এই এলাকার উঠতি বয়সী গ্রামীন মেয়েদের অনেকে রঙ্গীন সুতো দিয়ে কাপড়ে ফুল তুলে কিংবা জোড়া পাখির ছবি এঁকে তাদের প্রেমাস্পদকে গোপনে নিবেদন করত।সেগুলোতে আবার বিচিত্রসব বানী উৎকীর্ণ থাকত।যেমন-‘ভুলনা আমায়’ ‘যাও পাখি বলো তারে সে যেন ভুলেনা মোরে’ ‘পুকুরেতে পানি নাই পদ্ম কেন ভাসে,যার সাতে দেখা নাই সে কেন আসে,ইত্যাদি।অনেকে আবার স্কুলগামী বা বেড়াতে যাওযা কোন মেয়ের প্রতি মোহমুগ্ধ হয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণে নানাবিধ প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়ে থাকে। অতি বেয়াড়া গোছের কেউ কেউ হয়তো সরাসরি টিজ করে অথবা প্রেম নিবেদন করে বসে।বর্ণচোর গুলো মুখ ফুটে বলতে না পারার অক্ষমতায় জীবন্ত সুপারী, নারিকেল,কলাগাছ বা অন্যান্য গাছের গায়ে নিজের নামের আদ্যাক্ষর আর আরাধ্য তরণীর নাম বা তার আদ্যাক্ষর যোগচিহ্ন(+)দিয়ে খোদায় করে রাখে।

কিশোরগঞ্জের বর-কনে দর্শন  কিংবা বিয়ে-শাদির পার্বিকতা, আনুষঙ্গিকতা বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেত না।সাধারণত এই-এলাকায় দেশের অন্যান্য এলাকার মতোই কনে দেখার প্রচলন রয়েছে। কনে দেখতে গিয়ে,‘মা,কোমার চুলগুলো ছেড়ে দেখাওত, ‘ ‘এবারের একটু হাঁটো,’ জাতীয় যাচাইপর্ব।এরপর ‘সুরা ইয়াসিনের কয় মবিন মুখস্ত করেছ? একটু পরে শোনাওত’ ধরনের মুখস্তবিদ্যার দৌড় বুঝা। এবারে বুদ্ধি যাচাই।‘তুমি কি দুই আনা(মানে তৎকালীন বার পয়সা)দিয়ে একটি ঘোড়া,এক আঁটি লাকড়ি এবং একটি কাঠের বাক্স কিনে দিতে পারবে? মেয়ে চালাক-চতুর পর্যায়ের হলে হয়তো তড়িৎ উত্তর পাওয়া যাবে:‘ম্যাচ’বা ‘দিয়াশলাই।’মানে দাঁড়াচ্ছে-বারুদসহ কাটি ভর্তি ঘোড়া মার্কা আস্ত দিয়াশলাই।

বিয়ে সংশ্লিষ্ট আরো একটি বিষয় হচ্ছে,যখন বর-কনের বিয়ে সম্বন্ধ ঠিক হয় এবং বিয়ের দিন-তারিখ নির্ধারণ করা হয়,তখন এর আগে কিছু প্রাক-আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়ে থাকে।বিয়ের চুড়ান্ত পর্বের আগে বর-কনের উভয় পক্ষের দিক থেকে আংটি পরানো হয় অথবা কোন কোন ক্ষেএে অগ্রিম কাবিননামা সম্পুন্ন করে রাখা হয়।এ উপলক্ষে উভয় পক্ষের মুরুব্বী গোছের সীমিতসংখ্যক লোকদের পারস্পারিক বেড়ানো-খেলানো সম্পুন্ন হয়। তাদেরসহ উপস্থিত স্থানীয় গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ ও ছোঁড়া-ছুড়িদেরও বাতাসা,পান-চিনি ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।এ ধরনের বিযেপূর্ব ক্ষুদে অনুষ্ঠানকে ‘আগবস্তি’বা ‘পান-চিনি’বলা হয়।

