তখন মাত্র কয়েক মাস হবে  আমি বাবা ছাড়া হয়েছি। বড়ই অকালে  উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত বাবার দামী কলম গুলু যদিও আমার পকেটে বেমানান তবুও প্রতিদিন একটা করে পকেটে গুজে স্কুলে যাই। সহপাঠিদের চোখ ছানাবড়া হয়।

জৌষ্ঠের প্রথম দিক। প্রতি বছরের মতো স্কুলের খালে বর্ষার নতুন পানি। হটাত করেই, একদিন সকালে  দেখি খালে  বেদের বহর এসেছে। এভাবেই আমি   ক্লাশ মনোযোগী না, শিক্ষকের কথায় কর্নপাত দূরের কথা বরং  ক্লাশরুম এর জানালা গলিয়ে গুপ্তবাবুর পুকুরের লাল পদ্ম, বাবুর বাড়ির সিংহ দরজার উপরে কোন এক গুপ্তের আধেক ভাঙ্গা মুর্তি, কদম গাছে মান্দাল পিপড়ার লংমার্চেই আমার দৃষ্টি নিবন্ধনে স্বাচ্ছন্দ বোধ করি । ক্লাশ  থেকেই অপলক চোখে তাকিয়ে দেখি বেদে বহর। সময় পেলেই ছুটে যাই বহরের কাছে। তীর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি- কি দারুন,  নাও সংসার।  কবুতর, মুরগী, বিড়াল  সবই তো আছে ওদের বহরে। বহরের মধ্যে একটি নৌকার গঠন গাঠনই ছিলো আলাদা। উজ্জ্বল রঙ এর কাজ কারবার । আঁকা ছবিতে  গাছ পালা, পাখী ,পদ্মফুল সাপ ময়ূরীর খেলা। আমি এগিয়ে যাই। সুন্দর দুটো চেয়ার নৌকার দুয়ারের পাশে। চেয়ার দুটো না যত সুন্দর তার চেয়ে বেশী সুন্দর  যারা চেয়ারে  উপবিষ্ট  ওরা ।  আমি অপলক দৃস্টিতে তা’কিয়ে রই।

ওদের খিল খিল হাসিতে সহসাই আমি হয়ে উঠি “পু্রুষত্তোম”, সাপ ময়ূরীর খেলা টা যেনো জীবন্ত হয়ে উঠে। সম্বিত ফিরে পাই, যখন অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলতে শুনি “ আয় না,  না’য়ের উপরে” আমি উঠার আগেই অতি আগ্রহী রাজনৈতিক দলের কর্মীর মতো আমার সহপাঠিরা আমাকে ঠেলে দেয় আমার কাংখিত মঞ্চে। পার থেকে কুড়ি বিশ জন আমাদের কে দেখছে। নিজেকে নায়ক রাজ ভাবতে শুরু করি নিমিষেই। ওদের শরীর থেকে আলতা, স্নো , পাউডার , লিপষ্টিক এর গন্ধে আমি বিমোহিত হতে থাকি। এক চেয়ারে আমাকে বসানো হয়।  চেয়ারের দু’হাতলে ওরা দু’জন বসে যায় । ওদের বাকচারীতা আমার কানে মধূবর্ষিত হয়। একজন বলে উঠে – দে ‘ না তোর নামটা আমার হাতে লিখে… নিজকে বিশ্বের সবেচে বড়  সেলিব্রেটি ভেবে আমার অকালত্বত্তীয় অটোগ্রাফের উল্কি টা এঁকে দিই বেদেনীর  হাতে। পরপরই দ্বিতীয়জন “ ওমা কি সুন্দর!!  দে না আমাকেও”;  আহ!! কি দারুন আমার সুখানুভুতি। স্বয়ং  স্রষ্টা’র সাথে স্থায়ীভাবে স্বর্গবাসের চুক্তি স্বাক্ষরে ও আমার কাছে এত সুখকর হতো কিনা আমার জানা নেই।  শুনতে থাকি, ওরা দু’জন বেদে সর্দার কন্যা।  আমন্ত্রন পাই ওরা  যত দিন এই  ঘাটে আছে আমি যেনো সময় পেলেই ওদের কে দেখতে আসি। প্রতিশ্রুত বদ্ধ হয়ে নেমে আসি। হৃদয়ে হাস্যমুখিদের হাজারো স্ন্যাপশট আর প্রশাধনীর মৌ মৌ গন্ধে বাড়ী ফিরে আবিস্কার করি সদ্য উত্তরাধীকার সূত্রে প্রাপ্ত  প্রয়াত বাবা’র  প্রথম কলম খানি খোয়া গেলো।

সন্ধ্যায় মা’য়ের কলম সংক্রান্তীয় জেরা’তে  আমতা আমতা জবাবে সাময়িক পার পেয়ে যাই। পরের দিন, গুপ্তবাবুর বাড়ী, লালপদ্ম, মান্দাল পিপড়া, জগদীশ স্যার এর পড়ানো বড়ই অপরিচিত মনে হয়। ভাবি, ওরা আমায় হাত ইশারায় ডাকছে প্রতি নিয়ত। টিফিনের আগেই দে ছুট!!

