রাত তখন একটা বেজে ৪০ মিনিট। টাঙ্গাইল স্টেশনে নামলাম নিশিদলের তিন সদস্য। আমার সাথে তুহিন ও রোমন। নিশিদলের স্থায়ী বা অস্থায়ী কোনো সদস্যপদ নেই। নেই কোনো সংখ্যার সীমা। যে কেউ যে কোনো মুহূর্তে এর সদস্য হতে পারে। আবার দলের চৌদ্দদুগুণে আটাশ গোষ্ঠী উদ্ধার করে চলেও যেতে পারে। আমরা কয়েকজন নিশিকুটুম্ব রাত জেগে অভ্যস্ত। এর আগে অনেক রাতই চারদেয়ালের ভেতর জেগে কাটিয়েছি। উদভ্রান্তের মতো হেঁটেছি রাজধানীতে। নিভৃত গ্রামে নিশি ডাক ডেকেছি। কারো কারো শ্মশানঘাটে রাত কাটানোরও অভিজ্ঞতা আছে। হেঁটেছি অশুভ অমাবশ্যায়। কালো ভ’ত, ভালো ভ’ত সবই আমাদের কাছে মামুলি। এমনকি ভ’তের চেয়ে ভয়ঙ্কর রাতের মানুষদের ভয়েও তেমন ভীত নই।

সুতরাং আমরা বেপরোয়া, অন্তত ভর নিশিতে। রাতের চাদর পৃথিবীকে নিরব করে দেয়ার পর আমরা ঢুকে যাই নিশিঘোরে। নিশিদলের সদস্য রোমনের বিয়ে, তুহিনের নতুন ব্যবসা শুরু করার কারণে বেশ কিছুদিন নিশি আড্ডায় ছেদ পড়ে। বিরতির পর আবার নতুন উদ্দ্যমে ঘুরে দাঁড়াই। রোমনের বিবাহিত জীবন, অসহ্য বাস্তবতা কোনো কিছুই ফেরাতে পারেনি আমাদের। নিশিদল মোড় নিলো নতুন দিকে। ঠিক হলো প্রতিমাসে অন্তত একটি নিশি কাটাবো ঢাকার বাইরে। কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠবো, গিয়ে নামবো অপরিচিত কোনো স্টেশনে। আমাদের প্রথম যাত্রা ঠিক হলো জুনের শেষ সপ্তাহে।

সূর্য্য ডোবার পর থেকেই ছটফট করছিলাম। অনেক বাস্তবতা পাশ কাটিয়ে, দায়িত্ব সম্পন্ন করে অবশেষে রাত নয়টার দিকে পৌঁছুতে পারলাম কমলাপুর স্টেশনে। দেখলাম প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে লালমনি এক্সপ্রেস। ছাড়বে রাত দশটায়। তাৎক্ষনিক ঠিক করলাম এই ট্রেনে চড়ে যাবো যমুনা সেতু পার হয়ে।
কোন স্টেশনে?

ঠিক হলো সায়েদাবাদ স্টেশনে নামবো। এর আগে কেউ কখনো সায়েদাবাদ যাইনি।
কিন্তু ট্রেনে উঠে মত পাল্টে গেলো। সর্বসম্মতিক্রমে গন্তব্য ঠিক করলাম টাঙ্গাইল।
তারপর কুউ-ঝিক ঝিক, কুউ-ঝিক ঝিক পুঁউউ….
ছো মন্তর ছো মন্তর ছুঁউউ…….
টাঙ্গাইল স্টেশনে নেমেই ভ্যাবাচেকা খেতে হলো আমাদের। জীবনভর দেখে এসেছি স্টেশন মানেই সরগরম। সারারাত লোকের আনাগোনা। ছোটখাটো টঙ দোকান। চায়ের কাপে ঝড়। ঘুমে ঢুলোঢুলো যাত্রীর অপেক্ষা। আর ছিন্নমূল মানুষের নিশ্চিন্ত নিদ্রা।
এখানে এসবের কিছুই পেলাম না। ট্রেন থেকেও আমরা ছাড়া অন্য কোনো যাত্রীকে নামতে দেখলাম না। আশাহত হলাম। তবে ঝকঝকে স্টেশনের একটি পিলারে বুড়োমতো এক লোককে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখলাম।
আর দেখলাম তড়িঘরি করে স্টেশন মাস্টারের কক্ষ তালাবদ্ধ করছেন শুভ্রদাঁড়ির এক প্রৌড়। দ্রুত এগিয়ে গেলাম তার দিকে।
চাচা সকালের ট্রেন কয়টায়?