পান-চিনি বা আগবস্তি হয়ে থাকুক বা না থাকুক,বিয়ের চুড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতার পূর্বক্ষনে কিংবা অন্তত আগের দিন বর-কনের হাতে মেহেদী পরানো হয়।এ মেহেদী  পরানোর কাজটিতে চিরাচরিত পুরানো প্রথা হচ্ছে,বরফে সচরাচর তা পরিয়ে থাকে,তার সহোদর  অথবা চাচতো,ফুফাতো ছোট ছোট বোনেরা;অথবা আপন বা চাচাতো,জেঠাতো ভাবীরা।কনের বেলাও এই একই রকম সম্পর্কীয়রা তা পালন করে থাকে আর মেহেদীপর্ব  শুরু করার প্রস্তুতিপর্বটিও আলাদা ব্যঞ্জনার দাবিদার।কিশোরী মেয়েরা দল বেদে নতুন একটা ‘কলা’য় কিছু ধান-দুর্বা,পান-সুপারি,‘পাড়া গুড়’(পাটালী গুড়)আর একাটি ‘মুচি’(মাটির তৈরী ছোট্র চেপ্টা বাটি বিশেষ।)তে তেল দিয়ে সলতে জালিয়ে মেহেদী গাছের দিকে রওয়ানা হয়।মেহেদী গাছ নিজের বাড়িতে না থাকলে পড়শি কারো বাড়িতে যায়,যেখানে মেহেদী গাছ আছে। সেখানে গিয়ে ঐ বাড়ির লোকদের,বিশেষত মহিলা মুরব্বীদের পান-সুপারি,গুড় দেয়।শিশুদেরও গুড় দেওয়া হয়।এর পর মৌখিক অনুমতি ও দোয়া চেয়ে নিয়ে মেহেদী গাছের নিচে যায়।এবারে সলতের পিদিমটি মেহেদী গাছের গোঁড়ায় রেখে দেয়।পাশে কিছু পান-সুপারি এবং গুড়ও রাখে।এরপর সমবেতভাবে মেহেদী পাতা তোলা শুরু হয়।কখনো কখনো ‘মেন্দী বাটো,হলুদ বাটো ধরনের গানও গায় দল বেঁধে।মেহেদী তোলা হলে,তা নিয়ে গিয়ে পিষে বর বা কনের হাতে নানা নকশা করে পরানো হয়।

সাম্প্রতিককালে চিরায়ত প্রথার কিছুটা বিলীন আর কিছুটা নব আঙ্গিকে রুপান্তরিত হয়ে,নতুন সংস্কৃতির মিশ্রতা চালু করেছে।আর তা হচ্ছে,বর বা কনের মেহেদী পরানোর জন্য বিপরিত পক্ষের কন্যাদল দুএকদিন আগেই বাসন্তী রঙ্গের,শাড়ী পরে বর বা কনের বাড়ীকে যায়।এই মেহেন্দীদলকে সাধ্যমতো  সাদর-আপ্যায়ন করতে হয়।এমনকি আনেক ক্ষেত্রে তাদের পরনের বাসন্তী শাড়িও অগ্রিম সরবরাহ করতে হয়,বিপরিত পক্ষের।

এতো গেল বিয়ে-পার্বিকতা।

এর পর বিয়ে পর্ব।জামাই বা দুলা মিয়া ‘পালকি’দিয়ে বরযাত্রী সহযোগে হবু শ্বশুবাড়িতে গমন করবে।সেখানে দু’ পাশে কলা গাছ পুঁতে বা বাঁশের ফাঁকা ফাঁকা চাটাই দিয়ে ‘বরবরণ তোরণ ’নির্মান করা হয়।মাঝখানে ‘স্বাগতম’ ‘গেইট পাশ একহাজার এক টাকা’খচিত কাগজলিপি চতুষ্পার্শ্বে দেবদারু গাছের পাতা সহ ছোট ছোট ডাল দিয়ে সজ্জিত করা থাকে।সেখানে প্রবেশপথের ঠিক মাঝ বরাবর গোটকয় চেয়ারসহ একটি টেবিল পেতে প্রবেশের পথ আটকে রাখা হয়,যাতে করে বর ও বরযাত্রিরা সহযে প্রবেশ করতে না পারে।টেবিলের উপর ফুল-লতা বা মুয়ুর আঁকা একটি টেবিল ক্লথ বিছিয়ে রাখা হয়।এই ক্লথটি অনেক ক্ষেত্রেই কনের সূচিশিল্পের স্বাক্ষর বহন করে।এই তুরন-টেবিলে কিছু চিনি-বাতাসা এবং একটি পানদানে বা পান্থালে উত্তমরুপে বিন্যস্ত খিলিপান রাখা হয়।বরপক্ষকে আপ্যায়ন করার জন্য।গেটে অভ্যর্থনা ও কিছু অর্থ-কড়ি বাগানোর জন্য তৈরি থাকে কিশোর বয়সী শ্যালক-শ্যালিকা বাহিনী।এদের মধ্যে ‘মুখর ও মুখরা’গুলো‘বার্গেনিং এজেন্ট’হিসেবে কাজ করে।জামাই প্রবেশের প্রবেশমূল্য নির্ধারিত হলে,গেটের টেবিল-চেয়ার সরিয়ে নেয়া হয়।নতুন বরকে চিনি-মিষ্টি দিয়ে বরণ করা হয়। অনেক সময় এক-আধটা পানের খিলিও ঈষৎ সলজ্জ বরের মুখে ঠেসে দেয়া হয়।কখনো কখনো ঠাট্টা-মষ্কবার ছলে সেই পানের খিলির ভেতওে অল্প মরিচের গুঁড়ো গোপনে সেঁধে দেয়া হয়,জামাইকে বিব্রতকর অবস্থা ফেলার জন্য।

