বাঁধ নির্মাণের রাজনীতি ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময়েই ভারতে কমবেশি ৩০০টি বৃহৎ বাঁধ নির্মিত ছিল। ২০০০ সালের মধ্যে নির্মিত এই বাঁধের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজারের বেশি। আর এসব বাঁধের অনেকগুলোই বাংলাদেশের সঙ্গে অভিন্ন নদীতে। যার অর্ধেকেরও বেশি নির্মাণ করা হয় ১৯৭১ থেকে ১৯৮৯ সময়ের মধ্যে। বিশ্বে নদীর ওপরে বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণে ভারতের অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে তিন নম্বরে। ভারতে বাঁধকে বিবেচনা করা হয়ে আসছে উন্নয়নের নিদর্শন হিসেবে। জওহরলাল নেহেরু একসময় বলেছিলেন যে, ”বড় বাঁধগুলো আধুনিক ভারতের মন্দির।” মূলত বাঁধ নির্মাণকে নিয়ে আসা হয়েছে একদিকে লাভজনক বিনিয়োগক্ষেত্র হিসেবে পুঁজির স্থবিরতার সংকট দূর করতে, অন্যদিকে সবুজ বিল্পবের মাধ্যমে কৃষির একমুখিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের প্রয়োজনে উৎপাদন বৃদ্ধির নামে হাইব্রিড ফসলের চাষ চালু করতে। এতে সেচের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সেচ কার্যের জন্য ব্যবহৃত বাঁধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ইত্যাদি।

সারা পৃথিবীতে বাঁধ নির্মাণ ব্যবসা দাঁড়িয়েছে বছরে ২০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। গড়ে উঠছে বাঁধ নির্মান কোম্পানি, আমলা, রাজনীতিবিদদের একটি চক্র যারা বাঁধ নিমর্াণের পুরো কর্মকাণ্ড নিজেদের সুবিধা মতো নিয়ন্ত্রণ করে। বাঁধ নির্মাণ কোম্পানিগুলোর পোষা আনত্দজাতিক পরিবেশ পরার্মশকদলও রয়েছে, যারা গুরুগম্ভীর ঢঙে, অনেক দেখাশোনার ভান করে ‘পুর্নবাসনে মনোযোগী হতে হবে’ কিংবা ‘পরিবেশ বির্পয়ের ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করা চলবে না’ ধরনের বাণী দেয়। আর বিশ্বব্যাংক সবসময়ই হাজির থাকে বাঁধ নির্মাণের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে। কখনও কখনও তাদের ভূমিকার অদল বলদ ঘটে। ব্যাংকার থেকে কেউ হয়ে যায় পরার্মশক আবার পরার্মশক থেকে ব্যাংকার। এভাবেই উন্নয়ন সহায়তা বা ঋণ, শেষ পর্যনত্দ পরার্মশকদের সম্মানী এবং যন্ত্রপাতির মূল্য বাবদ যে দেশ থেকে এসেছিল সে দেশে ফিরে যায়।

এই প্রক্রিয়ায় ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পরার্মশকরা বিদেশ থেকে আয় করে ২.৫ বিলিয়ন ডলার এবং এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত ছিল বাঁধ নিমর্াণ। ১৯৯৩ সালে মালয়শিয়ায় ‘পারগাও বাঁধ’ সেদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে এমন সর্তকবাণী সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র মালয়েশিয়াকে অত্যনত্দ কম সুদে ২৩৪ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়। পরবর্তী সময়ে আসল ঘটনা প্রকাশিত হলে এই কম সুদের ঋণ প্রদানের উদ্দেশ্য জানা যায়। যুক্তরাজ্য থেকে ১.৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র যাতে মালেয়শিয়া কেনে, তার প্রণোদনা হিসেবে এই ঋণ দেয়া হয়েছিল। এমনি করে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেভিড হুপার স্বীকারও করেছেন যে, দক্ষিণ এশিয়ায় সেচের জন্য বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কেননা সেগুলো অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের নীতি হলো জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে দেয়া এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধি পর্যন্ত অপেক্ষা করা। এরপর নিষ্কাশন বাঁধের জন্য আবার ঋণ দেয়া এবং লবণাক্ত মাটিতে জন্মাতে সক্ষম প্রজাতির ফসল উদ্ভাবনে যেসব কোম্পানি নিয়োজিত তাদের মুনাফার সুযোগ সৃষ্টি করা। অন্যদিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মাধ্যমে নদীগুলোর স্বাভাবিক নাব্যতা ও প্রাণ ধ্বংস করে ফেলা।

