কোন এক জৈষ্ঠ্যের কাঁঠাল পাকা গরম দিনে  কোথা থেকে এক ব্রাহ্মনএর উদয় হলো আমাদের গ্রামে। বাড়ীর  বসার  ঘরের সামনের সদর রাস্তা দিয়ে দ্রুত পা’য়ে হন্যে হয়ে চলতে দেখি দিনে কয়েকবার। কয়েক জন উনার সমন্ধে বলা কয়া ও  করছে। আমার আগ্রহ বাড়লো। অন্যান্য ব্রাহ্মনদের মতো উনি মোটেও , উচ্চ নাসিকা, বৃহৎ চক্ষের, দীর্ঘদেহের অধিকারী তো ননই, বরং খর্বাকৃতির, একটা চোখ  নষ্ট , দই এর  মতো  সাদা।  টাকপরা মাথাটা, দেহের তুলনায়  কেমন  যেনো বেমানান। বয়স ষাটের কোঠায় । কুরো বাঁশের মত শরীরের নিম্নাংগ বেশ সম্ভ্রান্তিক কীর্তনীয়া আংগিকে জড়িয়ে আছে বেজায় নোংরা ধুতিটা।  একটা অর্ধ্ময়লা বেনিয়াম গেঞ্জী। পৈতাধারী।  বগলে একটা  ঢাউস সাইজের  লোকনাথ  পঞ্জিকা। জানতে পারি, ব্রাহ্মনের একমাত্র আয়ের উৎস এই পঞ্জিকা।

বিশেষ করে হিন্দু পল্লীতে বউ  ঝি দের বিভিন্ন  দিন ক্ষনের ধার্য্য, বিচার বিশ্লেষন, শনি  বৃহষ্পতির রাহুগ্রাসের  আগাম সতর্কবানী তে  জীবিকা নির্বাহ।  একজন  বললো  এ যে  সে  পঞ্জিকা নয় , আদি  লোকনাথ এবং  কোলকাতা থেকে আমদানীকৃত। আবার এ ব্রাহ্মন নাকি রাশি গননাতেও বেশ সিদ্ধঃহস্ত।  এমনিতেই  ছোট বেলাতে  দেখতাম আমার দাদাকে  সময়ে অসময়ে  লোকনাথের  নিবির  পর্যবেক্ষন করতে , যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতেন। পুঞ্জিকা টা  খুললেই আমি বুঝতে পারতাম , মৌ মৌ গন্ধে ভেসে  যেতো  সারা বাড়ী।  কোনদিন আর ছূয়ে দেখার সুযোগ হয়নি ।  ব্রাহ্মন  পুঞ্জিকার প্রতি আমার  আগ্রহটা  বেড়ে গেলো  অনেকাংশে।

একদিন বাড়ীর  সামনে দিয়ে  যাচ্ছেন ব্রাক্ষ্মন , আমি ঘরে বসে থেকে একজন কে  পাঠালাম  ডাকার জন্য, দেখলাম ব্রাহ্মন একবার আমাদের বাড়ীর  দিকে তাকালেন, আর  দ্রুত “না” সুচক মাথা নাড়ালেন ঘারের এপাশ ওপাশ এবং  আরও দ্রত হেটে চলে গেলেন।  ছেলেটা এসে বল্লো  “ ভাই আইলো  তো নাই, উলটা  গালা গালি করলো”।   আমি বললাম  ব্রাহ্মন  তো  নিরীহ  প্রকৃতির  হওয়ার  কথা,  উনি  তো  তা  হলে  মনে  হয়  অনেক  “গরম  ব্রাহ্মন  ”

