অদিতি ফাল্গুনি:  বাঙালির এই সরকার যখন ছিল না, পাকিস্তান যখন ছিল না, হামরা তখন থেকে এই চান্দপুর আর বেগমখান চা বাগানের লেবার আছি! উ ব্রিটিশের কালে হামাদের যখন এখানে আনা হয়, হামরাই ইখানের সব বন-জঙ্গল সাফ করে ধানি জমি আবাদ করেছি।  ইখন ই জমি থেকে উচ্ছেদ করলে যাব কুথায়?

বুধবার বিকেলে হবিগঞ্জের চান্দপুর চা বাগানের এক শ্রমিক পরিবারের বারান্দায় বসে এভাবেই আমাকে হতাশামিশ্রিত খেদোক্তি জানান স্বপন সান্তাল। তিনি ‘চান্দপুর বেগমখান ভূমিরক্ষা কমিটি’র যুগ্ম আহ্বায়ক। একই রকম উদ্বেগ ঝরে পড়ছিল ‘চান্দপুর বেগমখান ভূমিরক্ষা কমিটি’র আহ্বায়ক অভিরথ বাকতি, সহ-যুগ্ম আহ্বায়ক কাঞ্চন পাত্র, সদস্য সচিব শ্রীধনী মুন্সী, সহ-সদস্য সচিব সূর্য্য কুমার রায়, সহ-সদস্য সচিব লক্ষ্মীচারণ বাকতি এবং আরও অনেক চা শ্রমিক নেতাকর্মীর কণ্ঠ থেকে।
tea_labor

চা বাগানের শ্রমিকরা যেমন চা পান করেন, তেমন লবণমিশ্রিত এক কাপ গরম চা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তারা জানান, ইতিমধ্যেই সত্তরের কাছাকাছি বয়সের মন্টু কর্মকার এবং কৃষ্ণ বাকতি নামে আরেক প্রবীণ চা বাগান শ্রমিক আসন্ন উচ্ছেদের হতাশায় স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এদের ভেতর কৃষ্ণ বাকতির মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। গত দিন দশেকের ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচির এক পর্যায়ে ১৩ ডিসেম্বর থানা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের সামনে আন্দোলন কর্মসূচি সেরে আসার পথে স্ট্রোক করে হাসপাতালে নিলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

‘চা বাগানে ত নানা জাতের শ্রমিক আমরা। আসাম, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, উড়িষ্যা থেকে আমাদের বাপ-পরদাদারা এসেছে। বাকতি পদবিটা যারা উ আসাম থেকে এসেছে। কানুরা উত্তরপ্রদেশ থেকে। অনেকে বাঙালি হিন্দুদের পদবি লিয়েছে। যেমন ভূমিজরা এখন পদবি লেখে ভৌমিক। কর্মকার, মিত্র এসব পদবি লিয়েছে। পালই আছে তিন রকম। রুদ্রপাল, চন্দ্রপাল আর তেলিপাল। আছে ভোজপুরি, মাদ্রাজি। তা এ আন্দোলন ভূমিজ, রাজবংশী, বাকতি, পাল, সান্তাল_ সব জাতের চা শ্রমিকের জীবনের আন্দোলন!’ বললেন ‘চান্দপুর বেগমখান ভূমিরক্ষা কমিটি’র আহ্বায়ক অভিরথ বাকতি।

দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রপত্রিকায় এরই মধ্যে আমরা বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার চান্দপুর এবং বেগমখান নামে দুটি চা বাগানের ৫১১ একর কৃষিজমিতে সরকার কর্তৃক এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) গঠন এবং সে লক্ষ্যে জমি অধিগ্রহণের পদক্ষেপবিরোধী চা শ্রমিকদের আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখেছি। দেশের একাধিক বাম রাজনৈতিক দল, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং সচেতন সাংবাদিক, লেখকসহ অনেকেই চা শ্রমিকদের এ আন্দোলনের সঙ্গে ইতিমধ্যে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই সহমর্মিতা এবং সংহতি প্রকাশ করতে ছুটে যাচ্ছেন চান্দপুর চা বাগানে। তেমন এক তাগিদ থেকে এই প্রদায়ক গেছিলেন গত বুধবার।