প্রৌড় ভদ্রলোক ভ’ত দেখার মতো চমকালেন। আমরা যেনো অনাহুত আগন্তুক। হ্যাঁ স্টেশনে নামার পর নিজেদের তাই মনে হচ্ছিলো। এই দুই লোক আর আমরা তিনজন ছাড়া অন্য কোনো মানুষেরই অস্তিত্ব নেই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিম ছাম প্লাটফরমের কোথাও একটি টঙ দোকান পর্যন্ত নেই।
ভদ্রলোক ঝটপট উত্তর দিলেন সকাল চারটায় একটা ট্রেন আছে, আরেকটা ছয়টায়। তারপর ঘন পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন।
আমরা হতভম্ব। হাত পায়ের জঙ ছুটিয়ে সোজা দাঁড়ালাম রেল লাইন সামনে রেখে। ফুর ফুর করে ফুলের ঘ্রাণ ভাসিয়ে ছুটে এলো এক পশলা বাতাস। স্টেশনে ট্রেন থামার পর থেকেই মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। কিন্তু এর আগে এর উৎপত্তি তলিয়ে দেখিনি। কড়া ঘ্রাণ, ফুসফুসকে চাঙ্গা করে দেয়ার জন্য যথেস্ট। বড় বড় করে শ্বাস নিতে লাগলাম আমরা। প্লাটফরম এর বিপরীত দিকে রেল লাইনের ঠিক ওপাশেই সারি সারি গাছ। কী গাছ ধারণা করা যাচ্ছে না। সম্ভবত ওখান থেকেই ঘ্রাণটা আসছে। স্টেশন যেমন ঝকঝকে, তেমনি এর ভেতর ও বাইরের সবকিছুই নতুন।

ওহ্হো, আগেই ভাবা উচিত ছিলো ব্যপারটা। টাঙ্গাইল স্টেশন তো নতুনই। এখানে রেল লাইন করা হয়েছে কেবল যমুনা সেতুর জন্য। সুতরাং নতুন স্টেশনে নেমে পুরনো স্টেশনের মতো সরগরম আশা করাটা রীতিমতো অন্যায়। তাই বলে এতো নিষ্প্রাণ!

সম্ভবত টাঙ্গাইলের মানুষ এখনো রেল যাতায়াতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। বিষয়টি আরো স্পস্ট হলো যখন ক্ষুধায় পেট বিদ্রোহ করলো। এর জন্য যেতে হবে স্টেশনের বাইরে। একবার উঁকি দিলাম বাইরের দিকে। কোনো দোকান টোকান নেই। নেই তো নেই-ই। একেবারে খাঁ খাঁ রাত। ডানে, বায়ে রেল লাইন, খোলা মাঠ, জঙ্গল। সামনে লাইন পেরিয়ে সারি সারি গাছ। এরপর খোলা মাঠ। পেছনে গাছপালার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরে কোথাও হুঁস হাঁস করে দৌড়াদৌড়ি করছে হেডলাইটের আলো। অর্থাৎ কাছেপিঠে কোনো বসতিই নেই। বড় মায়া হলো রোমনের জন্য। বেচারা খুব আশা করে এসেছিলো স্টেশনের আশপাশের কোনো ভাঙা হোটেলে ভুরিভোজ করবে। গরম ভাতের সাথে ডিমের ঝোল নিয়ে চেটেপুটে খাবে। তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে।

সেই ঢেকুর তোলার জন্য মরিয়া হলাম তিনজন। যারপরনাই ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করলাম। আমাদের অস্থিরতা অনুমান করে আড়াআড়িভাবে এক চোখ খুললেন পিলারের সাথে গুটিয়ে থাকা বুড়ো। সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, খাবারের সন্ধান পাবো কোথায়? শরীর কাঁচুমাচু করতে করতে তিনি যা জানালেন, তা আরো হতাশাজনক। এই রাত্তিরে নাকি কোথাও খাবার পাবার সম্ভাবনা নেই। তবে শহরের দিকে যেনো একবার চেষ্টা করে দেখি। তারপর ঠাস ঠাস করে পেটে, হাতে দুইটি চাপড় মারলেন তিনি। সম্ভবত টার্গেট মিস হয়নি। মশাগুলোকে আচ্ছামতো ডলা দিয়ে আইম আইম করতে করতে আবার নির্জীব হয়ে গেলেন বুড়ো।

আমরা তখন মানসিকভাবে নির্জীবের পথে। পেটে ফুয়েল না থাকলে শরীরে জঙ ধরে। হাঁটতে গেলে কট কট করে। জাগতে চাইলে চোখ ঢলে আসে। খিটমিটে মেজাজ নিয়ে পা বাড়ালাম স্টেশনের বাইরের দিকে। শান্ত স্টেশন, ফুলের ঘ্রাণ সবই তখন আমাদের কাছে বিষ। আরে দেখো দেখি কী কা-, স্টেশনের বাইরেই একটা রিকশা দাঁড়ানো। আমাদের চেয়ে বেশি আগ্রহ দেখালো রিকশাওয়ালা। তটস্ত হয়ে রিকশার সিট মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো। বয়স ত্রিশ কি বত্রিশ হবে। চোখদুটো বলের মতো বের হয়ে আসছে। তবে বড়সর চোখের সাথে গলার স্বর একেবারেই বেমানান। মিনমিনে গলায় কী যেনো বললো ঠিক ধরতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম- এখানে ভাতের হোটেল পাওয়া যাবে কোথায়?

