প্রতি মাসেই ভাড়া নিতে এসে একটানা খানিক্ষন বক বক করে যায় লোকটা। নিজের সুখ দঃখের কাহিনী, অভাব অনটনের অতীত গল্প। সেই কবে ভিটে মাটি সব নদীর জলে বিলীন হয়ে গেছে।তারপর বাপ মরল, মা মরল। একটা জুট মিলে দাড়োয়ানের চাকরি জুটিয়েছিল, জুট মিলেও কিভাবে তালা লেগে গেল । তারপর কিভাবে ঢাকার মত একটা বড় শহরে বাড়ির মালিক হওয়া।গত দুই বছরে সেই একই গল্প কতবার যে শুনতে হলো বাড়িওয়ালা আনিস সাহেবের মুখে তার হিসেব নেই। একজন ভাড়াটিয়া হয়ে বাড়িওয়ালার মুখে এসব গাল গল্প শুনতে আজ বিরক্তি ছাড়া কিছুই লাগছেনা সজলের।

মিরপুরের তালতলার এই বাড়িটার দুতলায় ভাড়া থাকে সজল-মৌরি দম্পত্তি। রাজধানী শহর হলেও বাড়িময় গ্রাম গ্রাম গন্ধ পাওয়া যায়। তিনতলা বিশিষ্ট বাড়িটার দুতলায় বেশ বড়সড় একটা ড্রয়িংরুম, একটা লিভিং রুম, রান্নাঘর, ছোট্র একটা স্টাডিরুম। আর মনভুলানো পূর্ব-দক্ষিণ খোলা বারান্দা। বারান্দার গ্রিল ঘেষে দু দুটো বড় আম গাছ আর নিচের দিকটায় একটু ঝোপঝাড় মত। শুবার ঘরের জানালা দিয়ে শুয়ে শুয়ে জোছনা দেখা যায়।

সারাদিন অফিসে খাটাখাটনির পর ক্লান্ত এ দেহ চায় একটু প্রশান্তি। সেই শান্তির খোঁজেই খোলা বারান্দায় কফি হাতে বসে আছে সজল। শেষ বিকালের মন খারাপী আকাশ মেঘ লুকোচুরি দিনের সুবাস দিয়ে রাতের আমানিশায় ডুবে যেতে প্রস্তুত হচ্ছে। দিনের আলো হয়তো আর পাওয়া যাবে ঘণ্টা খানেক। আজ ঘরের পাশের আকাশটাও অন্য রকম লাগে। সূর্যের মৃদু ওম ছুয়ে যায় হৃদয়,কোন শীতলতা স্পর্শে সিক্ত হতে চায় দেহ, মন, আত্মা। ততক্ষনে সন্ধ্যা নেমে এলো,রাতের আঁধারে চারপাশে দু তিনটে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। আরাম কেদারায় বসে দূর অন্ধকারে তাকিয়ে আছে সজল। ভাবনার আকাশ তার একেবারেই শুন্য। অফিস থেকে ফিরে এই সময়টায় খোলা বারান্দায় আড্ডা আর কফি খেতে খেতে মৌরির সাথে একান্তে সুন্দর সময় কাটায় সজল। আজ মৌরি নেই। একা একা আরাম কেদারায় বসে আছে সজল। রুমের এলইডি লাইটের খানিকটা বারান্দায় এসে পড়ছে। ফলে বারান্দায় একটা আলো আধারি আবহ সৃষ্টি হয়েছে। মৌরি ইদানিং সন্ধ্যার এই সময় টাতে প্রায় ই বাবার বাসায় থাকে। এশার নামাজ পড়ে সজলকেই ও বাসা থেকে নিয়ে আসতে হয়।

