আমরা লালে লাল হতে চেয়েছিলাম!ইয়াবা আর ফেন্সিডিল ব্যবসায় আদাজল খেয়ে নামার চ’ড়ান্ত সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম। ঢাকায় ফিরেই এ ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছি বলে কথা দিয়েছিলাম ঘোড়াশালের এক মাদক ব্যবসায়িকে। ঘোড়াশাল প্লাটফরমে তার সাথে পরিচয়। অপেক্ষা করছিলো চার লাখ টাকার চালানের জন্য। ইয়াবা আর ফেন্সিডিলের এ চালান আসছিলো আখাউড়া থেকে।ঘোড়াশাল প্লাটফরমে বসেই আখাউড়ার প্রতি একটা দূর্বলতা তৈরি হয়েছিলো আমাদের। তারপর আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম। ঘোড়াশালের সেই যুবক পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থে আমাকে ফোনও দিয়েছিলো দুইবার। আমরা ভাবলাম ব্যবসা যখন করতেই হবে, একটু জেনেশুনে পথ ঘাট চিনে করাটাই ভালো। তাই তাকে তেমন পাত্তা দিলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেরাই পরিদর্শন করে আসব মাদক ও চোরাচালানির স্বর্গরাজ্য সীমান্ত এলাকা আখাউড়া। অর্থাৎ নিশিদলের তৃতীয় গন্তব্য স্থির হলো আখাউড়া স্টেশন। আখাউড়া ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার একটি উপজেলা।

৫ সেপ্টেম্বর বৃহষ্পতিবার আমরা রওয়ানা হলাম আখাউড়ার উদ্দেশ্যে। নিশিদলের পুরাতন নিশাচর জাফর হায়দার তুহিন, মফিজুর রহমান রোমন এবং আমার সাথে এবার যোগ হলো নিশিপ্রার্থী সাইমুম সাদ। রাত ভ্রমণের অভিজ্ঞতাহীন কাউকে নিশিদলীয় পরিভাষায় বলা হয় নিশিপ্রার্থী। দলের সাথে একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারলেই নিশিপ্রার্থী থেকে নিশাচরে উন্নীত হওয়া যায়। জমজমাট ও রোমাঞ্চকর এ আখাউড়া ট্রিপের মাধ্যমেই নিশাচর পদবি অর্জন করলো সাদ। মোট চারজনের নিশিদল লালে লাল হওয়ার উদ্দেশ্যে কমলাপুর স্টেশনে এসে উপস্থিত হলাম।যাত্রার শুরুতেই হতাশ হতে হলো। মহানগর গোধূলী ছাড়ার কথা বিকেল তিনটা বিশ মিনিটে। কিন্তু প্লাটফরমের মাইকে ঘোষণা এলো চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা মহানগর গোধূলী কমলাপুর এসে পৌঁছবে বিকেল পাঁচটা বেজে তিরিশ মিনিটে।আমরা অপেক্ষায় থাকলাম। আগের দিনই টিকেট কেটে রেখেছি। ইচ্ছে করলে ফেরত দিয়ে অন্য ট্রেনেও যেতে পারতাম। কিন্তু ফেরত দেই দেই করে দেয়া হলো না। আর ওদিকে ট্রেন আসি আসি করেও আসছে না। অপেক্ষা করে আমরা নেতিয়ে পড়েছি। তবুও অপেক্ষা করছি। দেখছি যাত্রীর আনাগোনা। শুনছি ট্রেনের হুঁইসেল। পায়চারি করছি। চা খাচ্ছি। সেকেন্ড, মিনিট করে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে ঘন্টার পর ঘন্টা।অবশেষে ট্রেন এলো। রাত আটটা বেজে তিরিশ মিনিটে দাম্ভিক হুঁইসেল বাজাতে বাজাতে প্লাটফরমে প্রবেশ করলো মহানগর গোধূলী। আমরা ভাবলাম আসতে যেহেতু দেরি হয়েছে, সম্ভবত দ্রুতই ছেড়ে যাবে।

কিন্তু বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই এই দাম্ভিক ট্রেনটার। আমাদেরকে পেটে চালান করে দিয়ে অলস অজগরের মতো প্লাটফরমে পড়ে রইলো আরো এক ঘন্টার মতো। তারপর একটু ইঞ্জিনে টান দেয়, আবার পিছিয়ে যায়। এভাবে ছাড়ি কি ছাড়ি না করতে করতে অবশেষে ড্রাইভারের সুমতি হলো। কমলাপুর ছাড়িয়ে খিলগাঁও রেলগেট ক্রস করার পর আমরা একরকম শান্ত হয়ে বসলাম। তাও অপূর্ণতা থেকে গেলো।আমাদের মোট চারটি টিকেট। আশা করেছিলাম চারজন একসথে পাশাপাশি ও মুখোমুখি বসে আলাপ করতে করতে যাবো। কিন্তু সিটবিন্যাসের কারণে দুইজন দুইজন করে ভাগ হয়ে বসতে হলো আমাদের। তুহিন ও রোমন পাশাপাশি যে দুটি সিটে বসেছে, আমাকে ও সাদকে বসতে হলো এর উল্টো দিকের দুটো সিটে। সাঙ্ঘাতিক রকমের অস্বস্তি। কোনোভাবেই আলাপ জমছে না। আলাপ করার জন্য তুহিনকে বার বার ওঠে আসতে হচ্ছে আমাদের এখানে।পরামর্শ করলাম এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। অন্য যাত্রীদের সাথে সিট বদল করে হলেও চারজন একসাথে হতে হবে। চেষ্টাও করলাম। কিন্তু বিনাটিকেটের যাত্রীরা সিট হারানোর শঙ্কায় আমাদের প্রস্তাবে রাজি হলো না। আমরাও মানবিক বিবেচনায় চাপাচাপি করলাম না। রোমন ও তুহিনের মুখোমুখি সিটে বসা দুই যাত্রী নরসিংদী স্টেশনে নামবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। অপেক্ষায় রইলাম। তবুও অস্বস্তি আমাদের পিছু ছাড়লো না।রোমনকে সিটের পাহারায় রেখে কিছুক্ষণের জন্য আমার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো তুহিন। দাঁড়ানোরও জোঁ নেই। ট্রেন ভর্তি যাত্রী।

গায়ের ওপর ঢলে পড়ছে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে সে নিজের সিটে ফিরে গেলো।মিনিটখানেক পর অনুভব করলাম কোথায় যেনো উচ্চবাচ্য হচ্ছে। যাত্রীদের শোরগোলের ভেতর তুহিন ও রোমনের উচ্চকিত গলাও ভেসে এলো। আমি উল্টো দিকে তাকালাম। দাঁড়ানো যাত্রীদের জন্য কিছুই দেখতে পেলাম না। তবে আশপাশের সবার দৃষ্টিই দেখলাম ওদিকে। কেউ কেউ হাসছে, মজা নিচ্ছে।নিশ্চয়ই কিছু একটা গড়বড়ে হয়েছে!তড়াক করে সিট ছেড়ে দাঁড়ালাম আমি। বাম দিকের কয়েকজনকে ঠেলেঠুলে এগিয়ে গেলাম ওদের সিটের দিকে। মাস্তান মাস্তান ভাব নিয়ে বুকের ছাতি উঁচু করলাম- এই গন্ডগোল কীসের তুহিন?জবাবে মুচকি হাসলো তুহিন । হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো তার সিটে বসা এক বয়স্ক লোককে। গায়ে মাছ বেপারিদের শর্ট পাঞ্জাবি, থুতনিতে অল্প কয়টা দাড়ি। আর কালো কুঁচকুঁচে হ্যঙলা শরীর নিয়ে সটান বসে আছেন তিনি। পাশের সিটে বসে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে রোমন। তুহিনের মুচকি হাসি, রোমনের অস্বস্তিকর কপাল কুঁচকানো, আর লোকটার বোকা কিসিমের সটান চেহারা দেখে আমার মাস্তানিভাব পানি হয়ে এলো। ধারণা করলাম  তিনি হয়তো সিট খালি পেয়ে বসে পড়েছেন, এখন উঠতে চাচ্ছেন না। ভাবলাম একটু বুঝিয়ে বললেই ওঠে যাবেন। কিন্তু ঘটনা এত সহজে সমাধান হলো না।আমাদের হাতে যেমন টিকেট আছে। তার হাতেও আছে।তার সিট নাম্বার আর আমাদের টিকেটের সিট নাম্বারও এক!তবে তিনি ওঠেছেন ভ’ল কম্পার্টমেন্টে।আমাদের কম্পার্টমেন্ট-ড। আর তারটা-জ। আমরা ‘ড’ কম্পার্টমেন্টেই ওঠেছি। কিন্তু তিনি ‘জ’ কম্পার্টমেন্টের টিকেট নিয়ে এসে আমাদের সিটকে তার বলে দাবি করছেন, এবং খালি পেয়ে বসেও পরেছেন। আমরাসহ আশপাশের অন্য যাত্রীরা তাকে বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করছি।কিন্তু তিনি কম কথার মানুষ। আমরা দশ কথা বললে জবাব দেন একটার। তিনি সিট ছাড়বেন না।

আর ছাড়তে হলেও আমাদের কথায় ছাড়তে রাজি নন। যদি ট্রেনের টিটি এসে বলে তবে বিষয়টা বিবেচনা করবেন। কিন্তু টিটি কখন আসবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। অনেক সময় পুরো যাত্রায় টিটির দেখাই পাওয়া যায় না। তবুও লোকটা নাছোড়। সিট ছেড়ে এক চুলও উঠবেন না। আমরা তাকে বোঝালাম- ভয়ের কিছু নেই, এই সিট ছাড়লেও আপনি ‘জ’ কম্পার্টমেন্টে গিয়ে নিজের সিটে বসতে পারবেন। কম্পার্টমেন্টটা কোনদিকে সেটা পর্যন্ত দেখিয়ে দিলাম। তবুও তিনি উঠবেন না। সিটের সাথে আরো নিবির হয়ে বসলেন। তার ধারণা হলো আমরা বুঝি ধানাই পানাই বুঝিয়ে তাকে ঠকানোর চেষ্টা করছি। আমাদেরও ধৈর্য্যরে বাঁধ ভাঙছে। ইচ্ছে হলো টেনে টুনে সিট থেকে তুলে দেই।কিন্তু এই বয়স্ক লোকের সাথে দূর্ব্যবহার করতেও বিবেকে বাঁধলো। তারপরও অধৈর্য্য রোমনের গলা চড়া হয়ে উঠলো। না হাত তুলতে পারছে লোকটার ওপর, না সহ্য করতে পারছে গোয়ার্তুমি। রাগে অন্ধ হয়ে সে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কম্পার্টমেন্টের বাইরের দিকে সাঁটা প্লেটটি খুলে নিয়ে এলো। তারপর লোকটার চোখের সামনে ধরে উচ্চগলায় বর্ণমালা শেখাতে লাগলো- এই যে চাচা দেখেন, এখানে স্পষ্ট করে লেখা ‘ড’-‘ড্ড’।