ভাতের হোটেল! এই রাইতের বেলা!
হুম
হহ্ পাওয়া যাইবো। রিকশায় ওঠুইন।
ওর অতি উৎসাহে খটকা লাগলো আমাদের- কোন যায়গায় পাওয়া যাইবো?
গাছপালার ফোকল গলে ছুটন্ত হেডলাইটের আলোর দিকে আঙ্গুল তাক করে জানালো, এই বিশ্বরোডে ওঠে ডান দিকে গেলেই পাওয়া যেতে পারে।
শহর কোন দিকে?
বাম দিকে যাইতে অইবো?

খটকাটা আরো বেশি জাঁকিয়ে বসলো। শহর বাম দিকে, আর হোটেল পাওয়া যাবে ডান দিকে! সবার মনে একই প্রশ্ন। কিন্তু কেউ কাউকে বলছি না, মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি কেবল। তবুও বললাম- ঠিক আছে আমরা যাবো, ভাড়া কত নিবা?
একশো’ ট্যাকা।

যাক বাবা, রিকশাটা না করার একটা উপায় পাওয়া গেলো। বেশি দাম চেয়েছে ভাব দেখিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম তিনজনই। পেছন থেকে মিনমিন করতে করতে আরো কী যেনো বললো রিকশাওয়ালা। আমরা পাত্তাই দিলাম না। মধ্যরাতে রিকশায় ওঠে আবার কোন বিপদ ডেকে আনি!
টাঙ্গাইলে এর আগেও গিয়েছি, তবে বাসে করে। তাই স্টেশন ও স্টেশন রোড সম্পর্কে মোটেও ধারণা ছিলো না। আমরা এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। স্টেশনের ঠিক পেছনেই একটি পার্ক। কাঁটাতারের বেস্টনিতে ঘিরে রাখা হয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক লম্বা এলাকা নিয়ে সাজানো। ভেতরে থেকে থেকে বৈদ্যুতিক আলো জ্বালানো। পায়ে হাঁটার সলিং পথ, মাঝখানে লেক।

কিন্তু পার্কে ঢোকার কোন মুখ খোলা নেই। নেই কোনো প্রহরীও। রেললাইনকে বামে আর পার্ককে ডানে রেখে একটি পিচঢালা পথ হারিয়ে গেছে দূরের অন্ধকারে। আমাদের সামনে কেবল এই পথটিই খোলা। সুতরাং পা চালাও।
নিশিদলের সাহসি সদস্যরাও কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। ঢিপ ঢিপ করছে বুকের ভেতর। সম্ভবত অচেনা যায়গা বলে। তাছাড়া মাত্র কয়েকদিন হলো নগদ দশ হাজার টাকাসহ পনেরো হাজার টাকা দামের মোবাইল সেট খোয়া গেছে রোমনের। গলায় কিরিচ ধরার পর সযতেœ ছিনতাইকারীর হাতে তুলে দিতে হয়েছে সব। তাই আমা

দের এ নিশিট্রিপে ছবি তোলার কোনো বন্দোবস্ত রাখিনি। গলায় দামি ক্যামেরা ঝোলানো থাকলে সেটাই বিপদ ডেকে আনার জন্য যথেস্ট।
ঘন অন্ধকারের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছি আমরা। ঝিঁঝিঁর ডাক, গাছের পাতার শন শন, আর ক্ষুধার্ত পেটের বিদ্রোহ সাথে নিয়ে রওয়ানা হয়েছি। বড়জোর চল্লিশ কদম এগিয়েছি। ফিসফিস করে উঠলো তুহিন- রিকশাওয়ালাটা এদিকেই আসছে।

তড়াক করে ঘুরলাম। দেখে মনে হলো এক চক্রাকার আলোর উৎস থেকে ধেয়ে আসছে ওটা। শান্ত ছন্দে ঘুরছে সামনের চাকা, গতি ধীর। দুই পাশের অন্য দু’টি চাকাই যেনো টাল। টলটল করে ঘুরছে। আর ড্রাইভারের সিটে বসে আছে ভয়ঙ্কর এক পিশাচ। ডিস্কু ড্যান্সারের মতো কোমর দোলাচ্ছে, প্যাডেল মারছে। আর নীল বার্তা নিয়ে এগুচ্ছে রিকশাটা।

আমরা তখন থেমে গেছি। আটকে গেছি ঘোরে। সামনেও যাচ্ছি না, পেছনেও না। যায়গায় স্থির। শুনেছি রাতের স্টেশনে অনেক পিশাচেরা আসে রিকশাওয়ালা সেজে। যাত্রী নিয়ে ওরা সেঁধিয়ে যায অন্ধকার জঙ্গলে। তারপর কটরমটর শব্দ তুলে যাত্রীদের হাড় চিবায় আর পৈশাচিক উল্লাস করে। এই মিনমিনে রিকশাওয়ালাটা এমন কোনো পিশাচ নয়তো?