বারান্দায় বসে একটার পর একটা সিগারেট ফুকছে আর এতাল-বেতাল অনেক স্মৃতিই আওড়াচ্ছে সজল। সজলের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হাওরে। হাওরের বুকেই কাটে তার শৈশব-কৈশোর। ফেলে আসা হাওরের সময় গুলো কেন জানি আজ  খুব মনে পড়ছে সজলের। নাগেশ্বরী হাঁসের গোশত ভুনা, আহা কি স্বাদ! ভাবতেই জিবে জল চলে এলো ওর। হাওরের ভরা বর্ষা তাকে সব সময় ই টানে। কি চমৎকার হাওরের পরিবেশ! পানির নিচে লতা পাতা জলজ উদ্ভিদগুল্ম যেন গড়ে তুলেছে অপরূপ সবুজের স্বর্গরাজ্য। হাওরের নীলাভ জলরাশি কেটে কেটে কি সুন্দর সামনে এগিয়ে যায় ডিঙ্গি নৌকাটা। গলুইয়ে হেলান দিয়ে দুপা স্নিগ্ধ জলে আচড়ে দিয়ে বসে থাকে সজল। উপরে যত দূর চোখ যায় নীল আকাশ,মন শুধু চায় হারিয়ে যেতে এই নীলাভের নীলিমায়। ঘাস ভরা মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে গরু-মহিষের পাল। বালি হাস,পানকৌড়ি জলকেলি খেলতে নেমেছে এই নীলাভ জল রাশিতে। দূর থেকে দেখা গ্রাম গুলো যেন জলে ভাসমান,যেন জলেই তাদের বাস। এই এলাকার অধিকাংশের জীবিকা মাছ ধরা। সবাই পেশাদার জেলে এরকমও নয়। বেশিরভাগই মৌসুমি জেলে। পেশায় কৃষক,সারাদিন জমিতে কাজ করে অনেকেই রাতে ছোট্ট নৌকা নিয়ে ছুটে মাছ ধরার জন্য। শঙ্খের মত সাদা এদের মাথা,ঘাঢ়,বুক,পেটের তলা’র পালক আর তাই বুঝি এদের নাম হয়েছে শঙ্খচিল। কিন্তু ডানা দু’টি ও শরীরের অন্যান্য অংশ খয়েরী। প্রায় বিপন্ন প্রজাতির এই চিল বাংলার আকাশে আগের মত খুব একটা দেখা না মেললেও সজলের স্বপ্নের আকাশে প্রায় ই জ্যোৎস্নার সঙ্গী হয়ে ধরে দেয়। ইদানিং একটু বেশি ই। হঠাৎ চু মেরে হাওরের বুক ছিড়ে শঙ্খচিলের মাছ শিকারের দৃশ্যটা খুব মনে পড়ে। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের কবিতায় এই শঙ্খচিল খুব দেখা যায় । বাংলার সেই চিরচেনা রূপ। হাওরের এই মন মাতানো রুপে মুগ্ধ হয়ে সজলের মনে জীবনান্দ দাসের সেই বিখ্যাত কবিতা উকি দেয়ঃ

“আবার আসিব ফিরে ধান সিড়িটির তীরে এই বাংলায়-
হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে-
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে-”

অফিস থেকে ফিরে বাসার গেইটের সামনে অনেকক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটি করছে কিন্তু বাসার ভিতরে ডুকবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা সজল। হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে বললো,–বাসার সামনে এইভাবে ঘুরঘুর করছিস কেন? উল্টো হয়ে ঘুরে তাকায় সজল। ডব্লিউ ভাই। বাসামেট। দুই হাত ভর্তি বাজার। মজার লোক বটে। আবার আজবও। বিরক্তিকর। খালি জ্ঞান দেয়। কথায় কথায় বলে “হয়েন আই ওয়াজ জাপান”, জুর তার জাপান ভ্রমনের গল্প শুনায়। এবার ও রক্ষা নেয়। গল্প শুরুঃ শোন সুজু হয়েন আই ওয়াজ জাপান। জাপানী লোকেরা কিন্তু আমাদের মত বউকে এত পাত্তা দেয়না। তার মতে স্ত্রীকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে নেই। মাঝে মধ্যে একটু কঠোর হতে হয়। সব সময় যদি বউকে বেশি বেশি ভালোবাসেই যাও,তাহলে একদিন বউয়ের কাছে তোমার ভালোবাসাটা সস্তা হয়ে যাবে। তাই এখন থেকে মাঝে মধ্যে বউকে শাসন করবে। বুঝলে? কিছুই বলনা সজল।শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এমনিতেই মেজাজ টা খুব খারাপ। অফিসে ঝামেলা চলছে। পড়াশোনা করলেই কি চাকরি করতে হবে? চাকরি টা ছেড়ে দিলে কেমন হয়? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাসায় ঢুকে সজল।

মৌরি খুব একটা সাজেনা। কি মনে করে আজ খুব ঘটা করে সাজলো ও। না কোথাও কোন দাওয়াত নেই। এমনিই। আমার জন্যই নাকি সেজেছে।“কালো শাড়ি,সাথে সাদাকালো রেশমি চুড়ি ,চোখে হালকা কাজল,কপালে কালো  টিপ, খোলা চুলে  দেখতে তো ভালই লাগছে । ঠিক যেন কোন উপন্যাসের জীবন্ত নায়িকা। মৌরি কিছু বলেনা। দুজনে বসে টিভি দেখে। ইদানিং একটা খুব বাজে অভ্যাস পেয়ে বসেছে সজলকে। নির্ঘুম রাত। একটা সময় ছিল যখন শোয়া মাত্রই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিত।আজকাল ফেইসবুকে ঘাটাঘাটি করতে করতে কখন যে ভোর হয় সে ঠের ই পায়না।