এখন  আমি  ব্রাহ্মন  কে  যেখানেই দেখি  আমার  হাত  দুটো কে  “পৈতাজোড়”  করে উনার  পিছনে   হাটি,  আর  বলতে  থাকি   “কর্তা!  কর্তা!!”  ব্রাহ্মন   আমাকে  দেখামাত্রই  লোকনাথ  কে  মারাত্মক  ভাবে  বগলে  চেপে  ধরে  আরেক  হাত  দিয়ে  সজোরে  ধরে রাখেন। হাটার গতি বাড়ান।  থানার  সামনে  যেয়ে  একটু  সাহস  দেখান , থেমে  গিয়ে আমাকে বলেন “ এই পেত্তর, বেটা  হইলে এখন আস”  থানার  দারোগা  পুলিশ  হাসে।   আমি  বলি  “কর্তা আপনি আমার  রাশি টা  শুধু  একবার  দেখে  দেবেন”। জন্মের পর   “কুষ্টি”  তে  বাবা লিখেছিলেন  অনেক  কিছুই দাঁত ভাঙ্গা  শব্দাবলীতে,  আমার  জন্মতিথি,  লগ্ন,  কত  কি।  মর্মাথ উদ্ধার  করা  হয়নি  কখনো।  মাঝে  মধ্যে  উলটে  পালটে  দেখতাম  ঐ  পর্যন্তই ।  আমার  রাশি সমন্ধে  ব্রাহ্মন  কিছুই বললো না।  আমার কৌতুহল  এখন  দ্বিগুন‌  রাশিফল এবং  লোকনাথ।  আমি  ব্রাহ্মন  কে বলি  “কর্তা আমার রাশি না বলা  পর্যন্ত  আর  আদি   লোকনাথ  না  দেখানো পর্যন্ত আপনি  যত দিন  আমাদের  বাড়ির  সামনে  দিয়ে  যাবেন  আমি   হাত জোড় করে আপনার  পিছু নেবোই ”  ব্রাহ্মন  আমাকে  স্থানীয় গন্য মান্যের   ভয় দেখালেন,  যাদের ভয় দেখালেন  উনারা  যে  ব্যাপারটা  আরো  উপভোগ  করবে  জেনে  আমি   মনে  মনে  হাসলাম।

একদিন  ব্রাহ্মন  যাচ্চছেন,  আমি  একজন  কে  বললাম  কর্তা কে  আমার  প্রনাম  দিয়ে  আসতে বলবি,  যদি না  আসে  কর্তা কে  আস্তে  করে  আড়কোলা  করে  নিয়ে  আসবি।  আমি বারান্দা তে দাড়িয়ে  কি আশ্চর্য , বলা মাত্রই কর্তা  এগিয়ে  আসছেন,  আড়কোলার  কোন দরকারই  হলো না ।  খালি পা,  ধুতিটা ভেজা,  সারা  গা  রোমকাটা  দিয়ে আছে।  বগলে চেপে ধরে আছেন  আদি লোকনাথ।  আমি  চেয়ার টা  দেখিয়ে   বসতে বললাম।  উনি আমাকে শোনার আগেই   মেঝেতে বসে পরলেন।  আমি চা’ নাস্তা  আনতে  বললাম,  জানালেন মুসলমানের ঘরে  চা  তো  দূরে  থাক  পানি  পান ও  বারন।   আমার জন্মতিথিতে   বাবার  লিখা  “কুষ্টি”  টা  বের করে ব্রাহ্মনের সামনে  দিলাম,   ভ্রুক্ষেপ ও  করলেন না।   বললাম  কর্তা  আপনার আদি পুঞ্জিকা মতে আমার  রাশি টা  শুধু  একবার বলে দিন , উনি  আমার জন্য  পুঞ্জিকা খুললেন  প্রথম  বারের মতো!   আমি  আশ্চর্য  হয়ে  দেখতে  থাকলাম   আদি  লোকনাথ কিছুই বুঝতে পারছি না, বাবার লেখার মতই অসম্ভব দাঁত ভাঙ্গা  শব্দাবলী। মেঝেতে উবু  হয়ে  নিবিড়  ভাবে  পুঞ্জিকা  দেখে চলছে  একচোখা  ব্রাহ্মন  ।   কি  দারুন ফুলের গন্ধ  বেরুচ্ছে  ব্রাহ্মনের আদি  লোকনাথ  পুঞ্জিকা’ টা  থেকে।