আমাদের কাছে এসে গতি স্লো করলো। মিনমিনে গলায় কী যেনো বললো। কিন্তু আমরা ওরচেয়েও মিনমিনে হয়ে গেলাম। ওর কথা শুনতেও পেলাম না। কিছু বলতেও পারলাম না। কেবল আতঙ্কে নীল হয়ে আবার ঘুরলাম। ফিরে যেতে লাগলাম স্টেশনে। রিকশাওয়ালা বলের মতো চোখ দুটি বের করে দিলো। শেষবারের মতো দেখলো আমাদের। তারপর সুরসুর করে হারিয়ে গেলো অন্ধকারে। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা।

বাঁচলাম বটে। তবে পেটের তো বিহিত করতে হবে। কিন্তু সামনে অন্ধকার। খেতে হলে অন্ধকার সাঁতরেই যেতে হবে। আল্লাহ ভরসা, বলে রওয়ানা হয়ে গেলো তুহিন। পেছন পেছন বাকি দু’জনও। পিচঢালা পথ ধরে অনেকটা এগিয়ে গেছি। সামনে তিন রাস্তার মোড়। হাতের বাম দিকে একটি পথ, আর ডান দিক থেকে মোড় নিয়েছে অন্য একটি। কোন পথে যাবো? বিচার বিবেচনা করে ডান দিকে যাবার সিদ্ধান্তই নিলাম। হাঁটছি তিনজন। কথা বলছি পরষ্পর। স্মরণ করছি ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর কাহিনী। লাশ, খুন, রক্ত ইত্যাদি। হাঁটছি সারি করে। নয়তো দেখা যাবে, হঠাৎ পেছন থেকে একজন নাই। পশ্চিমা হরর ছবির মতো এমন ঘটনা ঘটলে মহা ফ্যাঁসাদে পড়বো। ঢাকা থেকে গুনে গুনে তিনটি মাথা নিয়ে রওয়ানা দিয়েছি। একটি টাঙ্গাইলে রেখে গেলে পরিবারে জবাব দেয়া কঠিন। বিশেষ করে সদ্য বিবাহিত রোমনের মাথার নিরাপত্তা একটু বেশিই প্রয়োজন। তাই রোমনকে মাঝখানে রেখে চললাম তিন নিশিকুটুম্ব।

তিনটি মাথা অক্ষত রেখেই আমরা গিয়ে পড়লাম মহাসড়কে। মিনিট পনেরো লাগলো। এবার হ্যাডলাইটের আলোগুলো আর দূরে নয়। আমাদের চোখের সামনে দিয়েই ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটছে গাড়ি। বড় বড় বাসের যাত্রীদের দেখে মনে হলো যুগ যুগ ধরে মানুষের দেখা পাই না। আধুনিক বাহনে চলন্ত মানুষের দেখা পেয়ে নিজেরা মনুষ্য প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত বলে গর্ববোধ করলাম।

আমাদের ভাগ্য ছিলো সুপ্রসন্ন। চলন্ত মানুষ ছাড়াও মহাসড়কে স্থির জীবন্ত মানুষের দেখাও পেয়ে গেলাম। তবে ‘কিন্তু’ আছে। ওরা সাধারণ মানুষ নয়, পুলিশ। আমরা যে দিকটা থেকে এসেছি এর বিপরীত পাশে দায়িত্বরত হাইওয়ে পুলিশ। মহা উৎসাহে এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে।
সাধারণত যা হয় এবারও তাই হলো। প্রথমে সন্দেহের চোখে দেখলো আমাদের। তারপর যথাযথ পরিচয় পেয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ালো। তবে ওদের আন্তরিকতার হাতটা আমাদের তেমন কাজে না এলেও শহরের লোকেশনটা অন্তত জানতে পেরেছি। শহরে যাওয়ার দুই পদ্ধতি। এই মোড় থেকে হাইওয়ে ক্রস করে সোজা একটি রাস্তা শহরে চলে গেছে। তবে বললো, এতো রাতে এ পথ নিরাপদ হবে না। পরামর্শ দিলো, একটু ঘুরপথ হলেও বাইপাস রোড ধরে যাওয়াটা ভালো।