আর আপনার টিকেটে লেখা ‘জ’, বর্গিয় জ্জ। লোকটা এবার একটু ভ্যবাচেকা খেলেন। আগের সেই সটান ভাবটা কিছুটা ঢিলে হয়ে এলো। আর এই সুযোগে অন্য যাত্রীরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো- আবাল কোথাকার, কোইত্থেকে যে আসে এইগুলা! যান নিজের সিটে গিয়া বসেন।আমরা এদের কয়েকজনকে থামানোর চেষ্টা করলাম। থামলোও বটে। আর ওদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে সুড়সুড় করে সিট ছেড়ে দিলেন লোকটা। তার এই অবুঝ গোয়ার্তুমির পরিণতিতে মায়া হলো আমার। দেখলাম একবারও পেছনের দিকে না তাকিয়ে উদভ্রান্তের মতো ‘জ’ কম্পার্টমেন্টের দিকে ছুটে যাচ্ছেন তিনি।এই ঘটনার পর আমাদের সিটবিষয়ক সতর্কতা আরো বাড়িয়ে দিলাম। শিক্ষা নিলাম- সিট অর্জনের চেয়ে সিট রক্ষা করা কঠিন। নিজেদের সিট আগলে রাখতে রাখতেই আমরা নরসিংদী এসে পৌঁছলাম। সেখানে তুহিন ও রোমনের সামনের সিটের যাত্রী দু’জন নেমে গেলো। আমি এবং সাদও চলে এলাম ওদের মুখোমুখি। মোটামোটি সবাই স্বস্তি পেলাম। কিন্তু এই নরসিংদীতেই আমাদের সঙ্গ ছেড়ে গেলো নিশিদলের অতিপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ ক্যমেরা।না, চোর বা ছিনতাইকারীর হাতে যায়নি।রোমনের এই দামি মোবাইল ফোনটি আমরা সাথে নিয়ে যেতে সাহস করতে পারলাম না। আখাউড়ার মতো একটি বিপজ্জনক এলাকায় এই ফোনটি নিয়ে যাওয়া নিরাপদও নয়। নরসিংদীতেই রোমনদের বাড়ি। ফোনটি নেয়ার জন্য আগেই বাড়িতে খবর দেয়া ছিলো। ওর এক আত্মীয় স্টেশনে এসে এটি নিয়ে গেলো। তবে যাওয়ার আগে নিশিদলের একটি গ্রুপ ছবি তুলে নিতে ভ’ল করলো না।আমরা এতেই সন্তুষ্ট থাকলাম। সন্তুষ্ট চিত্তে বিপুল বিক্রমে গালগপ্পো শুরু করলাম। টিপ্পনি চললো পরস্পরের জ্ঞানের দৌড় নিয়ে।

ওঠে এলো নতুন ও চমকপ্রদ তথ্য। আলোচনায় ওঠে এলো আমাদের লালে লাল হওয়ার বিষয়টিও। আখাউড়া স্টেশনে নেমে কোথায় কোথায় যেতে পারি তার একটা ছকও করলাম।মুখোমুখি একজন অন্যজনের সিটে পা তুলে দিয়ে আয়েশ করে বসলাম সবাই। আয়েশি ভঙ্গিতে সাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো রোমন- এক মানুষ সমান লম্বা মোম দেখেছো কখনো?স্বভাবসুলভ বিনয় নিয়ে সে বললো- না ভাইয়া।আজকে যদি খড়মপুর মাজারে যেতে পারি, তবে দেখাবো তোমাকে।ছোটবেলায় একবার খড়মপুর মাজারে গিয়েছিলো সে। ধূয়াশাচ্ছন্ন সেই স্মৃতিগুলোই রোমন্থন করতে শুরু করলো রোমন। বাংলাদেশের বড় ও সরগরম মাজারগুলোর মাঝে খড়মপুর একটি। এই মাজারটি কেল্লা শহীদের দরগাহ নামে পরিচিত। এই নামের পেছনে একটি কাহিনী প্রচলিত রয়েছে- এখানে তিতাস নদীর পারে অনেক বছর আগে কিছু হিন্দু জেলে পরিবারের বসতি ছিলো। একদিন চৈতন দাস নামের এক জেলের জালে একটি মানুষের কাটা মাথা উঠে আসে। জেলেরা ভীত হয়ে মাথাটি উঠাতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তারা অবাক হয়ে লক্ষ করলো শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন এ মাথাটি কথা বলছে- সাবধান! তোমরা যে পর্যন্ত কলেমা পাঠ করে মুসলমান না হবে ততক্ষণ আমার মস্তক স্পর্শ করবে না। তারপর মাথাটি কালেমা পাঠ করতে লাগলো। এ সময় চৈতন দাস ও তার সঙ্গীরাও কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যায়।

পরে এই মস্তক বা কেল্লাটিকে তারা তিতাস নদীর পাড়ে এনে খড়মপুর কবরস্থানে দাফন করে। সেই থেকে এ কবরটি কেল্লা অর্থাৎ মাথা বাবার মাজার নামে পরিচিতি পায়।খড়মপুর মাজারপন্থীদেরে দাবি এই মস্তকটি ছিলো সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ (রঃ) এর। অবশ্য এই নামে একজন আউলিয়া ছিলেন তা ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত। হজরত শাহ জালাল (রঃ) এর সঙ্গে সিলেটে যে ৩৬০ জন শিষ্য এসেছিলেন হজরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তরফ রাজ্যে রাজা আচক নারায়নের সঙ্গে হজরত শাহজালালের প্রধান সেনাপতি সৈয়দ নাসিরউদ্দিন যে যুদ্ধ পরিচালনা করেন সে যুদ্ধে সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ শহীদ হন।এরপর তার লাশ কোথায় কিভাবে গিয়েছে সে ব্যপারে ইতিহাসে কোনো বক্তব্য নেই।ভক্তদের দাবি এই যুদ্ধে গেছুদরাজ (রঃ) শহীদ হওয়ার পর তাঁর মস্তক তিতাস নদীর স্রোতে ভেসে এখানে আসে।কেল্লা বাবার মাজারের ইতিহাস, এখানে ভক্তদের সরগরম সমাগমের খবর শুনে আমরা শিহরিত হলাম। যদি সম্ভব হয় স্টেশন থেকে খড়মপুর যেতেই হবে আমাদের। তাও আবার রোমন জানালো প্রতি বৃহষ্পতিবার রাতে সেখানে জমজমাট আসর বসে।

আজ বৃহষ্পতিবার। সুতরাং এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।খড়মপুর মাজার নিয়ে আলোচনা করতে করতেই আমরা চলে এলাম আখাউড়া রেল স্টেশনে। রাত তখন ১টা বেজে ২০ মিনিট। তখনো স্টেশনভর্তি মানুষ। ব্যস্ত ছুটোছুটি করছে অনেকেই। কেউ ট্রেনের অপেক্ষায় বসে, কেউ দৌড়াচ্ছে। কুলিরা মালামাল নিয়ে টানাটানি করছে। একেবারে সরগরম স্টেশন। আখাউড়া কেবল স্টেশনই নয় জংশনও। তাই সরগরম হওয়াটাই স্বাভাবিক। পুরো স্টেশনে বেশ কয়েকটি প্লাটফরম।ট্রেন থেকে নেমেই আমরা রেল লাইন ডিঙিয়ে চলে এলাম মূল প্লাটফরমে। স্থির হয়ে একনজর চোখ বুলিয়ে নিলাম চারদিকে। খুঁজলাম লালে লাল হওয়ার কোনো উপায় পাওয়া যায় কি না। একনজরে এমন কিছু পাওয়া না গেলেও সরগরম স্টেশনটিকে কেমন রহস্যজনক মনে হলো। সবাই যেনো লুকোচুরি খেলছে। হয়তো স্টেশনটির ব্যপারে আমাদের নেতিবাচক ধারণা ছিলো বলেই সবকিছুকেই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছি। মানুষের গতিবিধিকে যতই স্বাভাবিক ভাবার চেষ্টা করছি, মন ততই বিরোধীতা করছে। স্টেশনের প্রায় সবাইকেই সন্দেহ করতে লাগলাম- এই লোকটার পুটলার ভেতর হয়তো ইয়াবা ভর্তি।

ওই লোকটার লাগেজে অন্য মালামালের সাথে নিশ্চিত তিন বোতল ফেন্সিডিল আছে। ওই যে ঝিম মেরে এক কোনে বসে আছে লোকটা, সে গভীর জলের মাছ। আর আমাদের আশপাশে যাদেরকেই ঘুর ঘুর করতে দেখছি, ভেবে নিচ্ছি ওরা বুঝি মাদকের দালাল।মনকে প্রবোধ দিতে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। এই মাত্র হুঁইসেল বাজাতে বাজাতে ছাদভর্তি মানুষ নিয়ে যে ট্রেনটি প্লাটফরমে ঢুকলো, এর একটি কম্পার্টমেন্টের পাশেই হট্টগোল হচ্ছে। তড়িৎ এগিয়ে গেলাম আমরা। এর মধ্যেই শ’খানেক লোক জমে গেছে এখানে। কিন্তু কেন?তাকিয়ে দেখলাম এক আশ্চর্য্য দৃশ্য- ট্রেনের ছাদ থেকে একটা লোককে জোর করে নিচে ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। হ্যাঁ লোকটা ঝুলে আছে আমাদের দিকে মুখ করে। না, সে সুপারম্যন নয়। ট্রেনের ছাদের কিনারার দিকে দুইজন লোক উল্টো দিক থেকে তার দুই হাত ধরে রেখেছে। আর এর ওপর ভর করেই ট্রেনের গায়ের সাথে নিবির হয়ে নিচের দিকে ঝুলে আছে লোকটা!প্লাটফরমেও দুইজন লোক তৈরি হয়ে আছে ঝুলন্ত লোকটাকে লুফে নেয়ার জন্য। অবাক হওয়ার মতো দৃশ্য। অথচ লোকটা বলতে গেলে নির্বিকার। বড় বড় চোখ করে চেয়ে আছে দর্শকদের দিকে।