ভোর থেকেই আবহাওয়াটা কেমন গুমোট রূপ ধারণ করে আছে।গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।এরকম আবহাওয়া দেখলে মনটাও কেমন যেন ভারী হয়ে ওঠে তার। প্রকৃতি আসলেই মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।জানালার কাছে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাইরের ঘোলাটে আবহাওয়াটা দেখছিল। বসের মুখ টা ভেসে উঠলো। কি গম্ভীর মুখখানা। সব সময় ভ্র কুচকে থাকে। একটু ও হাসি নেই মুখে। কাজ ছাড়া দুনিয়ার কিছুই তার মনের জায়গা দখল নিতে পারেনা। কি যেন একটা জরুরী কাজে আজ সকাল সকাল অফিসে যেতে বলেছিল সেটা কিছুতেই মনে করতে পারল না সজল।

টিফিন কেরিয়ার টা হাতে দিয়ে সজলকে বিদায় জানাল মৌরি। সাবধানে যেও। এই বলে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা টেনে ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে মৌরি।

ইদানিং সময়টা বড্ড খারাপ যাচ্ছে সজলের-অফিসে-বাসায়-সমাজে। মেঘলা দিন। তাই বিকেল টাকেও সকালের মতই লাগে। বস কে বলে  আজ সকাল সকাল  অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল সজল। যে শুন্যতা বাইরের আচ্ছন্ন আকাশে সে শুন্যতার ছায়া যেন সজল তার অন্তরেও অনুভব করছে। নেই, নেই, কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। নেই নেই রোগ টা ইদানিং খুব পেয়ে বসেছে সজলকে। সজল মৌরির বিবাহিত জীবনের এক যুগ হতে চলল। এখনও কোন অতিথির আগমন ঘটেনি। সমস্যা টা মৌরির। ডাক্তার বলছে ঠিক হতেও পারে। যদিও সজলের এ নিয়ে নুন্যতম দুঃখ নেই। কিছু কিছু ব্যাপারে মানুষের কোন কিছুই করার থাকেনা। ভরসা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু চিয়ায়ত সমাজকে সে কথা বুঝানো যে এতটা সহজ নয় সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এই দম্পত্তি। এরই মধ্যে বড় ভাই আর মায়ের চাপে পড়ে দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তাটাও ঘুরপাক খাচ্ছে সজলের মাথায়।

এখন শেষ রাত। রাতের শেষ ট্রেন টা কাছের ষ্টেশনে এসে থামল। হুইসেলের শব্দে হঠাৎ ঘুমের মধ্যে মৌরি সজলকে জড়িয়ে ধরলো। মৌরির হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে বন্দি করে নিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে সজল। ততক্ষনে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা সরে এসেছে। তাইতো অন্ধকার রাতটা হঠাৎ জ্যোৎস্নার আলোতে ভরে গেল। চাঁদের আলোর এক ফালি জোছনা জানালা দিয়ে বিছানায় এসে পড়ছে। নিবিড় শান্ত একটা ছায়াস্নিগ্ধ শীতল পরিবেশ যেন মুহূর্তে মনকে স্পর্শ করে। তবু কি যেন একটা চাপা শূন্যতা। ঘুমে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে সজলের। ঘুমের মধ্যে আজকাল প্রায় ই একটা দুঃস্বপ্ন দেখে সজল। মাঝরাতে বারান্দায় বসে আছে সজল। খুব জোছনা। আম গাছের ডাল-পাতার আড়াল থেকে একটা খচ খচ শব্দ আসে। সজল কান খাড়া করে সেটা দেখার চেষ্টা করে। চাঁদ-ভেজা আম পাতা, ডালের ছায়া থেকে কিছু একটা বেরিয়ে আসছে। সে ডানা ভাঙ্গা শঙ্খচিল টা না! সারা শরীরময় ভরা চাঁদের জোছনার আলো জড়িয়ে আছে। সেবার হাওরের বুকে এই ডানা ভাঙ্গা চিলটাকে উড়তে দেখেছিল সজল। কিন্তু ওটা  ঢাকার শহরে এলো কি করে? উত্তর খুজে পায়না কিছুতেই। খুব কাহিল লাগছে চিলটাকে। কিন্তু চোখে মুখে কি যেন একটা হিংস্র চাহনী। চোখ দুটো যেন বের হয়ে আসছে। আচমকা চিল টা চু মেরে সজলের দিকে তেড়ে আসতে চায়। কিন্তু পারেনা। বাঁধ সাধে বারান্দার লোহার গ্রিল। ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় । বিছানা থেকে উঠে বসে সজল। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। মাথার কাছে টেবিলে রাখা পানি ভর্তি গ্লাস টা ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে পুরোটা শেষ করে দেয় সজল। বুকের বাম পাশের হৃদ যন্ত্রটা বেশ জুরে জুরে বিট দিচ্ছে। স্বাভাবিক হতে খানিক্ষন সময় লাগে। দূরের মসজিদ থেকে ফজরের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে।

লেখকঃ কৃষিবিদ ও ব্যাংকার, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