বাইপাস রোডের দূরত্ব কত হবে?
বড়জোর দুই কিলোমিটার।
আমরা তিন সাহসি হন্টকের কাছে এই দুই কিলোমিটার কোনো ব্যপারই না। তবে তখনকার পরিস্থিতিটা ছিলো ভিন্ন। মোটামোটি সবার পেট ছিলো অতিমাত্রায় খালি। আমি সেই যে সকালে নাস্তা করেছি, তারপর আর পেটে কিছু পড়েনি। সহকর্মী সোহেল অটল মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় আহত হওয়ায় দৌড়াদৌড়ির ওপর ছিলাম। অন্যদের অবস্থাও তাই। তবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও তো খাবার কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। সুতরাং খেতে হলে যেতে হবে।

হাঁটার বিনিময়ে খাদ্য। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য। বাঁচতে হলে খেতে হবে। এমন কয়েকটি স্লোগান ঠিক করে আমরা চললাম। চললাম হাইওয়ে ধরে। হুঁস হাঁস করে আমাদের পাশ কাটাচ্ছে বাস-ট্রাক। চোখ ধাঁধাচ্ছে হেডলাইট। আতঙ্কে আছি কখন আনমনা একটি ট্রাক এসে হেলতে দুলতে আমাদের পিষে চলে যায়। আর সম্ভবত ওরা আতঙ্কে আছে, কখন রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে আমরা হাত উঁচু করে ওদের থামতে বলি। একেকটি বাস একেকটি ট্রাক আমাদের অতিক্রম করতে পেরে হাঁফ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা হাঁটছি খাদ্যের সন্ধানে। হাতের ডানদিক ধরে হাঁটছি। হাঁটছি হাইওয়ের দু’পাশের গাছগুলোর ইশারায়। বেয়াড়া বাতাসে পতপত করে পতাকার মতো শব্দ তুলছে কলার পাতা। আমরা হাঁটছি বীরদর্পে। শরীরে শক্তি নেই, তবুও। দুই কিলোমিটার পথকে মনে হলো তিনদুগুণে ছয় কিলোমিটার।

অবশেষে ছয় কিলোমিটার মানসিক দূরত্বের পথ পাড়ি দিয়ে একটি মোড়ে এসে থামলাম। আমরা মোটামোটি নিশ্চিত এখান থেকে ডানদিকে যে পথটি গেছে সেটাই টাঙ্গাইল শহরের। তবে বাইপাস সড়ক ধরে একটু সামনে কিসের যেনো আলো জ্বলছে।

ধারণা করলাম তেল নেয়ার পাম্প। কিম্বা কোনো হোটেল। আবার এসবের কিছুই না হতে পারে। দেখা গেলো আরো দেড় কিলোমিটার মানসিক দূরত্ব পাড়ি দিয়ে হতাশ হতে হলো। গিয়ে দেখলাম হোটেল বন্ধ। কিম্বা ওটা পাম্পও নয়, হোটেলও নয়। অতিবুদ্ধিমান আমরা উজ্জ্বল এই আলোর উৎসটাকে মরিচিকা ভাবলাম। এর খেসারত দিতে হলো ডান দিকে মোড় নিয়ে শহরের দিকে আরো চার কিলোমিটার মানসিক দূরত্ব হেঁটে। শহরের ভেতর পা রাখার পর এক রাতপ্রহরী আমাদের বোকামিটা ধরিয়ে দিলো। শহরে প্রবেশ করার পরও আরো অনেকটা পথ হাঁটতে হলো আমাদের। বিশ্বাস বেতকা, আট পুকুর এলাকায় দুই রাতপ্রহরী ছাড়া আর কোনো প্রাণীর দেখাই পেলাম না। টাঙ্গাইলের মহল্লাগুলোর নাম খুব শ্রুতিমধুর। যেমন নগরজলফৈ, আকুরটাকুর পাড়া, প্যারাডাইস পাড়া, নিরালার মোড়। কারা কবে এমন সুন্দর নাম রেখেছিলো জানার কৌতুহল হলো।

কিন্তু কৌতুহল মেটানোর কোনো সুযোগ না পেয়ে আপাতত রাতপ্রহরীর দেয়া মানচিত্র অনুযায়ী আমরা হাঁটতে লাগলাম। মানচিত্রটা তেমন জটিল নয়, সোজা পথ ধরে হাঁটলেই পুরাতন বাস স্ট্যান্ড। তারপর ওখানে খাবারের দোকান খোলা থাকলেও থাকতে পারে।
সেই আশাতেই ভরসা। পৌঁছলাম পুরাতন বাস স্ট্যান্ড এলাকায়। দূর থেকেই একটা সরগরমের উত্তাপ পেলাম। কয়েকটা দোকান খোলা। সামনে কিছু খালি রিকশা দাঁড়ানো। মনুষ্যবিবর্জিত এলাকা পেরিয়ে হঠাৎ এতগুলো মানুষ দেখে ইচ্ছে হলো রাস্তায় গড়াগড়ি করেই ঘুমিয়ে যাই। জোড়ায় জোড়ায় অবশ হয়ে এলো শরীর।

কিন্তু নাহ, আগে খাবারের সন্ধ্যান। তারপর আরামের ব্যবস্থা। এখানে একটি কথা বলে রাখি, ভ্রমণের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যতবারই আমরা আরাম খুঁজতে গিয়েছি, ততবারই বেকায়দায় পড়েছি। এমনকি আমরা যে ট্রেনে চড়ে ঢাকায় ফিরেছিলাম সেখানকার ঘটনাটাও বেকায়দার। একটু খুলেই বলি- ফেরার ট্রেনে টিকিট না পাওয়ায় আমরা দাঁড়িয়েছিলাম। ট্রেন হুঁইসেল বাজিয়ে প্লাটফরম ছাড়ার পরই সিঁড়িতে পা রেখে বসেছিলো তুহিন ও রোমন। ঘুমে ওরা ঢুলছিলো। ঢুলতে ঢুলতে যে কোনো সময় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই আমি দাঁড়িয়ে থেকে একটু পর পর সজাগ করিয়ে দিচ্ছিলাম ওদের। অবশেষে বিরক্ত হয়ে তুহিন ওঠে দাঁড়ালো। কিন্তু রোমনকে জোর করেও দাঁড় করাতে পারলাম না।

সময় কখন কোন দিকে মোড় নেয় বলা কঠিন। কিছুক্ষণ পর রোমন নিজেই ওঠে দাঁড়ালো।
কিন্তু কেন?
প্রচণ্ড বিরক্ত এবং মলিন মুখে ওর ডান পাটা এগিয়ে ধরলো আমাদের চোখের সামনে।
ওহ্্হো, ওয়াক্্ থু।
রোমনের প্যন্টভর্তি তাজা পায়খানা!

পাঠক, নির্দোষ রোমনকে শুধু শুধু ভ’ল বোঝবেন না। এই পায়খানা রোমনের নয়, ওড়ে এসেছে ট্রেনের টয়লেট থেকে। ও পা রেখেছিলো বাম দিকের সিঁড়িতে। আর ট্রেন যেদিকে যাচ্ছে সেদিক বরারর একটু সামনেই এই কামরার টয়লেট। তখন কেবল সকাল হয়েছে। টয়লেটের সামনে যাত্রীদের অস্থির লাইন। আর সেই সময়ই কোনো এক যাত্রীর প্রাকৃতিক কর্মটি বাতাসের অনুকুলে ভেসে এসে লেপ্টে গেলো রোমনের প্যান্টে।

ঘটনাটা রোমনের বউ জানেন কি না জানা নেই। জেনে থাকলে রোমনকে ঘরে ঢোকতে দিয়ে উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। অবশ্য সবসময়ই তিনি উদার। আমাদের মতো এমন বখে যাওয়া ছেলেদের সাথে স্বামীকে ট্রিপে পাঠানোও একটা উদারতার পরিচয়।
যাই হোক, ফিরে যাই আগের কথায়।

পুরাতন বাস স্ট্যান্ড এলাকায় তিনটি দোকান খোলা পেলাম। সবগুলোর সামনে বড় করে মাচান দেয়া। দূর থেকে মনে হয়েছিলো ভাত পেলেও পেতে পারি। কিন্তু মাচানে বসেই সে আশা উবে গেলো, ভাত তো নেই-ই বরং রুটিও নেই। আছে কেবল কয়েকটি বেকারি আইটেম। এমন দুঃসময়ে এটাও মন্দ নয়। হঠাৎই চোখ গেলো মাঝখানের দোকানটায়- কয়েকটি মালাইভর্তি গ্লাস সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেখেই প্রচন্ড লোভ হলো। দূর্বল শরীরে মালাই খেয়ে নিলে শক্তি পাওয়া যাবে। চেখে খাওয়ার আগে চোখেই যেনো খেয়ে ফেলছি। চকচকে চোখে বিশ্রীভাবে তাকিয়ে রইলাম গ্লাসের দিকে। লোভাতুর আবেদন নিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম দাম কত?
ষাট টাকা গ্লাস।

সম্ভবত আমাদের চোখের ভাষা পড়তে পারলো দোকানি। এ কারণেই আকাশচুম্বি দাম চেয়ে আর নড়চড় করলো না। এতো মুলামুলি করার ধৈর্য্যও আমাদের ছিলো না। দাম যতই হোক, মালাই না খেয়ে উঠছি না। গ্লাস হাতে নিয়ে বেশ আয়েশ করে বসলাম। ঘন মালাই, গিলতে একটু সময় নেবে।
কিন্তু না, আমাদেরকে একেবারে হতাশ করে দিয়ে মুহূর্তের মাঝেই ঢক ঢক করে গলার ভেতর চলে গেলো তরল। আসলে গ্লাসের উপরের দিকে ঘন মালাই থাকলেও নিচে কেবল তরল ছিলো।

মেজাজ খারাপ হলো, কিন্তু দেখানোর মতো শক্তি নেই। বিমর্ষ মনে দাম চুকিয়ে, কয়েকটা বেকারি আইটেম খেয়ে আবার সন্ধ্যান করতে লাগলাম ভাতের হোটেল।
জিজ্ঞেস করলাম রিকশাওয়ালাদের। ওরা বললো ভাতের হোটেল এখন কোথাও পাওয়া যাবে না। তবে রুটির হোটেল পাওয়া যেতে পারে।
কোথায়?
পার্কের বাজার।
ঘুরাও চাকা। চালাও পঙ্খিরাজ।

আমোদে রিকশাওয়ালা আমাদের নিয়ে পঙ্খিরাজের মতোই ছুটলো। হাসলো, গাইলো। শহরের সাথে পরিচয় করালো। এটা ওটা দেখালো। শূন্য রাস্তায় ডানে হাত বাড়িয়ে চিৎকার দিলো- এই ডাইনে যাইবো। আবার বামে মোড় দেয়ার প্রয়োজন হলে- বায়ে যাইবো। একবার ডাইনে, একবার বায়ে মোড় নিতে নিতে কিছুক্ষনের মাঝেই চলে এলাম পার্কের বাজার। পথে কোনো মানুষের দেখা পাইনি। কেবল একটা লেজ কাটা শিয়ালকে দেখলাম ময়লা নিয়ে টানাটানি করছে। আমাদের রিকশা দেখেও ওটা ভাবলেশহীন। কাছে গিয়ে ধাওয়া দেয়ার পরও নড়ছিলো না। কটরমটর করে তাকিয়ে ছিলো। যেন রিকশায় বসা না থাকলে একচোট দেখে নিতো আমাদের। এটা বঙ্গবীরের এলাকা। এখানকার শেয়ালদের এমন দাপট থাকাটাই স্বাভাবিক।

টাঙ্গাইলের পার্কের বাজারকে বলা যায় ছোটখাটো এক কাওরান বাজার। ঢাকার কাওরান বাজারের মতোই সেখানে প্রতি রাতে কাঁচামাল লোড-আনলোড হয়। এর আশাপাশে কোনো পার্ক নেই, তবুও অ™ভ’ত কারণে একে পার্কের বাজার বলেই ডাকা হয়। ছোট একটি খালি যায়গার তিন পাশ ঘিরে অসংখ্য ছাপড়া। মাঝখানে ট্রাক, লরি, টমটম আর কাঁচামালের বস্তা। আশপাশে ব্যস্ত শ্রমিক-কুলিদের ছোটাছুটি।
হ্যাঁ রুটি এখানে মিললো।

আমরা পার্কের বাজারের ছাপড়ামতো একটি হোটেলে জ্বলন্ত চুলার শব্দ পেলাম। এই শব্দটাই মনকে চাঙ্গা করে দিলো। পেট অর্ধেক ভরিয়ে দিলো। ভাঙ্গা কয়েকটি টেবিল, টোল দখল করে শ্রমিকেরা হু হা ফুঁ দিয়ে গরম রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। চা দিয়ে ভেজাচ্ছে। আবার একটু ডালে মাখাচ্ছে। পাশেরজনকে জোরাজুরি করছে রুটির অর্ধেক নেয়ার জন্য।

আমরা ঠেলেঠুলে একটি টেবিল দখল করে নিলাম। বলা যায় শ্রমিকেরা একরকম সম্ভ্রমের সাথে আমাদের যায়গা করে দিলো।
অতি খিধেয় রুটির সাথে ডিম মামলেট, সব্জি¦ ও ডাল তিনটাই অর্ডার করলাম। পরে অবশ্য ডালের মান খুব নিচু বলে সেটা বাতিল করা হয়েছিলো।
তেলছাড়া ভাজা রুটি যখন আমাদের সামনের টেবিলে রাখা হলো, ধুয়া উড়ছিলো। ধুয়া উড়ছিলো ডিম মামলেট থেকেও। সাথে কেটে দেয়া হলো কাঁচা পেয়াজ, কাঁচা মরিচ। তাতেও তুহিনের মন ভরলো না। খোলা মাঠে আনলোড হওয়া একটি বস্তা দেখিয়ে দোকানের ছেলেটাকে ইশারা করলো তুহিন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বস্তা থেকে হ্যাঁচকা টানে দুইটি শশা খুলে নিয়ে এলো ছেলেটা। যাচাই বাছাই করে কচি শশাটি আমাদের কেটে দিতে বললাম। মুহূর্তের মাঝেই আরো একটি প্ল্যাটে চলে এলো কাটা কচি শশা।