পকেটে বাবা’র দ্বিতীয় কলম। সংকল্পে পরিকর এ কলম খোয়া যেতে দেবো না। চির পরিচিতের মতো নৌকায় উঠলাম। চেয়ারে বসলাম। ওরা আমার দু’পাশে দাঁড়িয়ে। গলা খাকর দিতে দিতে ছৈ এর নিচ থেকে বেড়িয়ে  এলো, বেদে সর্দার।  বেরিয়ে বল্লো-  “থানার পাশে বড় বড় রেইন ট্রী (গাছের) বাড়ীটাই তোদের তাই না”? আমি হা সূচক মাথা নাড়লাম।  – “তোদের বাড়ীতে তো গোখরা আর দাঁড়াশ সাপের আড্ডা, কাল যাবো  সাপ ও ধরে নিয়ে আসবো আর  তোদের গাছ থেকে কিছু ডাল পালাও আনবো ,বহরে লাকরীর (খড়ি) বড়ই অভাব” – মুহূর্তে  আমার অবসরপ্রাপ্ত,  বৃটিশ পুলিশ কর্মকর্তা, আলিগড় পড়ুয়া  দাদা’র চেহারা টা আমার চোখে ভাসতে থাকে কিন্তু ততক্ষনে  ওদের দু’বোনের দু’হাত আমার কাঁধে ভর করে আছে। আমি কোন কথা না বলেই, বলে দিলাম – অবশ্যই আসবেন। ঐ দিন বেশী ক্ষন আর নৌকাতে থাকা হলো না।  স্কুলে ফিরে এলাম। সারা ক্ষন ভাবছি –কি হবে  আগামীকাল?   গৃহশিক্ষকের পড়া শেস করে রাতে  যথারীতি বালিশ নিয়ে দাদুর ঘরে এসেছি। প্রতিদিনের মতো দাদু  হারিক্যানের আলোতে প্ত্রপতিকায় মাথাগুজে আছেন, আমি অপেক্ষায়,  আমার সাথে সমসাময়িক বিশ্ব নিয়ে আলোচনা করবেন। খানিক পরে, অবজারভার থেকে মুখ তুলে বললেন- “কি রে, বাইদ্দার ভেল্কী তে পরছস”? শুনলাম, সর্দারের মাইয়ার হাতে নাকি নাম লেখছ?  আমি কিছু বলছি  না। যখন বললেন – দেখবি  ওরা  তোকে  নৌকায়  করে চুরি করে নিয়ে যাবে- আমি আঁতকে উঠলাম।

পরের দিন যথারিতী সর্দারের নেত্রীত্ত্বে জনা বিশেক বেদে  মন্ত্র তন্ত্র  উচ্চারনে বাড়িতে এসে হাজির। দু’দলে বিভক্ত হয়ে এক দল চলে গেলো বাড়ির পেছনে ধূলো পড়া নিয়ে গোখরা, দাঁড়াশ এর সন্ধানে; আরেক দল চকিতে বানরের মতো ঊঠে গেলো রেইন ট্রী গাছে, মরাত ,সরাত করে ভাংতে লাগলো গাছের ডাল পালা… দু’বোন  অদ্ভুত ভংগিতে কোমর দুলিয়ে Ramp মডেলের ক্যাট ওয়াক করতে করতে গাইতে লাগলো  “সাপে সাপান্ত ,ভুতে  ভুতান্ত…ওরে কি সাপে কাটিলো লখাই’রে…

ভেতর বাড়িতে  উতসুক  প্রতিবেশী মহিলারা সমবেত হতে থাকে। আতংকিত, এই বুঝি ধরা পরে  গাভির দুধ চুরি করা দুধরাজ সাপ, অথবা  সন্ধ্যাতে পুকুর ঘাটের  পাথরের নীচে লুকিয়ে লুকিয়ে  ছোট মাছ শিকার  করা  গোখরা।

দাদু পিতলে বাধানো লাঠিটা  হাতে নিয়ে বাড়ীর সামনে। আমি পিছু পিছু। অসম্ভব  মুখ  খারাপ পুলিশি ভাষাতে দাদু গালাগাল করতে থাকেন কাছে চরা লোকজন দের। ওরা কাঁদো কাঁদো  জবাব দেয় – “খোকা বাবু ই তো  কাল বলিলে”  দাদু আমার দিকে তাকায়। আমি দাদুর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হা সুচক জবাব দেই। দাদু ওদের কে  বলেন – “যা নিয়েছিস নিয়েছিস  এখন নেমে  চলে যা”; ওরা আবার দল বেধে চলে যেতে থাকে।  দাদু আমার আংগুল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। বারে বারে  পেছন ফিরে দু’বোন তাকাচ্ছে আমার দিকে।  গান থেমে গেছে।

ওদের জন্য অনেক কষ্ট হচ্ছে, রাতে দাদু’র ঘরে শুয়ে আছি। দাদু বক বক করে গুন কীর্তন করে যাচ্ছেন বৃটিশ ভারতবর্ষ। বাতাস বইছে। পাহারা ওয়ালা বেরিয়ে গেছে “জাগো বস্তি ওয়ালা”  বলতে বলতে। থেমে থেমে ভেসে আসছে সমস্বরের  গান , দাদু কে জিজ্ঞাস করি – “দাদু। কিসের গান”? দাদু মাথা নিচুতেই জবাব  দেন – বেদে বহরটা মনে হয় চলে যাচ্ছে অন্য ঘাটে।  সাথে সাথে আমার মানস সেল্যূলয়ডে স্লো মো ঘটতে থাকে। এপাশ ও পাশে রাত কেটে যায়।

অনেক ভোরে দৌড়ে চলি বহর ঘাটে, বিশাল শুন্যতা।   নৌকা বাধার লগির গর্ত গুলু সদ্য, তাজা। কেনো জানি ভেতর  টা হু হু করে উঠে।   ঠিক যেখানে ওদের নৌকাটা বাধা ছি্লো ওখানটায়  তাকাতেই দেখি জলজ লতা পাতার নীচে অল্প পানিতে চকচক করছে চার দিন আগে হারিয়ে যাওয়া উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত  আমার সদ্য প্রয়াত  বাবা’র কলম।

 

ছবিঃ ইন্টার নেট থেকে সংগৃহিত।