শম্ভু, কবলী, পাগলি, বুচি -অদ্ভুত ধরনের কিছু নামে ধরে সকাল সন্ধ্যায়  আমার দাদু ডাকাডাকি  করতেন তার গরু বাছুর গুলোকে।   নামের সাথে ওদের চেহারা ছবি কাজ কারবারেও মিল ছিলো অনেক। যেমন, পাগলী নামে ও স্বভাবে একই রকম। আমাদের কাউকেই কাছে ঘেষতে দেয় না, গুতো নিয়ে আসে।

বছরের বিশেষ কিছু দিনে বড়রা আমার সমবয়সীদেরকে কিছু ক্ষনের জন্য যে কোন ঘরে অন্তঃরীন রাখতেন। সেটা ছিলো যেদিন বিকালে আমাদের কোন গাভী কে কিছু অপরিচিত ষাড় গরু  মাঠ থেকে তাড়া করে বাড়িতে নিয়ে আসতো। আর অন্যটি হলো গাভীর বাছুর  প্রসবের সময় ।

বড়দের আশংকা পিছে, আমরা আবার অক্কাল পক্ক হয়ে যাই এই ভাবনায়। গাভীর বাছুর হবে  এটার আগাম সঙ্কেত আমি পেতাম যখন বাড়িতে হিরা লাল নামের এক লোক কে দাদার সাথে নিরবে নিভৃতে ঘন ঘন দেখতাম।  হিরালালা সাহা জিবনেও  জিম করে  নি ।এলাকাতে ‘মাল” বা “কুস্তীগির” হিশাবে খ্যাত।  পানির নিচে একডুবে ঝুনা নারকেলে  দাঁত দিয়ে  ছোবা ছাড়ানোর  মারত্মক সব রেকর্ড আছে।

মাথায় কদম ছাটের ছোট চুল  দেহের চে মাথা ছোট, বিশাল তার বপু,  শরীরের  বিভিন্ন যায়গাতে ঘুবলে খাবলে থাকা  মাংশপেশী হিরালাল কে  দিয়েছে ছোটখাটো  ব্যায়ামবীর বা  মল্লযোদ্ধার আদল।  হাডুডু, মালকুস্তিতে  তাকে  হারানোর কেউ ছিলো বলে জানা নেই।  রাত বিরাতে বউকে যখন  “ঝি লো ঝি” বলে হিরা লাল  নির্মম ভাবে প্রহার করতো, আর বউটার বুকফাটা আর্তনাদে-  আন্দাজে বুঝতাম  ছোটখাটো অসুর সদৃস্য লোকটার শারীরিক  ক্ষমতা ব্যপক।

হিরালাল এলাকাতে  যদি কাউকে পরোয়া করতো, সেটা ছিলো আমার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার দাদু ।  সারা বছরের আকাম কুকাম থেকে আগাম রক্ষা পাবার জন্যই হউক অথবা অন্য যে কারনেই হউক, আমাদের গরুর বাছুর প্রসবের সময়  হিরালাল এর কর্তব্যপরায়নতা বেড়ে  যেত দ্বিগুন।

বৃষ্টিঝরা শীতের গভীর  রাত, পাগলী  বেজায় ডাকা ডাকি করছে- বাচ্চা হবে, দাদু ততক্ষনে পাগলীকে গোয়াল ঘর থেকে নিয়ে বড় ঘরের বারান্দায়।  আমি দাদির সাথে, আচল টা ধরে দরজার আড়ালে। পাগলীর হাম্বা হাম্বা তে চোখ কচলাতে কচলাতে হাজির -হিরা লাল।  পাগলির অনেক কষ্ট হচ্ছে  শুয়ে আছে চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। হিরালাল মাল কাছা দিয়ে পা’দুটো ছড়িয়ে বসে পরলো পাগলি’র পেছনে,একটা হ্যাচকা টান। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখলাম দারুন সুন্দর একটা বাছুর হাতে হিরালাল উঠে দাড়িয়ে মেডেল বিজয়ীর মতো অদ্ভুত ভাবে  আওয়াজ করে হাসছে। বাছুরটা শীতে কাপছে ,দাদি ন্যড়া খরে আগু্ন জ্বালালেন।  পাগলিও ততক্ষনে উঠে দাঁড়য়ে অদ্ভুত আওয়াজ করছে আর বাছুরটার চারপ্বার্শে ঘুরছে।

