পিলখানা হত্যাযজ্ঞে অংশ নেওয়া কয়েক জওয়ান ফাইল ফটো

পিলখানা হত্যামামলায় চলতি মাসেই আদালতে চার্জশিট দায়ের করা হতে পারে। পুলিশের বিশেষ অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) চার্জশিটের কাজ শেষ করে এনেছে। সিআইডির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, চার্জশিটে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে কমপক্ষে ৫৮ জনের বিরুদ্ধে। মোট আসামি ৮২৪ জন। অভিযুক্ত খুনিদের অনেকেই বিদ্রোহ ও পরবর্তীকালে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে। এছাড়া তাদের কেউ কেউ লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগসহ বিভিন্ন গুরুতর অপরাধ করেছেন। বিদ্রোহের পরিকল্পনা, হত্যাযজ্ঞ, অগি্নসংযোগ, লুণ্ঠনের ঘটনায় যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তাদের সবার নাম পাওয়া যায়নি। হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে অভিযুক্তরা হলেন_ ডিএডি হাবিব, ডিএডি লতিফ, ডিএডি জলিল, ডিএডি রহিম, ডিএডি তৌহিদ, হাবিলদার শাহজাহান, হাবিলদার বেলায়েত হোসেন, হাবিলদার জালাল, সুবেদার মেজর গোফরান মলি্লক, ল্যান্স নায়েক সাইদুর, লুৎফর রহমান, জাকারিয়া, ওবায়েদ, সিপাহী সেলিম রেজা, আলতাফ, তারেক, আইয়ুব, কাজল, মাইনুদ্দিন, রেজাউল, জসিম মলি্লক, আজিম পাটোয়ারী, শরিফুল, সোহরাব, সিপাহী তোফাজ্জল, রুবেল, হাবিব, মাসুম, সাহাবুদ্দিন, সাহাদত প্রমুখ। সিপাহী মুহিতই প্রথম বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক
মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তার গুলিতেই শাকিল আহমেদ নিহত হন। সিপাহী ওবায়দুল হত্যা করেন বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালকের স্ত্রী নাজনিন শাকিলকে। সিপাহী মাসুম হত্যা করেন মেজর মমিনকে। সিপাহী শামীম আল মামুন, সিহাপী উত্তম বড়ূয়া, তরিকুল ও মোজাম্মেল হত্যা করেন ডা. মেজর মামুনকে।
সুবেদার মেজর গোফরান মলি্লকের নেতৃত্বে কয়েকজন খুনি ২৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল লুৎফর রহমান ছাড়াও আরও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। হাবিলদার ইউসুফ ও জালালের গুলিতে নিহত হন ৩৬ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার (সিও) লে. কর্নেল এনায়েত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় নিউমার্কেট থানার ফৌজদারি মামলা থেকে প্রায় দেড় হাজার জওয়ান অব্যাহতি পাচ্ছেন। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২ হাজার ৩০৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এদিকে পলাতক ২৩ জওয়ানসহ ৫০ জনকে পরিকল্পনাকারী হিসেবে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। জানা গেছে, খুনিসহ গুরুতর অপরাধে সবচেয়ে বেশি জড়িত ৪৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের সদস্যরা। দ্বিতীয় অবস্থানে ২৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের সদস্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ সমকালকে বলেন, চার্জশিট প্রণয়নের কাজ শেষ পর্যায়ে। এক বছর চার মাস তদন্ত শেষে চার্জশিট চূড়ান্তের কাজ সামান্য বাকি রয়েছে। শিগগিরই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।
মামলায় তদন্ত কর্মকর্তারা বিডিআর জওয়ান ছাড়াও মন্ত্রী, সাংসদ, বিডিআর কর্মকর্তা, পুলিশ, সেনাসদস্যসহ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে ৭ হাজার ৯৪ জনকে। সাক্ষী করা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার জনকে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। পিলখানা বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে সিআইডির পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আনিস-উজ-জামানের নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ ছাড়া লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি তদন্ত আদালত গঠন করে সেনাবাহিনী।
মামলার তদন্ত সূত্র জানায়, পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় গত বছরের ৪ মার্চ লালবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়। একই বছরের ৭ এপ্রিল মামলটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর করা হয়। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দের নেতৃত্বে ২০০ জনের একটি টিম এ মামলা তদন্ত করেছে। গত ৬ মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সিআইডি মামলার তদন্ত শুরু করে। মামলার তদন্তে সহায়তা করতে বিডিআর সদর দফতরে একটি টিএফআই সেল স্থাপন করা হয়। এখানে অভিযুক্ত বিডিআর সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের সিআইডির তদন্ত সেলে দেওয়া হয়।