বর ও বরযাত্রীরতো প্রবেশ করল। হাত-মুখ ধুয়ে চাটায়ের উপরে বিছানো ফরাশে সকলের অবস্থান গ্রহণ। বর ও কনের উভয়পক্ষ ‘খরপাইত্যা’অথাৎ দেওয়া-থুওয়া,বরপক্ষেও আনীত বস্তনিচয় প্রদর্শন, পর্যবেক্ষণ, মৃদু বর্চসা (কখনো কখনো তা সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া) শেষে বিয়ে পড়ানো। বরকে অন্দরমহলে নিয়ে কনের-সান্নিধ্যের ব্যবস্থা। সেখনে বরকে ‘কাব-বাসনে’র   (বিরাটাকারের থালা) দই-ভাতের ভেতরে‘কাঁচা টাকা’ (ধাতব মুদ্রার কয়েন), থালার উল্টো পিঠে নিচে সে সবের কয়েকটা সেঁটে দিয়ে বরের বুদ্ধিমত্তা যাচাই করা হয়ে থাকে। জামাই যদি মুদ্রাগুলো আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়, তাহলে সেসবের মালিকানা তারই।

বরযাদের বেশিরভাগই বিয়ের দিনই নিজ বাড়িতে ফিরে যায়।বরের দু’একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি যেমন বন্দু-বান্ধব,বড় ভগ্নিপতি  এমনতরো ইয়ার্কি সর্বস্ব লোকজন বরকে স্ংঙ্গ দিতে থেকে যায়।দু’একদিন পর বর নববধুকে নিয়ে সেই পালকি চরে নিজ বাড়িতে প্রত্যাাবর্তন ঘটে।নতুন বউকে নিয়ে বাড়ি এলে মা,দাদী বা ভাবীরা মিলে কপালে ধান-দুর্বা দিয়ে বর-বধুকে বরণ করে নেওয়া হয়।এভাবে বরণ করলে নাকি বাড়িতে ‘লক্ষী’আসে,প্রচুর শস্য হয়।এর পর কয়েকদিন বর-বধু একসাথে কাটানোর পর নববধু স্বামী সহযোগে ‘মাফা’(পালকির ছোঁ সংস্করণ)দিয়ে বাপের বাড়ি যায়।একে এই এলাকায় ‘ফিরা-উল্লা’বলে । কোনও এলাকায় ‘ফিরানি’ও বলা হয়ে থাকে।এই ফিরা-উল্লার পর থেকে বউ ‘মাফা’দিয়েই বাপের বাড়ি স্বামীর বাড়ি যাওয়া আসা করত।বর্তমানে একদএলাকায় এই ‘পালকি’ বা ‘মাফা’র বাহন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বর-কনের বিয়ে উপলক্ষে তাদের বন্ধু-বান্ধুবীরা কিংবা ঠাট্টা-মস্করা সম্পর্কের আত্মীয়রা ‘প্রীতি উপহার’ নামে স্মারক বের করত। এগুলো কখনো উড়ন্ত পরী বা নানাবিধ ফুল-লতাপাতার নকশা সজ্জিত হত।এগুলোর কোনটা লিফলেট আকারে, কোন কোনটা ১০/১২ পৃষ্ঠার ছোট বুকলেট আকারে ছাপা হতো। সেগুলোতে যেমন থাকত ধর্মীয় বা মহামানবের বানী,তেমনি বরকনেকে  নিয়ে মজাদার ও রসালো নানা ছড়া ও বিটকেলে সব কথাবার্তা।সেসবে বরকনের নতুন শুরু হতে যাওয়া দাম্পত্য জীবন সুখের হওয়ার আশীর্র্বাণীও থাকত। বর্তমানে এ প্রথা প্রাই বিলুপ্তির পথে।

পূর্ববর্তী পর্বঃ  কিশোরগঞ্জের লোকজপ্রথা, বোধ, বিশ্বাস

গবেষনা ও পান্ডুলিপিঃ রফিকুল হক আখন্দ