‘দিখো, হামরা ত গরিব। এক এক ফ্যামিলি থেকে একজন কি বড় জোর দুইজন ফ্যাক্টরির লেবার হতে পারে। কতজনের কাজ মেলে না! যত পাতাই তোলো, তলপের মজুরি সেই ৬৯ টাকা। কলম চারা পাতায় ২১ কেজি আর ফুলি চারা পাতায় ১৭ কেজি তুললে একদিনে ৬৯ টাকা। ডিসেম্বর থেকে মার্চ ত অফ সিজন। তখন বাগানে পাতা খুব কম থাকে। হাজার মেহনত কর তবু পাতা মেলে না। এপ্রিল থেকে অক্টোবর সিজনে কি ওই বৃষ্টির দিনে অনেক চা পাতা হয়। তখন আয় বাড়ে। অফ সিজনে কাম নেই। বাগানে পাতা নেই। আয় কমে যায়। তাই এই যে ধানি জমিটা বাগানের লেবার বলে আমাদের থাকে, সেখানে চাষ করে শীতের দিনে রবিশস্যটা কি তিন ফসলি ধান ফলায় যি টাকা মেলে সিখান থেকে আমরা ছেলেমেয়েদের পড়াই। আজ আমাদের ঘরে কিছু ছেলেমেয়ে এসএসসি পাস দিচ্ছে। কিছু এইচএসসি পাস দিচ্ছে। কেউ কেউ ভার্সিটিতে পড়ছে। ইখন ই ধানি জমি বেহাত হলে সংসারের টানাটানি কাটায়ে উদের পড়াবো কী করে?’ বললেন জ্যোতি বাকতি, নমিতা বাকতি, অলকা বাকতি, কনকলতা রাজবংশীর মতো কিছু নারী শ্রমিক।

মিইয়ে আসা গোধূলির আলোয় চান্দপুর চা বাগানের একটি ছোট মন্দিরের সামনে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চা শ্রমিকরা এই প্রদায়ককে বলছিলেন তাদের জীবনের গল্প। তারা জানান, ২০১৪-এর ৫ অক্টোবর সংবাদপত্রে চান্দপুর এবং বেগমখান চা বাগানের ৫১১ একর কৃষিজমিতে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজে) প্রতিষ্ঠিত হবে দেখে তারা মর্মাহত হয়ে পড়েন। এ সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ১২ নভেম্বর ২০১৪-এ চা শ্রমিকরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদনপত্র জমা দেন, তবে উত্তর পান না। কিছুদিনের ভেতর বাগানের নেতৃস্থানীয় কিছু চা শ্রমিককে চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কার্যালয়ের সভাকক্ষে ডেকে বলা হয়, এই জমি যেহেতু চা কোম্পানির লিজ দেওয়া, সেহেতু চা শ্রমিকদের আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ এই চা শ্রমিকরাই ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ ডানকান চা কোম্পানি এখানে চা শিল্প গড়ে তুললে এখানে এসে টিলা এবং সংলগ্ন দুর্গম অরণ্য সাফ করে অনাগত প্রজন্মের জন্য ধান এবং শাক-সবজিসহ বিভিন্ন কৃষি ফসল চাষ করার জন্য তৈরি করেছেন।

‘হামাদের ই ধান্যজমি থেকে বছরে ১৫ কোটি টাকার মতো ফসল আমরা ফলাই। তার কুনো দাম নাই? সি ফসলের টাকায় ছেলেমেয়েদের পড়াই, বিহা দেই, ধারদেনা শোধ করি। ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমলে ইসব ধান্য জমির কিছু দলিল হামাদের ছিল। স্বাধীনতার পর কোম্পানির ম্যানেজাররা কহিলো কি যে দেশ স্বাধীন হবার পর উ কাগজগুলো আর দরকার নাই। হামরা উহাদের কথায় কাগজগুলো দিয়া দিলাম। এখন ত সে দলিলগুলা আর হামাদের নাই বটে। তবে হামাদের রেশন কার্ড হামাদের একটা দলিল যে আজ কয়েক পুরুষ হামরা ইখানকারই বাসিন্দা আর ই জমি হামাদের।’ বললেন চা বাগানের পুরুষ শ্রমিকরা।

‘হামাদের অভাবের কথা যদি বলি, প্রতি সপ্তাহে ছয় দিনের প্রতিদিন ৬৯ টাকা করে ওই ৪১৪ টাকা তলপের টাকা। প্রতি বৃহস্পতিবার তলপের টাকা মেলে। তার ভেতর ১০০ টাকা বাজার খরচা, কিছু টাকা মেঠাই-উঠাইয়ে যায়। বছরে এক দুর্গা পূজায় একটা মোরগা কাটিয়া তিন দিন খাই। এখন ব্র্যাক, আশা এসব অফিস থেকে লোন নিয়া একটা গরু পালি কি গরুর দুধ বেচি। কত কী করে সংসারে ঠেকা দিই! এই ধানি জমি বেহাত হলে কী থাকিবে?’ বলেন চা বাগানের নারী শ্রমিকরা।