চোখে লজ্জা বা বিরক্তির ছায়া নেই। নেই কোনো আতঙ্কও। তবে একটু মুচড়ামুচড়ি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু দশাসই লোকগুলোর হাতের বাঁধন খুলার জন্য এই যতসামান্য চেষ্টা মোটেও যথেস্ট নয়।প্লাটফরমের লোকগুলো যখন ওকে লুফে নিতে প্রস্তুত, তখনই ওপরের দুইজন ভারমুক্ত হয়ে ছেড়ে দিলো লোকটার হাত। আর এ ভার এসে পড়লো নিচের দুই লোকের হাতে। জুটে গেলো আরো কয়েকজন। সবাই টেনে টুনে তাকে নিয়ে রাখলো প্লাটফরমের এক কিনারায়। কয়েকজনকে সেখানে পাহারায় রেখে মূল দুইজন আবারো চলে এলো কম্পার্টমেন্টের পাশে। আরো একটা মাল খালাস করতে হবে।ইতিমধ্যেই ছাদের শুরু হয়ে গেলো অন্য একজনকে নিয়ে টানাটানি। সে নিচে নামতে একেবারেই নারাজ। শরীর মুচড়ামুচড়ি করছে। যে ধরতে যাচ্ছে তাকেই লাথি মারার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার শরীরে অতটা বল নেই বলেই মনে হচ্ছে। তাই ছাদের মানুষগুলোর কাছে কাবু হতে মিনিটখানেক সময়ও লাগলো না লোকটার। সেই আগের মতোই দুইজন ওর হাত পেছন থেকে শক্তভাবে ধরে রেখেছে। অন্য দুইজন চেষ্টা করছে ছাদে বিছানো লোকটার দুই পাকে একত্র করে টেনে হিঁচড়ে ছাদের সীমানার বাইরে আনার ।

চেষ্টা সফলও হলো। কিছুক্ষণের ভেতরই ঝুলে গেলো সেও। তারপর সেই আগের প্রক্রিয়া।এভাবে এক এক করে তিনজনকে খালাস করতে দেখলাম আমরা। তারপর উৎসুক জনতার রাগ ঢালার পালা। কেউ জুতো দিয়ে গুঁতো মারছে, কেউ গালির তুবড়ি ওড়াচ্ছে।আমরা ঘটনা আঁচ করতে পারলাম, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারলাম না। তাই ট্রেনের ছাদে বসা এক যাত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। ইশারায় জানতে চাইলাম ঘটনাটা কী?তিনি ইশারায় হাতের আঙ্গুলগুলোকে গোল করে পানপাত্রর মতো করলেন। তারপর গলায় ঢক ঢক করে পানীয় ঢালার ভান করে আমাদের বুঝাতে চাইলেন যে ওই লোকগুলো তরল পিয়ে গড়ল হয়ে আছে।কিন্তু এতে তাদের সমস্যা কী? এখানকার জন্য তো এটাই স্বাভাবিক। নেশা করার জন্যই এখানে অনেকে আসে।তারপর ছাদের লোকটা আমাদের যা বুঝালেন- ওই তিন মাতাল পাহাড় থেকে নেশা করে ট্রেনের ছাদে ওঠে বেহুঁশের মতো টলছিলো। বার বার গড়িয়ে চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিলো।

এতক্ষণ ছাদের লোকগুলোই ওদের ধরে বেধে পতন থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু কত আর! তাই এ স্টেশনে ট্রেন থামার পরই সবাই মিলে মাতাল তিনটিকে জোর করে নামিয়ে দিলো।লোক তিনটা প্লাটফরমে ঠিকমতো শুয়েও থাকতে পারছে না। একজন এসে ঘাড় ধরে টেনে তুলছে। আবার অন্যজন বুকে ধাক্কা মারছে। তারপর আবার টলতে টলতে পড়ে যাচ্ছে। আর এই চিড়িয়াদের দেখার জন্য মৌ মাছির ঝাঁকের মতো ছুটে আসছে দর্শক।দৃশ্যটাকে এ পর্যন্ত রেখে আমরা পা চালালাম প্লাটফরমের বাইরের দিকে। যেতে হবে খড়মপুর। খড়মপুর মাজার যে এখান থেকে খুব দূরে নয়, এবং গভীর রাতে যাতায়াত ব্যবস্থাও সহজ তা স্টেশনে থেকেই ধারণা করতে পারলাম। স্টেশনে কিছু লোককে দেখেই বুঝা যাচ্ছে এরা মাজার ফেরত কিংবা মাজারে যাচ্ছে। লালসালু গায়ে অনেক সন্নাসীকে দেখলাম আমরা। দেখলাম সাদা পোশাকের পুরুষ-মহিলা বৈষ্ণবের আনাগোনা। আর সাধারণ অনেক ভক্তদের দেখেও বুঝা যাচ্ছিলো ওরা মাজার থেকে এসেছে। কারো হাতে বড় বড় জরির ফুল, কারো গলায় জরির মালা। মেয়েদের খোঁপার ভাঁজে ভাঁজে কয়েকটি করে জরিন রাবার। আবার কারো পুরো মুখ চিকচিক করছে রঙিন জরিতে। মোটকথা চেহারায় একটা অগোছালো চিকচিকে জৌলুস দেখলেই আমরা বুঝে যাচ্ছি সে কেল্লাবাবার ভক্ত।মাজারে যাওয়ার পথ খুঁজতে মোটেও বেগ পেতে হলো না আমাদের।

স্টেশনের বাইরেই সার করে রিকশা দাঁড়ানো- খড়মপুর, খড়মপুর বলে হাঁক ছাড়ছে। এই এলাকাটা দেখে মনেই হলো না যে, এখন মধ্যরাত। রিকশায় ওঠে খড়মপুর মাজারের গেট পর্যন্ত এক কিলোমিটারের মতো পথটাও একই রকম। সার ধরে মানুষ মাজারে যাচ্ছে, ফিরছে স্টেশনে। প্রায় সবার গলায়ই মোটাসোটা জরির মালা। কারো হাতে লাঠি। কাঠের খেলনা। বাঁশি।এক কিলোমিটারের মতো পথ পাড়ি দিয়ে রিকশা থেকে যেখানে নামলাম, এর বা দিকেই একটি গলি চলে গেছে। গলির ভেতরে দু’মুখো লোকের ¯্রােত। কেউ বের হচ্ছে। আর আমরা ভেতরে ঢুকছি। গলির ঠিক মুখেই হাতের বাম দিকে দেখলাম ভাগ্য গননার পসরা নিয়ে বসেছে এক গণক। এর পর একটা জুয়ার আসর। তারপর খেলনার দোকান। । হাতের দু’দিকে একের পর এক মোড়ালি-গজার পসরা। মাঝখান দিয়ে হাঁটছি আমরা। একটু এগিয়েই দেখতে পেলাম বিশাল এক তোরণ-‘হজরত শাহ পীর কল্লা শহীদ (রঃ) মাজার শরীফ তোরণ’।

গম্বুজওয়ালা তোরণটি পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। এলোমেলো মাইকের আওয়াজ আসছে। আর আসছে হাজার হাজার মানুষের ছন্দবদ্ধ কোলাহল। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু মনে হলো গোটা পৃথিবীতে যেনো ঢেউ খেলে যাচ্ছে। ঢেউ খেলছে আমাদের মনেও।তোরণটি পেরিয়েই বিস্তৃত মেলা। মেলার একপাশেই একটি স্কুল। স্কুলের আঙিনাসহ সব একাকার হয়ে আছে লোকে। কী নেই এই মেলায়- মুড়ি, মুড়কি, তিল্লা, খেলনা, বেলুন, চড়কি, হাতপাখা সবই আছে। আছে মোমবাতি, আগরবাতির দোকান।বলে রাখা প্রয়োজন, এখানেই সাদকে দেয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে পারলো রোমন। ঠিক সাইমুম সাদের মতো উচ্চতার একটা মোমবাতি হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো সে। আমরা লক্ষ্য করলাম একটা নয়, কয়েকটা মোমবাতিই শোভা পাচ্ছে দোকানে। একেকটা পাঁচ হাজার টাকা করে বিক্রি করা হয়।আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলেই মূল মাজারের সীমানা দেয়াল। মাজারের বিপরীতেই রেল লাইন। আর বাম দিকে একটি মার্কেট। মার্কেটের দুতলায় দেখলাম মাজার পরিচালনা কমিটির অফিস কক্ষ। বিশাল এলাকা জুড়ে অনেক স্থাপনা থাকলেও গাছ পালা কম।আমরা তখনো মাজারের মূল সীমানা দেয়ালের বাইরে।

ভেতর থেকে মানুষের ছন্দবদ্ধ শোরগোল শুনতে পাচ্ছি। হাজার হাজার মানুষের পদচারনায় মুখরিত বাইরের অঙ্গনটাও। তবু গোটা পরিবেশটা কেমন গুমোট গুমোট লাগছে। আমরা হাটতে লাগলাম সীমানা দেয়াল ঘেঁষে। কয়েক কদম হেঁটেই দেখতে পেলাম একটি গেট। ভেতরে ঢুকবো কি ঢুকবো না করতে করতে আরো কয়েককদম এগিয়ে গেলাম। তারপর সামনের গেট দিয়ে ঢুকে গেলাম মাজারের মূল প্রাঙ্গনে।ঘড়ির কাঁটা তখন দুইটা পেরিয়ে।আমরা প্রবেশ করলাম নতুন এক পৃথিবীতে। আমাদের ফেলে আসা পৃথিবীটা তখন ঘুমে নিমজ্জিত। আর এ পৃথিবীতে আলো আাঁধারির ঝলকানি। পুরো প্রাঙ্গন কেঁপে উঠছে হাজার হাজার নারী-পুরুষের ঝাঁকুনিতে- ঝিম ঝিম ঝিক ঝিক। ঝিম ঝিম ঝিক ঝিক। করতাল, খঞ্জন, ঢোল, বাঁশি আর হারমোনিয়ামের সাথে গানের ঢেউ উঠছে বাতাসে। মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে যাচ্ছে নৃত্য। নাচছে পুরো মাজার। আর এই অগোছালো নৃত্যকে সম্ভ্রমের সাথে আকাশের চোখ থেকে আড়াল করতে চাইছে রাতের অন্ধকার।