মামলায় ৬ হাজার আলামত সংগ্রহ করা হয়। ৭ হাজার ৯৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ২ হাজার ৩০৭ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ৫৩৯ জন। বিডিআর বিদ্রোহে ব্যবহৃত অস্ত্রের ব্যালাস্টিক (অস্ত্রের রাসায়নিক পরীক্ষা) পরীক্ষা করে ৪ হাজার ৪শ’টি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার তথ্য মিলেছে। তবে কী পরিমাণ গুলি ব্যবহার করা হয়েছে তার হিসাব মেলানো সম্ভব হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। এতে মামলার বিভিন্ন আলামত সংযুক্ত করা হয়েছে। দেশের যে কোনো মামলার চেয়ে বড় চার্জশিট হবে বিডিআর হত্যা মামলার এই প্রতিবেদন। এর আগে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ৫৪৮ পৃষ্ঠার চার্জশিট ছিল দেশের সবচেয়ে বড় তদন্ত প্রতিবেদন।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় একক কোনো পরিকল্পনাকারীর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিদ্রোহের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যৌথভাবে বিডিআর জওয়ানরাই এর নেতৃত্বে ছিলেন। বিদ্রোহের ঘটনায় বিদেশি কোনো শক্তির বিষয়টিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডিএডি ও সুবেদার ও সুবেদার মেজর পদমর্যাদার কয়েকজন বিডিআর জওয়ান বিদ্রোহের সমন্বয় করেছেন। তবে কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী জওয়ানদের বেশিরভাগই বয়সে নবীন।
সিআইডি সূত্র জানায়, বিডিআর বিদ্রোহের আগে জওয়ানরা বিভিন্ন দফায় পরিকল্পনা বৈঠকে অংশ নেয়। সিআইডির অভিযোগপত্রে বলা হচ্ছে, বিদ্রোহ ঘটানোর জন্য জওয়ানরা চারবার গোপনভাবে শলাপরামর্শ করেন। বিদ্রোহের আগে তারা মোট চারবার বৈঠকে বসেন। বৈঠকে অংশ নেওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী ও তার ছেলে লেদার লিটনকে আসামি করা হচ্ছে। এ মামলায় আসামি করা হচ্ছে বিএনপির সাবেক সাংসদ নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হচ্ছে, সবচেয়ে জরুরি বৈঠক হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় প্রথম পরিকল্পনা বৈঠক। বিদ্রোহীদের চারটি বৈঠকের তিনটিই হয়েছে বিডিআর সদর দফতর পিলখানার বাইরে। বিদ্রোহীদের পরিকল্পনা বৈঠকে যারা অংশ নেয়, কেবল তারাই নয়, বিদ্রোহের শুরুর পর অনেকে হত্যাসহ অনেক গুরুতর অপরাধ ঘটিয়েছে, যারা পরিকল্পনা বৈঠকে উপস্থিত ছিল না। চার্জশিটে বলা হবে_ পিলখানা ঘটনায় একক কোনো ব্যক্তির জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় রাজনৈতিক দলের জড়িত থাকারও প্রমাণ মেলেনি। বিডিআর সদস্যদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও নানা দাবি-দাওয়া থেকেই এ বিদ্রোহের সূচনা বলে চার্জশিটে উল্লেখ থাকবে। মামলার তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে বিডিআর জওয়ানরা জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে জওয়ানদের দাবি-দাওয়ার বিষয় বিডিআর কর্তৃপক্ষ আমলে আনেনি। বিডিআর সদস্যরা চেয়েছিলেন, সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে অফিসার নিয়োগ করা হোক। অন্যদিকে বিদেশে মিশনে যাওয়া ও ডাল-ভাত কর্মসূচি নিয়েও তাদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। এদিকে জওয়ানরা বিদ্রোহের আগে ও পরে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও বিদ্রোহের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আগে থেকেই বিদ্রোহীরা সেনাসদস্যের খুনের পরিকল্পনা করেছিল, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিদ্রোহ শুরুর পরই তারা হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। জওয়ানদের সমর্থন জানিয়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি হাজারীবাগ এলাকায় যে মিছিল বের করা হয়, তাও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে হয়েছে।
সিআইডি ও বিডিআর সূত্র জানায়, সেনাসদস্যদের হত্যার পর ৪৭ জওয়ান গণকবর খোঁড়া ও লাশ বহন করে গণকবরে নেওয়ার কাজ করেছে। এ কাজে যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তারা হলেন, নায়েব সুবেদার মনোরঞ্জন, হাবিলদার জাকির, সুবেদার ইউসুফ, সুবেদার মোস্তফা, হাবিলদার জালাল প্রমুখ। মামলায় কারও অপরাধকে আলাদাভাবে শনাক্ত না করে সব আসামিকেই অপরাধী হিসেবে দেখানো হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হবে।