ফুলেরতল ব্যারেজঃ
টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কারিগরি পরামর্শ শুক্লা কমিশনের আরেকটা সুপারিশ ছিল টিপাইমুখ থেকে ৯৫ কিমি ভাটিতে, আসামের কাছাড় অঞ্চলে সেচ প্রদানের সুবিধার্থে ফুলেরতলে একটা ব্যারেজ নির্মাণ করা। ফারাক্কা ব্যারেজের অভিজ্ঞতায় ফুলেরতল ব্যারেজের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে কেমন হতে পারে তা বোঝা মোটেও দুঃসাধ্য নয়, কিন্তু ভারত বরাবরই ফুলেরতল ব্যারেজ নির্মাণের কথা অস্বীকার করে আসছে। বরাবরের মতো এটিও যে স্রেফ ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর ভাওতাবাজি তা টিপাইমুখ বাঁধের এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা ইআইএ রিপোর্টের ১ম অধ্যায়ে পড়লেই বোঝা যায়। সেখানে উল্লেখ আছে যে, ফুলেরতল ব্যারেজ বরাক নদ থেকে প্রয়োজনে প্রতি সেকেন্ডে ১১২০ ঘনমিটার পানি প্রত্যাহার করতে পারবে। উল্লেখ্য, ফারাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে ভারত প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ ১১৩৩ ঘনমিটার পানি ভাগিরথী নদীতে সরিয়ে নেয়। অর্থাৎ ফুলের তল ব্যারেজ তৈরিহলে তা থেকে ফারাক্কার প্রায় সমপরিমাণ পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত।

ইআইএ রিপোর্টের ৩য় অধ্যায়ের টেবিল ৩.১৬ অনুসারে, ভরা মৌসুমে আসামের লক্ষীপুরে বরাক নদের পানি প্রবাহের নিরাপদ পরিমাণ হলো ২৭৬০ কিউমেক এবং বদরপুর ঘাটের কাছে (অমলশিদ থেকে ১০ কিমি আগের স্থান) এর পরিমাণ ৩৪৪০ কিউমেক। এই ডাটা থেকে দেখা যায়, পুরোপুরি কার্যক্ষম থাকলে, ফুলেরতল ব্যারেজের মাধ্যমে লক্ষীপুর অঞ্চলের কাছে বরাক নদ থেকে ৪১% এবং বদরপুর ঘাটের কাছ থেকে ৩৩% পানি প্রত্যাহার করে নেয়া সম্ভব। অন্যাদিকে শুকনো মৌসুমে বরাক নদের প্রবাহের পরিমাণ গড়ে ১৭৫ থেকে ২৫০ কিউমেক। ভারতের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক শুকনা মৌসুমে যদি পানির পরিমাণ বেড়ে এমনকি যদি ৫০০ কিউমেকও হয়, তাহলেও পুরো কার্যক্ষম ফুলেরতল ব্যারেজ বরাক নদকে একেবারে পানিশূন্য করে দিতে পারবে যার ফলে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ হয়তো একফোটা পানিও পাবে না।

বাঁধ ও ব্যারেজ সাম্প্রতিক কিছু সাধারণ তথ্যঃ
জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল স্থাপনা হলো বাঁধ। এটি নদীর প্রবাহে আড়াআড়ি ভাবে স্থাপিত হয়, যেমনটা কাপ্তাই বাঁধ। সাধারণত খরস্রোতা নদীর প্রবাহকে আটকে এর উজানে জলাধার তৈরি করে পানির উচ্চতা বাড়ানো হয় বাঁধের সাহয্যে। এরপর জলাধারের নিচের সুড়ঙ্গের মাধ্যমে এই পানিকে প্রবাহিত করে টারবাইন ঘুরিয়ে উৎপন্ন করা হয় বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো কমানো নির্ভর করে জলাধারের পানি ছাড়ার পরিমাণের ওপর। এভাবে বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানির প্রবাহ বাড়লেও জলাধারে আটকে রাখার কারণে ভাটি অঞ্চলে পানির প্রবাহ কমবে। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে উজানে পানি কমলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে জলাধার থেকে নিয়মিত পানি ছাড়া হবে। ফলে বাঁধের ভাটিতে পানির প্রবাহ আগের থেকে বাড়বে।

আর ব্যারেজ হলো নদীর পানিকে একাধিক গেট দিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবাহিত করা। ব্যারেজের ঠিক উজানে এক বা একাধিক কৃত্রিম খাল খনন করে নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি প্রবাহিত করে আরও ছোট ছোট খাল দিয়ে (তিস্তা ব্যারেজ, বাংলাদেশ) বা পামপের মাধ্যমে (জিকে প্রকল্প, বাংলাদেশ) আবাদি জমিতে সেচ দেয়া হয় অথবা অন্য কোনও নদীতে পানির প্রবাহ বাড়ানো হয় (যেমন ফাঁরাক্কা ব্যারেজ)। অর্থ্যাত ব্যারেজের মূল লক্ষ্যই থাকে একটি নদী থেকে পানি অপসারণ, অন্যদিকে বাঁধের মূল উদ্দেশ্য উজানে পানিসঞ্চয়। উজান এবং ভাটি, দুই দিকেই বাঁধের প্রভাব পড়ে। উজানে কৃত্রিম জলাধারের কারণে এবং ভাটিতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারণে।

উজানে বাঁধের সাধারণ প্রভাব:

ক) কৃত্রিম জলাধারের কারণে বিপুল পরিমাণ এলাকা পানির নিচে নিমজ্জিত হয়, ফলে মানুষের ঘরবাড়ি আবাদি জমিসহ বিশাল শুষ্ক এলাকা জলাভূমিতে পরিণত হয়। বনভূমি ও অন্যন্য উদ্ভিদ পানির নিচে তলিয়ে পচে গিয়ে বিপূল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে, বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস বাড়ায়।