পুরো প্রাঙ্গন জুড়ে আলাদা আলাদা করে অগুনতি জটলা। একেকটি জটলায় একেকটি আসর। এগিয়ে গেলাম সরাসরি গেটের মুখোমুখি একটি আসরের দিকে। শত লোক জটলা করে  নয়-দশ বছরের এক চপলা কিশোরীর গান শুনছে। তবে করতাল খঞ্জনের দাপটে কেউ লিরিক বুঝতে পারছে কি না সন্দেহ। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থেকেও দুই একটি শব্দ ছাড়া আর কিছুই ধরতে পারলাম না। তবে এতটুকু নিশ্চিত হলাম যে, এটা একটি হিন্দি গান। এই কিশোরীর গোলগাল চেহারায় একটা নিষ্পাপ ভাব লক্ষ্য করলাম। কিন্তু তার অকালপক্ক পরিবেশনা সেই নিষ্পাপতাকে ঢেকে দিলো। মেয়েটার গায়ে ফ্রক। পায়ে ঘুঙুর। কব্জির দিকটায় লাল সূতোর হাতবন্ধনী। মাথায় পট্টি। আর হাতে লতানো মাইক্রোফোন। একটু পর পরই ঘুঙুর ঝাঁকুনি দিয়ে প্রাণোবন্ত করে তুলছে ভক্তদের। ওর পায়ের কাছাকাছি বসেই হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে লম্বা চুলো, লম্বা দেঁতো এবং লিকলিকে এক বাদক। দু’চোখ বন্ধ। গলায় ঝুলিয়ে হলুদ কাপড়ে মোড়া তবলায় তাল তুলছে তারচেয়ে আরো লিকলিকে আরেকজন। দর্শকদের কেউ গানের যুতমতো এসে তালিয়া বাজিয়ে চিতকার করে উঠছে ‘হেইও’।

কেউ গলার রগ মোটা করে গড়গড় আওয়াজ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে। কেউ নাচছে। হাত পা দোলাচ্ছে। মোটামোটি সবাই গানে বুঁদ, ভাবে বুঁদ।আমরা বুঁদ হলাম না কিছুতেই। সবেমাত্র মাজারে প্রবেশ করেছি। এক যায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। দুই কদম বায়ে সরে মনযোগ দিলাম হাতের বাম দিকে। এখানকার জটলাটা একটু ধীর লয়ের। একটু ভাবের। সাদা চাদরে ঢাকা শরীর নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন এক প্রৌড় বিবাগি। আঙুল চালাচ্ছেন একতারায়। সৌম্য চেহারা। একবার গানের দরদে চোখ বন্ধ করছেন আবার খুলছেন। এক ঝটকায় আঙুলের ফাঁকে রাখা বিড়ি ফুঁকে নিচ্ছেন। তারপর গলার রগ ফুলিয়ে আবার গানে টান দিচ্ছেন- প্রাণোবন্ধু…………।

কোরাস তুলছেন দাঁড়িয়ে থাকা আরো দুই বিবাগি- ও আমার প্রাণের বন্ধু .. ঢুক ঢুক করে ঢোলের তাল বাড়াচ্ছেন ঢোলি। ঢোলির আশপাশে করতাল, খঞ্জন হাতে চোখ বন্ধ করে বসা আরো গোটা বিশেক লোক। ওদের পাশেই লম্বা হয়ে শুয়ে থেকেও নাচের মুদ্রা তুলছেন আরো তিরিশ চল্লিশজন।এরা সবাই বিবাগি। মাজারে মাজারেই এদের বসতি। হয়তো এরা ঘর বাঁধতে পারেনি। নয়তো ঘর ওদের আটকাতে পারেনি। কিংবা কারো কারো ঘরের দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ।তবে ঘর ওদের ছিলো। কষ্টের ঘর। একেকটি ঘর পাহাড়সমান উঁচু। ঘরের আঙিনা সাগরের মতো বিস্তৃত। কষ্টের পাহাড়, সাগর ডিঙিয়ে ওরা কষ্টের পাথরে চাপা দিয়েছে কষ্টকে। ভাবের জগতে কষ্ট বলতে কিছু থাকতে নেই। তাই ওরা কষ্টকে অস্বীকার করে। কষ্ট কী এটাও বলতে পারবে না এই বিবাগিরা।এই কষ্টহীন বিবাগীদের পাশে দাঁড়িয়ে আমার সারা শরীরে লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলো ঝপ ঝপ করে জড়ো হতে লাগলো বুকের খাঁচায়। তারপর কী আশ্চর্য্য, ওদের ভেতর থেকে একজন আর্তনাদের মতো শব্দ করে উঠলো। সাথে সাথে আমার বুকের খাঁচা থেকে কষ্টগুলো কর্পুরের মতো ওড়ে যেতে শুরু করলো।আর একটু দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে হয়তো কষ্টশূন্য হয়েই ঢাকায় ফিরতে পারতাম। কিন্তু তুহিনের আর ভালো লাগছে না দৃশ্যটা। সে পুরো মাজার ঘুরে দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো।

আমি নড়তে চাইলাম না। ইচ্ছে হলো আস্তে করে নিশিদলকে ফাঁকি দিয়ে ওদের ভেতর হারিয়ে যাই। সাদা পোশাকে মিশে যাই বিবাগিদের ভীড়ে। তারপর কে বা আমার আপন, আর কেইবা আমার পর! আর যার আপন পর বলতে কিছু নেই, তার কাছে কষ্ট বলতেও কিছু নেই।অবশেষে একবুক কষ্ট নিয়েই আমাকে ঘুরতে হলো। কষ্টঘোর নিয়েই ওদের পিছু পিছু চলছি। কয়েক মিনিট আমার হুঁশ ছিলো না। ওরা কোন দিক দিয়ে কোথায় নিয়ে এলো আমাকে ঠিক ধরতে পারলাম না।হুঁশ ফিরে এলো বিশাল এক গামলা দেখে। একমানুষ সমান উঁচু গামলাটা মাটিতে গর্ত করে বসানো হয়েছে। আর গামলার মুখ থেকে আরো এক মানুষ সমান উঁচু করে লোহার গ্রিল দেয়া হয়েছে। একটু দূর থেকে গ্রিলটিকে মাছের পেটের মতো মনে হতে পারে। মজার ব্যপার হলো গামলার প্রায় অর্ধেকটা ভড়ে গেছে টাকায়।এটা হলো মাজারের দানবাকসো। অসংখ্য লোক গ্রিলের ফাঁক দিয়ে টাকা ছুঁড়ে মারছে গামলাতে। গামলা দেখতে দেখতেই চোখ গেলো আমরা যে দিক থেকে এসেছি এর বিপরীত দিকে। লম্বা এলাকাজুড়ে লম্বা করে একতলা টিনের ঘর। সামনে বড়সর আঙিনা। দেখে আলাদা একটি বসতবাড়ির মতোই মনে হলো।

ওখানে হাজার হাজার পুরুষ মহিলারা চুলো জালিয়ে রান্না করছে। ভক্তরা এ মাজারে গরু, ছাগল, মহিষ মানত করে দিয়ে যায়। এগুলো জবাই করে রান্না করে অন্য ভক্তদের খাওয়ায়, নিজেরা খায়।খাওয়া দাওয়ার আয়োজন দেখলে আমি স্থির থাকতে পারি না। সম্ভব হলে খেতে বসে পড়ি, না হলে চোখ ঘুরিয়ে নিই। এক্ষেত্রে যেহেতু খাওয়ার জন্য কেউ সাধাসাধি করছে না, তাই বাধ্য হয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। অন্যদের তাড়া দিলাম দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে।এবার সোজা চলে এলাম সেই স্থানটিতে, যেটা কেল্লা বাবার কেল্লার কবর হিসাবে পরিচিত। বাইরে থেকে জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। সাদের পায়ের জুতা খুলতে গেলে রীতিমতো পায়ের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। তাই সে বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের জুতাগুলো পাহারার দায়িত্ব নিয়ে নিলো।বাকি তিনজন সিঁড়ি বেয়ে মাজারে উঠছি।কয়েকজনকে দেখলাম জিয়ারত করার পর পিছু হটতে হটতে সিঁড়িকে সালাম করতে করতে নামছে। আমরা সোজা চলে গেলাম ভেতরে। কবরের তিনদিকে ভক্তরা লুটাচ্ছেন যার যার মনোবাসনা নিয়ে। আমরা যে দিক দিয়ে প্রবেশ করলাম, সেখানে মহিলাদের সমাগম। কয়েকজন যুবতীকে দেখলাম কবরের দিকে মুখ করে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে পঞ্চাশোর্ধ এক মহিলা মোনাজাত তুলেছেন। টপ টপ করে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে হাতের তালুতে।

একেবারে কবরের বেদিতে মাথা লাগিয়ে সার ধরে দাঁড়িয়ে আছেন বিভিন্ন বয়সি দশ-পনেরোজন মহিলা। তারা কবর ছুঁয়ে মানসি মানছেন। কারো হয়তো ছেলে অবাধ্য, কেউ স্বামীকে বশ করতে চান, কারো বার বার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ প্রেমিককে হাতের মুঠোয় পেতে চান। এদের ডান দিকে একটু আলাদা যায়গায় এক মহিলা উদভ্রান্তের মতো মাথা ঠুকছেন। আর এ দিকটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেজদা করছেন আরো কয়েক মহিলা।আমরা ডানে ঘুরে কবরের সম্মুখ অংশে চলে এলাম। সেখানে কবরের পরিচিতি লেখা। আমি বানান করে পড়ার চেষ্টা করলাম ‘হযরত শাহ্ ছৈয়দ গেছু দারাজ (রঃ) প্রকাশ্য শাহপীর কল্লাহ্্ শহীদ (রঃ)-এর রওয়াজা মোবারক, খড়মপুর।’ তারপর বড় বড় অক্ষরে লিখে রাখা হয়েছে ‘সেজদা করিবেন না’ লেখাটা পড়া শেষ করে মনযোগ দিলাম সেজদারত কয়েকজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সি যুবকের প্রতি। কবরের বাম দিকের সরু অংশটাতে ওরা হাঁটু গেড়ে মাথা নুইয়েছে। অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু মাথা তোলার নাম নেই। ওদের মাথার সামনেই জ্বলছে আগরবাতি। একটি দু’টি নয় হাজারে হাজার। কাঠের বাকসোর মতো করে আগরবাতির স্ট্যন্ডগুলো সারি করে বসানো আছে। এর পাশেই যে যার খুশিমতো মোমবাতি ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আগরের ঘ্রাণে আমার পেট ভর্তি হয়ে এলো। ইচ্ছে ছিলো এই যুবকরা কতক্ষণ সেজদায় পড়ে থাকে তা পর্যবেক্ষণ করবো। সে উদ্দেশ্যে মনযোগও দিলাম ওদের প্রতি। কিন্তু পর্যবেক্ষণে ছেদ পড়লো ঠা-া ধরনের তরলের ছিটায়। কে যেন গায়ে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে!তাকিয়ে দেখি পানি নয়, গোলাপজল ছিটাচ্ছেন এক ভক্ত। ডান হাতে প্লাস্টিকের বোতল ধরে সামনের দিকে ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করছেন, আবার হাতটা পিছিয়ে নিচ্ছেন।

আর ঝুক ঝুক শব্দ তুলে লাফিয়ে পড়ছে তরল। ভদ্রলোক খুব যতেœর সাথে সবার গায়ে গোলাপজল পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করছেন।সেজদারত যুবকেরা তখনো মাথা তুলেনি। আমার অধৈর্য্য দৃষ্টি চলে গেলো অন্য দুই যুবকের প্রতি। ওরা আমাকে একরকম ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেলো কবরের একেবারে শেষ কোনায়। আস্তে করে ঝুঁকে বসে চুমু খেলো বেদিতে। তারপর ওঠে দাঁড়িয়েই জিকির তুললো- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। লম্বা টানে তিনবার পড়ার পর দ্রুত লয়ে জপতে শুরু করলো- আল্লাহ, আল্লাহ।আরো কিছুসময় দাঁড়ানোর ইচ্ছে ছিলো আমার। কিন্তু তুহিন আর রোমনের চটপটে ভাব দেখে মিইয়ে গেলাম। দ্রুত চলে এলাম কবরের সামনের দিকটায়। তিনজন খাদেমকে দেখলাম মহা ব্যস্ত হয়ে ভক্তদের সেবা করছে। দু পাশে দুই মধ্যবয়স্ক খাদেম। আর মাঝখানে আটাশ-ঊনত্রিশ বছর বয়সি দাড়ি-গোঁফ চাঁছা এক তরুন। পরনে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। কেতাদুরস্থ করে আঁচড়ানো চুল। অন্য দুইজনের চেয়ে তাকে একটু আলাদা চোখে দেখছে ভক্তরা। কেউ পানির গ্লাস এনে তার সামনে ধরছে, তিনি ফুঁ দিয়ে দিচ্ছেন। সামনে রাখা আছে খাঁচা ভর্তি ফুলের পাপড়ি। কেউ এসে তার আশীর্বাদ চাইলে কয়েকটি পাপড়ি হাতে তুলে দিচ্ছেন।একবার চোখাচোখি হলো তরুনের সাথে। কথা বলার জন্য উদ্যত হলাম। কিন্তু ততক্ষণে লক্ষ্য করলাম তুহিন ও রোমন বেরিয়ে যেতে উদ্যত।

আমিও বাইরে বের হওয়ার জন্য তরুনের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। কেল্লা বাবার কবরকে পেছনে রেখে দৃষ্টি দিলাম মাজারের সম্মুখ অংশে। এটাই মূল কবরে প্রবেশ করার প্রধান পথ। কবর থেকে নেমে যাওয়া সিঁড়ির পরই চলাচলের জন্য এক চিলতে পথ। এর পরই আরো কয়েকটা ধাপ নেমে গেছে খালে। একটু সামনে গিয়েই এই খালটা তিতাস নদীর সাথে সংযুক্ত।খালে ছোট বড় আকারের অসংখ্য ইঞ্জিন নৌকা। এসব বোঝাই করে ভক্তরা এসেছে মাজারে। অধিকাংশ নৌকাই রঙিলা সাজে সজ্জিত। কোনো কোনো নৌকায় বিজলি বাতি চমকাচ্ছে। মনে হলো, আমার পায়ে আছড়ে পড়েছে এক মস্ত জমজমাট বন্দর।আমরা সরে এলাম কবরের কাছ থেকে। পায়ের জুতো পায়ে এঁটে এলোমেলো ঘুরলাম কিছুক্ষণ। দেখলাম অনেক কিছুই। চোখে পড়লো একটি কুয়ো ঘিরে মানুষের জটলা। কৌতুহলী হয়ে কুয়োর ভেতর মাথা নুয়ালাম। আশ্চর্য্য হলাম, কুয়োর কালো কুঁচকুঁচে পানিতেও ভাসছে টাকা!আমারও ইচ্ছে হলো দশটি টাকার নোট ফেলে দিয়ে যাই। পেছনের পকেট থেকে দশ টাকা বের করেও কুয়োর পানিতে ফেলে দিতে মায়া হলো। কিন্তু আমার চোখের সামনেই মায়া দয়াহীন কয়েকজনকে দেখলাম দশ টাকা, বিশ টাকা এমনকি একশ’ টাকার নোটও নির্দ্বিধায় জলে ফেলে দিচ্ছে। আমরা আমাদের সময়গুলো জলে ফেলতে চাইলাম না।রাত তখন দুইটা বেজে বত্রিশ মিনিট। সিদ্ধান্ত নিলাম যত দ্রুত সম্ভব খাওয়া দাওয়া সেরে পাই টু পাই হিসাব করে সময় কাজে লাগাবো। খাওয়া দাওয়া করলাম মাজারের সামনের একটি ভাতের হোটেলে।

বলে রাখা প্রয়োজন, এখানে খাওয়াটা মোটেও সুবিধার হয়নি। এক প্লেট ভাত খেতে গিয়ে কমপক্ষে একশোবার বালি কামড়ে পড়েছে। আমার মতো পুরোদস্তুর একজন খাদকের পক্ষেও এক প্লেট পুরোটা শেষ করা সম্ভব হয়নি।খাওয়া দাওয়ার পর খালের দুইপাশে সংযোগ সেতুতে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবার ভাসমান নৌকাগুলো সরাসরি আমাদের পায়ের নিচে। সামনে, পেছনে যতদূর চোখ যায় কেবল নৌকা আর নৌকা। যে নৌকাগুলোতে যাত্রী রয়েছে, সেগুলোতে হিন্দি গানের তালে চলছে উদ্যম নাচ। আর বেশিরভাগ নৌকাই খালি। ওগুলোর যাত্রীরা মাজারের ভেতরে নাচগান করছে। পুরো মাজার নাচে গানে উচ্ছ্বল।কয়েক মুহূর্তের জন্য উচ্ছ্বলতা ভর করেছিলো রোমনের ওপরও। সংযোগ সেতু থেকে ঘুরে এসে মাজারের মূল প্রাঙ্গনে একটি জটলার সাথে ঢিলেঢালা নাচ তুলেছিলো সে। ওর নাচ ঢিলেঢালা হলেও পুরো জটলার নাচে ছিলো ভয়ঙ্কর রকম গতি। আর দৃশ্যটা ছিলো অসম্ভব রকম ধারালো। ত্রিশ-চল্লিশজনের এ দলের সবাই অনুসরণ করছে দশাসই শরীরের এক লোককে। ঝন্ডা মার্কা এই লোকটাকে মনে হলো জ্বলন্ত আগুনের হলকা। মাথাভর্তি বাবরি। গানের তালে তালে মাথা দোলাচ্ছেন। মুখের দু’পাশের খাঁজ বেয়ে গড়াচ্ছে সাদা ফেনা। কালোমতো লোকটার ডানে বামে তরবারির মতো বাকা হয়ে ডুগডুগি, খঞ্জনি বাজাচ্ছেন অসংখ্য ভক্ত।আকর্ষণিয় আরেকটি দৃশ্য হলো পঞ্চাশোর্ধ একজনের করতাল বাজানো।

তিনি করতাল বাজাচ্ছেন ঝিম ঝিম ঝিক ঝিক তালে। একবার দুই হাত একটু উঁচু করে একসাথে করতাল দুটোতে তাল দেন, তারপর তাল দেন একটু নিচু করে। দেখে মনে হলো অসম্ভব দ্রুত গতিতে তিনি মাছ ধরছেন, আর খলুইতে রাখছেন। ধরছেন-রাখছেন। তার ঠিক সামনেই দু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে গলায় ঝোলানো ঢোল বাজাতে বাজাতে অজ্ঞানপ্রায় ঢোলি। গোটা জটলার প্রায় সবারই অজ্ঞান হবার মতো অবস্থা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একজন থেকে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে অন্যজনে। কারো হুঁশ নেই। নাচছে তো নাচছে। নেই ক্লান্তি। নেই বিরাম।এই অবিরাম নাচের ভেতর থেকেই নাকে এসে ঠেকলো গন্ধটা। গাঁজার গন্ধ। কোথাও কোনো কলকি দেখা গেলো না। তবে কয়েকজনকেই দেখলাম সিগারেটের খোলসে টান দিয়ে ভুঁসভুঁস করে ধূঁয়া ছাড়ছে। কিন্তু আসল নকল রাতের বেলা ঠাহর করা মুশকিল। আমাদের ভেতর এবার লালে লাল হওয়ার ইচ্ছা চাড়া দিয়ে উঠলো। সুতরাং গন্ধ শুঁকে শুঁকেই এগুতে হবে।মজার ব্যপার হলো এর পর থেকে বিরতি দিয়ে দিয়েই উৎকট গন্ধটা নাকে এসে ঠেকতে লাগলো। একজনের কাছে জেনেওছিলাম, মাজারের পাশেই রেল লাইনে জিনিসটা পাওয়া যায়। কিন্তু মাজারের এতো বৈচিত্র, এতো আয়োজন রেখে ওদিকে যাওয়ার মতো সময় তখন হাতে ছিলো না।বৈচিত্র দেখলাম মধ্যবয়স্ক এক মহিলার চোখে। বিড়ালচোখো এই মহিলার সাথে আচমকা চোখাচোখি হলো।

পনেরো-বিশজনের ছোট্ট এক জটলা থেকে হঠাৎই বিড়ালের চোখের মতো ঝলমলিয়ে উঠলো মহিলার চোখ। বিভ্রান্তির ঝলকানিতে আমি অন্ধ হয়ে গেলাম। স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। তারপর যখন দৃষ্টি ফিরে পেলাম, দেখলাম তার চোখ দুটো টগবগ টগবগ করছে। যেন সাতরঙের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে চাচ্ছে আমাদের। জটলার মাঝখানে এক পুরুষ হারমোনিয়ামে গান ধরেছেন। কিন্তু ওদিকে মনযোগ নেই মহিলার। আমরা যেই জটলাটাকে পাশ কাটিয়ে অন্য একটি জটলার দিকে এগুচ্ছি, অমনি ঝট করে দাঁড়িয়ে যেতে দেখলাম তাকে। তারপর জটলার মাঝামাঝি গিয়ে আচমকা একটি রুমুঝুমু ড্যন্স দিয়েই স্থির হয়ে গেলেন। তার বিড়ালচোখদুটো দেখলাম তখনো আমাদের কিম্বা আমার দিকে তাকিয়ে।পরের দৃশ্যটা  রাতস্বীনি নদীর মতো। হই হই করতে করতে পাগলা ষাঁড়ের মতো ছুটে এলো একদল তরুন। ওরা ঘুরছে মাজারের এক প্রান্ত ধরে। একবার এক পাশে দৌড়ে যায়, আবার ফিরে আসে। দেখে মনে হলো একটি চঞ্চল নদী খলবল খলবল করে বয়ে চলেছে। মানুষনদীর দুই তীরে বাজছে হাজার হাজার ব্যনপার্টির বাঁশি। কানঝালাপালা অবস্থা। কেউ কারো কথা শুনতে পাওয়া তো দূরের কথা। ভীরের চোটে কেউ কাউকে দেখতে পর্যন্ত পারছিলাম না। মানুষনদীর রাতে এলোমেলো করে দিতে চাইলো নিশিদলকে। তাই সেখানে আর বেশি সময় না দাঁড়িয়ে পিছলে-পাছলে কোনোরকম চলে এলাম সেই প্রথম জটলাটিতে। যেখানে গান গাচ্ছিলো নয়-দশ বছরের এক কিশোরী।ফিরে এসে তাকে আর পেলাম না।

দেখলাম ওখানে গাইছে ষোল-সতেরো বছরের অন্য আরেক কিশোরী। দাঁড়াবার খুব একটা ইচ্ছে ছিলো না আমার। কিন্তু গানের কথা পরিচিত মনে হলো- তোমাকে চাই আমি আরো কাছে। তোমাকে বলার আরো কথা আছে। বলতে পারি না মুখে তওবা তওবা। দিলে জখম লাগে ওহো আহা।…স্বাভাবিক তালের চেয়ে আরো দ্রুত গাইছে মেয়েটি। ওর পাশেই করতাল বাজাচ্ছে একচোখ অন্ধ একটি ছেলে। মেয়েটির গায়ে জমকালো পোশাক থাকলেও অন্ধ ছেলেটাকে একেবারেই দীন দরিদ্র মনে হলো। পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি, তাও নিচের দিকে কম করে হলেও তিনটি গিট্টু দেয়া। তবুও ওর পারফরম্যন্স চমৎকার। মেয়েটা মেইন ভোকাল হলেও আসরটাকে জমিয়ে রেখেছে মূলত এই দিনদরিদ্র ছেলেটাই। ওর হাতের করতাল, গানের তাল, শরীরের ঝাঁকুনি অসম্ভবরকম ছন্দবদ্ধ। ওর প্রতি মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। আর দাঁড়ালাম বলেই ভ’লটা ভাঙলো। অর্থাৎ গানের সুরটা ‘তোমাকে চাই আমি আরো কাছে..’র মতো হলেও কথাগুলো আসলে ভিন্ন। দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থেকে ছন্দে ছন্দে কলজেয় কাঁপুনি উঠলেও কথাগুলো ঠিকভাবে ধরতে পারলাম না। তবে মনে হলো হৃদয় প্রাণ আকুল করে ওরা গাইছে- ‘স্বপ্নে দেখি আমার প্রিয়া আইছে..’ ধরনের একটা কিছু।ওরা গাইতে থাকলো। আমরা মুখ ফেরালাম। রাত তখন ঢুলতে শুরু করেছে।ঘড়ির কাটায় তিনটা বেজে চল্লিশ মিনিট। সূর্য্য ওঠার খুব দেরি নেই। সুতরাং এই মাজারেই বুঁদ হয়ে থাকা চলবে না। এ যাত্রায় লালে লাল হতে না পারলেও অন্তত ব্যবসার পথ ঘাটটা চিনে যেতে হবে। এর জন্য আমাদের পা রাখতে হবে সীমান্তে।মাজার ছেড়ে যেতে রাজি নয় রোমন। রাজি করানোর জন্য তার ওপর একরকম চাপাচাপির বোলডোজার চালাতে হলো। বোলডোজারের যাতায় পিষ্ট করে রাজি হতে বাধ্য করা হলো তাকে। কিন্তু মাজারের মূল গেট পেরিয়েই আবার মতিবিভ্রম হলো রোমনের। কিভাবে যেন তুহিনকেও নিজের দলে যোগ করে ফেললো সে।

দেখলাম আমাকে পেছনে রেখেই সাদসহ ওরা তিনজন আগে আগে স্কুল মাঠের দিকে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। কী ঘটনা!কানে এসে ঠেকলো মাইকের আওয়াজ- লা……স্ট শো। জাদু প্রদর্শনের ইল্্লা….স্ট শো… বিখ্যাত জাদুশিল্পী, ভারত থেকে আগত কামাল নিশানের জাদু প্রদর্শনের ইল্্লা….স্ট শো…টিকেটের মূল্য মাত্র ব্বি..শ টাকা।ওরা ততক্ষণে বিশ টাকা করে চারটি টিকেটের মূল্য আশি টাকা কাউন্টারে বাড়িয়ে ধরেছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে গিয়ে বাগড়া দিলাম। এই কামাল নিশানের লাস্ট শো শুরু হতে হতে আরো কমপক্ষে আধাঘন্টা নেবে। তারপর আরো আধাঘন্টা বা তারচেয়েও বেশি সময় ধরে চলবে শো। এর মানে রাতটাই শেষ!তা হতে দিলাম না।কাউন্টারে বসা ঝাঁকড়া চুলের গোফওয়ালা লোকটা আমার দিকে কটমট করে তাকালেন। কোত্থেকে হঠাৎ উদয় হয়ে তার লাস্ট শো’র চারটি টিকেট ক্যন্সেল করে দিয়েছি!এতটুকু নির্দয় হতেই হলো। সময় আমাদের ওপর দয়াপরবশ হলে হয়তো এমনটা হতো না। আবার হয়তো হয়ে যেতো আরো অনেক কিছু। এই যেমন খড়মপুর থেকে স্টেশন পর্যন্ত সিএনজিতে করে নয়, হেঁটেই যেতাম। স্টেশনে কলসভর্তি তাড়ি বিক্রেতা চাচার সাথে আলাপ জমিয়ে রেল লাইন ধরে হারিয়ে যেতাম অন্ধকারে। শেষরাতে আখাউড়া রেলস্টেশনে তাড়ির কলস কাঁধে বয়ে অদ্ভ’ত এক ডাক ডেকেছিলেন চাচা- অই.. আ… অই.. আ…এই ডাকের কী অর্থ হয় জানা নেই। তবে ধারণাটা সঠিকই ছিলো। তিনি হাত দিয়ে ঢকঢক করে তরল পানের ইশারা করলেন। আমি হাসলাম। জবাবে হাসলেন তিনিও।

অদ্ভ’ত এক ভালোলাগার মতো হাসি হেসেই তিনি আবার ডাকতে শুরু করলেন ‘অই.. আ… তার এই ডাকে দুলে উঠেলো রাতের পর্দা। একটু পরই কালো রঙটা সরে যাবে চোখের সামনে থেকে। এর আগেই যা করার করতে হবে আমাদের। যে কোনো মূল্যে পৌঁছাতে হবে সীমান্তে। কিন্তু কিভাবে? পথ ঘাট জানা নেই। তাছাড়া এই শেষ রাতে?শেষরাত হলেও চেষ্টা করতে দোষ নেই। আমরা নেমে গেলাম মাঠে। নিরিবিলি একটা চায়ের স্টল খুঁজছি। চা খেতে খেতে বিক্রেতার সাথে আলাপ জমাতে হবে। জেনে নিতে হবে বাংলাদেশÑভারত সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার অবস্থান। স্টেশনের এ মাথা থেকে ওমাথা কয়েক চক্কর দিলাম। কিন্তু সবগুলো স্টলই সরগরম। জনসমাগমে ওসব কথা তোলা মানেই খামোখাই মানুষের কৌতুহল বাড়ানো। খুঁজলাম বেশ কিছুক্ষণ। মনের মতো স্টল পেলাম না। ওদিকে সময় ফুরিয়ে আসছে। কী করা যায়!ভীরে গেলাম অপেক্ষাকৃত কম জটলার একটি স্টলে। চার জনের হাতে চার কাপ চা নিয়েই আসল কথা তুললাম। চা বিক্রেতা একমুহূর্তের জন্য বাঁকা চোখে চাইলো। পরক্ষণেই কি কারণে যেন আবার স্বাভাবিক হয়ে এলো। হয়তো আমাদেরকে এতটা জটিল মনে হয়নি। কিন্তু যখন শুনলো আমরা রাতেই যেতে চাই। আবার কপাল কুঁচকে এলো তার। ভীষণভাবে মানা করলো রাতে ওদিকে যাওয়া মোটেই ঠিক হবে না। সীমান্ত এলাকায় বহু লোক বহু ধান্দা নিয়ে ঘুরে।

এছাড়া বিজিবির সদস্যরাও সন্দেহবশত ঝামেলা করতে পারে। বিজিবি চেকপোস্টে যাওয়ার মতো যথেস্ট তথ্যই নিয়ে নিলাম চা বিক্রেতার কাছ থেকে। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী আমরা স্টেশনের পূর্বদিকে গিয়ে ঠিক ঠিকই সিএনজি পেয়ে গেলাম।চারজনের এ দলটা বিজিবি চেকপোস্টে যাবে শোনে সিএনজিওয়ালাদের মধ্যে রীতিমতো তোলপার শুরু হলো। সবাই ধরে নিলো হয়তো আমরা বড় মাপের চোরাচালানি, অথবা রাতের আঁধারে সীমান্ত পাড়ি দিতে যাচ্ছি। সিএনজিতে ওঠে বসার পর বিষয়টা আরো স্পষ্ট করলো রোমন-আমরা যখন সিএনজি ঠিক করে উঠতে যাচ্ছিলাম, পেছনে তাকিয়ে দেখি রোমন নেই। ডানে, বামে কোথাও নেই।  প্রায় সময়ই ও না বলে পেছন থেকে উধাও হয়ে যায়। তাই বলে এই মুহুর্তেও!মেজাজ বিগড়ে গেলো। এলোমেলো হয়ে এলো চিন্তা। হাঁক ডাক করছি, সাড়া নেই। এত দ্রুত কোথায় উধাও হয়ে যেতে পারে সে!  প্রতি সেকেন্ডে একশোটি শঙ্কা ঘুরপাক খেতে শুরু করলো মাথায়। মুহুর্তের মাঝেই তিনজন ছড়িয়ে গেলাম। বেশি দূর যেতে হয়নি। কয়েক কদম এগিয়েই দেখি একটি টঙ দোকানের আড়াল থেকে পান চিবুতে চিবুতে বেরিয়ে আসছে রোমন। তাৎক্ষনিক কিছুই বললাম না ওকে। তার এই দায়িত্বহীনতার জন্য কয়েকটা চোখা চোখা কথা তৈরি রাখলাম সিএনজিতে বসে ঝাড়বো বলে।সিএনজি স্টার্ট নিলো। গম্ভীর হয়ে চোখা কথাগুলোকে চেঁছে ছুলে আরো চোখা করতে লাগলাম। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই মুখ খুললো রোমন- আমরা সিএনজি ঠিক করার সময় সে টঙ দোকানের সামনে  দাঁড়িয়েছিলো।

দোকান ঘিরে পাঁচ ছয়জনের একটা জটলা। সবাই কথা বলছিলো আমাদের নিয়েই। ওরা বুঝতে পারেনি রোমন আমাদের দলেরই একজন। সুযোগ নিলো রোমনও। কিছুক্ষণ বোকার মতো জটলার ভেতরে থেকে শুনে নিলো ওদের ধারণাগুলো। মোটামোটি সবারই প্রশ্ন কিসের ধান্দায় আমরা সীমান্তে যাচ্ছি। আমরা যে গভীর জলের মাছ, এটা ওরা নিশ্চিত। তবে নিশ্চিত নয় জলের গভীরতার পরিমাণ। তাই ওদের ভেতর থেকেও কেউ কোনো ধান্দা নিয়ে এগিয়ে এলো না আমাদের দিকে। ওরা ধৈর্য্যসহকারে সিএনজি চালকের ফেরার অপেক্ষায় রইলো। তার কাছ থেকেই জেনে নেবে আমাদের ব্যপারে।সিএনজি চালকের নাম মনির হোসেন বাবু। বয়স ত্রিশ কি বত্রিশ হবে। লক্ষ্য করলাম শেষরাতে সীমান্ত অভিমুখী একদল রহস্যযাত্রী পেয়ে তার ভেতরও রোমাঞ্চ কাজ করছে। আমরাও রহস্যের চাদরে আড়াল করে রাখলাম নিজেদের। চালকের সাথে বসা সাদকে কড়া করে ইঙ্গিত করলাম কোনো ব্যপারে কথা না বলতে।সিএনজি পূর্ণগতিতে চলছে। শ্বাসরুদ্ধ করে বসে রইলাম সবাই। সড়কের দুই পাশে ফসলি জমি। এক প্রস্থ আবছা আঁধার পেরিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে গ্রাম। থমথমে রাত। আকাশ আর জমিনের সুড়ঙ ধরে তীর বেগে ছুটছি আমরা। বাকি পৃথিবীটা স্থির। সিএনজির গুঞ্জনে চাপা পড়ে যাচ্ছে ঝিঁঝিঁর ডাক। আমরা এগুচ্ছি বাংলাদেশের মানচিত্রের শেষ রেখাটা ছুঁয়ে আসতে।

শরীর টান টান করে সজাগ দৃষ্টি রাখলাম সামনে। হেড লাইটের আলোর গতিতেই ছুটে চলেছে চোখের দৃষ্টি। দুলছি অনিশ্চিত দুলোনিতে। যে কোনো মুহূর্তে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে পারে বিপদ। আমরা ঘাড় প্রস্তুত রাখলাম।তবে কোনোরকমের বিপদের মুখোমুখি হতে হয়নি আমাদের। অক্ষত ঘাড় নিয়েই এসে পৌঁছলাম বিজিবি চেকপোস্টে।সিএনজিটা যেখানে থামলো এর ডানদিকেই বড়সর একটি অফিস দেখতে পেলাম। সড়কলাগোয়া দেয়ালের মাঝামাখি একটি গেট, ভেতর থেকে বন্ধ। সড়কে দাঁড়িয়েই দেখতে পেলাম ভেতরের ছোট আঙিনাটা। কারো সাড়াশব্দ নেই। তাকালাম সড়কের বিপরীত দিকে। সড়ক থেকে একটা ঢাল নেমে গেছে অপ্রশস্ত খাদে। খাদের ওপারে পাতলা ঝোপ। এরপর অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না।ঢিলে হয়ে এলো শরীর। কোথায় বিজিবি, কোথায় সীমান্তের কাটাতার?চেকপোস্টে তো বিজিবির টহল থাকার কথা!আমাদের মনের ভাষাটা হয়তো পড়তে পারলো চালক। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চাইলো আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম কী?আমরা বিজিবির টহল দলের অবস্থান জানতে চাইলাম তার কাছে।ধন্দে পড়ে গেলো সে। কোন উদ্দেশ্যে এসেছি, কেন এসেছি এসবের কোনটারই জবাব খুঁজে পাচ্ছে না বেচারা। আবার আমাদেরকে জিজ্ঞেস করতেও দ্বিধা হচ্ছে। অবশেষে সড়কের আরো একটু সামনের দিকে দেখিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত আঙুল তুললো সে। দেখলাম সড়কের মাঝখানে কোমর পরিমাণ উঁচু একটি পিলারের মাথায় লাল বাতি জ্বলজ্বল করছে। ওটা সিগন্যালবাতি। ওখানে গিয়ে থামতে হবে সবার।ওখানে সিএনজি নিয়ে যাওয়া যাবে না?প্রথমে না করলো চালক। তারপর কী কারণে যেন সব দ্বিধা ঝেড়ে সিএনজিতে উঠতে ইশারা করলো।

আমরা ওঠে বসলাম। স্টার্ট নিয়ে সামান্য পথ এগিয়ে সিগনালবাতির আগে একটি ব্রিজের গোড়ায় নামিয়ে দিলো আমাদের।সিগনালবাতির পাশ থেকে একটি ছায়ামানবকে নড়ে উঠতে দেখলাম।আমরা এগিয়ে গেলাম ওটাকে লক্ষ্য করেই। ছায়াটাও কয়েক কদম এগিয়ে খাম্বার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রইলো। তারপর ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরলো ডান দিকে। এক হাত দিয়েই পুরো সড়ক আগলে রাখার চেষ্টা।দূরত্ব কমে আসতে থাকলো আর ছায়ামানবটা রুপ নিতে থাকলো পূর্ণ মানবে। তারপর বিজিবির টহল সিপাই-এ। উষ্ণ পরিচয় বিনিময় শেষ হওয়ার পর আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন সিপাহী লিপন। ভদ্রলোকের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। বাড়িতে বউ, ছেলে মেয়ের সংসার ফেলে রেখে তিনি পাহারা দিচ্ছেন আমাদের বাংলাদেশ নামক সংসারটাকে।সড়কের ডান দিকে বিশাল এলাকাজুড়ে চেকপোস্টের ছাউনি। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। ইতি ওতি করে এটা ওটা দেখার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের অবস্থা বুঝে একটি সুইচ চাপলেন লিপন। সাথে সাথে বিজলির মতো আলোকিত হয়ে উঠলো গোটা চেকপোস্ট এলাকা। সড়কের পাশের গাছ, খাম্বাসহ সবকিছুতেই মিটমিট করে জ্বলছে বিজলিবাতি।দেখারমতো দৃশ্য তৈরি হলো। আমরা অভাবনীয় আনন্দে অভিভ’ত হলাম। কিছুক্ষণ পর আমাদেরকে সঙ্গ দেয়ার জন্য জুটে গেলো আরো একজন। ছাউনির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন হাবিলদার হাবিব। ভদ্রলোকের বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বারে। এ ছাউনিতে টহল দেন মোট ছয়জন। পাঁচজন সিপাহীর কমান্ডে রয়েছেন তিনি।