ই ছাড়া হামরা হিন্দু তবে টাকা আর জ্বালানি কাঠের অভাবে মরিয়া গেলে হামরা দেহ কবর দিই। ধানি জমিগুলায় বাপ-দাদার কবর আছে। কবরকেই আমরা শ্মশান বলি। ই ধানি জমিতে ফ্যাক্টরি হলে উ কবর বা শ্মশানের কী হবে?’ শ্রমিকরা প্রশ্ন করেন।

গোটা চা বাগানে এখনও ৬০ ভাগ মানুষ শৌচাগার সেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত। কিছু চা বাগানে বিদ্যুৎ গেছে আবার কিছু চা বাগানে নেই। অনেকেই সোলার প্যানেল কিনছেন আজকাল। অনেক চা বাগানে ছড়া বা প্রাকৃতিক ঝর্ণা রয়েছে, তবে কখনও লেবার কলোনি থেকে দূরত্বের কারণে আর কখনও বাগান কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই পানিতে চা শ্রমিকদের অধিকার নেই। ব্রিটিশ আমলে কুয়া ছিল। তবে এখন গভীর নলকূপ সব চা পল্লীতেই আছে। প্রসূতি বা স্বাস্থ্যসেবা আজও সরকারই দিচ্ছে। চা শ্রমিকদের সন্তানরা আজও সরকারি প্রাথমিক স্কুলেই বেশি পড়েন। সচেতনতার কারণে ১৮-২০-এর আগে এখন আর চা বাগানে তত বিয়ে হয় না।

‘প্রজন্মান্তর ধরে এই চা শ্রমিকরা চা শিল্পেই দক্ষ। আজ যদি এখানে সিরামিক বা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রি হয়, তারা কি সেখানে কাজ পাবেন? কাজ হয়তো পাবে বহিরাগত শ্রমিকরা। এরা হয়ে যাবেন আক্ষরিক অর্থেই উদ্বাস্তু। এমনিতে নানা কারণেই আজও বাংলাদেশের মূল জনস্রোতে তারা সম্পৃক্ত নন। এ ছাড়া চা বাগানে ইইজে হলে নানাবিধ কারখানা প্রতিষ্ঠার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে চা পাতা জন্মানোই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেদিকটা কি সরকারের নীতিনির্র্ধারক মহল বা পরিবেশ মন্ত্রণালয় খতিয়ে দেখছে?’ প্রশ্ন করলেন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) হাসান নামে এক স্থানীয় তরুণ সংগঠক, যিনি গত কয়েক বছর ধরে চা বাগানে শ্রমিকদের ভেতর কাজ করছেন।

‘১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘকাল ক্ষমতায় ছিল না আওয়ামী লীগ। কিন্তু চা বাগানের শ্রমিকরা সেই সময়ে তার দলকেই ক্ষমতা দিয়েছে। অন্য কোনো পার্টি এই চা বাগানে কখনও ঢুকতে পারেনি। ভোট আমরা সব সময় নৌকাকে দেই। শেখ হাসিনাকে আমরা বোন বলে মানি। আজ তার দলের সময় কি আমরা ভূমিহারা হবো? কিন্তু এ ভূমি আমাদের মা লাগে। এ ভূমি কী করে ছাড়ি?’ চা শ্রমিকরা বলেন বিচলিত কণ্ঠে। ১৯৭১-এর যুদ্ধে অগণিত চা শ্রমিকের জীবন, অসংখ্য চা নারী শ্রমিকের সম্ভ্রমহানির কথা তারা আবেগাপল্গুত কণ্ঠে বলেন।

১১ ডিসেম্বর থেকে শিশু-বৃদ্ধসহ হাজার হাজার চা শ্রমিক ভূমি রক্ষার দাবিতে রাস্তায় অবস্থান করছেন। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ১০টা অবধি ফ্যাক্টরির সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধনের পর তারা আবার কাজ করছেন। আগামী এক সপ্তাহের ভেতর ইকোনমিক জোন প্রত্যাহার না করা হলে বাংলাদেশের ১৫৮টি চা বাগান ও ২৪০টি ফাঁড়ি চা বাগানসহ সব চা বাগান শ্রমিক তাদের কাজ বন্ধ করে চান্দপুর চা বাগানের পাশের মহাসড়কে অবস্থান নেবেন বলে দৃঢ়কণ্ঠে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন।
লেখক; হবিগঞ্জ, চান্দপুর চা বাগান থেকে ফিরে –