পরের দিন বাঁশঝাড়ের নীচে যথাস্থানে খৈল ভুষির চাড়ি’র কাছে অন্য গরুর সাথে পাগলি আর পাগলি’র বাছুর তিরিং বিরিং লাফালফি করছে। অদূরে বেতের মোরাতে বসে আছেন অশ্বিনী শীল।  উনি আমাদের গৃহ শিক্ষক। রোজসকালে রামসুন্দর ত্রিবেদীর বাল্যশিক্ষা পড়ান। টোষ্ট বিস্কুট চা’তে ভিজিয়ে খান।  যাবার সময় কয়েকটা গরু পানিয়ে দিয়ে যান। মাঝে মাঝে অতি উৎসাহিত হয়ে উনার সহকারি’র কাজটি করতে গিয়ে  কম বেশি সকল গাভির লাত্থি গুতোই আমি খেয়েছি।

দিন দশেক পরের কথা, বাড়ির নিয়ম মাফিক অন্য গাভীর দুধের মতো পাগলী’ র  দুধ মসজিদে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে দুধ খাবে পাগলির বাছুর আর আমরা। বাচ্চা হবার পর পাগলী অনেক শান্ত, খামাকাই গুতো দিতে আসে না। গলার নীচে হাত বুলালে চোখ বন্ধ করে থাকে আরামে। পাগলী বেশ ভালো দুধ দেয়।

অনেক ভোরবেলাতে পাগলি’র আর্তনাদে বাড়ী’র অনেকে ঘুম ভাঙ্গে।  বাছুর টা মরে পরে আছে।  কেউ কেউ বলাবলি করছে  রাতে মনে হয় বড় গরুটা বাছুরটর উপরে পরে গেছে, কেউ বলছে কুনজর, বান টোনা। সাপে বাছুরে  দুধের হিষ্যাসংক্রান্ত ঝামেলায় কেউবা আবার দোষারোপ করছে দুধরাজ সাপকে।

মুচি পাড়ার অমূল্য দা হাজির হয়েছে।  মরা বাছুরটা নিয়ে যেতে। যতি চামড়া টা বিক্রি করা যায়। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে।  দাদু  মাথায় হাত দিয়ে  পাগলী’র হা হুতাশ দেখছেন। ঘুরে ঘুরে পাগলী চেটে পুটে জাগানোর চেষ্টা করছে বাছুরটাকে।  কি যে অসহায় চাপা গোঙ্গানি পাগলীর নাসারন্ধ্রে। আমি এবার  দাদির আচল কামড়ে ধরে কান্না লুকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। পাগলি কে বাধা হলো। অমুল্য দা বাছুরটা কাধে তুলে  নিয়ে চলে গেলেন।

পাগলীর পাগলামি বেড়ে গেলো দ্বিগুন সবাই কে গুতো দিতে তেড়ে আসে যখন তখন। খৈল ভুষি খাওয়া বন্ধ। রাত বিরাতে হাম্বা হাম্বা- বাড়ির সবার অনিদ্রা।  কেউ কেউ দাদু কে বল্লো- “দুধ পানিয়ে দেখতে পারেন”। অশ্বিনী স্যার কে বালতি নিয়ে বসতে দেখে গেলো। প্রথম টানেই  দেখলাম বালতি ছিটকে একদিকে আর স্যার ধূতি উল্টিয়ে অন্যদিকে- চিৎপটাং!!

নতুন কায়দায় পরের দিন পাগলি কে দুই বাঁশের মধ্যিখানে “কেঞ্চির চিপায়” আটকানো হলো।  কিছুক্ষন পাগলি নড়াচড়া লাফালাফিতে ব্যর্থ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। অশ্বিনি  স্যার হাতে সরিষার দেল মেখে টানাটানি করে যা দুধ পেলেন,তা বালতির  তলাতেই পরে রইলো।  বিরক্ত হয়ে নিজে নিজে স্যার বলে উঠলেন “ হারামজাদী দুধ তুইল্লালছে”  দাদু বলেন- থাক, অশ্বিনি ছেড়ে দাও আজ।

বিকালের দিকে অর্ধফাটা গোল কাচের ইরানী চশমা পরা দাদুর সমবয়সী সাদা লম্বাদাড়িওয়ালা মনফর দাদা কি যেন আলাপ করলেন দাদুর সাথে।

পরের দিন সকালে, অমূল্য দা ন্যাড়া খড়  আর পাগলির মৃত বাছুরের চামড়া  দিয়ে বানানো “ভুইত্ত্যা” টা কাঁধে নিয়ে  বাড়িতে হাজির হলো।  বেঢপ সাইজের “ভুইত্ত্যা” বাছুরটা বাঁশের খুটির কৃত্রিম পা’য়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।  পাগলি  কোথা থেকে জানি ছুটে এলো সে কি আওয়াজ, আদরে আদরে প্রান ভরে সারা গা চাটতে লাগলো ওর ফিরে পাওয়া বাছুরটাকে। অশ্বিনি স্যার ততক্ষণে বিনা সরিষার তেলেই বসে গেছেন বালতি নিয়ে, নিমিষেই আমার চোখের সামনে দুধে উপচে উঠছে বালতি!!