বাহ চমৎকার, অতি চমৎকার। গো গ্রাসে খেতে আরম্ভ করলাম। খাওয়ার ব্যপারে আবার আমার কোনো প্রতিযোগি নেই। একটানা গো গ্রাসে ঘাস, লতা, পাতা সবই হজম করে দিতে পারি। নিজেরটা খেয়ে পাশের জনকে খাওয়ায় সহযোগিতা করতে পারার সুনাম আমার সবসময়ই আছে।
সম্ভবত ভালো খেতে পেরেছিলাম বলেই ফেরার সময় আমার জ্ঞানবুদ্ধি ঠিক ছিলো। ঘুমে চোখ জড়ালেও মাথা জড়ায়নি। অথচ এলোমেলো হাঁটতে গিয়ে পায়ের স্যান্ডেল খোয়াতে হলো তুহিনকে। নাহ, কোনোভাবেই ছেঁড়া স্যান্ডেল আর জোরা লাগানো গেলো না। রিকশায় ওঠার আগেই সুদুর টাঙ্গাইলে তাকে বিসর্জন দিতে হলো স্যান্ডেলজোড়া।

ফিরতে গিয়ে আবার সেই আমোদে রিকশাওয়ালার সাথে দেখা। বেশ আমোদ করেই বললো- রাইতের বেলা যেহাইনেই যাইবাইন, আমারেই পাইবান।
আমরাও তার রিকশায় চড়ে রওয়ানা দিলাম রেল স্টেশন অভিমুখে। রিকশাওয়ালা মধ্যবয়স্ক। থুতনিতে লম্বা দাড়ি। এবার সে নতুন বাসস্ট্যান্ড হয়ে, বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে আমাদের নিয়ে চললো। আমরা তখন চলে এসেছি রাতের কিনারায়। কিছুক্ষণ পরই সূর্য্য উঠবে। আমরা সেই পথে ফিরে যাচ্ছি, যে পথ ধরে না আসার পরামর্শ দিয়েছিলো পুলিশ। রিকশাওয়ালাও পুলিশের আশঙ্কার সত্যায়ন করলো। মাঝ রাতে এই স্টেশন রোডে কয়েকটি ছিনতাইকারি দল সচল থাকে। অনেকের রিকশাও নাকি নিয়ে নেয় ওরা।

আমাদের রিকশা যখন হাইওয়েতে এসে উঠলো, তখনই ফজরের আজান ভেসে এলো। প্রকৃতি জুড়ে একটা কোমল চাদর ছড়াতে আরম্ভ করলো। আকাশ ফেটে যেনো সূর্যটার জন্ম হবে। আর পিচঢালা কঠিন মহাসড়কটাকেও মনে হচ্ছে মোলায়েম, পবিত্র। যেনো ছুইঁয়ে দিলেই জেলির মতো থল থল করবে। বাইপাস রোডের এই চাররাস্তার মোড়েই দাঁড়িয়েছিলো টহল পুলিশেরা। ওদেরকে আর দেখা গেলো না।

তারপর রিকশা চললো সেই পার্কের পাশ দিয়ে। তবে এবার কোনো ভয় ভীতি সাথে নেই। নেই কোনো পিশাচ আতঙ্ক। রিকশায় বসেই আমরা বরণ করে নিলাম নতুন আরেকটি দিনকে।

নামলাম রেলওয়ে স্টেশনে। দেখলাম গুটিমেরে থাকা সেই চাচা আর সেখানে নেই। স্টেশনে এলোমেলো পায়চারি করছে দু-চারজন যাত্রী। আর ফুলের কড়া গন্ধটা আরো কড়া হয়ে উঠেছে।

তখন চারটা বেজে ৩৫ মিনিট। জানতে পারলাম পাঁচটায়ও ট্রেন আছে। আশান্বিত হলাম। অথচ গত রাতে প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলেছিলেন ছয়টার আগে ট্রেন নেই।
এই সময়টুকু কাটানোর জন্য আমরা চলে গেলাম প্লাটফরমের চাতাল ছাড়া অংশে। খোলা আকাশের নিচে একটা বেঞ্চি দখল করে বসলাম। ঘন গাছ থেকে হঠাৎই একটি পাখি ডেকে উঠলো- কুউ কো, কুউ কো (রেখার মাগো)/ কুউ কো, কুউ কো (ট্যাকা দ্যাও গো) বেঞ্চির সামনে এক ঝাঁক ভাতশালিক উড়ে এসে খুঁটতে শুরু করলো। তুহিনের চোখ বন্ধ হয়ে এলো। বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পরলো রোমন। আর চোখ খুলে রেল লাইনের স্লিপার ধরে ভাত শালিকের রাজকিয় চলনে মনযোগ দিলাম আমি।

ট্রেন আসতে খুব দেরি নেই। হুঁইসেল শোনা যাচ্ছে। কয়েকমিনিট পরই টাঙ্গাইলের একটি রাতকে পেছনে ফেলে তিন নিশিকুটুম্ব ফিরে যাবো ঢাকায়। বেঁচে থাকলে আবার নামবো অন্য কোনো নিশিতে।