রাতজাগা দুই সীমান্তপ্রহরীর সাথে বেশ কিছু সময় উষ্ণ আলাপ হলো নিশিজাগা নিশাচরদের।আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সড়ক ধরে এর বিশ কি পঁচিশ ফুট সামনে এগুলেই বাংলাদেশের স্থলসীমার সমাপ্তি। তারপর সীমানা ঘেঁষেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষি বাহিনী বিএসএফ এর চেকপোস্ট। আমাদের পায়ের নিচের পিচঢালা সড়কটাই প্রবেশ করেছে ভারতের স্থলসীমায়। তারপর সোজা চলে গেছে ও দেশের আগরতলায়। এ সড়কটাকে বলা হয় আগরতলা সড়ক।আগরতলা সড়কে দাঁড়িয়ে থেকেই দেখলাম কাঁটাতারের বেড়া। আমাদের হাতের ডান দিকে বিজিবি চেকপোস্ট। আর বাম দিকে দুই-তিন সারি গাছ। তারপর এক প্রস্থ পতিত জমি। এই পতিত জমিটুকুই হলো নো ম্যনস ল্যন্ড। অন্ধকার ভেদ করে নো ম্যনস ল্যন্ড এর ও পাশেই আবছা দেখা যাচ্ছে বড় বড় বাঁকানো পিলার। আর পিলারের ভেতর দিয়ে কাঁটাতারের বুনন।মিনিটখানেক তাকিয়ে থাকলাম ওদিকে। কালো নিশিতে কাঁটাতারের কাঁটাগুলো স্পষ্ট দেখতে না পেলেও বুকে এসে বিঁধলো। চোখের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে এলো। মুহূর্তেই বদলে গেলো দৃশ্যপট। ওখানে ঝুলতে দেখলাম ১৪ বছরের শিশু ফেলানীর লাশ! গায়ে রঙিন জামা। কাঁটাতারের পিলারের ঘাড়ে পা আটকানো। মাথাটা ঝুলে আছে নিচে। তারের দুই পাশে দুটি মই।ঘোর কাটিয়ে প্রকৃতস্থ হলাম। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, কাটাতার দেখেই ফেলানীর কথা মনে হলো কেন?পরক্ষণেই ভাবলাম প্রশ্নটা পুরোপুরি অবান্তর। সীমান্তে এসে কাঁটাতার দেখলে, ওখানে আরো একটি চিত্র ভেসে ওঠাটাই স্বাভাবিক।

আর সে চিত্রটা হলো ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ।কাকতালিয়ভাবে ফেলানী হত্যার বিচারের রায়ের দিনটাও ছিলো সেদিন। ঢাকায় ফিরে জানতে পারি এ রায়টা হয়েছে বৃহষ্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) বৃহষ্পতিবার পড়ন্ত দুপুরেই আমরা বের হয়েছিলাম নিশিযাত্রার উদ্দেশ্যে। অথচ রায়ের খবরটা তখন জানা ছিলো না। ফেলানী হত্যায় অভিযুক্ত বিএসএফ কনস্টেবল অমিয় ঘোষকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করেছে বিএসএফের নিজস্ব আদালত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় কুড়িগ্রামের মেয়ে ফেলানী।সে ভারতের দিল্লিতে বাবার সাথে থাকতো। বাবা নুরুল ইসলাম ১০ বছর ধরে সেখানে কাজ করতেন। দেশে বিয়ে ঠিক হওয়ায় তিনি মেয়েকে নিয়ে আসছিলেন। সীমান্ত পারাপারকারি দালালদেরকে কিছু টাকা দিয়ে মই বেয়ে বাবার সাথে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার চেষ্টা করছিলো মেয়েটি। কিন্তু বাবা সীমানা পেরিয়ে যেতে পারলেও বিএসএফের গুলি খেয়ে কাঁটাতারেই ঝুলে যায় ফেলানী।বাংলাদেশের নাগরিকেরা অবৈধ উপায়ে ভারতে যায়। আবার ভারতীয়রাও বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশে বহু ভারতীয় নাগরিক ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজও করছে।

আখাউড়া রওয়ানা হওয়ার সময় কমলাপুর স্টেশনে এমন একজনের দেখাও পেয়েছিলাম। তার নাম ডেমরু, কমলাপুর স্টেশনে ক্লিনারের কাজ করেন। পড়ন্ত বয়সী এই ডেমরু চাচার বাড়ি ভারতে, ঠিকমতো বাংলাও বলতে পারেন না। তবে আধো বাংলা আধো হিন্দিতে তিনি আমাদের জানালেন, তার ভারতের দিনগুলো ছিলো নিদারুণ কষ্টের। খেয়ে না খেয়ে ফুটপাথে রাত কাটাতেন। তাই জীবিকার সন্ধানে চলে আসেন বাংলাদেশে। এখানে সরকারি কাজ করছেন। সরকার থেকে মাইনে নিচ্ছেন। এবং আয়ের একটা অংশ নিজের দেশেও পাঠাচ্ছেন।আমরা কী করে এ বিষয়গুলোকে অস্বীকার করবো?তাছাড়া সীমান্ত এলাকায় এমন বাড়িও রয়েছে যার আঙিনার অর্ধেক পড়েছে এ পারে, আর অর্ধেক ওপারে। দুই দেশের নাগরিকদের মাঝে বিয়ের বন্ধনও হচ্ছে। এসব বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কথায় কথায় গুলি চালায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। সর্বশেষ আলোচিত ফেলানির বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিন্দিত হয়। ভারতে এই হত্যাকান্ডের বিচারও শুরু হয়।

অথচ দীর্ঘ সময় ধরে পানি ঘোলা করার পর হত্যাকারিকে নির্দোষ ঘোষণা করা হলো।এ খবর তখনো আমাদের কানে পৌঁছায়নি। এই দিনটিতে সীমান্ত হত্যার বিষয়ে একটি প্রহসনের রায় হয়েছে জানলে হয়তো সকাল পর্যন্ত সীমান্তেই কাটিয়ে দিতাম। বিভাজন রেখায় দাঁড়িয়ে দেখে আসতাম দুই দেশের একটি সকাল। একটি সূর্য্যই ভারতের দিক থেকে ডিমের কুসুমের মতো ভেসে এসে আলোকিত করতো বাংলাদেশকেও। একই সূর্য্যরে আলোয় কোলাহলে মুখরিত হতো দুই দেশের নাগরিকেরা।সকালের সূর্য্য ওঠার আগেই আমরা রওয়ানা করলাম বিজিবি চেকপোস্ট ছেড়ে। আখাউড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে যাবে সকাল পাঁচটার ট্রেন তিতাস। তার আগেই পৌঁছুতে হবে আমাদের।সিএনজিতে ওঠে বসলাম সবাই। চালক মনির হোসেন বাবু বড় বড় চোখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সিএনজি স্টার্ট দিয়ে রওয়ানা দিলো স্টেশনের দিকে। তারপর কয়েকমুহূর্ত নিরব রইলো সে। হাজারো প্রশ্ন খেলে যাচ্ছে ওর মাথায়- আমরা কেন এলাম, কী করলাম বিজিবি চেকপোস্টে ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রশ্নগুলো বেশিক্ষণ মাথায় জমিয়ে রাখতে পারলো না। জিজ্ঞেস করেই বসলো। যা জবাব পেলো, তারপর থেকে আমাদেরকে আলাদা সমীহ করতে শুরু করলো সে। পট পট করে মুখও খুলে গেলো বাবুর। সে জানালো, সকাল হলেই সাধারণত আগরতলা রোডে হাজার হাজার ট্রাকের জ্যম লেগে থাকে। আখাউড়া থেকে মাছ যায় ভারতে। বছরে তিন কোটি টাকার মতো মাছ ব্যবসা হয় এই চেকপোস্ট দিয়ে। কিন্তু গত পনেরো দিন যাবত মাছ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।কেন?কারণ সাধারণ মাছের সাথে লুকিয়ে চুরিয়ে ইলিশ মাছও ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছিলো।তাহলে আজ সূর্য্য ওঠার পরও কি আগরতলা সড়ক ধরে কোনো গাড়ি আসবে না?জবাব দিলো বাবু- গাড়ি আইবো না ক্যান! সকাল হইলেই দেইখেন হাজার হাজার মোটরগাড়ি, সিএনজির লাইন পইরা যাইবো।তারপর সে যা জানালো- সড়কের দুই দিকে ফসলি জমির পর যে গ্রামগুলো দেখা যাচ্ছে, ওগুলোর বেশিরভাগ বাড়িতেই প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা হয়। কাঁটাতারের ওপার থেকে সস্তায় ইয়াবা ফেন্সিডিলের বোতল এনে এ পারে পাইকারি দরে বিক্রি করে গ্রামবাসি। গ্রামের পুরুষ মহিলাদের অধিকাংশই এ ব্যবসার সাথে জড়িত।পুলিশ জানে না? পুলিশ গেরামে ঢুকলে মহিলারা ঝাড়– লইয়া দৌড়ানি দেয়।ইচ্ছে হলো সিএনজি থামিয়ে পাশের গ্রামটা থেকে একবার ঘুরে আসি। কিন্তু ভাবলাম রাতের অন্ধকারে যাওয়াটা অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। মাদকব্যবসায়িরা সবসময়ই এটা ওটার ভয়ে আতঙ্কিত থাকে।

তার ওপর ভোর রাতে আমাদের মতো অনাহূত আগন্তুক দেখে ভিন্ন কিছু ভেবে বসতে পারে তারা। ঘটে যেতে পারে অপ্রীতিকর ঘটনাও।তারপরও আকুল ইচ্ছা নিয়ে একবার তাকালাম মাদক গ্রামের দিকে। দেখলাম ভারতের দিকের আকাশটাতে সূর্য্য ওঠার একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই হয়তো আলোকিত হয়ে আসবে প্রান্তর।তাহলে কি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবো?একবার মনে হলো অপেক্ষা করেই যাই। আবার ভাবলাম লালে লাল হওয়ার পথঘাটতো মোটামোটি চেনা হলোই। এটাও নিশ্চিত হলাম যে, ইয়াবা ও ফেন্সিডিলের চালান নিতে হলে আখাউড়ার চেয়ে ভালো পাইকারি বাজার আর নেই। এখন কেবল ঢাকায় ফিরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- কবে থেকে আমরা এ ব্যবসায় নামছি।