খ) নদীর স্থানে জলাধার তৈরির ফলে পানির উপরিতলের ক্ষেত্রফল বাড়ে, যা স্বতঃবাষ্পীভবনের (ইভ্যাপরেশন) হার বাড়ায়। আগের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ পানি নদী থেকে স্বতঃবাষ্পীভূত হয়ে নদীর প্রবাহ কমায়। এক হিসেবে আমেরিকার ‘হোভার ড্যাম’ সৃষ্ট ‘লেক মেড’ থেকে বাৎসরিক ৩৫০ বিলিয়ন গ্যালন পানি বাসপীভূত হয়ে নদীর প্রবাহে প্রভাব ফেলে।

গ) বাঁধের সবচাইতে বড় প্রভাব বাস্তুসংস্থান বিপর্যয়। বাঁধের উজানের স্বাভাবিক স্থলজ বাস্তুসংস্থান সমপূর্ণ বিনষ্ট হয়ে একটি কৃত্রিম জলজ বাস্তুসংস্থান তৈরি হয়। বিলুপ্ত হয় অনেক প্রজাতির প্রাণী। এছাড়া বহু প্রজাতির মাছ বছরের একটি বিশেষ সময়ে ভাটি থেকে উজানে যায়। বাঁধের কারণে মাছের এই অভিবাসন সমপূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে উৎপাদন কমে নিঃশেষ হয়।

ঙ) পানি ছাড়াও নদী প্রবাহ বয়ে নিয়ে চলে বিপূল পরিমাণ পলি। বাঁধের ফলে উজানে নদীর গতিবেগ অনেক কমে। পানির পক্ষে এই পলি আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না, তা ধীরে ধীরে নিচে পড়ে জলাধারের বুকে জমতে থাকে। এটি জলাধারের নিচের সত্দরের উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়।

ভাটিতে বাঁধের সাধারণ প্রভাবঃ

ক) পানিবিদ্যুৎ বাঁধের কারণে স্বভাবতই বর্ষা মৌসুমে প্রবাহ কমে, ফলে ভাটি অঞ্চলের স্বাভাবিক জলজ বাস্তুসংস্থান ব্যহত হয়। যে সকল জলজ প্রাণীর প্রজননে বাৎসরিক বন্যা সমপর্কযুক্ত, তাদের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যহত হয়। এছাড়া স্বাভাবিক বন্যায় আশেপাশের স্থলভূমি থেকে জলজ প্রাণীর প্রয়োজনীয় খাদ্য নদীতে মেশে। সুতরাং স্বাভাবিক বন্যা ব্যহত হয়ে এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রসত্দ হয় এবং পরিণামে এদের বিলুপ্তি ঘটে।

খ) গভীরতা অনুযায়ী পানির বেগ নদীতে ভিন্ন ভিন্ন হয়। সাধারণত তলদেশে বেগ কম থাকে আর উপরিতলের ঠিক আগে থাকে সর্বোচ্চ। উলম্ব তল বরাবর পানির বেগের পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে নদীর বিভিন্ন সত্দরে বিভিন্ন ধরনের মাছ অভিযোজিত হয়। এই বেগের পরির্বতন মাছের স্বাভাবিক অভিযোজন বিনষ্ট ও জীবনচক্র ধ্বংস করে। ধ্বংসে হয় ভাটির মৎস সম্পদ।

গ) ‘নিম্নাঞ্চল’ সমতল ভূমির বৈশিষ্ট। প্রাকৃতিক নিয়মে বর্ষায় নদীর পানি উপচে এইসব নিম্নাঞ্চল পূর্ণ হয়ে সারা বছর জলজ প্রাণীর অভয়াশ্রমে পরিণত হয়; উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের হাওড়গুলো। এই নিম্নাঞ্চলই আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি মজুদের কাজ করে, যা থেকে ছোট ছোট নদী-খাল ‘বেইজ ফ্লো’ হিসেবে পানির যোগান পায়। এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে নিম্নাঞ্চলগুলো সঠিক সময়ে পানি না পেয়ে এদের স্বাভাবিক ‘মরফোলজি’ ব্যহত হবে আর সেই সঙ্গে এর ওপর নির্ভরশীল ছোট ছোট নদী-খাল শুকিয়ে যাবে।

গ) বাঁধের ফলে নদীর সমসত্দ পলি উজানের জলাধারের নিচে সঞ্চিত হওয়ায় টারবাইনের মধ্যে দিয়ে পানির যে প্রবাহ ভাটিতে পরিবাহিত হয় তা সম্পূর্ণরূপে পলিমূক্ত থাকে আর তাই এর পলি ধারণক্ষমতাও হয় সর্বোচ্চ। ফলে তা ভাটিতে প্রবাহিত হবার সময় নদীর বুক আর পাড় থেকে মাটি নিয়ে যায় আর তাই নদী ক্ষয়ের পরিমাণ হঠাৎ করে বিপুলাংশে বেড়ে যায়।

তারিক মাহমুদ: লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট