে দ্রব্যসামগ্রী, প্রযুক্তি, সরঞ্জাম ও সার্ভিসেস হস্তান্তরের আশ্বাস থাকবে। এ ছাড়া চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ন্ত্রণ করতে দুই দেশের একটি যৌথ কো-অর্ডিনেশন কমিটি প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে।

সচরাচর এসব স্থাপনার ছবি তোলা নিষিদ্ধ হলেও একজন রাশিয়ান ব্লগার বিশেষ অনুমতি নিয়ে কিছু কিছু ছবি তোলেন। চলুন দেখা যাক, বিশ্বের বৃহৎ এই স্থাপনার ভেতরে কী আছে:

 

রাশিয়ার স্মলেন্সক সিটিতে অবস্থিত সে দেশের বৃহৎ পারমানবিক পাওয়ার প্লান্ট। ১৯৮২ সালে ৪টি রিএ্যাক্টর স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হলেও চেরনোবিল দুর্ঘনার কারণে ৩টি স্থাপনের পর কাজ তখন স্থগিত করা হয়।

রাশিয়ার অন্যতম ১০টি পারমানবিক পাওয়ার প্লান্টের একটি যা সবচেয়ে বড়। এখান থেকে চাহিদার ১/৭ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

রাশিয়ার চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর থেকে পারমানবিক প্রকৌশল এখন অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করে যেগুলো অচিন্তনীয় পর্যায়ের বা আদৌ ঘটবার সম্ভাবনা নেই।

পাওয়ার প্লান্টের বাইরের স্ট্রাকচার যা আনবিক বোমার ১০ গুণ শক্তিশালী বোমার আঘাতেও ধ্বংস হবে না।

চতুর্দিকে ৩০ মাইলব্যাপী এলাকা হচ্ছে সিকিউরিটি জোন যা সম্ভাব্য সকল ধরনের নিরাপত্তা সেন্সর ও মনিটরিং ডিভাইস দ্বারা সজ্জিত। এগুলো পরিবেশ-প্রতিবেশ এর সব ধরনের পরিমাপ সংরক্ষণ ও রিপোর্ট করে। প্লান্টের পাশ্বর্বতী স্থানে অত্যন্ত পরিস্কার পানিতে পুর্ণ রাখা হয় প্রয়োজনীয় আকৃতির পুকুর যেখানে নানা প্রজাতির মাছচাষের মাধ্যমে তাদের লাইফ-সাইকেল পর্যবেক্ষণ করা হয়।

স্টেশনে প্রবেশকালে কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহন জরুরী।

 

প্রত্যেকের জন্য ইউনিফর্ম পরা বাধ্যতামূলক।

 

ব্যক্তিগত রেডিয়েশন চেকার।

টারবাইন বা বিদ্যুৎ তৈরির জেনারেটর।

প্রধান রিএ্যাক্টর-হল। কংক্রিটের তৈরি গর্তে স্থাপিত রিএ্যাক্টর।

ইউরেনিয়াম২৫৫ পারমানবিক রিএ্যাক্টরে ব্যবহৃত জ্বালানী। সবুজ রঙের টিউবে এই জ্বালানী ভরা হয়।

ছবিতে একটি নীল আলোর আভা দেখা যাচ্ছে যেটি রয়েছে ৮ ফুট গভীরে, এটা ঘটছে ‘সেরেংকোভ এফেক্টে’র কারণে। যখন কোনো বিদ্যুৎ সঞ্চারিত ইলেক্ট্রন কণা ইনসুলেটরের ভেতরে দিয়ে আলোর গতির চেয়েও বেশি গতিতে প্রবাহিত হয় তখন এই নীল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন উৎপন্ন হয়। রাশিয়ান নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী Cherenkov-এর নামানুসারে এর নামরকণ করা হয়।

মেইন কন্ট্রোল পয়েন্ট।

এই হচ্ছে তাই। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিতব্য পারমানবিক শক্তিকেন্দ্রের ভেতর-বাহিরও এরকমই কিছু একটা হবে বলে আশা করা যায়। অতএব, আমাদের প্রস্তুতি নেবার এখনই সময়। এই প্রস্তুতি নেবে নতুন প্রজন্মের বুদ্ধিমানরা। আর এটা হলে তা হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের এক নবযুগের সূচনা।

লিখেছেনঃ মতিউর রহমান